তন্ময়ের মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। মুখ মানে মুখের ভিতরটা। দু’দিকের গাল, টাকরা, জিভ, আলজিভ সব খসখসে। কথা বলতে গেলে জিভ আটকে যাচ্ছে। বার বার ঢোক গিলেও কোনও কাজ হচ্ছে না। লালা নেই বলে এই অবস্থা।
অসুখের কথা লোকে শুনতে ভালবাসে না, তবে বলতে ভালবাসে। দুটো সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার যে কী ভাবে সম্ভব, তা তন্ময় গুহ জানে না। তবে পঁয়তাল্লিশ বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সুবাদে সে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যদিও নিজের এই অসুখের কথা নিজের মুখে বলার উপায় নেই তার। সেটা এক রকমের বাঁচোয়া। কথা বলতে গেলেই তো জিভ জড়াচ্ছে। অনেক চেষ্টা করে সাবধানে কিছুটা পরিষ্কার কথা বেরোয়। সে কারণে যেটুকু না বললে নয়, সেটুকু দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হয়।
ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল তন্ময়। সঙ্গে বৌ শ্রাবণীও ছিল। বাড়িতে কথা বলা কমে গেছে অনেকটা। এমনকি ঝগড়াঝাঁটিও হয় না। কারণ তার মুখগহ্বর রসসিক্ত নয় আর। কিন্তু ডাক্তারকে যদি ব্যাপারটা বলতে না পারে, তাই শ্রাবণীকে দোভাষীর ভূমিকায় ভেবেছিল সে।
“কত দিন ধরে এ রকম হচ্ছে?”
তন্ময় মনে করার চেষ্টা করেছিল, কবে থেকে সে এই দশায় পড়েছে। এ তো এক দিনের অসুখ নয়। এক বছর? দু’বছর? না কি আরও বেশি? কবে থেকে লালারসে বঞ্চিত সে? হতে পারে, ক্রমশ শুকোচ্ছিল। তন্ময় খেয়াল করেনি। আচমকা শুকনো কাশি, গলাখাঁকারি দেওয়া, খাবার আটকে গিয়ে গলায় জল ঢেলে মাথায় থাবড়া— এ সবই ছিল লক্ষণ। মুখ তত দিনে বালিয়াড়ি থেকে মরুভূমি।
বেশ খানিক ক্ষণ টর্চের আলোর সামনে মুখব্যাদান করে বসে ছিল তন্ময়। তাকে পরীক্ষা করতে করতে নানা প্রশ্ন করেন ডাক্তার— সে স্মোক করে কি? ড্রিঙ্ক করে? কোনও বড় অসুখ হয়েছিল?
এ সব প্রশ্নের উত্তরে না বলার পর ডাক্তার বলেছিলেন, “কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি। করিয়ে নেবেন। রিপোর্ট দেখে ডিটেলস বোঝা যাবে। আপাতত বার বার করে জল খান।”
দ্বিতীয় বার যাওয়ার পর সব রিপোর্ট দেখে সরিয়ে রাখলেন ডাক্তার। তার পর বললেন, “ক্লিনিক্যালি তো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। শুগার নেই, কোলেস্টেরল অল্প, প্রেশারটা একটু হাই, স্লিপ অ্যাপনিয়া নেই, ফাইন নিডল টেস্টে কিছু নেই। আচ্ছা, আপনি পার্টি-পলিটিক্স, ইউনিয়ন, এ সব করেন? মানে ভাষণ-টাষণ, মিটিং-মিছিল?”
এ রকম একটা প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা তন্ময়। শ্রাবণী বলল, “না না। ও তো ও সবের মধ্যে—”
“স্কুল-কলেজে পড়ান না? সেলসে নেই? গানবাজনাও করেন না?”
“না। আমি তো অফিসে যে ডিপার্টমেন্টে, সেখানে অনেক ফাইল ঘাঁটতে হয়। কথা তো তেমন...” কোনও ক্রমে বলে তন্ময়।
ডাক্তার বললেন, “আমাদের মুখে লালা ন্যাচারালি আসে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলেই মুশকিল। আপনার কিন্তু স্যালাইভা সিক্রেশন একদম কমে গেছে। এটাকে বলে জেরোস্টোমিয়া। আপনি কি টেনশনে থাকেন? কোনও বিশেষ ব্যাপার নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করেন? বা ধরুন কারও সঙ্গে কোনও আর্গুমেন্টে জড়িয়ে পড়ছেন—”
শ্রাবণী বলল, “এটা কিন্তু করে। অফিসে কথা বলে না বলছে, কিন্তু কে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, কে ঘুষ নিচ্ছে, কাকে অকারণে ট্রান্সফার করে দেওয়া হল, কার প্রোমোশন আটকে রাখা হয়েছে... এ সব নিয়ে কত কথা যে বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে এত বছরে! তা ছাড়াও চার পাশে যা ঘটছে, তাই নিয়েও কোনও না কোনও রিঅ্যাকশন ও দেবেই দেবে। আগে তো রাস্তাঘাটে চেঁচিয়ে উঠত, কারও না কারও সঙ্গে ঝগড়া হত। কে গালাগালি দিল, কে জোরে হর্ন বাজাল, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কেন মাইক বাজছে, কে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইয়ে করছে, মেট্রোয় কে বয়স্ক লোককে সিট ছাড়েনি, কে কোন মেয়ের দিকে বাজে ভাবে তাকাচ্ছে... আমি তো বলেছি, তোমার এত কথা বলার দরকার কী? মেয়েও বারণ করে। সকালে খবরের কাগজ পড়তে বসেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। বিড়বিড় করে নানা রকম কথা বলতে থাকে। টিভি দেখতে দেখতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরময় পায়চারি করে। রাগে মুঠি পাকিয়ে বলে, ‘সব ক’টাকে ধরে গুলি করে দিতে হয়...’ এই সব।”
তন্ময় হয়ে তন্ময় শ্রাবণীর এ সব কথা শুনছিল। এ সব কি অভিযোগ? নাকি ভালবাসার উল্টো পিঠ? বিরক্তি? নাকি প্রশস্তি?
ডাক্তার তন্ময়ের মুখের দিকে তাকালেন, “তার মানে আপনাকে দেখে যেমন শান্তশিষ্ট মনে হয়, আপনি তো তা নন দেখা যাচ্ছে।”
তন্ময় ভাবছিল। একটা ন্যাচারাল ব্যাপার তার মধ্যে থেকে চলে গেল? সে কি অপ্রকৃতিস্থ? নিজেকে তো ভদ্রলোক বলেই জানত।
“আমি তো কোনও অশান্তি করিনি। আমার তো জিভ আটকে...” আবার বলতে চেষ্টা করে তন্ময়।
ডাক্তারের গলা গম্ভীর হয়ে এল, “অনেক দিন ধরে খুব রাগ জমলে, মনের উপর চাপ পড়লে, ভয় পেলেও এ রকম হতে পারে। চার পাশে যা চলছে চলুক, আপনি কোনও কিছুর মধ্যে জড়াবেন না। অ্যালুফ থাকুন। যা দেখছেন, দেখে যান। কোনও কিছু শোধরাতে তো পারবেন না। তা হলে স্ট্রেস নিচ্ছেন কেন? ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড হয়ে যেতে পারে। খেতে পারবেন না, মুখে ঘা হতে পারে, কথা আরও আটকে যাবে, কিছু শব্দ তো উচ্চারণই করতে পারবেন না। বাড়াবাড়ি হলে আর্টিফিশিয়াল স্যালাইভা দিতে হতে পারে।”
“তা হলে কী করব?”
“মুখের ভিতরটা যাতে ড্রাই না থাকে, সে জন্য লজেন্স রাখুন মুখে। তাতে স্যালাইভা সিক্রেশনটা ঠিক থাকবে।”
টাকরায় লেগে যাওয়া জিভ টেনে এনে বিস্মিত তন্ময় বলে ফেলল, “লজেন্স!”
“হ্যাঁ। অনেক রকম লজেন্স তো পাওয়া যায়। মুখে দিয়ে চুষবেন।”
তন্ময় কোনও বয়স্ক শিশুর মতো তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, লজেন্স তো কত রকমের হয়। ওই দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে হবে তা হলে।
এখন তন্ময় লজেন্স চোষে। মুখের ভিতরটা রসালো করে রাখার চেষ্টায় থাকে।
গ্যাসের দাম বাড়ুক, পেট্রলের দাম বাড়ুক, নেতারা ঘুষ খাক, দলবদল চলতে থাকুক, ভোটে লাশ পড়ুক, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি হোক, পুলিশ যাকে পারে লাঠিপেটা করুক, সুইস ব্যাঙ্কে চুরির টাকা জমুক, বেকাররা চাকরি না পেয়ে রাস্তায় নামুক, জিনিসপত্রের দাম আগুন হোক, চাষিরা আত্মহত্যা করুক, শপিং মলে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হোক, দেশে দেশে যুদ্ধ হোক, টিভিতে গানের লড়াই হোক, চ্যানেলের প্যানেলগুলোয় তর্ক চলুক, আন্টার্কটিকার বরফ গলে যাক— তন্ময় কোনও কথা বলবে না। সে বীররস থেকে করুণরসে পৌঁছেছে। পৃথিবীর কী হবে, ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, মানুষের পরিণতি কী হতে চলেছে— এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে লজেন্সের সাহায্য নিয়ে লালা ঝরানো ছাড়া তার গত্যন্তর নেই আপাতত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)