Advertisement
E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব৫

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

অবিন সেন

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৪৩
Share
Save


পূর্বানুবৃত্তি: ধূর্ত যোদ্ধা ইসমাইল গাজি পুরীর মন্দির থেকে দেববিগ্রহ অপহরণ করতে এসে হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ মন্দিরে বিগ্রহ নেই। সে ঠিক করল, মন্দির অবরুদ্ধ করে রাখবে। পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত গোবিন্দ বিদ্যাধরও। তিনিও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পথে নেমে পড়লেন। অন্য দিকে নৃসিংহ, মাধব আর পিরুমল তিন দলে ভাগ হয়ে গিয়ে রওনা দিয়েছেন বন্দরের উদ্দেশে। হস্তিপৃষ্ঠে পেটিকা ও অন্যান্য বাণিজ্য দ্রব্যসহ একটি ঘোড়-শকটে বনপথে চিষ্কার দিকে চললেন নৃসিংহের শিক্ষাগুরু কাহদেব পণ্ডিত। অরণ্যে তাদের দলে মিশে গেল একাধিক দস্যু। যষ্ঠেন্দ্রিয়ে বিপদ টের পেয়ে মোকাবিলা করলেন কাহদেব এবং যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিলেন সেই পেটিকা। তা নিয়ে বাণিজ্যভড়ে চেপে চিল্কা হ্রদের এক দ্বীপে চড়াই গুহার দিকে রওনা হলেন নৃসিংহ। আবার কৃষ্ণা নদীর তীরে গজপতি মহারাজ প্রতাপ রুদ্রদেবের মনও বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে কোনও অজানা বিপদের আশঙ্কায়।



মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব দ্রুত শিবিরে ফিরে গিয়ে দেখলেন, সেখানে তাঁর জন্য দক্ষিণের প্রদেশপাল রায় রামানন্দ অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মহারাজকে প্রভাতী অভিবাদন জানালে প্রতাপরুদ্রদেব বললেন, “এত সকালে কী সংবাদ, রামানন্দ?”

রায় রামানন্দ মাথা নিচু করে বললেন, “ইসমাইল গাজি দেবভূমি আক্রমণ করেছে।”

মহারাজ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। এমনটা তিনি যেন কল্পনাই করতে পারেন না। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি প্রায় চিৎকার করে বললেন, “এ কথা সত্যি? কে খবর দিল?”

প্রদেশপাল রায় রামানন্দ নতমুখে বললেন, “সত্যি রাজাধিরাজ। রাজধানী থেকে দূত এসেছে।”

রোষকষায়িত নেত্রে রাজা বললেন, “গোবিন্দ বিদ্যাধর পাঠিয়েছে?”

“ক্ষমা করবেন মহারাজ! দূত মাধব মিশ্রের কাছ থেকে এসেছে।”

মহারাজ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন, “তা হলে রাজধানীতে বসে গোবিন্দ বিদ্যাধর কী করছে?”

রায় রামানন্দ কোনও উত্তর দিলেন না। মাথা নিচু করে বসে থাকলেন।

মহারাজ তাঁকে মৌনী দেখে মুখের মধ্যে ক্রোধের একটা শব্দ করলেন। অপেক্ষা করলেন রায় রামানন্দের উত্তরের জন্যে। কিন্তু তাঁকে নিশ্চুপ দেখে আবার বললেন, “কী হল, চুপ করে আছ কেন?”

রায় রামানন্দ মুখ তুলে এক বার মহারাজের মুখের দিকে তাকালেন, তার পর আবার মাথা নিচু করে শান্ত মৃদু স্বরে বললেন, “ক্ষমা করবেন মহারাজ, ছোট মুখে হয়তো বড় কথা হয়ে যাবে। কিন্তু গোবিন্দ বিদ্যাধরের মতো কুশলী সেনানায়ক রাজধানীতে উপস্থিত থাকার পরেও শত্রুর সেনারা একেবারে পুরীতে ঢুকে পড়ল কী করে?”

রাজা তীব্র দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “তুমি বিদ্যাধরকে সন্দেহ করছ?”

পরক্ষণেই তিনি আবার নিজের মনে মাথা নাড়লেন। বললেন, “না, না রামানন্দ। তুমি ঠিক ভাবছ না। কামরূপের পরাজয়ের পরে হুসেন শাহ এ বার বোধ হয় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।”

কথাটা বলেই তিনি সহসা চুপ করে গেলেন। তাঁর মনের ভিতরে ভাবনার একটা স্ফুলিঙ্গ যেন ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “আচ্ছা! এর পিছনে বিজয়নগরের অধিপতি কৃষ্ণদেবরায়ের কোনও ষড়যন্ত্র নেই তো? দূত সত্যি তো? না সাজানো? তুমি বাজিয়ে দেখেছ?”

“হ্যাঁ মহারাজ। দূতকে আমি চিনি। দূত মিথ্যে নয়। তা ছাড়া দূত আরও একটা সংবাদ দিয়েছে। এ বার ইসমাইল গাজির লক্ষ্য জগন্নাথদেবের মন্দির। যেমন তারা কামরূপে গিয়ে কামাখ্যা মন্দির আক্রমণ করেছিল।”

মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব দ্রুত চিন্তা করলেন কিছু। তার পর বললেন, “রামানন্দ, তুমি সবচেয়ে কুশলী যোদ্ধাদের একজোট করো। এখনই। আমি তাদের নিয়ে পুরী ফিরে যাচ্ছি। দেখি ইসমাইল গাজি কত বড় যোদ্ধা হয়েছে! তুমি আর বীরভদ্র এখানে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাও।”

সাময়িক উত্তেজনা স্তিমিত হলে তিনি রামানন্দের কাঁধে হাত রাখলেন। নরম কিন্তু গভীর স্বরে বললেন, “রামানন্দ, আমি তোমার উপরে ভরসা করছি। আজ থেকে দক্ষিণের এই যুদ্ধে তুমিই সেনাপ্রধান। যুবরাজ বীরভদ্রকে তুমি দেখো।”

রায় রামানন্দ অভিভূত হয়ে গেলেন। এত বড় সম্মান তিনি কখনও পাননি। তিনি আভূমি নত হয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন মহারাজাকে।

রায় রামানন্দ বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি পুত্র বীরভদ্রকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিলেন। হয়তো যুদ্ধ বিষয়ে কিছু অমোঘ পরামর্শ। কিন্তু তাঁরা কেউই জানতে পারলেন না যে, তাঁদের কথার আরও এক জন শ্রোতা ছিল।

দুপুরের পরেই মহারাজা এক দল দুর্ধর্ষ সৈন্যসামন্ত নিয়ে পুরীর উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তবে তিনি স্থলপথ পরিহার করলেন এ বার। দু’টি দ্রুত গতির ভড় নিয়ে তিনি কৃষ্ণা নদী বেয়ে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু তিনি জানতে পারলেন না, স্থলপথে দুই ঘোড়সওয়ার ছায়ার মতো হাওয়ার বেগে পুরীর দিকে ছুটে চলল।

মহারাজ যত দ্রুত পারলেন চিল্কার উপকূলে পৌঁছলেন। পথে দুর্ঘটনা ঘটল না, কিন্তু চিল্কার উপকূলে নামতেই তিনি সংবাদ পেলেন, মন্দিরে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নেই।

মহারাজ কি ক্রোধে ফেটে পড়বেন? কিংবা শিশুর মতো বিলাপ করবেন? তিনি যেন ভেবে ঠিক করতে পারছেন না। অন্ধ, উন্মাদ হয়ে শুধু আস্ফালন করছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছা করছিল, এখনই ছুটে গিয়ে ইসমাইল গাজির মুণ্ডটা কেটে নিয়ে এসে চিল্কার জলে ভাসিয়ে দেন। একটি ভড়কে তিনি পুরীর সমুদ্র উপকূলের দিকে রওনা করিয়ে দিলেন। সঙ্গে দিলেন বীর সেনাপতি রঘুবীরকে। তিনি নিজে এখান থেকে স্থলপথে পুরী যাত্রা করবেন। দু’দিক থেকে গৌড়ের সেনাদের তিনি পিষে মারবেন।

মহারাজ এসেছেন, এই সংবাদ পেয়ে চার পাশ থেকে সাধারণ মানুষ, মাঝিমাল্লারাও চিল্কার উপকূলে জড়ো হচ্ছিল। চতুর মাধব মিশ্র তাঁর বাকচাতুর্যে সকল সাধারণ মানুষকে একজোট করছিলেন। সৈন্যদের সঙ্গে এরাও যুদ্ধে যাবে।

সহসা ভিড়ের মধ্যে থেকে নৃসিংহ উপরায় বেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে মহারাজকে অভিবাদন জানালেন। নৃসিংহকে দেখে মহারাজের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এমনই এক জন পরিচিত কাউকে তিনি যেন তাঁর পাশে খুঁজছিলেন। উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “নৃসিংহ, তুমি এসেছ? কী দুঃসময় বলো তো!”

নৃসিংহ মাথা নত করে বললেন, “মহারাজের জয় হোক। মহারজাকে দীনের একটি নিবেদন আছে। গোপনে।”

প্রতাপরুদ্রদেবের দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ণ হল।

নৃসিংহ একটি ক্ষুদ্র পত্র মহারাজের হাতের সামনে এগিয়ে দিলেন।

রাজা পত্রটি হাতের আড়ালে নিয়ে পড়লেন। মাত্র দু’ছত্র লেখা। তাঁর মুখমণ্ডলে বিপুল একটা হাসির আবেশ যেন ক্রমশ ফুটে উঠছিল।

বণিকপুত্র করজোড়ে নমস্কার করে অপরাধীর মতো বললেন, “আমায় ক্ষমা করবেন মহারাজ। এ ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না।”

আবার একটি ক্ষুদ্র রণতরী চিল্কার বুকে ভাসল। কয়েক জন রক্ষী-সহ মহারাজা আর নৃসিংহ উপরায় সেই রণতরীর যাত্রী। এ দিকে মাধব মিশ্র আর তার গুপ্তচরদের কৌশলী উৎসাহে দলে দলে সাধারণ মানুষ চিল্কার উপকূলে জড়ো হচ্ছে। তারাও যুদ্ধে যাবে। এ যেন তাদের এক স্বাধীনতা সংগ্রাম। শত্রু সেনাদের হাত থেকে পবিত্র দেবভূমিকে রক্ষা করার জন্য তারা মরণপণ লড়াই করবে।

ও দিকে দ্রুতগতির রণতরীতে মহারাজা আর নৃসিংহ একটি নির্জন দ্বীপে এসে উপস্থিত হলেন। চিল্কার বিপুল জলরাশির ভিতরে এমন একটা দ্বীপ থাকতে পারে, এমনটাই যেন মহারাজের কাছে অজ্ঞাত ছিল।

এক বিজন দ্বীপ। চার পাশে গভীর জঙ্গল। দিনের আলো এই দ্বীপে ভাল করে প্রবেশ করতে পারে না। মানুষের পদচিহ্নও এখানে বিশেষ পড়েনি এর আগে। তাঁরা দ্বীপে পদার্পণ করতেই এক দল পাখি কিচিরমিচির রবে ডেকে উঠল। যেন মনুষ্যপ্রবেশের বিরুদ্ধে বিপুল অসন্তোষ জানাল তারা।

বীর যোদ্ধা মহারাজের বুকও যেন দুরুদুরু করে উঠল। মনে মনে ভাবলেন, নৃসিংহ তাঁকে কোথায় নিয়ে এল! তাঁর মন কু ডাকল। তিনি কি ভুল করলেন? তিনি এক বার ঘাড় ঘোরালেন চার পাশে। দেখলেন, তাঁর ব্যক্তিগত রক্ষীরা সজাগ। কিন্তু তিনি জানতেও পারলেন না, গাছে গাছে, গাছের দেহের সঙ্গে মিশে আছে দুর্ধর্ষ সব সশস্ত্র যোদ্ধা।

নৃসিংহ বনের মধ্যে একটি অস্পষ্ট পথরেখা দেখিয়ে বললেন, “আসুন মহারাজ, আমাদের কিছুটা পথ পদব্রজে যেতে হবে।”

মহারাজ মুখে মৃদু হাসি রেখে বললেন, “এ আমায় কোথায় নিয়ে এসেছ নৃসিংহ?”

বণিকপুত্র মৃদু হাসলেন, “আমার উপর ভরসা রাখুন মহারাজ। আমার পিতা আপনার মিত্র ছিলেন। আমি আপনার সেবক।”

মহারাজ কিছু বললেন না। তিনি বুঝলেন, বুদ্ধিমান নৃসিংহ তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন।

কিছুটা বিজন অন্ধকার পথ অতিক্রম করার পরে তাঁরা একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের সানুদেশে এসে উপস্থিত হলেন। চার পাশ বনজঙ্গলে আকীর্ণ। দূরে কোথাও একটা নাম-না-জানা পাখি ক্রমাগত ডেকে চলেছিল। তার পরে শোনা গেল একটা ভয়ঙ্কর জংলি কুকুরের ডাক। বিজন বনের মাঝে সেই ডাকে যেন গা শিরশির করে ওঠে।

নৃসিংহ একটা তীব্র শিস দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোনও অদৃশ্য স্থান থেকে চার জন ছদ্মবেশী যোদ্ধা বেরিয়ে এল। মহারাজ শিউরে উঠলেন। নৃসিংহ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, “এরা সব আমার লোক।”

এ বার তারা সেই ক্ষুদ্র টিলার সামনে থেকে গাছপালা সরিয়ে দিতে একটি ক্ষুদ্র গুহামুখ খুলে গেল। এক দল পাখি সেই গুহামুখ থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল দূরে। বেজে উঠল ঘণ্টা।

নৃসিংহ বললেন, “রাজাধিরাজ, আসুন। এই গুহার নাম চড়াই।”

গুহার ক্ষুদ্র পথ দিয়ে তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভিতরটা অন্ধকার। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে দেখা গেল, দূর থেকে একটা আলোর রেখা আসছে। সেই আলোর রেখা লক্ষ্য করে তাঁরা এগিয়ে গেলেন। একটি ক্ষুদ্র ঘরের মতো জায়গা। মশালের আলো অজস্র মণিমুক্তার উপরে প্রতিফলিত হয়ে এক আলোর স্বর্গ যেন রচনা করেছে। মহারাজ দেখলেন, সামনে রত্নখচিত আসনে অলঙ্কারে সজ্জিত জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। মহারাজা ও নৃসিংহ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।

ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে মহারাজা গেলেন পুরী পুনরুদ্ধারে। তাঁর পরামর্শে নৃসিংহ উপরায় থেকে গেলেন চড়াই গুহায় শ্রীজগন্নাথের পাহারায়।

দু’দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে ইসমাইল গাজির বাহিনী পিছু হঠতে থাকল। বহু সৈন্য মারা পড়ল। ভয়ঙ্কর কুশলী যুদ্ধ লড়লেন রাজা প্রতাপরুদ্রদেব। ইসমাইল গাজির সৈন্যদল পিছু হঠতে হঠতে ওড়িশা-বাংলা সীমান্তে গড় মান্দারণ দুর্গে ঢুকে পড়ল। মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের সৈন্যরা তাদের সেই দুর্গ অবরোধ করে রাখল। ফাঁদে বন্দি মূষিকের মতো অবস্থা হল ইসমাইল গাজির।

প্রতাপরুদ্রদেব তখন প্রদেশপাল গোবিন্দ বিদ্যাধরের হাতে সেই গড় মান্দারণ দুর্গ অবরোধের ভার দিয়ে নীলাচলে ফিরে গেলেন। গোবিন্দ বিদ্যাধরকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ইসমাইল গাজিকে আত্মসমর্পণ করিয়ে সেই দুর্গের অধিকার নিতে।

মহারাজা নীলাচলে ফিরে গিয়ে সারা নগরে উৎসব আয়োজনের নির্দেশ দিলেন। সে যেন অকাল রথযাত্রা। শ্রীজগন্নাথ আবার তাঁর মন্দিরে ফিরে এসেছেন। সাত দিন ব্যাপী সেই আনন্দ উৎসব চলতে থাকল।

উৎসবের আবহ কাটতে না কাটতেই মহারাজা দুঃসংবাদটি পেলেন।

গোবিন্দ বিদ্যাধরের অবরোধকে ফাঁকি দিয়ে শত্রুর সেনারা পলায়ন করেছে। মহারাজ ক্রুদ্ধ হয়ে ভাবলেন, এটা কেমন করে সম্ভব হল! মহারাজের নির্দেশ অমান্য করে তবে কি গোবিন্দ বিদ্যাধর অবরোধ তুলে নিয়েছে?

কিন্তু মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেব একটা ঘটনার কথা জানতে পারেননি। অবরোধ তুলে নেওয়ার ঠিক আগের রাত্রেই বেতসকাঠি নির্মিত বৃহৎ একটি পেটিকা কারা যেন একান্ত গোপনে সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধরের শিবিকায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। লোলুপ চোখে গোবিন্দ বিদ্যাধর সেই পেটিকার ডালা উন্মোচন করে বিস্মিত হয়ে দেখলেন, সাপিনীর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে সালঙ্কারা এক অপরূপা নারী আলস্যে ঘুমিয়ে আছে। তিনি আরও অবাক হয়ে গেলেন, দেখলেন, নারীশরীরটি বস্ত্রহীন। শুধু তার শরীরের অসংখ্য রত্নখচিত অলঙ্কারের উপরে মশালের মৃদু আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝিকিমিকি করে উঠছে।

গোবিন্দ বিদ্যাধরের দুই চোখও যেন লোভে চিকচিক করে ওঠে। পেটিকার ডালার ভিতরের দিকে কয়েকটি সাঙ্কেতিক চিত্র। তিনি সেই চিত্রের অর্থ জানতেন।

মাঘ মাসের শুক্লপক্ষ। হিমেল বাতাসে চরাচর যেন স্তব্ধ, মূক। শব্দহীন জ্যোৎস্নার নীচে মৃদু হাওয়া কেবল ফিসফিস কথা বলে যায়। মনে হয় সমস্ত পৃথিবী নিদ্রামগ্ন। শুধু মাত্র নবদ্বীপের একটি গৃহে কারও চোখে ঘুম নেই। দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ দিব্যকান্তি এক যুবাপুরুষ ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর বৃহৎ দুই আঁখির কোণে অশ্রু টলমল করছে। প্রদীপের মৃদু আলোকে মনে হয়, দুইটি হীরকখণ্ড এখনই বুঝি দুই স্বর্ণপদ্মের পাপড়ি থেকে ঝরে পড়বে।

শচীদেবী পুত্রের মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর দুই চোখ থেকেও অবিরল ধারে অশ্রু ঝরায় কপোল প্লাবিত। তিনি এক বার ডান হাত প্রসারিত করে পুত্রের চিবুক স্পর্শ করলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিমাই পণ্ডিতের তিন সখা নিত্যানন্দ, মুকুন্দ দত্ত ও চন্দ্রশেখর। এই তিন বাল্যসখাও আজ তাঁদের প্রাণপ্রিয় নিমাইয়ের সঙ্গী হবেন।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Novel Bengali Novel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}