E-Paper

পুরনো প্রেম

রুমার রাগের কারণ বুঝে পাল্টা কোনও উত্তর দেয় না অশেষ। জানে, উত্তর দিয়ে লাভ নেই। আয়নায় দেখল এক বার শার্টটাকে, আলতো হাতে কয়েক বার আঙুল বোলাল।

সুব্রত নাগ

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৮
ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

আজও তুমি এই শার্টটাই পরে যাবে?” গলায় বেশ ঝাঁঝ মিশিয়েই জিজ্ঞেস করে রুমা।

ক্রিম কালারের উপর হালকা বাদামি স্ট্রাইপ দেওয়া শার্টটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে অশেষ জবাব দেয়, “হ্যাঁ। কেন?”

“কেন মানে? তোমাকে পইপই করে বলেছি, ওটা পরে আর বাইরে বেরোবে না তুমি, বাড়িতে পরলে পরো। তা নয়, তুমি কিনা ওটা পরে অফিস চললে?” ঝাঁঝ বাড়ে রুমার।

গায়ের শার্টটা ভাল করে জরিপ করে অশেষ বলে, “কেন? দিব্যি তো শার্টটা!”

এ রকম গা-ছাড়া উত্তরে আরও তেতে ওঠে রুমা, “ওয়ার্ডরোবে আর শার্ট নেই? যে না ছেঁড়া পর্যন্ত এটাই পরে যেতে হবে? কবেকার পুরনো শার্ট! বিয়ের পর থেকেই দেখছি!”

রুমার রাগের কারণ বুঝে পাল্টা কোনও উত্তর দেয় না অশেষ। জানে, উত্তর দিয়ে লাভ নেই। আয়নায় দেখল এক বার শার্টটাকে, আলতো হাতে কয়েক বার আঙুল বোলাল। পুরনো তো কী হয়েছে? আরামসে এখনও পরা যায়। তা ছাড়া রাঙাপিসির দেওয়া শেষ উপহার। ওর জন্মদিনে দিয়েছিল। তার মাস তিনেক পরেই হঠাৎ সেরিব্রাল স্ট্রোকে চলে গেল রাঙাপিসি। তার স্মৃতির একটা আলাদা মূল্য আছে না? রুমা কি বোঝে এ সব?

না, বোঝে না রুমা। বোঝে না কী ভাবে অশেষের মতো এক জন হ্যান্ডসাম এগজ়িকিউটিভ নিজের জামাকাপড়ের ব্যাপারে এত নিস্পৃহ হতে পারে! শুধু জামাকাপড়ই বা কেন, ওর ব্যবহার করা যে ক’টা পুরনো জিনিস আছে, প্রত্যেকটিকে যখের ধনের মতো আগলে রাখতে চায় অশেষ। পুজো আর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ফি-বছর জামাকাপড় তো কম কেনা হয় না! তাতে কী? অশেষ ওয়ার্ডরোব ঘেঁটে বার করবে সেই ওর পছন্দের দু’-চারটে প্রাগৈতিহাসিক শার্ট-প্যান্ট, শীতকাল হলে সোয়েটার, জ্যাকেট। অন্য পোশাকগুলোর দিকে তাকায়ই না। জামাইয়ের জন্য ব্র্যান্ডেড সাফারি স্যুট দিয়েছিল রুমাদের বাড়ি থেকে। সাকুল্যে দু’-তিন বার বোধহয় পরেছে। তার পর থেকে সাজানোই আছে ওয়ার্ডরোবে। শুধু কি জামাকাপড়! অন্তত কুড়ি-পঁচিশখানা কলম আছে, তাও লেখার জন্য অশেষ বেছে নেবে প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া একটা ফাউন্টেন আর একটা ডটপেন! যদি ইয়ার্কি করেও রুমা কোনও দিন বলেছে, “আর কেন? পেন দুটোকে মিউজ়িয়মে দান করে এসো,” অমনি ফুঁসে উঠবে অশেষ, “জানো, হায়ার সেকেন্ডারিতে স্কুলে ফার্স্ট হয়ে পেন দুটো প্রাইজ় পেয়েছিলাম!”

প্রথম প্রথম রাগ হত রুমার, তীব্র অভিমান হত, এখন সয়ে গেছে। শ্বশুরমশাইয়ের সর্বক্ষণের বাহন ছিল একটা লজঝড়ে স্কুটার। শ্বশুরমশাই চলে গেলেন, কিন্তু স্কুটার গেল না। বহাল তবিয়তে গ্যারেজে গ্যাঁট হয়ে রইল। যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তাতে সওয়ার হয় অশেষ। বন্ধুবান্ধবরাও কি কম আওয়াজ দেয় ওকে! “দয়া করে একটা নতুন বাইক কিনে আন বাবা, আমরা না হয় চাঁদা তুলে ইএমআই মেটাব।” এক-এক সময় এত লজ্জা করে রুমার... আড়ালে আবডালে অনেকেই যে অশেষকে হাড়কঞ্জুস বলে, সেটাও কি বোঝে না?

বুঝতে পারে না অশেষও। চার পাশের সবাই ওর পুরনো প্রেম নিয়ে এত খোঁচা দেয় কেন? সব সময় নতুন-নতুন করে এত আদিখ্যেতারই বা কী আছে! জামাপ্যান্ট, শাড়ি-ব্লাউজ়, ঘর-গেরস্থালির জিনিসপত্র, ফার্নিচার— একটু পুরনো হতে না-হতেই পাল্টে যাচ্ছে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে নতুন বিকল্প। পারে কী ভাবে মানুষ? যে কাপে প্রতিদিন চা খায় অশেষ, যে শেভিং-সেটে দাড়ি কামায়, যে কলমে প্রতিদিন লেখালিখি করে, যে চশমাটা পরে কাজ করে— সেগুলোর সঙ্গে দিনের পর দিন সহবাস করতে করতে কি একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় না? চাইলে তো যে কোনও দিন একটা হালফ্যাশনের দামি বাইক কিনতে পারে অশেষ, কিন্তু ওই পুরনো স্কুটারে যখন চেপে বসে ও, স্টার্ট দেয়, স্কুটার ছুটতে শুরু করে, তখন যেন মনে হয় বাবা পিছনে বসে ওকে ছুঁয়ে আছে। যে কাঁসার থালায় অশেষ প্রতিদিন ভাত খায়, সেটায় খাবার সাজিয়ে কত যত্নে মা এক সময় খেতে দিত। আজ মা নেই বলে কি পুরনো থালাটাও পাল্টে ফেলা যায়?

এক বারের বেশি ডোরবেল বাজাতে হল না, দরজা খুলে দিল রাকা। অশেষ ঢুকতেই ভ্রু বাঁকিয়ে বলল, “কুড়ি মিনিট লেট।”

“কী করব?” হাতের ব্যাগটা সোফার উপর রেখে বলে, “যা জ্যাম রাস্তায়!”

ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বের করে অশেষকে দিয়ে রাকা বলে, “পালাই-পালাই করবে না কিন্তু। ডিনার সেরে ফিরবে।”

মোজা খুলতে খুলতে অশেষ বলে, “মাথা খারাপ! ন’টার মধ্যে ফিরতেই হবে।”

“বৌকে কী বললে? অফিসে জরুরি মিটিং?”

“আবার কী?”

“বিশ্বাস করে? সন্দেহ করে না?”

“জানি না...” দু’ঢোঁক ঠান্ডা জল গলায় ঢেলে অশেষ জিজ্ঞেস করে, “তোমার কত্তা ফিরবে কবে?”

“পরশু বিকেলে... এসো...”

প্লেটে স্ন্যাক্স আর বাহারি কাটগ্লাসে হুইস্কি সাজিয়ে এনেছে রাকা। ভ্রু কুঁচকে অশেষ বলে, “গ্লাসগুলো কি নতুন?”

“দারুণ, না? অনলাইনে কিনেছি।”

“কেন? পুরনোগুলো কী দোষ করল?”

“পুরনো হয়ে গেছিল, ফেলে দিয়েছি।”

অশেষের বুকের কাছে ঘন হয়ে আসে রাকা। আদুরে গলায় বলে, “আমার কাছে আর এই পুরনো শার্টটা পরে আসবে না তো... বেশ, আমিই না-হয় তোমাকে একটা নতুন শার্ট গিফ্ট করব।”

বিরক্ত হয় অশেষ। কেন রাকাও সেই নতুনের পেছনেই ছুটবে? কাল সন্ধ্যায় তৃষার কাছে যাওয়ার কথা আছে। ওখানে গিয়ে হয়তো দেখবে, বেডরুমে খাটের উপর নতুন বেডকভার পাতা হয়েছে! পরশু রুচিরার বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করবে, দরজা-জানলার পর্দাগুলো সদ্য পাল্টানো হয়েছে। আহ্লাদি গলায় বলবে রুচিরা, “দেওয়ালের কালারের সঙ্গে ম্যাচিং করে কালই কিনলাম। লাভলি না?”

কোথায় যাবে অশেষ? অফিসের নতুন সুন্দরী স্টেনোটার সঙ্গে সদ্য মাখামাখি শুরু হয়েছে, ফ্ল্যাট অবধি পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু অশেষ নিশ্চিত, স্টেনো মেয়েটাও সে দিন হাতের আঙুলগুলো মেলে ধরে বলবে, “আজই নতুন নেলপালিশটা কিনেছি। মভ্ কালারটা তো আপনার ফেভারিট, তাই না?”

সে দিনও ছটফট করে উঠবে অশেষ, আর অস্থির হয়ে ভাববে, পুরনোকে খুঁজে পাওয়ার জন্য পরবর্তী দিনগুলোয় আর কার কার কাছে ছুটে যেতে হবে তাকে!


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy