পূর্বানুবৃত্তি: ছোট হরিদাসকে কৌশল করে শিখী মাহাতীর গৃহ চিনিয়ে দেন ভরদ্বাজ। ফলে সেখানে মাধবীর প্রতি মুগ্ধ হরিদাসের আনাগোনা বাড়ে। এ নিয়ে নানা কথা রটে। শিখী মাহাতী সরাসরি হরিদাসকে তার গৃহে যেতে নিষেধ করলে মাধবীর সঙ্গে গোপনে মেলামেশা শুরু করে হরিদাস। এক দিন সন্ধ্যায় তারা গোপনে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ধরা পড়লে শিখী মাহাতী আর তার ভাইয়ের হাতে প্রচণ্ড মারধর খায় হরিদাস। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে গৌড়ীয় ভক্তরা। তার পর তারা শিখী মাহাতীর বিরুদ্ধে মহাপ্রভুর কাছে বিচার চাইতে যায়। মহাপ্রভু দু’পক্ষের কথা শুনে হরিদাসকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। গভীর মনোকষ্টে আত্মহননের রাস্তা বেছে নেয় সে। অন্য দিকে, মহারাজের কানে পৌঁছেছে মহারানি পদ্মাদেবী এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বীরসিংহের প্রসঙ্গ। তিনি গোবিন্দ বিদ্যাধর, কাশী মিশ্র প্রমুখের কাছ থেকে সংবাদের সত্যতা যাচাই করে সরাসরি এসে উপস্থিত হন মহারানির কক্ষে। সেই সংবাদ পৌঁছে দিতে কোথাও একটা যাচ্ছিল পদ্মাদেবীর দাসী মন্থরা। তখনই জঙ্গলের পথে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয় সে।
অন্য দিকে, মহারানি পদ্মার সম্মুখে শয্যার উপরেই বসলেন মহারাজ। মহারাজের ভ্রুকুটিকুটিল মুখভঙ্গি দেখে মহারানির বুকের ভিতরে যেন একটি ভয়ের কাঁটা বিঁধে গিয়েছে। তিনি মুখে কিছু বলতে পারছেন না। এক বার শুধু মহারাজের চোখের দিকে চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিয়েছেন। হরিণশিশুর মতো তাঁর ভীত চোখদু’টি মহারাজের বুকের কাছে ঘোরাফেরা করছে।
মহারাজও যেন ভীষণ বিস্মিত। তিনি মনে মনে ভাবলেন, সত্যি কত দিন তিনি মহারানি পদ্মার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাননি। কত দিন তিনি তাঁর প্রিয় পদ্মার দিকে ভাল করে তাকাননি। এই পদ্মাকে তিনি বিবাহের পরে আদর করে চম্পা বলে ডাকতেন, পদ্মাই তাঁকে বীরভদ্রের মতো বীর পুত্র উপহার দিয়েছেন। এই রাজবংশের পরবর্তী অধীশ্বর হওয়ার জন্যে যে উপযুক্ত। কিন্তু দিনে দিনে সময়ের কঠোর আঁচড়ে পদ্মার সৌন্দর্য যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিংবা তাঁর নিজেরও দেখার চোখ বদলে গিয়েছিল! তাঁর মনে কি অনুতাপ হয়! তিনি নিষ্পলক চোখে মহারানির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পদ্মার জীবনে কি আবার নতুন করে যৌবন ফিরে এসেছে! দ্বিতীয় যৌবন! পদ্মার শরীর যেন বেতস-কাঠির মতো টান টান, ঋজু হয়ে গিয়েছে। আলুথালু বসনের ভিতর থেকে স্পষ্ট যৌবন উশৃঙ্খল হয়ে আছে যেন। মাথার এলো চুল প্রপাতের মতো পিঠ বেয়ে নেমে এসেছে। মহারাজের মুখের রেখাগুলি ক্রমশ কোমল হয়ে আসতে থাকে। যে ক্রোধের অগ্নিকুণ্ড মাথায় নিয়ে তিনি মহারানিকে কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়ার জন্যে এসেছিলেন, সেই অগ্নিকুণ্ডের উপরে যেন শ্রাবণের ঘন মেঘ থেকে ধারাবর্ষণ ঘটে গিয়েছে। তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন। মহারানি যা করেছেন তা ঠিক নয়, অন্তত তাঁকে আগে থেকেজানাতে পারতেন!
কিন্তু... হ্যাঁ! একটা বিশাল ‘কিন্তু’ তাঁর বুকের ভিতরে আন্দোলিত হচ্ছে।
মহারাজা একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে রানি পদ্মা যেন বুকের ভিতরে একটু সাহস সঞ্চয় করেছেন। সেই সাহসে ভর করেই তিনি মৃদু কিন্তু সুরেলা গলায় বললেন, “মহারাজ, আজ হঠাৎ আমাকে আপনার মনে পড়ল! আপনি তো আমাকে ভুলেই গিয়েছেন।”
মহারাজের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। হাসিমুখেই তিনি বললেন, “তোমাকে আজশাস্তি দেব!”
মহারানি অস্ফুটে বললেন, “তাই তোদিচ্ছেন মহারাজ।”
হঠাৎ মহারাজকে বিস্মিত করে দিয়ে মহারানি পদ্মাদেবী মহারাজের পায়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কালো মেঘের মতো চুলে মহারাজের পদযুগল ঢেকে গেল। রাজা প্রতাপরুদ্রদেব তাঁর পায়ে উষ্ণ অশ্রুর স্পর্শ পেলেন।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে রানি বললেন, “মহারাজ, আমাকে দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দিন। পুত্র বীরভদ্র কী করছে, কেমন আছে, জানি না। একে একে দুর্গের পতন ঘটছে। আমি স্থির থাকতে পারছি না মহারাজ। আমাকে পুত্রের কাছে পাঠিয়ে দিন।”
বীরভদ্রের কথা শুনে মহারাজের মনও বিষণ্ণ হয়ে উঠল। দু’জনেই যেন এক অসুখে অসুখী হয়ে গিয়েছেন সহসা। তিনি মনে মনে তাঁর কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। এই বরং ভাল হল। প্রজারাও জানবে মহারাজ উপযুক্ত বিহিত করেছেন, আবার মহারানিরও মন রাখা হবে। সেই সঙ্গে তাঁর ছোট রানি ইলার কথা মনে পড়ল। ইলাকেও তিনি সন্তুষ্ট করতে পারবেন।
মহারাজা হাত ধরে ধীরে ধীরে পদ্মাদেবীকে পায়ের কাছ থেকে তুলে শয্যার উপরে বসালেন। বিপুল আদরে দুই হাত দিয়ে প্রিয় রানির চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। তার পর, কত কত দিন পরে তাঁর প্রিয় চম্পাকে বুকে টেনে নিয়ে মুখচুম্বন করলেন। পদ্মার হৃদয়ও তৃষিত ছিল। বহু দিনের বর্ষণহীন মাটি যেন বর্ষার প্রথম বারিপাতের স্বাদ পেয়েছে। তিনিও মহারাজাকে আশ্লেষে আবিষ্ট করে অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে নিলেন। বহু ক্ষণ পর দু’জনেই যখন আদরে আদরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, মহারানি তাঁর প্রিয় রাজার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে তাঁর সারা অঙ্গে কোমল অঙ্গুলি চালনা করতে করতে খেলা করছিলেন। রাজা প্রতাপরুদ্রদেব প্রেমসিক্ত কণ্ঠে বললেন, “বীরভদ্রের জন্য আমার মনও উতলা হয়ে উঠেছে চম্পা। তুমি পুত্রের কাছে গিয়ে থাকলে তোমার চোখ দিয়েই যেন আমি পুত্রকে দেখতে পাব।”
রানিও খুব খুশি হলেন। আহ্লাদিত স্বরে বললেন, “হ্যাঁ রাজন, আমাকে পুত্রের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন!” একটু বিরতি দিয়ে তিনি আবার আদুরে গলায় অনুযোগের ভঙ্গি করে বললেন, “রাজন, আমাকে যেন আপনি কী শাস্তি দিতে এসেছিলেন!”
প্রতাপরুদ্রদেব হাসতে হাসতে প্রিয়াকে বুকের কাছে দৃঢ় ভাবে আকর্ষণ করে নিয়ে তার ওষ্ঠাধরে অধর ডুবিয়ে দিয়ে আবেগের গলায় বললেন, “এই তো শাস্তি দিচ্ছি।”
মহারানি একটা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন, কেন এমন করে হঠাৎ মহারাজ তাঁর কাছে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছেন, জয় তাঁরই হয়েছে। তাই কোনও ভাবেই পদ্মাদেবী ওই প্রসঙ্গ তুললেন না।
মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেবও হয়তো সেই কথাই ভাবছিলেন। যে কারণে তিনি রানির কাছে এসেছিলেন, সেই কারণের অবতারণা ছাড়াই তিনি কেমন তার সুষ্ঠু সমাধান করে ফেলেছেন। সেই সঙ্গে বহু দিন পরে এমন নিবিড় করে রানিকে পাওয়াও তাঁর পুরস্কার।
কিন্তু ওই সমস্যার আংশিক সমাধান হয়েছে মাত্র। বীরসিংহকে তিনি ছেড়ে দিতে পারেন না। কারণ এই সমস্ত ঘটনার সে সাক্ষী। সুতরাং তাকে মুক্ত রাখা ঠিক নয়। সেই সঙ্গে তার নব্যবৌদ্ধ সঙ্গীদেরও।
মহারানির কাছ থেকে বেরিয়ে তিনি আবার নিজের মহলে গিয়ে বসলেন। গোপন মন্ত্রণাঘরে তখন দীপ জ্বলে উঠেছে। গোপনে তিনি প্রিয় এক সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। একান্তে বসে তার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। সেই সেনাপতি বললেন, “মহারাজ, এক বার মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধরকে জানালে হয় না?”
মহারাজ মনে মনে হাসলেন, “তুমি ঠিকই বলেছ সামন্ত। তাকে ডেকে পাঠাও এখনই।”
বিদ্যাধর তখন মহলেই ছিলেন। রাজসভার সংলগ্ন প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত বসবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। মহারাজের জরুরি তলব পেয়ে গোবিন্দ বিদ্যাধর বিলম্ব করলেন না। দ্রুত এসেউপস্থিত হলেন।
প্রতাপরুদ্রদেব কোনও ভণিতা না করেই বললেন, “বীরসিংহ ও তার বৌদ্ধ সঙ্গীরা যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। আমি তার প্রাণদণ্ড দেব। সেই সঙ্গে তার সঙ্গীরাও নির্বাসিত হবে রাজ্য থেকে। বিদ্যাধর, তুমি কালই আমার কাছে বীরসিংহকে বন্দি করে হাজির করো।”
বিদ্যাধরের মুখের রেখায় কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি যেন মনে মনে এমনটাই আশা করেছিলেন। মনের ভিতরে কূট হাসিটাকে গোপন রেখে তিনি বললেন, “যথা আজ্ঞা, মহারাজ।”
মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোবিন্দ বিদ্যাধর দ্রুত তাঁর বাসভবনের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন। এখন তাঁর অনেক কাজ। এই সুযোগ তাঁকে কাজে লাগাতে হবে। নিজের গৃহে ফিরে গিয়ে অন্ধকারে অলিন্দের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আপন মনেই হা হা করে হেসে উঠলেন। মহারাজ নিজেই যে তাঁর হাতে এমন সোনার সুযোগ তুলে দেবেন, তা তিনি ভাবতেই পারেননি। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেওয়া চলে না। তিনি আবার হো হো করে হেসে উঠলেন। সেই হাসির তীব্র অভিঘাতে অন্ধকার যেন ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল।
অন্ধকারে একটা প্রদীপ নিয়ে সেই ঘরের দিকেই আসছিল মল্লিকা। বিদ্যাধরের এমন অমানুষিক অট্টহাসিতে সেও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই হাসিকে সে খুব ভয় করে। তার কম্পিত হাত থেকে পিতলের জ্বলন্ত প্রদীপ পড়ে গিয়ে কঠিন পাথরের ভূমিতে একটা করুণ সুর তুলল। উষ্ণ এক ফোঁটা তেল তার পায়ে পড়তে সে ককিয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে দিকে বিদ্যাধরের কোনও খেয়াল নেই। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন দু’হাত দিয়ে অন্ধকারকে ডাকছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন, আগে অন্ধকার, তার পরে তো সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে ফুটে উঠবে আলো।
ও দিকে রাতের অন্ধকারে দিকে দিকে রাজসৈন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে। বৌদ্ধদের পাড়ার গিয়ে যাকে পারছে তাকে ধরপাকড় করছে রাজার সেনারা। দু’-একটা বৌদ্ধ মঠ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধরে ধরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বন্দি করা হচ্ছে। যারা প্রতিরোধ করছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হচ্ছে। অনেকে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই রাজ্যে আর থাকতে পারবে না।
বীরসিংহ নিজের বাটীতে উপস্থিত ছিল না। রাতে তার সঙ্গে মন্থরার দেখা হওয়ার কথা ছিল। সে তাই অরণ্যের এক পাশে একটি বিশাল আম্রবৃক্ষের আড়ালে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বহু ক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন মন্থরা এল না, তখন সে অন্ধকারেই গা ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে গৃহের দিকে চলেছিল। রাজপথে রাজপথে ঘোড়সওয়ার সেনাদের তৎপরতা দেখে তার কেমন সন্দেহ হল। একটু এগোতেই সে দেখতে পেল, একটি বৌদ্ধ চৈত্য আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রাণভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে নিরীহ মানুষগুলি।
ঘটনাপ্রবাহ অনুমান করতে বুদ্ধিমান বীরসিংহের দেরি হল না। সে বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটেছে, সেই কারণেই মন্থরা আজ এসে পৌঁছয়নি। ছদ্মবেশ থাকায় রাজার সেনারা তাকে চিনতে পারেনি।
বীরসিংহ সেই সুযোগে নিজের মুখ চাদরের খুঁটে ভাল করে ঢেকে নেয়, তার পরে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে পথ চলতে লাগল। বুকের ভিতরে দুরুদুরু ভয়। তাকে যেমন করেই হোক মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছতে হবে। কিন্তু একটা কথা সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, মন্ত্রীমশাই তাদের এত পৃষ্ঠপোষক হওয়া সত্ত্বেও কেন বৌদ্ধদের উপরে এমন নির্মম অত্যাচার নেমে এল। এর পিছনে কি রাধা-ভজা বৈষ্ণবদের হাত আছে! ওই ছিঁচকাঁদুনে মহাপ্রভুর এতে কোনও হাত নেই তো! মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব যেভাবে বৈষ্ণবদের তোয়াজ করেন, তাতে এমন ঘটা অসম্ভব নয়।
ঘুরপথে অন্ধকারে মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়ি পৌঁছতে তার বেশ রাত হয়ে গেল। বিদ্যাধরের একান্ত অনুচর গরুড় তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। বিদ্যাধর তখন তাঁর প্রমোদকক্ষে বসে মল্লিকার গান শুনছিলেন। সংবাদ পেয়ে তিনি তাঁর গোপন মন্ত্রণাকক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, বীরসিংহ ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে।
বিদ্যাধর ঘরে পা দিতেই বীরসিংহ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, “আমাকে বাঁচান মন্ত্রীমশাই!”
গরুড় নিঃশব্দে সেই ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হয়েছে।
বিদ্যাধর হাসলেন। মানুষকে এই রকম ভয় পেতে দেখলে তাঁর বড় ভাল লাগে। এ যেন তাঁর কাছে একটা খেলা। তাঁর ইশারা পেয়ে, গরুড় শক্ত হাতে বীরসিংহকে তুলে দাঁড় করাল।
তার ভয়ভঙ্গুর চেহারা দেখে গোবিন্দ বিদ্যাধর রসিকতা করলেন, “এই কি বীরের মতো চেহারা? তুমি যে দেখছি ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে গেছ? তা হয়েছে কী?” বলে তিনি মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
“কী বলছেন মন্ত্রীমশাই! আপনি জানেন না! রাজার সৈন্যরা যে নির্বিচারে বৌদ্ধদের হত্যা করছে!” কাতর স্বরে বলে বীরসিংহ।
বিদ্যাধর যেন এর কিছুই জানেন না। তিনি আরও বিস্ময়াপন্ন ভঙ্গিতে বললেন, “সে কী! সে কী কথা! আমি তো এ সবের কিছুই জানি না! তা তোমরা কী করেছিলে? তোমাদের উপরে মহারাজ হঠাৎ এমন রেগে গেলেন কেন?”
এ বার বীরসিংহের অবাক হওয়ার পালা। সে অকৃত্রিম বিস্ময়ে বলল, “কী বলছেন মন্ত্রীমশাই! যা করেছি, সে সব তো আপনার নির্দেশেই করেছি! আর এখন আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না!”
বীরসিংহ খেয়াল করেনি, গরুড় একেবারে তার শরীরের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে দীর্ঘ একটি ছোরা।
গোবিন্দ বিদ্যাধর আবার তাঁর সেই অমানুষিক হাসিটা হেসে উঠলেন। কিন্তু হঠাৎই সেই হাসি থামিয়ে ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে এসে হিস হিস করে বললেন, “চুপ! চুপ! এই সব কথা যে কাকপক্ষীরও জানার অধিকার নেই।”
তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই গরুড়ের হাতের ছোরা বীরসিংহের হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল। মৃত্যুর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে বীরসিংহ শুধু শুনতে পেল গোবিন্দ বিদ্যাধরের আকাশ-কাঁপানো পৈশাচিক হাসি।
হাসি থামিয়ে তিনি গরুড়কে বললেন, “যাও, প্রচার করে দাও, বীরসিংহ পলায়ন করতে গিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কাল প্রভাতেই এর মৃতদেহ রাজার কাছে নিয়ে যাবে।”
গরুড় ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে মৃতদেহটি টেনে টেনে স্থানান্তরে নিয়ে গেল।
গোবিন্দ বিদ্যাধরের মুখে আবার সেই মৃদু হাসি ফিরে এল। প্রমোদকক্ষে গিয়ে দেখলেন, মল্লিকা আপন মনে তানপুরাতে হাত বুলিয়ে সুর তুলছে। বিদ্যাধর ভাবলেন, আহা! কী অপরূপ দৃশ্য!
ক্রমশ
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)