E-Paper

শেষ ট্রেনের গায়ক

কুকুরের মতো হাঁপায়। রুমাল বার করে ঘাম মোছে। সময় নেয় ধাতস্থ হতে। মেলা লোকজন।

দেবতোষ দাশ

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৪০
ছবি: সমরজিৎ রজক।

ছবি: সমরজিৎ রজক।

শেষ ট্রেন। তার পর লম্বা বিরতি নিয়ে সেই ভোরের লোকাল। মাথার ভিতরটা ফাঁকা লাগলেও দৌড় থামায় না বাসুদেব। বস্তুত, অ্যাপ-ক্যাব থেকে নেমে বন্ধ-ছবিঘরের সামনে থেকেই ছুটতে শুরু করেছিল। কেবল বাসু নয়, ওর বাকি তিন সহকর্মীও। উড়ালপুলের তলা দিয়ে তিন জন নর্থের দিকে, আর বাসু দক্ষিণ শাখা। মস্ত সে করিডোর। হাঁপায় বাসু। হঠাৎ শোনে ট্রেনের ভোঁ, এবং তার চোখের সামনে দিয়েই ছেড়ে দেয় ট্রেন। একটা লোক ছুটছে, প্রায় ধরেও ফেলেছে শেষ কামরা। একটি কমবয়সি ছেলে বাড়িয়ে আছে হাত। লোকটা পৌঁছে যেতেই একটানে কামরায় তুলে নেয় সে। গতি বাড়ায় বাসু। চালক দ্রুত পিকআপ নেননি, শেষ ট্রেন বলেই সম্ভবত এই গজগমন। না হলে চল্লিশ-ছুঁইছুঁই বাসুর মনে এ-ট্রেন পাকড়ানোর প্রত্যাশা আমলই পেত না। ট্রেনের ল্যাজা আর বাসুর পায়ের মধ্যে ক্রমশ কমতে থাকে দূরত্ব। ছেলেটি বাড়িয়ে আছে হাত। মুখে হাসি। গার্ডসাহেবকে অতিক্রম করে বাসুও হাসে। দৌড় তো আজ শুরু হয়নি, দৌড়চ্ছে গত বাইশ বছর ধরে। লাস্ট ট্রেন হয়তো কালেভদ্রে ধরেছে, কিন্তু এগারোটার লোকাল ধরতে হয় হামেশাই। ছুটতে-ছুটতেই মাথার মধ্যে ফিরে আসে ছবি। যেন অবধারিত। সিমরন-কাজল ছুটছে ট্রেন ধরতে, কামরা থেকে হাত বাড়িয়ে আছে রাজ-শাহরুখ। আত্মবিশ্বাসী বাসু হেসে টপকে যায় ছেলেটিকে। পরের কামরায় গিয়ে ওঠে।

কুকুরের মতো হাঁপায়। রুমাল বার করে ঘাম মোছে। সময় নেয় ধাতস্থ হতে। মেলা লোকজন। কে বলবে শেষ ট্রেন! সাউন্ডবাক্স বাঙ্কে তুলে, হাতে মাইক নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন একটি লোক! দু’-এক জনকে টপকে ভিতরে ঢুকে, একটা সিট পেয়ে যায় বাসুদেব। মহালয়া গেল দু’দিন আগে। মালিক আজ বোনাস দেবে জানাই ছিল, ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা মিলে আজ একটু বিরিয়ানি-টিরিয়ানি, তাও ঠিক ছিল আগে থেকেই, কিন্তু রাস্তায় প্রবল যানজটের জন্য, শেষমুহূর্তে যে কেবল শেষ ট্রেনই পড়ে থাকবে, ওরা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ তারস্বরে বেজে ওঠে গান— ‘আশিকি মে হর আশিক হো যাতা হ্যায় মজবুর…’

পুনরাবৃত্তির সময় লোকটি যখন মজবু বলার পর উ-উ-র যোগ করছেন, চোখাচুখি হতেই হাতের ইশারায় শব্দ কমাতে বলে বাসু। রিমোট উঁচিয়ে স্বর সামান্য কমিয়ে, বাসুর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘ইসমে দিল কা, মেরে দিল কা, ইসমে দিল কা ক্যায়া কুসুর!’

মোবাইল খুলে ডুবে যায় রিলসে। মাঝে মাঝে কানে আসে গান। তেমন ভাল গায় না লোকটা, কিন্তু এই সব গান হলে ভিতরটা চনমনে হয়ে যায় বাসুর। তখন আর গায়কের ভালমন্দ নিয়ে মাথা ঘামায় না ও। উঠতি বয়সে যে গানগুলো জড়িয়ে, কাগজের এরোপ্লেনের মতো, মসৃণ পেরিয়ে যেত মেয়েদের ইস্কুল, মোনালিসার বাড়ি, সেই গানগুলোই ইনি পর পর গাইছেন। গাইতে-গাইতেই লোকটি হাত পেতে অনুদান প্রার্থনা করেন সকল যাত্রীর কাছে। দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় বাসু।

হঠাৎ থেমে যায় গান। বাঙ্কের উপর রাখা সাউন্ডবাক্সও। মুহূর্তে একটা স্তব্ধতা নেমে আসে কামরা জুড়ে। এক বার মাথা তুলে চায় বাসু। লোকটার ঘোষণা, এ বার গাইবেন অন্য গায়ক। বাসু ফের ডুবে যায় মোবাইলের পর্দায়। ‘তু-উ-উ মেরি জ়িন্দেগি হ্যায়...’ নতুন গায়ক গান ধরতেই আর রিলসে ডুবে থাকতে পারে না। ‘তু-উ-উ-উ মেরি হর খুশি হ্যায়’— মেরিতে মোচড় দিয়ে খুশির ‘শি’তে সামান্য চাপ, গায়কের দিকে অপলক চেয়ে থাকে বাসু। কডের একটা ক্যাপ মাথায়। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে গাইছেন, মুখ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে মাথা বাঁয়ে ঝুঁকিয়ে, মাইক্রোফোনটা মুখের সামনে থেকে ডান দিকে চকিতে সরিয়ে নিয়ে পরক্ষণেই আবার মুখের সামনে নিয়ে আসছেন— ‘তু হি পেয়ার, তু হি চাহত, তু হি আশিকি-ই-ই-ই হ্যায়...’ অন্তরার ‘পহেলি মহব্বত কা অ্যাহসাস হ্যায় তু’, ধরতেই স্থবির হয়ে যায় বাসু। এমনই স্থির সে হয়েছিল বহু বছর আগে, এক কালীপুজোর পরের রাতে, সুলতানপুরের মাচার ফাংশনে। কার্তিকের সেই হিম-হিম অন্ধকারে, পর পর গান শুনিয়ে যাচ্ছিলেন এক গায়ক। একটা গান তো কেবল গান নয়, আরও অ-নে-ক কিছু! স্মৃতির ট্রাঙ্ক। খুললেই যার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ন্যাপথালিন-জীবন। সে দিন তার পাশে ছিল মোনালিসা।

গায়ক এর পর ‘যব কোই বাত বিগড় যায়ে...’ ধরতেই বিস্মিত হয় বাসু। কে এই গায়ক? বাইশ-চব্বিশ বছর আগে, সে দিনও এই গানগুলো এ ভাবেই, পর পর শুনিয়েছিলেন বরুণ সরকার। নামটা এখনও মনে গেঁথে আছে। মূলত কিশোরকণ্ঠী, কুমার শানুর গানও গাইতেন। বরুণের বহু ফাংশনের সাক্ষী সে। গান বন্ধ হয়। যন্ত্রপাতি গোছানোর পালা। পরের কামরায় যাবেন সম্ভবত। ব্যাগটা সিটে রেখে উঠে যায় বাসু।

“আপনি কি বরুণ সরকার?”

গায়ক স্থিরদৃষ্টিতে বাসুর দিকে কিছু ক্ষণ চেয়ে থাকেন। তার পর হাসি না-হাসির একটা আভা ছড়িয়ে যায় প্রবীণ মুখমণ্ডলে।

“‘ও চোখে আমার’ এক বার গাইবেন প্লিজ়?” সামান্য বিরতি নিয়ে বাসু ফের বলে, “টাকা দেব!”

মঞ্চ থেকে প্রস্থানোদ্যত গায়ক ইষৎ থমকালেন, পিছু ফিরে চোখের ইশারায় সঙ্গীকে ফের সাজাতে বললেন আসর। লম্বা প্রিল্যুড শেষ হতেই, সেই পরিচিত স্টাইলে গেয়ে উঠলেন, “ও চোখে আমা-আ-আ-র, শুরু আর শেষ, আমারই জীবন আর আমারই মরণ…”

মোনালিসার হাতের উপর হাত দেয় বাসুদেব। কার্তিকের হিমে মিশে যায় ভালবাসার ওম। সেই বছরই ওরা আশা টকিজ়ে এক সঙ্গে শেষ বই দেখেছিল, ‘সাথী’। মাঘে বিয়ে হয়ে গেল মোনালিসার। দেওয়ালে গোঁত্তা খেয়ে পড়ে গেল কাগজের উড়োজাহাজ।

পরবর্তী স্টেশন আসে। ঘাড়ে সাউন্ডবাক্স নিয়ে, গায়কের হাত ধরে পরের কামরার দিকে চলে যান সঙ্গী। নাহ, কোনও কথাই গায়ককে জিজ্ঞেস করতে পারেনি বাসু। আসন ছেড়েই উঠতে পারেনি। সিটে বসে মনে-মনে ভেবেই গেছে কেবল।

বাসু মোবাইলের পর্দায় আঙুল ছোঁয়ায়। বাংলা গানটা খোঁজে। পায়ও। কিন্তু শোনার ইচ্ছে হয় না। আতসকাচে নাম লেখে, মোনালিসা। ওই নামের অসংখ্য প্রোফাইল আসে। খুলে খুঁজতে ইচ্ছে করে না। একটা পোস্ট দেয়। জুড়ে দেয় ছবিও। ট্রেনের কামরায়, হাতে মাইক নিয়ে, গাইছেন এক জন।

ক্যাপশনে লেখে, ‘ছুঁয়ে যাবে এই সুর’।

মুছে দেয়। ফের লেখে নতুন শিরোনাম, ‘শেষ ট্রেনের গায়ক’।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy