E-Paper

অনন্ত পথের যাত্রী

বিষ্ণুপ্রিয়া নিশ্চিত জানে, কৃষ্ণপ্রেমে ভাবাকুল তার স্বামীর কাছে তার পরিচয় কেবল এক শূন্য মাত্র। বিষ্ণুপ্রিয়া সেই আধো অন্ধকারের ভিতরে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

অবিন সেন

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:২০

পূর্বানুবৃত্তি: ইসমাইল গাজির পুরী আক্রমণের খবর গজপতি মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের কাছে পৌঁছে দিলেন দক্ষিণের প্রদেশপাল রায় রামানন্দ। যখন মহারাজ শুনলেন যে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরই ইসমাইল গাজির লক্ষ্য, তখন রায় রামানন্দকে দক্ষিণের যুদ্ধক্ষেত্রের দায়িত্বে রেখে তিনি দ্রুত পুরী ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুরী এসে তিনি দেখলেন মন্দিরে বিগ্রহ অনুপস্থিত। বণিক নৃসিংহ উপরায় একটি ছোট রণতরীতে চেপে মহারাজকে নিয়ে পৌঁছন চিল্কা হ্রদের চড়াই গুহায়। সেখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে পুরী মন্দিরের জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে। নিশ্চিন্ত মহারাজ ফিরে আসেন যুদ্ধস্থলে। মহারাজের সৈন্যদলের তাড়া খেয়ে ইসমাইল গাজির বাহিনী আটকে পড়ে ওড়িশা-বাংলা সীমান্তের গড় মান্দারণ দুর্গে। কিন্তু আবার গোবিন্দ বিদ্যাধরের অসততায় সেনাদের ফাঁকি দিয়ে ইসমাইল গাজির লোকজন পালিয়েও যায়। অন্য দিকে মাঘী শুক্লপক্ষের রাতে গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নবদ্বীপের নিমাই। তিন বাল্যবন্ধুও তাঁর সঙ্গে পথে নামতে তৈরি।

এই ঘরেই ছায়ার মতো আরও এক জন দাঁড়িয়ে আছে। সে বিষ্ণুপ্রিয়া। প্রদীপের স্বল্প আলোকে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সে যেন নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার দুই চোখের সমস্ত প্রস্রবণ আজ শুকিয়ে গিয়েছে। প্রাণপ্রিয় স্বামী আজ তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো সন্ন্যাসের পথে চলে যাচ্ছেন। তার তো কেঁদে লুটিয়ে পড়ার কথা। কিংবা বিপুল অভিমানে দগ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনও কিছুই সে করে উঠতে পারছে না। পাছে স্বামীর অকল্যাণ হয়! অভাগিনী নারীর চোখের জলের বিনিময়ে সে তো স্বামীর অকল্যাণ হতে দিতে পারে না! প্রাণ থাকতে তো নয়ই। ফলে অসীম এক সংবরণ-ক্ষমতায় সে নিজেকে ছায়ার ভিতরে, আলোর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। অথচ প্রাণের ব্যাকুলতা তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিতে চাইছে। সে বুঝতে পারছে, বিপুলা পৃথিবীর সমস্ত আলোকের উৎস থেকে সে নির্বাসিত হয়ে গিয়েছে। তার কম্পিত ওষ্ঠাধর যেন কিছু বলছিল। কিন্তু সেই অস্ফুট আকুলতা কি তার প্রাণাধিকের কানে পৌঁছচ্ছে? বিষ্ণুপ্রিয়া নিশ্চিত জানে, কৃষ্ণপ্রেমে ভাবাকুল তার স্বামীর কাছে তার পরিচয় কেবল এক শূন্য মাত্র। বিষ্ণুপ্রিয়া সেই আধো অন্ধকারের ভিতরে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

নিমাই পণ্ডিত আর দাঁড়ালেন না। পিছন ফিরে পত্নীর দিকেও তাকালেন না। অন্ধকার শীতের রাতে তিনি একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করলেন। তিন প্রিয় সখার সঙ্গে তিনি যাত্রা করলেন কাটোয়ার উদ্দেশে।

পথ তেমন অধিক নয়। শুক্লপক্ষের চাঁদ আর অজস্র নক্ষত্রকে সাক্ষী রেখে তাঁরা হাঁটতে থাকলেন। কয়েক ক্রোশ কারও মুখেই কোনও কথা নেই। সবাই যেন আপন অন্তরের ভিতরে ডুবে গিয়েছেন।

আরও অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর ভোরের আলো ফুটে উঠল। গাছে গাছে জেগে উঠল পাখি। তখন নিমাই পণ্ডিত প্রিয় সখাকে হরির নামগান শোনাতে বললেন।

নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর মধুর কণ্ঠে গান শুরু করলেন। মহাপ্রভু আবার কৃষ্ণভাবাবেগে আকুল হয়ে উঠলেন। ভাবে অন্ধ তিনি অন্ধের মতো পথ চলছেন দেখে চন্দ্রশেখর সখার হাত ধরলেন। পাছে প্রভু পথে হোঁচট খেয়ে ভূপতিত হয়ে যান।

বেলা দ্বিপ্রহরে তাঁরা কাটোয়ায় কেশব ভারতীর গৃহে উপস্থিত হলেন।

২৯ মাঘ নিমাই পণ্ডিত কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। সকালের রোদে কেশব ভারতীর দাওয়ায় ক্ষৌরকার যখন মহাপ্রভুর অমন চাঁচর কেশগুলো কেটে দিল, তখন চার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চোখেও অশ্রু বাধা মানল না। যাঁরা মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ দেখতে এসেছিলেন, তাঁরা যেন কেঁদে আকুল হলেন। অমন দিব্যকান্তি শরীরের কতই না সৌন্দর্যহানি হয়ে গেল, ভেবে তাঁরা আকুল হলেন। দ্বিপ্রহরে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে মহাপ্রভুর বাহ্যজ্ঞান যেন লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণপ্রেমে তিনি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বারে বারে তিনি মূর্ছিত হয়ে যেতে লাগলেন। আর যখনই তিনি সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, তখনই তিনি শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি বৃন্দাবন দেখার জন্যে আকুল হয়ে উঠছেন। কারও নিষেধই তিনি মানতে রাজি নন।

কেশব ভারতীর গৃহ থেকে বেরিয়ে আকুল হয়ে তিনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছেন। পথে পথে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন। কখনও অমন সোনার বর্ণ শরীর হোঁচট খেয়ে ভূমিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সে দিকে তাঁর খেয়ালই নেই। কখনও তাঁর তিন সখা তাঁকে ভূমিশয্যা থেকে তুলে সেবা করছেন, কিন্তু সে সবের দিকেও তাঁর কোনও হুঁশ নেই।

বৃন্দাবন যাচ্ছেন ভেবে তিনি পথে পথে পাগলের মতো ফিরতে থাকেন। পথে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে তার কাছেই তিনি আকুল হয়ে জানতে চাইছেন, “কাঁহা করো কাঁহা যাঙ্ কাঁহা গেলে কৃষ্ণ পাঙ্!”

প্রিয় সখা নিত্যানন্দ প্রভু ভাবলেন, এই অবস্থায় কোনও ভাবেই মহাপ্রভুকে নিয়ে বৃন্দাবন যাওয়া সম্ভব নয়। তিন সখা মিলে একান্তে পরামর্শ করলেন। নিত্যানন্দ প্রভু কিছু পরামর্শ দিয়ে চন্দ্রশেখর আচার্যকে নবদ্বীপে ফিরে যেতে বললেন।

তিনি আর মুকুন্দ দত্ত এই পথ সেই পথ ভাঁড়িয়ে মহাপ্রভুকে নিয়ে চলেছেন সাবধানে। মহাপ্রভু ভাবছেন তিনি বুঝি বৃন্দাবনের পথেই চলেছেন। ভাবে আকুল তিনি চোখের সামনে কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। এমন করে তাঁরা তিনটে দিন রাঢ় বঙ্গদেশের পথে পথে ঘুরতে থাকলেন। মহাপ্রভু কখনও কখনও ব্যাকুল হয়ে ‘কাঁহা গেলে কৃষ্ণ পাঙ’ ক্রন্দন করছেন। কখনও নিত্যানন্দ প্রভু তাঁর মধুর কণ্ঠে হরির নাম গেয়ে শোনাচ্ছেন। সেই গীত শ্রবণে মহাপ্রভু আনন্দে নৃত্য করছেন। চোখে তাঁর অবিরত অশ্রু ঝরে চলেছে।

চতুর্থ দিবসে তাঁরা গঙ্গার তীরে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন, গঙ্গার তীরে নৌকো নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন অদ্বৈত আচার্য। অদ্বৈতকে দেখে মহাপ্রভু বিস্মিত হলেন। কিছুটা বিস্ময়ভরা গলায় বললেন, “তুমি এখানে? কোথায় যাচ্ছ?”

অদ্বৈত রহস্য করে বললেন, “এই তো, তোমার সঙ্গে বৃন্দাবন যাব।”

সরল বিশ্বাসে তিনি অদ্বৈতর কথা বিশ্বাস করলেন। তিনি জানেন, বৃন্দাবন যাওয়ার পথে আগে যমুনা দর্শন করতে হয়। ভাবে বিভোর তিনি গঙ্গাকেই যমুনা ভেবে যমুনায় অবগাহনের ইচ্ছেয় জলে নেমে গেলেন। তাঁর অঙ্গ ছুঁয়ে তার সঙ্গে জলে নামলেন মুকুন্দ দত্ত। সখার প্রতি তাঁদের এতই ভালবাসা যে, এক মুহূর্তের তরেও তাঁরা প্রভুর ছায়া ছাড়তে রাজি হচ্ছেন না।

গঙ্গায় নেমে যমুনার উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করে প্রভু আবার ভাবে প্রায় মূর্ছিত হয়ে গেলেন। দুই সখা ধরাধরি করে তাঁকে অদ্বৈতর নৌকোর ছইয়ের ভিতরে শুইয়ে দিলেন। একটি ভিন্ন দ্বিতীয় পোশাক নেই প্রভুর। গঙ্গার বাতাসে প্রভুর সোনার অঙ্গের সিক্ত পোশাক শুকিয়ে গেল।

নৌকো চলেছে শান্তিপুরের উদ্দেশে। মহাপ্রভুকে তাঁরা অদ্বৈত আচার্যের গৃহে নিয়ে চলেছেন। নিত্যানন্দ প্রভু আগেভাগে চন্দ্রশেখরকে পাঠিয়ে এই ব্যবস্থাই করে রাখতে বলেছিলেন।

নৌকো যখন শান্তিপুরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, তখন মহাপ্রভু ঘটনাপ্রবাহ অনুধাবন করতে পারলেন। অনুমান করলেন, অদ্বৈত তাঁর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছেন। তাঁকে বঞ্চনা করে অদ্বৈত তাঁর বাটীতে নিয়ে চলেছেন। মহাপ্রভু বললেন, “তুমি আমাকে প্রবঞ্চনা করেছ!”

অদ্বৈত সবিনয়ে বললেন, “সামান্য অন্ন রান্না করেছি গৃহে। সঙ্গে শাক-ডাল-শুক্তো। গরিবের ঘরে এটুকু আহার করে তুমি বৃন্দাবনে যাত্রা কোরো।”

মহাপ্রভু তবু যেন মানতে চান না। মুণ্ডিত মস্তক আন্দোলিত করে বলেন, “গঙ্গাকে তুমি যমুনা বলে আমায় প্রতারণা করেছ।”

অদ্বৈত করজোড়ে নিবেদন করলেন, “যেখানে মহাপ্রভুর চরণ পড়েছে, তা-ই তো যমুনা!”

কথা শুনে প্রভুর আবার ভাবোদয় হল। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো বয়োজ্যেষ্ঠ অদ্বৈত আচার্যকে আর বিব্রত করতে চাইলেন না। মনে মনে হরির নামগান গাইতে লাগলেন।

অদ্বৈত আচার্যের গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, আয়োজন শুধুমাত্র সামান্য অন্ন-শাক-ডালের নয়। সে যেন এক উৎসবের বাড়ির আয়োজন। অন্ন-পঞ্চব্যঞ্জন তো রয়েছেই, সঙ্গে নানাবিধ মিষ্টান্ন।

মহাপ্রভু যেন বিরক্ত হলেন কিছুটা। মুখে বললেন, “সন্ন্যাসী এত অন্ন-ব্যঞ্জন আহার করে নাকি! এ আহার তো সন্ন্যাসীর নয়।”

বৃদ্ধ আচার্য ছদ্ম-ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে বলেন, “রাখো তো তোমার এই চাতুরি! তোমার এই সন্ন্যাসীর ঢং ছাড়ো! এমন সন্ন্যাসী আমি অনেক দেখেছি। কথা ছেড়ে তুমি আহার করো তো।”

তর্কে নিমাইও হার মানার পাত্র নন। তিনি বললেন, “এত অন্ন-ব্যঞ্জন আমি খেতে পারব না। সন্ন্যাসীর যে উচ্ছিষ্ট রাখতে নেই।”

অদ্বৈত ছাড়ার পাত্র নন, বললেন, “নীলাচলে তো তুমি খাও চুয়ান্ন বার। তার এক গ্রাস তো তিন জনের ভোজ্যের সমান। চাতুরি ছেড়ে আহার করতে বোসো তো...” বৃদ্ধ বাৎসল্যস্নেহে ধমক দিয়ে উঠলেন।

তিনি ঘটিভরা জল দিলেন মহাপ্রভুর হাতে।

মহাপ্রভু ভাবলেন, বৃদ্ধের কথা ঠেললে তিনি হয়তো আহত হয়ে আত্মহত্যার ভয় দেখাবেন।

মৃদু হেসে নিরুপায় মহাপ্রভু আহারে বসলেন।

আহার তো নয়, সে যেন এক উৎসব।

নিত্যানন্দ অদ্বৈতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “পাঁচ দিন পরে প্রভু ভাল করে আহারে বসেছেন। ভাল করে আহার করাও তো ঠাকুর!”

অদ্বৈত হাসতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর দুই চোখে অশ্রুর ধারা।

দুই-এক গ্রাস মুখে তোলার পরেই, অদ্বৈত আবার মহাপ্রভুর পাত পূর্ণ করে দিলেন। মহাপ্রভুর কোনও নিষেধই তিনি শুনলেন না।

এমন আনন্দের আবহেই আহার চলতে লাগল। মহাপ্রভু চার পাশে চন্দ্রশেখর আচার্যকে না দেখে এক বার তাঁর খোঁজ করলেন। নিত্যানন্দ প্রভু রহস্য করে প্রভুর কথা এড়িয়ে গেলেন।

নিত্যানন্দের একটি কথায় মহাপ্রভু ছদ্মক্রোধে এক মুঠো অন্ন ছুড়ে মারলেন তাঁর অঙ্গে।

পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন অদ্বৈত আচার্য। দুই-এক কণা উচ্ছিষ্ট অন্ন তাঁর গায়েও লাগল।

তিনি আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। অবধূতের প্রসাদ তাঁর অঙ্গে লাগায় তিনি পবিত্র হয়ে গেলেন। সাশ্রু নয়নে বললেন, “তোমাকে নিমন্ত্রণ করে এই তো আমার পাওয়া।”

বলে তিনি কান্নায় আকুল হয়ে উঠলেন।

মহাপ্রভুর আহার শেষে তাঁকে আচমন করিয়ে লবঙ্গ-এলাচ দিলেন মুখশুদ্ধির জন্যে। উত্তম শয্যায় প্রভুর শয়নের ব্যবস্থা করে দিলেন।

সন্ধ্যায় অদ্বৈতের গৃহে নামসঙ্কীর্তনে উৎসবের আবহ তৈরি হল। মুকুন্দ গান ধরলেন। সেই গান শুনে মহাপ্রভু ভাবে অন্ধ হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে নিত্যানন্দ প্রভু, হরিদাস, আরও অনেকে নৃত্যে মেতে উঠলেন। সন্ধ্যার বাতাস নৃত্যগীতে মুখরিত হয়ে উঠল। মহাপ্রভু কখনও হর্ষভরেনৃত্য করেন, কখনও ভূমিতে পড়ে উথালি-পাথালি রোদন করেন।

“হা হা প্রিয় সখি কি না হৈল মোরে।

কানু প্রেমবিষে মোর তনু মন জারে॥”

দ্বিতীয় দিন সকালে তখনও নামকীর্তন চলছে। সেই সময়ে চন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে অদ্বৈত-গৃহে এসে উপস্থিত হলেন শচীদেবী। সঙ্গে নবদ্বীপের অনেক নরনারী বালক-বৃদ্ধ-বনিতা।

মাতাকে দেখে মহাপ্রভু সাষ্টাঙ্গে মাতার চরণে পতিত হলেন। চোখের অশ্রুতে মাতার পদযুগল সিক্ত হয়ে উঠল। শচীদেবীরও চোখের জলের কোনও অর্গল ছিল না। অশ্রুপ্লাবনের ভিতর দিয়েই তিনি যেন পুত্রকে কোলে তুলে নিতে চাইলেন। মুণ্ডিতমস্তক পুত্রকে দেখে তিনি বিহ্বল হয়ে গেলেন।

“অমন সোনার অঙ্গে কিসের কলঙ্ক লাগল গো!” বলে তিনি উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠলেন। আপন অঞ্চলপ্রান্ত দিয়ে পুত্রের অঙ্গ মুছিয়ে দিয়ে তিনি নিমাইয়ের মুখ চুম্বন করলেন। কিন্তু অশ্রুতে আচ্ছন্ন চোখে তিনি যেন ভাল করে পুত্রের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। বার বার তিনি পুত্রের মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন আর মুখের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকছেন। তাকিয়ে তাকিয়েও যেন তাঁর আশ মিটছে না।

রোদনভরা কণ্ঠে তিনি বার বার বলছেন, “বাছা, বিশ্বরূপের মতো নিষ্ঠুর হয়ো না। সে তো সন্ন্যাসী হয়ে মাকে আর দর্শন দিল না। তুমি এমন নিষ্ঠুর হয়ো না। তুমিও ছেড়ে গেলে আমি আর কী নিয়ে বাঁচব!”

নিমাই সন্ন্যাসীরও কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ধরা-ধরা গলায় মাতার কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে বললেন, “মা, তুমিই আমার এই শরীর দিয়েছ। তোমা বিনা এ আমার কিছু নাই। কোটি জন্মেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না।”

তিনি বার বার মাতার চরণে লুটিয়ে প্রণাম করতে লাগলেন।

ক্রমশ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Novel Bengali Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy