E-Paper

১৩৯-এর মা

মধুমিতা কান্না সামলে উঠতে পারে না। ১৩৮-এর মা বেডের কাছে এসে বলে, “কেঁদোনি গো দিদি! তুমি বরং সিস্টারদের কাছে যাও। ডেকে নে এসো। আমি তোমার খুকিকে দেখছি।”

তাপস রায়

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৩৬
ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়।

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়।

রাত বারোটা বাজলেই টানা ন’দিন। এই সরকারি হাসপাতালে ইথানল, ব্লিচিং পাউডার আর ক্লোরিনের গন্ধে প্রথম-প্রথম বমি এসে যাচ্ছিল মধুমিতার। কোনও সাফসুতরো প্রাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া যেত রিয়াকে। মৃন্ময়ের বন্ধু পেডিয়াট্রিক সার্জেন ডা. সন্ধিক্ষণ রায় এই হাসপাতালে আছে বলেই এখানে আসা। রাত এগারোটায় ফোনে সিম্পটম শুনে ও-ই পরামর্শ দিয়েছিল, দেরি না করে এখানেই নিয়ে আসতে। সম্ভবত অ্যাপেন্ডিসাইটিস!

পেডিয়াট্রিক মেডিসিন ওয়ার্ড। মধুমিতার পরিচয়, ১৩৯-এর মা। হিন্দু-মুসলিম, জাতপাত, সব পরিচয় নিষ্প্রভ। সবাই মা, শুধু নম্বরটাই ভিন্ন। ১২২-এর মা পৈলানের সাবানা খাতুন বাথরুমে গিয়েছে, ১২১-এর মা বাঁকুড়ার মাধবী এসে সেই বেডের শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে কান্না থামাচ্ছে, “ঘুম-পাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো/ খাট নাই পালং নাই চোখ পেতে বোসো...”

রিয়ার অপারেশন তিন দিন আগে হয়েছে। কিন্তু অপারেশনের জায়গায় এখনও প্রচণ্ড ব্যথা, সঙ্গে জ্বর। যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে। প্রলাপ বকে যাচ্ছে, “মা, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। ছাদে গিয়ে ঘুড়ি দেখব!”

মধুমিতা কান্না সামলে উঠতে পারে না। ১৩৮-এর মা বেডের কাছে এসে বলে, “কেঁদোনি গো দিদি! তুমি বরং সিস্টারদের কাছে যাও। ডেকে নে এসো। আমি তোমার খুকিকে দেখছি।”

মধুমিতা কান্না থামিয়ে রিয়ার দায়িত্ব ১৩৮-এর মাকে সঁপে দিয়ে ছুটে যায় নার্সদের টেবিলে। গলা চড়িয়ে বলে, “মেয়ের জ্বর নামছে না। আপনারা কেউ আসছেন না কেন!”

নির্বিকার সিস্টার জাবদা খাতায় রোগীর ওষুধের তালিকা লিখতে লিখতে বলে, “১৩৯ তো?”

“হ্যাঁ!”

“ঘণ্টা তিনেক আগে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়েছে। এত অধৈর্য হলে চলে না দিদি!”

মধুমিতা বেডে যাওয়ার আগে চলে যায় ওয়াশরুমে। বেসিনের কল খুলে দেয়। ঝরঝর করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, রিয়া যেন সুস্থ শরীরে এই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ছোট্ট বেডে কোনও মতে যন্ত্রণাকাতর রিয়ার পাশে নিজের জায়গা করে নিয়ে শুয়ে শুয়ে রিয়ার কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। কখন যেন চোখ বুজে আসে মধুমিতার।

হঠাৎ ব্যথা অনুভব করে তলপেটে। ব্যথাটা ঢেউয়ের মতো আসছে আর চলে যাচ্ছে। একটা প্রাণী যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে তার পেট থেকে। মধুমিতা আবছা-আবছা দেখতে পাচ্ছে, তার চতুর্দিক সবুজ কাপড়ে ঢাকা। সহসা বাচ্চার কান্নার শব্দ। ব্যথাটাও উধাও। তার ঘুমটাও ভেঙে যায়। ধড়ফড় করে উঠে পড়ে মধুমিতা। মাথার উপর পেল্লাই সাইজ়ের সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে ঘরঘর শব্দে। ছোট্ট রিয়া উঠে বসেছে। হাউমাউ করে কাঁদছে।

মধুমিতা ঘাবড়ে যায়, “কী রে, কাঁদছিস কেন?”

“তুমি অমন চিৎকার করছিলে কেন মা?”

রিয়াকে জড়িয়ে ধরে মধুমিতা, “কিছু না, সোনা! একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।” রিয়ার কপালে হাত দেয়, “আরে, তোর গায়ে তো আর একটুও জ্বর নেই রে মা!” আনন্দে রিয়াকে আরও কিছুক্ষণ বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে ওর ওম নিতে নিতে স্মৃতির অতলে ডলফিনের মতো ডুব দেয় মধুমিতা।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিল ওরা। কিন্তু ডাক্তাররা যখন জানিয়ে দিয়েছিলেন তার পক্ষে আর কনসিভ করা সম্ভব নয়, তখন সে আর মৃন্ময় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি। দশ মাসের শিশুকে বাড়িতে নিয়ে এলে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল একান্নবর্তী পরিবারে। জেঠিশাশুড়ি তো মুখ দেখে বললেন, “রক্তের সম্পর্ক থাকুক আর না-ই থাকুক, মেয়ের মুখের আদলটা কিন্তু আমাদের বৌমার মতোই।”

ওঁর কথায় অতিশয়োক্তি ছিল না। মেয়ে যত বড় হতে লাগল, ততই সে কথা প্রমাণিত হল। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার মুখে এখন একই কথা।

মধুমিতা ওকে যথেষ্ট সময় দেয়। বন্ধুর মতো গল্প করে। এক দিন রিয়া দুম করে জিজ্ঞেস করেছিল, “মা, আমি কি তোমার পেটের মধ্যে ছিলাম?”

অপ্রস্তুত মধুমিতা ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছিল, “দেখ রিয়া, ভগবান কিছু কিছু বাচ্চাকে মায়ের পেটের ভিতরে দেয়, আর কিছু কিছু বাচ্চাকে বাড়িতে মায়ের কাছে দিয়ে যায়। যেমন তোকে।”

“ভগবান নিজে এসে দিয়েছিল?”

“না মানে... নিজে আসেনি। কাউকে দিয়ে চুপটি করে এই বিছানায় রেখে গিয়েছিল।”

ভাবনার তাল কাটে। দেওয়াল ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ। ভোর সাড়ে চারটে। পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে অল্প অল্প ভোরের আলো ঢুকছে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির। এক জন সিস্টার হাতে ট্রে নিয়ে জুতোয় খটাখট শব্দ তুলে বেডের কাছে চলে আসে। রিয়ার হাতের চ্যানেলে একটি ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়। কাজটা সারতে সারতেই সুখবরটা দেয়, “ডাক্তারবাবু আজ সকালেই ডিসচার্জে সই করে দেবেন, যদি আর জ্বর না আসে।”

রিয়া অর্থটা বুঝতে পারে না। কিন্তু ১৩৯-এর মায়ের মুখে তখন ডিমের কুসুমরঙা হাসি, “সত্যিই!”

অফিশিয়াল ফর্মালিটি সেরে ওরা যখন বেরিয়ে আসে, তখন দুপুর একটা। ক্যাব চলেছে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে। গন্তব্য নরেন্দ্রপুর।

মধুমিতার কোলে মাথা রেখে রিয়া বলে, “মা, তোমাকে থ্যাঙ্কস!”

“কেন রে?”

“এই যে তুমি আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে এসেছ। আমি ভেবেছিলাম আর বোধহয় কোনও দিন আকাশ, তারা, গাছপালা, ঘুড়ি কিছুই দেখতে পাব না।”

রিয়া যে বড্ড পাকা-পাকা কথা বলে, তা ওর স্কুলের টিচার থেকে শুরু করে গেটকিপার-ও জানে।

মধুমিতা উত্তর না দিয়ে কাঁদতে থাকে। রিয়া নিষ্পলক। তার শরীরের অবশিষ্ট বলটুকু সে মাকে ধন্যবাদ জানাতে ইতিমধ্যেই ব্যয় করে ফেলেছে। তাই ইচ্ছে করলেও জিজ্ঞেস করতে চায় না, মা কেন এত কাঁদছে।

মৃন্ময় বলে, “উফফ! ন’দিন তো নয়, যেন ন’মাস। অফিস সামলে, দু’বেলা হাসপাতালে ছোটাছুটি করে আমি জেরবার হয়ে গেছি... ছুটি হয়ে গেল, কোথায় আনন্দে হাসবে, তা নয়, কাঁদছ!... কাঁদছ কেন বলো তো মধু?”

আঁচলের খুট দিয়ে চোখের কোণ মুছতে মুছতে মধুমিতা বলে, “আনন্দে, তবে ছুটির জন্য নয়।”

“তা হলে?”

গলাটা ধরে আসে মধুমিতার, “আমি যেন ন’মাস রিয়াকে পেটে ধরেছিলাম। আর আজ ভোরেই জানতে পেরেছি প্রসবযন্ত্রণা কাকে বলে!”


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy