E-Paper

কেয়ার গন্ধ

বিকাশ ব্রহ্মচারী মাঝে মাঝে বলে গিয়ে যাত্রা দেখবে, কিন্তু যায় না। খুব কুঁড়ে, তার উপর পাছে পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সেই ভয়ে আরও যায় না। এ ভাবেই মৃত্যু হয় সম্পর্কের, বেঁচে থাকে স্মৃতি, এক সময় স্মৃতিরও মৃত্যু হয়।

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:২০

ছবি: সৌমেন দাস।

পূর্বানুবৃত্তি: যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবেই অনেকটা, ক্লাবঘরে সকলকে নিয়ে মোগল বাদশাদের স্বভাব-চরিত্র, তাদের হারেমের গল্প শোনাচ্ছিলেন জনমেজয়। তখনই সেখানে আসতে দেখা যায় পানস চৌধুরীকে। তিনিই যাত্রার প্রোডাকশন ম্যানেজার। খরচপত্র তিনিই দেন। নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের বাসনা থেকেই এসব করেন। স্টেশনে রাত কাটিয়ে ভোরে বাড়ি ফেরেন দীপঙ্কর। স্নান-জলখাবারের পর পল্লবী তাঁকে জানায় যে, সে দীপঙ্করের জন্য সাইকায়াট্রিস্টের কাছে গেছিল। দীপঙ্করের কথায় কথায় উঠে আসে তাঁর বাবার স্মৃতি, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা, তাঁর দেওয়া কাগজপত্রের কথা। দুপুরে সেই কাগজপত্র থেকে দীপঙ্কর পেলেন রামনিধি গুপ্ত, তথা নিধুবাবুর ইতিহাস। জনমেজয় ফোন করে দীপঙ্করকে আশ্বস্ত করেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে অফিসে কেউ তাঁর খোঁজ করেননি। অন্য দিকে নির্বাচনের কাজে আটকে গিয়ে গেস্ট হাউসে রাত কাটাতে হল জনমেজয়কে। মাতাঠাকুরানি ট্রাস্টের গেস্ট হাউসের একটি ঘর সার্ভেয়ারদের জন্যই বরাদ্দ।

সুদর্শন ছেলে শুভময়, সে-ই অরবিন্দর আসল বস। ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর শুভময় ভট্টাচার্য। ও নিজে অবশ্য এঁরগাছা নয়,বিয়ে করেছে কয়েক বছর হল। ছেলে আছে। খেতে ভালবাসে। আর এক জন আছেন, খেতে ভালবাসেন, তিনি বাপিবাবু। লম্বা পালোয়ান-পালোয়ান চেহারা, কিন্তু কিঞ্চিৎ ফাঁকিবাজ।

আছে ব্রহ্মচারী বিকাশ, কখনওই বিয়ে করবে না। এই অফিসের কাউকে সে ভালবেসেছিল, ভালবাসা না পেয়ে বিরহ জেগে রইল জীবনভর। তাই তার নাম বিকাশ ব্রহ্মচারী, এখন মোটর ভিকেলসে আছে।

বিকাশ ব্রহ্মচারী মাঝে মাঝে বলে গিয়ে যাত্রা দেখবে, কিন্তু যায় না। খুব কুঁড়ে, তার উপর পাছে পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সেই ভয়ে আরও যায় না। এ ভাবেই মৃত্যু হয় সম্পর্কের, বেঁচে থাকে স্মৃতি, এক সময় স্মৃতিরও মৃত্যু হয়।

অরবিন্দর রান্না করার ভার থাকলে সে ফাঁকি দেয়। অরবিন্দও মাঝে মাঝে মাতাঠাকুরানি গেস্ট হাউসে থাকে বাড়ি যেতে না পারলে। আসলে সে একটু-একটু করে বিয়ের বাজার করে নিজের স্বল্প আয় থেকে। একটু-একটু কল্পনা করে নিজের ভাবী বৌকে, অন্ধকার মেসঘরে ভাবী বৌকে সাজাতে সাজাতে সে নতুন স্বপ্ন দেখে আর ঘুমিয়ে পড়ে। ওঠা হয় না, রান্নাও হয় না।

ফলে রান্নার কাজটা এক জনই করে। শেখর ওষুধের দোকানে কাজ করে আর মাতা ঠাকুরানি গেস্ট হাউসে নিয়মিত থাকে। তার এই সংসারে কেউ নেই। ফলে অভিমান হলেও সে শেষমেশ রান্না করে। জনমেজয়ের কাছে তার আবদার সিরাজের রোল করা। আর এক জন সুন্দরী লুৎফুন্নিসা। ফিমেল অভিনেত্রী হতে হবে, মিথ্যে হোক, সে হবে সিরাজের শেষ প্রেম। সেই স্বপ্নে-স্বপ্নে শেখর রান্না করে ফেলে সকলের!

এক বার সাত মাইল উজিয়ে জনমেজয় গেছিলেন বাবার দ্বিচক্রযানে চেপে, বাবারই অভিনীত সিরাজ দেখতে। সেই সিরাজ, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব এ বার করবেন নটসম্রাট শেখর সমাদ্দার। এ সব বলে শেখরকে উজ্জীবিত রাখেন, না হলে ওষুধের দোকানের সেলসম্যান শেখরের একা-একা সকলের রান্না করতে অভিমান হয়।

অফিসও রংমহল। নিত্য যাওয়া-আসা লেগে রয়েছে। পর্দা উঠছে আর নামছে।

কত দিন দেখেছেন জনমেজয়, তাপস সাহা বলে এক জন অটো করে আসতেন অফিসে আর ড্রাইভারকে খাওয়াতেন, কখনও কখনও নিজের ঘরে শোয়াতেনও। তার পর তাপস সাহা মারা গেলে সেই অটোর ছেলেটি শ্রাদ্ধশান্তি করল তাপসের। এ সবই যেন রংমহলের খেলা।

“সাঁ সুসিতে কখনও থিয়েটার দেখেছিস?”

ফটিক একটু ফচকে টাইপের, বলল, “পানসদা, আপনি কি প্যারিসের কথা বলছেন? আইফেল টাওয়ারের কাছে সাঁ সুসি?”

কড়া চোখে তাকালেন পানস। তার পর বললেন, “প্যারিসে তো ওই একটা নামই জানিস।”

জনমেজয় বললেন, “সাঁ সুসি কোথায় পানসদা?”

“কলকাতায় এক সময় ছিল। ১৮৪৩ সালের দোসরা নভেম্বর ওখানে অভিনয় করতে এসেছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা টেলর।”

ফটিক বিস্মিত গলায় বলল, “পানসদা, তখনও আপনি ছিলেন!”

জনমেজয় কোনওক্রমে হাসি আটকে রাখলেন।

পানস বললেন, “তোর মতো ইতরদের জন্যই যাত্রার এই দশা।”

জনমেজয় বললেন, “ওর কথা ছাড়ুন, এটা নিশ্চয়ই আপনি কোনও থিয়েটারের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছেন।”

“শ্রীপান্থের কলকাতা লেখায় পড়ছিলাম।”

ফটিক বলল, “যাক আপনি দেখেননি!”

পানস চৌধুরী বললেন, “আমি প্যারিস গেছি। থিয়েটারও দেখেছি। ওখানেও সাঁ সুসি আছে।”

“ওখানে থিয়েটার দেখেছেন?” জনমেজয় জানতে চাইলেন।

“না, দেখা হয়নি। তবে মাদাম দারভেলমিন নামে যে এক জন অভিনেত্রী ছিলেন, তা জেনেছিলাম।”

ফটিক বলল, “এ বার কি ইউরোপের কোনও অভিনেত্রী আমাদের অপেরায় আসছেন?”

“আনতেই পারি, কিন্তু তোদের শিক্ষিত হতে হবে। লেডি ম্যাকবেথের নাম শুনেছিস?”

জনমেজয় বললেন, “গিরিশবাবু তিনকড়ি দাসীকে নিয়ে মিনার্ভায় ম্যাকবেথ করেছিলেন।”

পানসদা বললেন, “গ্রেট! তোর জন্যই আসি। তিনকড়ি দাসী করেছিলেন লেডি ম্যাকবেথ।”

“ইংরেজিতে?” ফটিক বলল।

“না, বাংলা তর্জমা করেছিলেন গিরিশবাবু।”

সাঁ সুসিতে সেই সন্ধ্যায় অভিনয় হওয়ার কথা ছিল ‘টেমিং অব দ্য শ্রু’। অভিনয় করবেন মাদাম।”

“কোন মাদাম পানসদা?” ফটিক বলল।

“তখন তো কলকাতায় একটিই নাম। মাদাম দারমেনভিল। নভেম্বর মাস হলেও বিদেশি দর্শকদের জন্য হাতপাখার ব্যবস্থা ছিল।”

জনমেজয় বললেন, “অভিনয় হল?”

“না, কারণ আগের রাতে মাদাম দারমেনভিলের স্বামী কলেরায় মারা যান।”

“আর অভিনয় করেননি এই দেশে?”

“করলেন হাসির নাটক, ‘মিস্চিফ মেকিং’। সে বার একটা কাণ্ড করলেন, ‘লর্ডস অব মাইন্ড’কে বললেন, এই অভিনয় যেন তাঁরা অভিনেত্রীর নয়, এক জন নারীর উপস্থাপনা হিসেবে দেখেন।”

“‘লর্ডস অব মাইন্ড’ মানে হল প্রেস,”জনমেজয় বললেন।

পানসদা বললেন, “হ্যাঁ।”

গুপ্তিপাড়া থেকে এসেছে নবকার্তিক। বারো ইয়ারের পুজো আর সিদ্ধির গুলির জন্য গুপ্তিপাড়ার কদর আছে গুলিখোরদের কাছে। কলকাতায় তাকে নিয়ে এসেছে কাশীনাথ পাকড়াশি।

ক্রমশ গঙ্গার ঘাট থেকে তারা যেখানে এল, সেই জায়গাটার নাম সোনাগাজি। এখন লোকজনের মুখে তার নাম সোনাগাছি।

তখন সন্ধে হচ্ছে। শাঁখ বাজছে, উলু দিচ্ছে মেয়েরা। তুলসীমঞ্চে প্রদীপও জ্বালিয়েছে কেউ কেউ। একটা কুপি-জ্বলা ঘরে ঢুকল কাশীনাথ। গলা নামিয়ে বলল, “বিধুমুখী, নতুন নাগর এয়েচে।”

নবকার্তিক বোকাসোকা নয়। গুপ্তিপাড়ায় গুলিখোর আর খেউড় গায়ক হিসেবে বেশ সুখ্যাতি ছিল। দেখতেও সে কার্তিকঠাকুরই বটে।

কুপির আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েমানুষটা দেখল নবকে। জোয়ান মদ্দ। টাকাপয়সা নিশ্চয়ই আছে। সে ছুটে গিয়ে নবর কোলে চড়ে বসল।

একটুও অস্বস্তি হল না নবকার্তিকের। মেয়েটি তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নাগর, তোমার নাম কী?”

“নবকার্তিক।”

“আমি বিধুমুখী,” বলেই সে খিলখিল করে হেসে উঠল।

নব একজোড়া তবলা আর বাঁয়া দেখতে পেল। এক জন তবলচি বাঁয়াটাকে নিয়ে খুটখুট শব্দ করছিল। তার পর ওর চোখে পড়ল বিছানায় এক পক্বকেশ, সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ শুয়ে আছেন।

নবকার্তিক বৃদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে মেয়েটিকে বলল, “উনি কে?”

তখন কাশীনাথ বলল, “ইনি নিধুবাবু, রামনিধি গুপ্ত। ওঁর গান তো তুই গাইতে ভালবাসিস।”

চমকে উঠল নবকার্তিক। এই ভাবে স্বপ্নের গীতিকারের দেখা পাবে, ভাবতেও পারেনি।

এই বার মেয়েটি বলল, “তুমি গাইতে জানো?”

“কতকটা,” উত্তর দিল নবকার্তিক।

“সুরে গাইলে তিনি চোক মেলে দেকবেন। না হলে কিন্তু অনর্থ করবেন। তকন মুকের ভাষা পাঁকের মতন মনে হবে।”

নবকার্তিক চোখ বুজে ধরল, “যদি বেঁচে থাকি/ আর গান গাহিব না/ অনুকৃতি বিকৃতি/ শাশ্বত বন্দনা/ আর গান গাহিব না...”

ঘরে বিজলিবাতি ছিল, জ্বলে উঠল। তবলচি বোল ফোটাল তবলায়।

নিধুবাবু উঠে বসলেন, বললেন, “কে গায়?”

নবকার্তিক হাত জোড় করে বলল, “আমি গুপ্তিপাড়ার নবকার্তিক।”

প্রশান্ত গলায় নিধুবাবু বললেন, “গাও।”

গাইল নবকার্তিক, “স্মরণে বরণে এসো/ মরম যন্ত্রণা/ আর গান গাহিব না/ লিখিত অনুকৃতি/ শাশ্বত বন্দনা/ যদি বেঁচে থাকি/ আর গান গাহিব না।”

“এই পদ তুমি কোতায় পেলে?” চোখে মেলে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন নিধুবাবু।

“আমি নিজে লিকেচি। আপনার টপ্পা শুনেশুনে লিকেচিলুম।”

কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলেন নিধুবাবু। তার পর বললেন, “বিধু, আমার খিদে পেয়েচে।”

বিধুমুখী বলল, “পুজোর পেসাদ রেকেচি, আপনি একটু উঠে বসলেই দিতে পারি।”

যে নিধুবাবুকে দেখার জন্য নবকার্তিক পাগল ছিল, তাঁকে যে এই ভাবে এখানে দেখতে পাবে, কল্পনাও করেনি নব।

এই সময় গুড়ুম গুড়ুম রাত ন’টার তোপ পড়ল।

নিধুবাবু প্রসাদের অন্ন মুখে দিয়ে বললেন, “বুইলে হে, সময় কারুর হাতধরা নয়কো।”

কাশীনাথ বলল, “বেবুশ্যের যৌবনের মতন। নট-নটীর রূপের মতন। জীবের পরমায়ু কারুর জন্য অপেক্ষা করে না।”

নবকার্তিক বলল, “আমার কী সৌভাগ্য, আপনাকে চর্মচক্ষে দেকতে পেলুম।”

“বুইলে হে, দলপতিবাবুরা, বধর্মান শোভাবাজারের রাজাবাবুরা তখন নিধুবাবুর পদতলে পড়ে থাকত। তার পর এক দিন দেকলুম, সব শূন্য। দোকানিরা ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। তোপের ধ্বনি শুনতে শুনতে নিধুবাবুর যৌবন চলে গেল।”

বৃদ্ধ হয়ে গেলেন নিধুবাবু। নিন্দুকেরা বললে, “নিধুবাবুর গান ইতরজনের গান। বেবুশ্যের গান।”

“জমি-জিরেত বিক্রি করে এয়েচি, পদতলে স্থান দেবেন। আপনি সরস্বতীর বরপুত্র।”

হাসলেন নিধুবাবু। মনে হল প্রসন্ন হয়েছেন।

বিধুমুখী জল নিয়ে এসে গামছা দিয়ে ওঁর মুখ মুছিয়ে দিল, উনি বলে চললেন, “আমি প্রথম গানের তালিম নিয়েচিলুম শরি মিঞার কাচে। তখন রামপ্রসাদী গানের যুগ বাংলায়। ভক্তিরসের গান। আমি আনলুম শৃঙ্গার রস। হিন্দুস্থানি রাগসঙ্গীতের তালিম নিয়েচিলুম গুরুর কাচে। রসিকবাবুর বৈঠকখানায় প্রথম গান ধরলুম।... কেয়ামত তবলাটা ধরো দিকিনি। বিধু, আলো জ্বালা ঘরে।”

ঘরের বিজলিবাতি জ্বলে উঠল। নিধুবাবু বললেন, “আমার তানপুরাটা দে। আজ নবকে আমার গান শোনাই।”

নবকার্তিক অভিভূত হয়ে গেল। নিধুবাবু তাকে গান শোনাবেন!

নিধুবাবু ধরলেন, “ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে/ আমার স্বভাব এই তোমা বিনাআর জানিনে...”

নবকার্তিক সাহস করে ধরল, “বিধুমুখে মধুর হাসি/ দেখতে বড় ভালবাসি/ সেই তোমারে দেখতে আসি/ দেখা দিতে আসি নে...”

মলিন অন্ধকার ঘরে যেন ঝাড়বাতি জ্বলে উঠল।

রাস্তায় কুকুর ডাকছিল। এখন তারা চুপ করে রয়েছে। তারাও নিধুবাবুর গান শুনছে।

গান শেষ হলে নিধুবাবু বললেন, “তোমার গান আর একখানা গাও দিকিনি। চাইলে খেউড়ওগাইতে পারো।”

নবকার্তিক ধরল, “আমার কাঁচা পিরিতি পাড়ার লোকে পাকতে দিল না/ পাকবো পাকবো করছিল/ পাকতে দিল না।”

তবলচি ঠেকা দিতে শুরু করল। বিধুমুখী ঘুঙুরে আওয়াজ তুলল।

অফিসে না গিয়ে দীপঙ্কর এলেন বিরাটিতে। ঠিকানাটা মিলিয়ে নিয়ে বাড়িটার কাছে এলেন। ছোট্ট বাড়ি। নাম মিনার্ভা।

ছোট্ট উঠোনে কেয়া ফুলের গাছ। তীব্র গন্ধ হাওয়ায়। আজ রোদ নেই। মেঘলা। হাওয়া দিচ্ছে।

ডোরবেল টিপলেন দীপঙ্কর।

সুরেলা গলায় আওয়াজ এল, “কে?”

দীপঙ্কর চুপ করে রইলেন।

সম্পর্কে তিনি মা। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু মা শব্দ হারিয়ে ফেলেছেন দীপঙ্কর বহু বহু যুগ আগে।

দরজা খুললেন তিনি। সবে স্নান সেরেছেন। চুল দিয়ে জল পড়ছে। এখনও সব চুল কালো। বয়স হয়েছে, তবু রূপের একটুও খামতি হয়নি।

“তুমি!” অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার পরেই বললেন, “এসো, ভিতরে এসো।”

দীপঙ্কর জুতো খুলে ভিতরে গেলেন।

বাবার ছবি টাঙানো রয়েছে।

দীপঙ্কর বলে উঠলেন, “কেয়া ফুলের গন্ধে কিন্তু সাপ আসে।”

“এটা ভুল ধারণা। সাপের ঘ্রাণশক্তি দুর্বল। আসলে ফুলে গন্ধ থাকলে পোকামাকড় বেশি আসে। তাই ও রকম একটা কথা আছে... আমি বরং আগে ভাত বসাই। আজ ইলিশমাছ এনেছি। তোমার বাবা বলতেন, তুমি নাকি খুব ইলিশ ভালবাসো।”

“আমার কথা বাবা বলতেন!”

“শেষে প্রায়ই বলতেন। কয়েক বার দেখাও করতে চেয়েছিলেন।”

“গেলেন না কেন?”

অপমানের ভয়ে। একা তো যেতে পারতেন না। আমাকে সঙ্গে যেতে হত।

দীপঙ্কর বললেন, “বাবার কী হয়েছিল?”

“প্রথমে পক্ষাঘাত, তবে চলতে পারতেন। তার পর হল অ্যালঝাইমার’স। স্মৃতিশূন্যতা। সব কিছু ভুলে যেতেন।”

কাগজগুলিতে নিধুবাবুর কথা আছে, গানও আছে। দীর্ঘশ্বাস পড়ল দীপঙ্করের। নিজেকে ভাবতেন গুপ্তিপাড়ার নবকার্তিক।

“এ রকম কাউকে চিনতেন বাবা?”

“মনে হয় না, সবটাই কল্পনা।”

“গানগুলি বাবার লেখা?”

“হ্যাঁ, বেশ কিছু টপ্পা লিখেছেন। শুয়ে শুয়ে গাইতেন আর নিধুবাবুর সঙ্গে কথা বলতেন যেন, আর সে-সব লিখে রাখতেন।”

“আমাকে দেওয়ার কথা কখন বললেন?”

“মৃত্যুর আগে। তখন স্বাভাবিক হচ্ছিলেন।”

“যাত্রা কবে ছেড়েছেন?”

“বহু আগে।”

“আপনিও ছেড়ে দিলেন?”

“না, তা হলে সংসার চলবে কী করে! তোমার পড়ার খরচাও যতটুকু পারতেন, পাঠাতেন।”

দীপঙ্কর বললেন, “আপনি বোধহয় ভাতবসিয়ে এসেছেন।”

“হ্যাঁ,” বলে দৌড়ে গেলেন।

ফিরে এসে আঁচল দিয়ে কপাল মুছে বললেন, “খেয়ে যাবে কিন্তু!”

দীপঙ্কর হেসে বললেন, “খাব, মা।”

ওঁর কেমন যেন এক তৃপ্তি হল বহু দিন পর কাউকে ‘মা’ বলতে পেরে।

এক রকমের লুপ্ত স্বরে ‘মা’ শব্দটা ওঁর গলায় উঠে এল।

সে ডাক শুনতে পেয়ে নতুন মায়ের চোখে জল এসে গেল।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Literature Bengali Novel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy