পূর্বানুবৃত্তি: ভরদ্বাজ বৈষ্ণবগোষ্ঠীতে ছোট হরিদাস নামে এক জনকে বেশ অনুগত করে নিয়েছেন। সে নাচে-গানে-অভিনয়ে খুবই দক্ষ। একই সঙ্গে ভরদ্বাজ চৈতন্য-বিরূপতা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন বৈষ্ণব ইষ্টগোষ্ঠীতে। জগন্নাথ দাসকে গিয়ে চৈতন্য-বিরোধী কথা বলার চেষ্টা করলে জগন্নাথ তাঁকে দ্রুত বিদায় করেন। গোবিন্দ বিদ্যাধরের সঙ্গে পরামর্শ করে ভরদ্বাজ ছোট হরিদাসকে তাঁর ষড়যন্ত্রের অংশ করে তোলার কাজে মনোযোগী হলেন। এক সন্ধ্যায় ইষ্টগোষ্ঠীতে মহাপ্রভুর উপস্থিতিতে আশ্চর্য সুন্দর কীর্তন পরিবেশন করল শিখী মাহাতীর বোন মাধবী। তাকে দেখে, তার গান শুনে মোহিত হয়ে পড়ল ছোট হরিদাস। তার মুগ্ধতা আগে থেকেই লক্ষ করেছেন ভরদ্বাজ। এ বার তিনি ছোট হরিদাসের মুগ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলার ইন্ধন জোগাতে শুরু করলেন। ফলে কথাটি জানাজানি হল। জগন্নাথ দাসও বাধ্য হয়ে মাধবীর ইষ্টগোষ্ঠীতে আসা বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশ মেনে নিল মাধবী। পাশাপাশি গভীর অভিমানে সঙ্গীতচর্চাও ছেড়ে দিল সে। ছোট হরিদাসের কাছে মাধবীর এই বৈষ্ণব মণ্ডলীতে না আসাটা খুবই বেদনাদায়ক হয়ে উঠল।
ছোট হরিদাসের এই উন্মনা, চঞ্চলমতি অবস্থা লক্ষ করেন ভরদ্বাজ। আসলে তিনি হরিদাসকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেন। মনে মনে ভাবেন, ‘এই তো, ওষুধে কাজ হয়েছে।’
এক দিন তিনি ছোট হরিদাসকে ডেকে বলেন, “কী ভায়া, দিন দিন তুমি এমন শুষ্ক হয়ে যাচ্ছ কেন!”
ছোট হরিদাস মলিন মুখে মৃদু হাসে। সেই হাসির ভিতরে প্রচ্ছন্ন বেদনা লেগে থাকে। কী উত্তর দেবে সে? এই হাসিটাই তার উত্তর।
ভরদ্বাজও মনে মনে হাসেন। সহসা তাঁর মাথায় একটা কূট রসিকতা খেলা করে ওঠে। বলেন, “শিখী মাহাতীর বাটী তো তুমি চেনো?”
তার পরে নিজেই যেন নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বলেন, “এই তো, সামনের এই পথ দিয়ে গিয়ে দক্ষিণে বুড়ো বটবৃক্ষ, তার পরেই ব্রাহ্মণপাড়া। সেটা পার হলেই মাহাতীদের বাড়ি।”
ছোট হরিদাস সব শুনছিল, কিন্তু কোনও উত্তর দেয়নি। শুধু নিজের বুকের ভিতরে একটা কম্পন অনুভব করে সে।
ভরদ্বাজ তাঁর কথা শেষ করেন না, “বুঝলে, আমাদের ঘরে আজ চন্দনকাঠ শেষ হয়ে গেছে। এইমাত্র খেয়াল হল। আমি তো আর গিরিমাটি লেপে রসকলি কাটতে পারি না! যাও না ভাই, শিখীর বাড়ি থেকে কিছু চন্দনকাঠ এনে দাও দেখি!”
ছোট হরিদাস এমন একটা কিছুই যেন চাইছিল মনে মনে। কিন্তু মাধবীর সঙ্গে কি দেখা হবে তার? বুকের ভিতরে আশা-নিরাশার একটা দোলাচল নিয়ে সে মাধবীদের বাড়ির পথে এগোয়।
দ্বিপ্রহরে মাধবী ঘরের কাজ সমাপন করে পুষ্করিণীতে স্নানে গিয়েছিল। সিক্ত বস্ত্র তার অঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। সিক্ত কেশদাম পিঠের উপর ছড়ানো। সেই কেশরাশি থেকে জল ঝরে পড়ছে তখনও। সে জানত গৃহে কোনও পুরুষ উপস্থিত নেই তখন, ফলে নিজেকে আবৃত করার বিষয়ে সে কিছুটা অসচেতন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাটীর অঙ্গনে প্রবেশ করেই সে ছোট হরিদাসের তৃষিত দুই চোখের সম্মুখে পড়ে যায়। সহসা এই ঘটনায় মাধবী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পরেই দ্রুতপদে অন্তঃপুরে চলে যায়। তার বুকের ভিতরটা ভয়ে কাঁপছিল। সে আর অন্তঃপুর থেকে বেরোল না।
হরিদাস তার গমনপথের দিকে সেই যে তাকিয়ে ছিল, সে দিক থেকে তার চোখ আর সরছিল না।
ভিতর থেকে মাধবীর বিমাতা বেরিয়ে এসে হরিদাসকে অন্তঃপুরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে ওঠেন, “কে গা বাছা, এমন হুট করে গৃহস্থের ঘরে ঢুকে পড়েছ? এই দুপুরবেলা!”
ছোট হরিদাস আমতা আমতা করে, ভরদ্বাজ পণ্ডিতের কথা বলে। সেই বয়স্কা মহিলা কয়েক খণ্ড চন্দনকাঠ এনে দিলে ছোট হরিদাস চলে আসে সেখান থেকে।
কিন্তু ছোট হরিদাসের বুকের ভিতরে যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে গেল, তা আর নিভল না। নানা অছিলায় প্রায়ই সে মাধবীদের বাড়ি যাওয়া শুরু করল। কোনও দিন চন্দন, কোনও দিন গন্ধদ্রব্য, কোনও দিন রন্ধনের সামগ্রী প্রভৃতি সংগ্রহের অজুহাতে সে মাধবীদের বাটীতে গিয়ে হাজির হয়।
প্রথম প্রথম মাধবী তার সামনে বেরোতে সঙ্কোচ অনুভব করত। কিন্তু দিনে দিনে তার সঙ্কোচ কেটে যায়। ছোট হরিদাসের সঙ্গে দু’-একটা কথা হয় তার। সঙ্কোচ ভুলে কথা বলতে তার ভাল লাগে। কোনও দিন শুধু তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। দু’জোড়া চোখের দৃষ্টি সম্পৃক্ত হয়ে অস্ফুটে বহু কথা বলে যায়।
কিন্তু ছোট হরিদাসের এই নিত্য যাতায়াত প্রতিবেশীদের দৃষ্টি এড়ায় না। এই বিষয়ে তারা কটূক্তি করতে শুরু করলে শিখী মাহাতি এক দিন ছোট হরিদাসকে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত করতে নিষেধ করেন।
ছোট হরিদাস এই কথা শুনে কয়েক দিন মাধবীদের বাড়িতে যাতায়াত থেকে বিরত থাকল। কিন্তু তার বুকের ভিতরে যে পিপাসার অনল জ্বলে উঠেছিল, তা যেন আর নির্বাপিত হওয়ার নয়।
মাধবীরও বুকের ভিতরটা শূন্য মাঠে দামাল হাওয়ার মতো হাহাকার করে ওঠে মাঝে মাঝে। সে তার গোপালঠাকুরের সামনে বসে বসে গান গায় আর কাঁদে। মনে মনে বলে, ‘ঠাকুর, কী করব আমাকে বলে দাও!’
পাথরের ঠাকুর নীরবে স্মিতমুখে চেয়ে থাকেন। ঠাকুর কি তবে ছোট হরিদাসকে সাহস জোগান? তা কেউ জানে না। তবে ভরদ্বাজ অনবরত হরিদাসকে সাহস দিয়ে চলেন। ছোট হরিদাস সাহস ফিরে পায়। যেন পতঙ্গ আলোর লোভে আগুনের কাছে ছুটে যেতে চায়।
এক দিন সন্ধ্যার পরে বিরলে মাধবীদের গৃহের পিছনে একটি বৃহৎ তমাল বৃক্ষের নীচে হরিদাস আর মাধবী ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ছিল। সহসা সেখানে এসে উপস্থিত শিখী মাহাতী। মাধবী আর ছোট হরিদাসকে একত্রে দেখে তাঁর মাথায় বিস্ফোরণ ঘটে যায়। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে ফেলেন হরিদাসকে। হাঁক দিয়ে ছোট ভাইকে ডাকেন। ভীষণ পদাঘাত করে তিনি ছোট হরিদাসকে মাটিতে ফেলে দেন। তাঁর ভাইও দৌড়ে এসে প্রহার শুরু করেছে। দুই ভাই মিলে ভীষণ প্রহার করেন ছোট হরিদাসকে। অদূরে দাঁড়িয়ে মাধবী প্রবল ভয়ে শুধু কাঁপছিল। দুই ভ্রাতাকে বিরত করবে, সে সাহস তার নেই।
তার পর দুই ভাই মিলে অর্ধচেতন ছোট হরিদাসকে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসেন নির্জন রাস্তার পাশে।
ভোরবেলা সেই পথ দিয়ে এক দল গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্ত ফিরছিলেন সারা রাত্রি কীর্তন গেয়ে। অচেতন ছোট হরিদাসকে তারা পড়ে থাকতে দেখতে পেলেন রাস্তার পাশে। তাঁরা তাঁদের মঠে নিয়ে গিয়ে হরিদাসের সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। ছোট হরিদাসকে আগে থেকেই চিনতেন তাঁরা। তার কাছে থেকে সমস্ত ঘটনা শ্রবণ করে গৌড়ীয় ভক্তরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন।
তাঁরা সমস্বরে বললেন, “এর একটা বিহিত করা দরকার। চলো সবাই মহাপ্রভুর কাছে যাই। মহাপ্রভুর কাছে এর বিচার চাই।”
হরিদাস একটু সুস্থ হয়ে উঠলে গৌড়ীয় ভক্তরা সকলে মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
মহাপ্রভু তখন পঞ্চসখার সঙ্গে গম্ভীরার বাইরে বসেছিলেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্য তাঁর পায়ের কাছে বসে শাস্ত্রের একটি বিষয় ব্যাখ্যা করছিলেন।
গৌড়ীয় ভক্তরা সেখানে এসে ছোট হরিদাসের উপরে শিখী মাহাতীর অত্যাচারের বিষয় ব্যাখ্যা করে অভিযোগ জানালেন। কিন্তু তাঁরা মাধবীর প্রতি ছোট হরিদাসের আসক্তির কথা প্রচ্ছন্ন রাখলেন।
তাঁরা একজোট হয়ে বললেন, “মহাপ্রভু, ছোট হরিদাসের প্রতি এই অত্যাচারের আপনি একটা বিচার করুন।”
মহাপ্রভু সব মন দিয়ে শ্রবণ করে বললেন, “এক পক্ষের বক্তব্য শ্রবণে তো বিচার হয় না।”
তিনি সেখানে উপস্থিত নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর চোখে চোখ রাখলেন। তাঁদের চোখে চোখে যেন কথা হয়ে যায়।
মহাপ্রভু বললেন, “শিখীকেও এখানে ডেকে পাঠাও। তার বক্তব্যও শোনা দরকার।”
তখনই এক ভক্ত গিয়ে শিখী মাহাতীকে ডেকে নিয়ে আসে। শিখী দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়ে মহাপ্রভুকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি তাঁর বিধবা ভগিনীর প্রতি ছোট হরিদাসের আসক্তির কথা জানালেন। তিনি বললেন, ছোট হরিদাসের কারণেই তাঁর ভগিনীর বৈষ্ণব ইষ্টগোষ্ঠীতে বসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনিও সব কথা ঠিক বললেন না হয়তো। তিনি বললেন, ছোট হরিদাস দিনে দিনে তাঁর ভগিনীকে পাপের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসে। সকলের সামনেই তিনি কেঁদে ফেললেন।
এই সময়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তরাও কিছু প্রতিবাদ জানালেন। বাদ-প্রতিবাদে গম্ভীরা যেন মুখরিত হয়ে উঠল।
মহাপ্রভু সকলের কথা মন দিয়ে শুনলেন। সহসা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ বলশালী সোনার বর্ণ ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠল। তাঁর দুই চোখ শুষ্ক, আরক্ত। মহাপ্রভুর এমন রূপ কেউ আগে কখনও দেখেনি। তিনি তীব্র স্বরে বললেন, “আমি আর কখনও ছোট হরিদাসের মুখদর্শন করতে চাই না। সে বৈষ্ণব ধর্মকে কলঙ্কিত করেছে।”
মহাপ্রভুর এই রূপ দেখে সকলে সাময়িক ভয় পেলেও, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তরা অন্তর থেকে মহাপ্রভুর এই বিচার মেনে নিতে পারলেন না। তাঁরা ভাবলেন, মহাপ্রভু গৌড়ীয় ভক্তদের থেকে নীলাচলের ভক্তগোষ্ঠীকেই বেশি প্রাধান্য দিলেন।
মহাপ্রভুর এই আদেশে ছোট হরিদাসের হৃদয় অপমানে চৌচির হয়ে গেল। সারা রাত সে ঘুমোতে পারল না। অন্তরদহনে সারা রাত্রি সে ছিন্নভিন্ন হতে লাগল। ভোরের দিকে নির্ঘুম চোখে সে শ্রীক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। কোথায় হাঁটছে সে দিকে যেন তার কোনও সংজ্ঞা নেই। মৃত জড়ের মতো সে হেঁটে চলে যায় সমুদ্রের দিকে। ভোরের নির্জন পথে সবে দু’-এক জন মানুষ। তারাও বোধ হয় সমুদ্রস্নানের জন্য বেরিয়েছে।
ছোট হরিদাস ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে নেমে গভীর থেকে গভীরতর জলের দিকে চলে গেল। তার পর দামাল ঢেউয়ের প্রবল তোড়ে তার ক্ষুদ্র শরীর কোথায় ভেসে চলে গেল। আর ফিরে এল না। সমুদ্রস্নানে আগত দু’-এক জন মানুষ এই দৃশ্য দেখে হায় হায় করে উঠল শুধু।
২৪
মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের সামনে বসে একটি সরতা দিয়ে কুট কুট করে সুপারি কাটছিলেন প্রধান রাজপুরোহিত পণ্ডিত কাশী মিশ্র।
মহারাজ গম্ভীর মুখে বললেন, “আমি যা রটনা শুনেছি, আপনি বলছেন সে সব সত্যি?”
কাশী মিশ্র সুপারি রেখে চোখ তুলে মহারাজের দিকে তাকালেন। বললেন, “হ্যাঁ মহারাজ।”
তার পর আবার একটু বিরতি দিয়ে বললেন, “তা ছাড়া আপনি অন্যের কথায় বিশ্বাস করবেন কেন? আপনি সরাসরি মহারানিকেই প্রশ্ন করুন। হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনি মহারানির কাছ থেকেই বিষয়টা সম্যক জেনে নিন। তবে একটা বিষয়ে আমি আপনাকে বলতে পারি, বীরসিংহ খুবই চতুর আর কূট চরিত্রের মানুষ। সাবেক বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু গুটিকয় তন্ত্রমন্ত্রের আমদানি করে আর আশ্চর্য বাগ্মিতায় কিছু মানুষকে সে তার দিকে আকর্ষণ করেছে। এরাই এখন নব্য বৌদ্ধদের মুখ।”
একটানা কথাগুলি বলে তিনি থামলেন।
মহারাজের কপালের ভ্রুকুটি যেন আরও বেড়ে গেল। এমনিতেই কয়েক দিন থেকে তাঁর মুখের উপরে মেঘের ছায়া বিস্তৃত হয়ে আছে। আজই সকালে তিনি খবর পেয়েছেন, উদয়গিরি দুর্গের পতন ঘটেছে। একে একে দুর্গ দখল করে কৃষ্ণদেবরায় ক্রমশ ওড়িশার দিকে এগিয়ে আসছে। চিন্তায় চিন্তায় তিনি বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর তাঁকে একান্তে বলেছিলেন, “প্রজারা নাকি ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রধান রানি যখন বৌদ্ধ অনুরাগিণী হয়েছেন, তখন মহারাজেরও মনোভাব কি তাই? জগন্নাথদেবের মন্দির, ব্রাহ্মণদের ভবিষ্যৎ তা হলে কোন দিকে যাচ্ছে?”
মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব এই কথা শুনে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন। তিনি কয়েক দিন কটক ছেড়ে শ্রীক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। তার মধ্যেই এত সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে! কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধরের কাছে এই মনোভাব প্রকাশ করলেন না। ঈষৎ রূঢ় কণ্ঠেই যেন তিনি বললেন, “তা তুমি কী করছিলে বিদ্যাধর! এর কোনও প্রতিকার বিধান করলে না, বা আমাকে জানালেও না কেন?”
গোবিন্দ বিদ্যাধরের ঠোঁটের কোণে এক চাপা আর খল হাসি খেলা করে। গোঁফের আড়ালে সেই হাসি গোপন করে তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, “মহারাজ, এ আপনার রাজ অন্তঃপুরের বিষয়। আমার কি এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত?”
তিনি প্রশ্নটা তির্যক ভঙ্গিতে মহারাজের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন।
রাজা প্রতাপরুদ্রদেব একটু থমকে গেলেন তাঁর কথায়। এটা কি বিদ্যাধরের চালাকি!
কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি রাজগুরু কাশী মিশ্রকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কাশী মিশ্রের সঙ্গে আরও কিছু গোপন পরামর্শ করে তিনি রানিদের মহলে প্রবেশ করলেন।
বেলা দ্বিপ্রহরে আহারের পরে প্রধান মহিষী পদ্মাদেবী শয্যায় গা এলিয়ে বিশ্রামে রত ছিলেন। দাসী মন্থরা তাঁর পায়ের কাছে বসে। মন্থরা তাঁকে সারা মহলের কে কোথায় সকাল থেকে কী করেছে তার বিশদ বর্ণনা দিচ্ছিল।
মহারাজকে এই সময়ে ঘরে ঢুকতে দেখে পদ্মাদেবী বিস্ময়াপন্ন হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মহারানির ইশারা পেয়ে মন্থরা গুটিগুটি বাইরে চলে গেল। কিন্তু মন্থরা খেয়াল করেনি, আর এক জন দাসী নিঃশব্দে তার পিছু নিয়েছে।
মন্থরা কয়েকটি মহল পেরিয়ে পিছন দিকের একটি গোপন গলিপথে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। এই দিকটায় বিস্তৃত উদ্যান। গাছগাছালি পেরিয়ে মেঠো পথে কিছু দূর অগ্রসর হলেই সে প্রশস্ত রাজপথ পেয়ে যাবে।
মন্থরা নিজের চিন্তায় এমনই মগ্ন ছিল যে অনুসরণকারিণীকে খেয়ালই করল না। সে ভাবছিল, মহারাজ কেন এই ভাবে মহারানির ঘরে এসে হাজির হলেন! মহারাজের মুখ-চোখের ভঙ্গি দেখেই চতুর মন্থরা একটা অশনি সঙ্কেত পেয়েছিল। তাই সে দ্রুত মহল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই সংবাদটি তাকে দ্রুত জায়গা মতো পৌঁছে দিতে হবে।
এই দিকে গাছগাছালি বড্ড ঘনসন্নিবিষ্ট। চার পাশে ঘনায়মান ছায়া। মন্থরার সঙ্গে সেই দাসীর দূরত্ব এখন কয়েক হাত মাত্র। তার গমন বিড়ালের মতো শব্দহীন। সে এ বার তার চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে যখন একেবারে মন্থরার ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে, তখন মন্থরা চমকে উঠেঘাড় ফিরিয়েছে। কিন্তু তত ক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। আত্মরক্ষার সময় পেল না মন্থরা।
মুহূর্তের মধ্যে একটি বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে ধরেছে। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মন্থরার গলায় বিঁধে গিয়েছে তীব্র বিষাক্ত একটি শলাকা।
মন্থরার মুখ থেকে অস্ফুট ঘড়ঘড় একটি শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরোতে পারল না।
ক্রমশ
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)