Advertisement
E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

বৈশাখী বাতাসের আবহও সহসা অন্য রকম। বাতাসের প্রবাহে যেন গানের সুর। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মহাপ্রভুর স্পর্শে কি জাদু আছে? এক স্পর্শেই তার সমস্ত অন্তরাত্মা বদলে গিয়েছে।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৫ ১০:১৮
Share
Save

মহাপ্রভু বললেন, “পণ্ডিতচূড়ামণি ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে আমি তোমার কথা শুনেছি। তুমি তো শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষ!”

রায় রামানন্দ অধোবদন হলেন। বললেন, “এ কথা বলে লজ্জিত করবেন না প্রভু। অধম আপনার দাসানুদাস।”

শ্রীচৈতন্য দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সময়েই ভেবেছিলেন, রাম রায়ের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করবেন। আর তা এমন সহসাই ঘটে গেল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, সবই ঠাকুরের কৃপা। আবার তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠল। তিনি ভাবে আপ্লুত হয়ে ‘কৃষ্ণ’নাম করে উঠলেন।

রাম রায় অপূর্ব বিস্ময়ে আবার শুনলেন স্বর্গীয় কণ্ঠের নামগান।

অবাক হয়ে দেখলেন, চার পাশের সূর্যের আলো বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়ে আশ্চর্য এক সোনার বর্ণের আভা দিচ্ছে। তাঁর মনে হল, সেই বিপুল সুন্দর আলোর আড়াল থেকে সহস্র দিব্য আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে তাঁদের উপরে। বৈশাখী বাতাসের আবহও সহসা অন্য রকম। বাতাসের প্রবাহে যেন গানের সুর। তিনি মনে মনে ভাবলেন, মহাপ্রভুর স্পর্শে কি জাদু আছে? এক স্পর্শেই তার সমস্ত অন্তরাত্মা বদলে গিয়েছে। ইনি কি সত্যি মানুষ? না কি স্বয়ং ঈশ্বর মানুষের রূপ ধরে মর্তে নেমে এসেছেন! স্বয়ং ঈশ্বর না হলে কি এমন করে সমস্ত ঘৃণার ভার সরিয়ে রেখে তাঁর মতো শূদ্রকে জড়িয়ে ধরতে পারেন!

সাশ্রুনয়নে তিনি এ বার মাটিতে বসে পড়ে মহাপ্রভুর পা জড়িয়ে ধরলেন, “প্রভু, এতই যদি কৃপা করলেন এই অধমকে, তবে এই অধমের গৃহে আতিথ্য গ্রহণের কৃপা করুন।”

মহাপ্রভু মনে মনে এমনটাই চাইছিলেন। পুরী ছাড়ার সময়েই তিনি অন্তরে আশা করেছিলেন, রাম রায়ের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করবেন।

তিনি হাত ধরে ধীরে ধীরে রামানন্দকে তুলে ধরলেন। রামানন্দ উঠে দাঁড়ালে এক বার তাঁর চোখে চোখ রাখলেন মহাপ্রভু। তার পরে তাঁর পিছনে বয়ে চলা পুণ্যতোয়া গোদাবরীর ও পারে সবুজ বনরাজির দিকে তাকালেন। দৈববাণীর মতো মৃদু গলায় মহাপ্রভু বললেন, “আমি মায়াবাদী সন্ন্যাসী। তোমার স্পর্শে আমি কৃষ্ণপ্রেমে ভাসি। তোমার কথা ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে শোনার পরে তোমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। কৃষ্ণের কৃপায় আমার সেই ইচ্ছে আজ পূরণ হয়েছে।”

মহাপ্রভু থামলে তাঁর দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলেন রাম রায়। দেখলেন, মহাপ্রভুর চার পাশে যেন দৈব আলোর বলয়।

মহাপ্রভু প্রায় দিন দশেক কাটালেন রাম রায়ের আতিথ্যে। দিনরাত তাঁরা দু’জনে শাস্ত্র আলোচনায় রত ছিলেন। রায় রামানন্দ ‘ব্রহ্মসংহিতা’ আর ‘কৃষ্ণকর্ণামৃত’ গ্রন্থদু’টি মহাপ্রভুকে উপহার দিলেন।

মহাপ্রভু আবার দাক্ষিণাত্যের দিকে যাত্রা করার সময়ে বললেন, “ফেরার পথে আমি আবার তোমার সঙ্গে দেখা করব।” একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “রাজকার্য তোমার কর্ম নয়। পুরীতে তুমি আমার কাছে যেয়ো। তোমার সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করব আর কৃষ্ণকে ডাকব।”

কথাটি বলে মহাপ্রভু সামনে ফিরে এগিয়ে চললেন। অনন্ত পথের দিকে। আর পিছনে ফিরে তাকালেন না। তখন সবে পুবের আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। রাম রায় দেখলেন, সেই আলো ছাপিয়ে মহাপ্রভুর গমনপথে আরও একটা স্বর্গীয় আলোর আভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

রায় রামানন্দ ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। মনে মনে বললেন, ‘তা-ই যেন হয় প্রভু।’

১০

বটুকেশ্বর এমন নিশুতি রাতেই চলাফেরা করে। চরাচরের সমস্ত মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন শুরু হয় তার কাজ। শহরের বাইরে এক গোপন আস্তানায় তার বসবাস। আর পাঁচটা দিনের মতো নৈশাহার শেষ করে সে শয্যা নিয়েছিল। ঠিক রাত্রির মধ্যযামে তার ঘুম ভেঙে গেল। শরীরটাকে সে এমন করেই বশে নিয়ে এসেছিল। তার শরীরের ভিতরে একটা সময়যন্ত্র কাজ করে। নির্দিষ্ট সময়ে সেই সময়যন্ত্র তার মগজে বার্তা পৌঁছে দেয়। বলে, ‘জাগো জাগো, এ বার সময় হয়েছে’।

শয্যার উপরে উঠে বসে বটুকেশ্বর খেয়াল করল, ঘরে প্রদীপটি তখনও জ্বলছে। সেই মৃদু আলোয় সে দেখল, তার কিশোরী তৃতীয় পক্ষ কুন্তা অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। বস্ত্র আলুথালু। তার ঘুমন্ত মুখটি বড় মিষ্টি। এক বার ইচ্ছে হল দু’হাত বাড়িয়ে সেই ঘুমন্ত কোমল শরীরটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সে তার একটা হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনই তার শরীরের ভিতরের সেই সময়গণকটি যেন ধমক দিয়ে উঠেছিল, ‘ওঠো, এই কি নষ্ট করার সময়?’

তার সারা শরীর হঠাৎ একটু আন্দোলিত হয়ে উঠল। তার ভিতরে আবার সেই কঠিন কর্তব্যপরায়ণ মানুষটি ফিরে এসেছে।

কুন্তাকে সে আর জাগাল না। বয়সটা তার পঞ্চাশ বৎসর অতিক্রম করলেও শরীর এখনও ভীষণ সবল ও বেতস কাঠির মতো ঋজু। সারা শরীরে কোথাও এতটুকু মাংসের বাহুল্য নেই। গাল দুটো ভাঙা। কোটরগত দুই চক্ষুর মাঝখানে বাজপাখির ঠোঁটের মতো নাক। মিশকালো বস্ত্রের উপরে একটা কালো পাগড়ি সে মাথায় জড়িয়ে নিয়েছে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সে আবার এক বার পিছন ফিরে কুন্তার ঘুমন্ত শরীরটার দিকে তাকাল।

বাইরে বেরিয়ে সে এক বার আকাশটা দেখে নিল। কালো আকাশের বুকে কয়েকটি তারা জ্বলজ্বল করছে। চরাচরে আর কোনও আলো নেই। সমস্ত পৃথিবী যেন নিকষ কালো পর্দায় ঢেকে আছে। বটুকেশ্বর হনহন করে এগিয়ে চলল। সে শ্বাপদের মতো দ্রুত আর প্রায় নিঃশব্দে পথ চলতে পারে।

অন্ধকারেও সে দেখতে পায়। তা ছাড়া এই নগরীর সমস্ত পথঘাট তার হাতের তালুর মতো চেনা। তার দু’চোখ আবদ্ধ করে দিলেও সে ঠিক নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। সে আরও দ্রুত পা চালায়। মনে মনে ভাবে, আর একটু সময় নিয়ে বেরোলে বোধ হয় বেশি ভাল হত।

নগরীর উপকণ্ঠে এই বসতিটির বদনাম আছে। দাস-দাসী মজুরদের পাড়া এটি। তারই মধ্যে দু’-একটা পাকা অট্টালিকা। সেগুলি কোনও না কোনও সম্ভ্রান্ত বণিক, রাজকর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত। এগুলি তাঁদের প্রমোদনিবাস।

বটুকেশ্বর এমনি একটি প্রাচীরবেষ্টিত দ্বিতল অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়াল। অট্টালিকাটি বিম্বাধর শেঠ নামে এক বণিকের। দু’বার দরজার কড়া ধরে ঝাঁকানি দিলে ছায়ার অন্ধকার থেকে এক প্রহরী বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। মশালের আলোকে শ্বাপদের দাঁতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল তার হাতের বল্লমের তীক্ষ্ণ ফলা।

বটুকেশ্বর দু’হাতের অদ্ভুত সঞ্চালনে এক বিশেষ সাঙ্কেতিক মুদ্রা রচনা করল। তত ক্ষণে প্রহরীর পাশে আরও এক ছায়া এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রহরী সেই ছায়ার দিকে ফিরে মস্তক নত করার ভঙ্গি করল। উত্তরে সেই ছায়াও সম্মতিসূচক ভঙ্গি করল। মশালের আলোয় সেই ছায়ার চেহারা এ বার স্পষ্ট হয়েছে বটুকেশ্বরের চোখে। সে তাকে চিনতে পারল। চিনতে পেরে একটু অবাকই হল। মনে মনে ভাবল, ‘এ আবার এখানে কেন!’

তার সঙ্গে বটুকেশ্বর অন্দরমহলের একটি কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হল। ঘরটি বাহুল্যবর্জিত। শুধুমাত্র কয়েকটি কাঠের কেদারা। বটুকেশ্বরকে সেখানে বসিয়ে রেখে সেই ছায়ামানুষটি ভিতরে চলে গেল।

বটুকেশ্বর বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। পিছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সে যেন একটু চমকে উঠল।

“কী বটুক, তোমার আসতে দেরি হল কেন?”

কক্ষে প্রবেশ করে প্রধান সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর একটি কেদারা দখল করে বসেছেন। গোবিন্দ বিদ্যাধরের চেহারাটি গড়পড়তা সাধারণ মানুষের মতো। লক্ষ করার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। কেবল চক্ষুদু’টি আশ্চর্য তীব্র। অহর্নিশ সে চোখের দৃষ্টি প্রজ্বলিত। সে চোখের দৃষ্টির উপরে সরাসরি চোখ রেখে কথা বলার সামর্থ্য যেন কারও নেই। বিদ্যাধর তাঁর দুই চোখ মেলে তাঁর সামনে দাঁড়ানো মানুষের অন্তস্তল পর্যন্ত অবলোকন করতে পারেন।

বটুকেশ্বর আভূমি নত হয়ে সেনাপতিকে অভিবাদন করল। তার পর দাঁড়িয়ে আনতমস্তকে বলল, “সেনাপতি, আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন।”

গোবিন্দ বিদ্যাধর হাতের একটা অলস ভঙ্গি করে তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, “তোমার সংবাদ বলো।”

“মহারাজ এখনও আপনার প্রতি বিরূপ।”

বিদ্যাধর মৃদু হাস্য করে ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে বললেন, “এ আর নতুন কথা কী! সে আমি অনুমান করতে পারি। দক্ষিণের যুদ্ধের বিষয়ে রাজা একেবারে মুখ বন্ধ করে আছেন। ও দিকের কী খবর বলো...”

বটুকেশ্বর যেন তোষামোদের ভঙ্গিমায় বলল, “রাজা আবার কে? আমরা তো উৎকলের রাজা হিসেবে আপনাকেই মানি।” দু’হাত জোড় করে সে আবার বলল, “আপনিই আমাদের রাজা।”

গোবিন্দ বিদ্যাধর খুশি হলেন। সহাস্যে বললেন, “কথাটা সব সময় মনে রেখো। দেখো বাবা, আবার যেন অন্য পক্ষে যোগদান কোরো না। তোমাদের বিশ্বাস নেই, তোমরা হচ্ছ বিষধর সর্প!” একটা শ্লেষের হাসি দিয়ে তিনি কথা শেষ করলেন।

বটুকেশ্বর অভিমানী গলায় বলল, “আমি আপনার নুন খেয়েছি রাজাধিরাজ। গর্দান গেলেও আপনার প্রতি আমার আনুগত্য অটুট থাকবে।”

বিদ্যাধর নীরবে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।

বটুকেশ্বর বলল, “গত তিন দিন পর পর রাজকুমারী তুক্কা আর নৃসিংহ উপরায়ের সাক্ষাৎ হয়েছে। আর এই সাক্ষাৎ একেবারেই কাকতালীয় নয়। গত দু’দিনের দু’বারের সাক্ষাৎটি উভয়পক্ষের সম্মতিতেই হয়েছে। আগামী কালও হবে।”

বিদ্যাধরের চোখদু’টি এক বার তীব্র ভাবে জ্বলে উঠল। তা দেখে বটুকেশ্বর বলল, “এই সংবাদটি বোধ করি আপনার কাছে ছিল না!”

উচ্চহাস্য করে তিনি বললেন, “আহা, কী সংবাদ দিলে বটুক! তবে তোমরা পিছন থেকে যেন কোনও কলকাঠি নেড়ো না। যেমন চলছে চলতে থাকুক। এমনকি মহারাজের কানেও যাতে এই সংবাদ না পৌঁছয়, সে দিকে খেয়াল রাখবে। যদি দেখো, কেউ এই সংবাদ মহারাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাকেও পথ থেকে সরিয়ে দেবে। বুঝেছ?”

বটুকেশ্বর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, “যথা আজ্ঞা সেনাপতি।”

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Literature Novel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}