E-Paper

ধিক্কার

প্রমীলা হেসে উঠে বললেন, “আবার কবিত্ব আসছে নাকি? ও তো তোমার প্রথম যৌবনের বাতিক ছিল… খাতার পর খাতা… ”

অমিতাভ সমাজপতি

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ ০৭:৫৬
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

আজ কয়েক দিন ধরে সমরেন্দ্রর মন ভাল নেই। বাইরে ওই দুমদুম শব্দ আর লোকজনের হই-হট্টগোলে কেমন গুলিয়ে উঠছে শরীর। রাস্তার উল্টো দিকের বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে একটু একটু করে। একটা দীর্ঘ ইতিহাস ক্রমশ যেন লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছেন না তিনি, তাই মাথা নিচু করে বসে আছেন ডাইনিং রুমটায়। নিঃশব্দে।

এত ক্ষণে স্ত্রী প্রমীলা এসে বসলেন তাঁর উল্টো দিকের চেয়ারে। কাজের মাসি অরুণা দু’কাপ চা আর বিস্কুট প্লেটে সাজিয়ে এগিয়ে দিল, বলল, “দাদা, চা…”

সমরেন্দ্র যেন কথাটা শুনতেই পেলেন না। ও বাড়ির ওই শব্দগুচ্ছ তার কান পেরিয়ে বুকের মধ্যে বাজছে। শৈশবে ও বাড়িটা তিনি গড়ে উঠতে দেখেছেন। মনে পড়ছে বাড়ির লোকজনদের কথা। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক… কত গল্প, কত গাথা…

“চা নিন দাদা! ঠান্ডা হচ্ছে তো!” অরুণার আলতো ধমকে সংবিৎ ফিরল তাঁর। কয়েক সেকেন্ড অরুণার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, “কিছু বলছিস, অরুণা?”

অরুণা ফিক করে হেসে বলল, “আপনি চা-টা তো খাবেন, না কি? বৌদির চা তো প্রায় শেষ...”

প্রমীলা তার কাপে একটা বড় চুমুকে চা শেষ করে কাপটা ঠক করে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। বললেন, “তোমার কী হয়েছে বলো তো? ক’দিন ধরে দেখছি তুমি কেমন গম্ভীর। খুব একটা কথাবার্তা বলছ না। বাজার থেকে ভুলভাল জিনিস আনছ। খবরের কাগজটাও দেখছ না। কী হল তোমার? শরীর খারাপ? নাকি রিটায়ারমেন্টের কথা ভেবে…”

সমরেন্দ্র মাথা নেড়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “শরীর খারাপ নয়, খারাপ হয়েছে মন। মন ভাল নেই... একদম ভাল নেই…”

প্রমীলা হেসে উঠে বললেন, “আবার কবিত্ব আসছে নাকি? ও তো তোমার প্রথম যৌবনের বাতিক ছিল… খাতার পর খাতা… ”

সমরেন্দ্র এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। বললেন, “যাকে এক দিন জন্মাতে দেখলাম, যার কৈশোর, যৌবন দেখলাম, সে এখন মৃত্যুবরণ করছে। এ মৃত্যু আমি নিজের চোখের সামনে দেখছি, তাতে কি আমার মন ভাল থাকার কথা?”

প্রমীলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, “কে মৃত্যুবরণ করছে?”

সমরেন্দ্র চায়ে আর এক বার চুমুক দিয়ে স্মিত গলায় বঙ্কিমি ভঙ্গিতে বললেন, “পথিক তুমি কি তোমার কান হারাইয়াছ?”

এ বার প্রমীলা ধমকে উঠলেন, “কী হেঁয়ালি করছ? পরিষ্কার করে বলো। ও, বুঝেছি, সামনের মাসে তোমার রিটায়ারমেন্ট, সে কথাই ইনিয়ে বিনিয়ে বলছ। সে তো সবাইকেই থামতে হয় এক সময়। তা তুমি তো এত দিন রিটায়ার করার কথা উঠলেই বলতে, ‘বেঁচে যাব। শুধু আর এক মাস। ব্যস, ফ্রি…’ তা হলে?”

সমরেন্দ্র চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। মস্ত একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা ছেড়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন সিলিংয়ের দিকে।

প্রমীলা বললেন, “শরীর খারাপ লাগলে বলো, না হলে পরে আবার ছেলেটাকে ছুটতে হবে হাসপাতালে। ওর পিএইচ ডি-র শেষ বছর। খুব খাটনি চলছে…”

সমরেন্দ্র প্রমীলার হাতটা ধরে তাঁকে আবার বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। বললেন, “বাদ দাও তো! এখন আমার কত কাজ বাকি! আজ বাদে কাল ছেলের বিয়ে দেব। তার আগে অফিস নামক নরক থেকে মুক্তি লাভ করব। বাড়িটা দোতলা বানাব, তার পর ধরো, নাতির হাত ধরে পার্কে ঘুরব। কত আনন্দের দিন আসছে বলো তো আমার জীবনে…”

প্রমীলা হেসে বললেন, “বুড়োর শখ কত! তা হলে তোমার এই ক’দিন মনমরা হয়ে থাকার কারণ কী?”

“মৃত্যু! মৃত্যু!” বলেন সমরেন্দ্র।

“কার মৃত্যু? কার মৃত্যুর কথা বলছ তুমি? পঞ্চাশ বছর বয়স থেকে সবারই মৃত্যুচিন্তা আসে। আমারও হয়। এ সব বার্ধক্যের লক্ষণ। কিন্তু তুমি তো বরাবর বলে আসছ তোমার নাকি বয়সই হচ্ছে শুধু, বৃদ্ধ হচ্ছ না, হবেও না... তা হলে?”

সমরেন্দ্র উঠে পড়লেন, যেতে যেতে বললেন, “নাহ! স্নানে যাই...”

মনে মনে ভাবলেন, এ মৃত্যু প্রমীলা বুঝবে না। বোঝার কথাও নয়। ভাবতে ভাবতে স্নানঘরের দরজা বন্ধ করে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন। ওটা চালালেন না। বরং ভাবনায় ডুব দিলেন...

তখন সমরেন্দ্রর কতই বা বয়স… পাঁচ কি ছয়। উল্টো দিকের যে বাড়িটা এখন ভাঙা হচ্ছে, ওখানে ছিল তাঁদের খেলার মাঠ। বাচ্চারা হইহই করে খেলত আর তাদের মায়েরা গোল হয়ে বসে গপ্পো করত। কখনও উল বুনত। আর বাচ্চারা ছোট্ট মাঠে নানা ধরনের খেলায় মশগুল হয়ে থাকত। ও মাঠের কত ধুলো যে তিনি মেখেছেন! মায়ের থেকে কম প্রিয় ছিল না তাঁদের ওই ছোট্ট খেলার মাঠটি।

শাওয়ারটা এখনও চালাননি সমরেন্দ্র। ওটার নীচে দাঁড়িয়ে ও বাড়ির দুমদুম শব্দগুলো এখন আর নিতে পারছেন না তিনি।

সমরেন্দ্রদের বাড়িটা ছিল কাঠের বাংলোবাড়ির মতো। তাঁর বাবা এক বার পাহাড়ে ভ্রমণে গিয়ে ও জায়গার বাড়িগুলো দেখে ওই রকম বাংলো ধরনের একটি বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তখনও সমরেন্দ্র জন্মাননি। দুই দিদি দেখেছিল সেই বাড়ি তৈরির আয়োজন। তাঁদের মুখেই গল্প শুনেছিলেন তিনি। বাড়িটা বানানোর সময় অনেকে তাঁর বাবাকে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ইটের পাকা বাড়ি বানাতে। বাবা নাছোড়। জমি তাঁর পিতৃপুরুষের। তবে তখন তাঁর যা পয়সা ছিল তাতে একটি মাত্র ঘরই তৈরি হতে পারত। তাতে তাঁর ছেলেমেয়েদের থাকতে অসুবিধে হবে। অতএব বাংলো তৈরি হল। তার চার পাশে গোল করে কাঠের রেলিং দেওয়া বারান্দা, টালির ছাদ। দু’টি বড় বড় ঘর। দক্ষিণ দিকে এক টুকরো ফুলের বাগান। বাড়িটা শেষ হওয়ার পর এ অঞ্চলের লোকেরা দেখতে আসত। আর আসত বাবাকে দেখতে। বাবা ছিলেন এখানকার একমাত্র স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। সেই সময়কার মানে, চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের বড় কাগজের নামকরা সাংবাদিক। এমএ পাশ। সেই সময় এক জন এমএ পাশ লোককে দেখার জন্য পাড়ার যুবকরা দল বেঁধে আসত। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চলত।

তা যা-ই হোক, এমনই এক দিন সকালে এক জন লোক এলেন বাবার কাছে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মাঝারি উচ্চতা। মুখে পান, পায়ে পাম্প শু। গলায় তুলসীকাঠের মালা। বাবা তাঁকে দেখে বললেন, “আসুন।”

“নমস্কার মুখুজ্জেমশাই। আপনার কথা অনেক শুনিচি এ অঞ্চলে এসে। তাই এক বারটি দেখা করতে এলুম। এমন একটি ভদ্দরলোকের পড়শি হওয়ার সৌভাগ্য যে আমার হবে, তা আমি ভাবতেই পারিনি…”

বাবা কী একটা আর্টিকল লিখছিলেন, তাঁর ভ্রু কুঁচকে উঠল। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে তাঁকে বসতে ইশারা করলেন। বললেন, “ঠিক বুঝলাম না।”

লোকটি হেসে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুচিয়ে বললেন, “আবনার বাড়ির রাস্তার ও পারের জমিটি আমি কিনিচি কিনা! ওখানে আমি বাড়ি বানাব। তা হলে আবনার পড়শি হলাম। কেমন, ঠিক কি না?”

বাবা কলম বন্ধ করে লোকটিকে এক বার ভাল করে দেখলেন। তার মুখের ভাষাটি শুনে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “নাম কী আপনার?”

“আজ্ঞে, আমি হলুম নিত্যানন্দ দাস। সাকিন মুর্শিদাবাদ জেলা, তবে কিনা জন্মেছি আমি কলকেতার হালসিবাগানে। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তেলের ব্যবসা তিন পুরুষের। ওই তেলটুকুই জ্ঞান আমার। তা এখানে কলকাতার এত কাচে কম পয়সায় জমিটি পেলুম, কিনে নিলুম। তবে তার আগে একটু দেখে শুনে নিলুম, বুঝলেন কি না…”

“তা কী দেখলেন?” বাবা মজা করে বললেন।

“দেখলুম, এখানে কোনও ভাল মিষ্টির দোকান নেই। নেই ভাল ডেকরেটর্স আর গম কল। বুঝলেন কি না? তাই এ জমিটি কিনে বাড়ি বানাবার পর ওই তিনটি ব্যবসা শুরু করব ভাবচি। তা ছাড়া আবনার মতো এক জন পণ্ডিত মানষির কাচাকাচি থাকতে পেরে আমি ধন্য হব। এই আর কী… ” বলতে বলতে একটি পা তিনি তুলে নিলেন চেয়ারে, দাঁত খুচিয়ে থু করে সুপুরির টুকরো ফেললেন। বাবার বিরক্তি একটু চড়ে উঠল। তিনি রান্নাঘরের দিকে গলা তুলে বললেন, “এ ঘরে দু’কাপ চা দিয়ে যাও।”

সেই শুরু। সমরেন্দ্রদের সাধের খেলার মাঠটিতে তরতর করে প্রকাণ্ড এক অট্টালিকা মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। নাম হল ‘নিত্যানন্দ ভবন’। সে ভবনে নিতাইবাবু, তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে গৌরাঙ্গ। ব্যস, আর কেউ নেই।

প্রথমে সমরেন্দ্রদের খারাপ লাগত মাঠটা চলে যেতে, কিন্তু ক্রমশ ও বাড়ির সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু হল সমরেন্দ্র আর তার দুই দিদির। প্রচুর আদর পেত তারা ও বাড়িতে। নিতাইবাবুকে কাকা আর স্ত্রীকে কাকিমা বলে ডাকত। সমরেন্দ্রর ডাকনাম ছিল সমু। কাকিমা ওকে গোপাল ঠাকুর বলে ডাকতেন।

প্রত্যেক দিন সমুর ডাক পড়ত সন্ধেয়। কাকিমার সন্ধের পুজোর পর এক প্লেট মালপো, নাড়ু, চন্দ্রপুলি আরও কত কী যে… সমরেন্দ্র সত্যি সত্যি ও বাড়ির গোপালঠাকুর হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে মিষ্টির দোকান হল। সঙ্গে চা-সিগারেটের দোকান। ডেকরেটর্স আর গমের কল হল বাজারে। সব মিলিয়ে জাঁকিয়ে বসলেন নিত্যানন্দবাবু। তাঁর ছেলে গৌরাঙ্গও বসে পড়ল ব্যবসাতে। তাকে সমরেন্দ্ররা বড়দা বলে ডাকত।

বড়দার যখন বিয়ে হল, তখন সমরেন্দ্রদের বয়স অল্প। সেই বিয়েতে প্রায় দশ দিন সমরেন্দ্রদের বাড়িতে অরন্ধন। খালি ও বাড়িতেই খাওয়া আর খাওয়া। মুর্শিদাবাদের আমের গন্ধ ম ম করত দুই বাড়িতে। দোতলার একফালি বারান্দায় বসেছিল নহবত।

এ দিকে চায়ের দোকান থেকে চা আসত মা-বাবার জন্য। বাবা অসন্তুষ্ট হতেন, “এ কী ব্যাপার?”

নিত্যানন্দবাবু সবিনয়ে বলতেন, “কী আর ব্যাপার দাদা। এই তো আমি একটু পুণ্য লাভ করছি। শত হলেও বামুনের সেবা বলে কতা… কেমন কি না? নতুন কোনও মিষ্টি বানাবার পরিকল্পনা করে আবনাদের দিয়ে টেস্ট করিয়ে নিয়ে তবে চালু হবে। তার পর, ধরুন বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ও বাড়ির ছাদে আমাদের গোপালঠাকুর ঘুড়ি ওড়াবে। তার জন্য এক বালতি পান্তুয়া তৈরি হবে। সে একটা করে ঘুড়ি কাটবে আর তার কাকিমা একটি করে পান্তুয়া তার মুখে পুরে দেবে। দুপুরে চাট্টি ডাল-ভাত খাবে, এই আর কী… হা হা হা…”

এই রকম চলতে চলতে এক দিন সমরেন্দ্রর বাবা হঠাৎই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। সমরেন্দ্ররা অনাথ হয়ে গেল। তখন সেই কাকাই সমরেন্দ্রদের সংসারের মাথা হয়ে দাঁড়ালেন। সে সময় কাকা সমরেন্দ্রদের খুব সাহায্য করেছেন। তখনই তাঁর ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠল। তিনি হয়ে উঠলেন এ অঞ্চলের এক জন কেউকেটা। বাবার পরিচিতির কল্যাণে ইতিমধ্যে তিনি এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়েই ছিলেন, এখন তাঁর প্রতিপত্তি আরও জোরালো হয়ে উঠল। সঙ্গে পাড়ার ক্লাবগুলোয় দেদার পয়সা ছড়াতে লাগলেন। এ অঞ্চলের গুন্ডা-বদমাশদের পয়সা দিয়ে হাত করে একটা রাজা-রাজা ভাব নিয়ে মিষ্টির দোকানের সামনে ইজ়িচেয়ারে বসে কোঁচানো ধুতি আর চাপকান পরে গড়গড়ার নলে টান দিতে দিতে বাজখাঁই গলায় একে ওকে মেজাজ দেখাতে শুরু করলেন। দু’-চার জন মোসাহেবও জুটল।

এক দিন তাঁর বাড়িতে টেলিফোনের লাইন এল। পাড়ার সবাইকে নম্বর দিয়ে বললেন, “যার খুশি ফোন করো। যাকে খুশি ফোন নম্বর দাও। নো পবলেম।”

‘প্রবলেম’ সমরেন্দ্রদের শুরু হল। কালের নিয়মে তাদের বাড়িটা ঝুপড়ি হয়ে উঠতে থাকল। বাবাকে সবাই ভুলে গেল। বাড়িটাকেও। লোকজন নিত্যানন্দবাবুর মস্ত অট্টালিকার দিকে আঙুল তুলে বলত, “এ হল বাবু নিত্যানন্দের অট্টালিকা।”

সমরেন্দ্র চাকরি করে টাকা জমিয়ে, লোন নিয়ে তাদের বর্তমান দোতলা বাড়িটা তৈরি করিয়েছেন।

সেই অট্টালিকা আজ ভাঙা হচ্ছে। গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে— দুম ! দুম ! দুম!

বাথরুম থেকে বেরিয়ে সমরেন্দ্র অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন।

বাইরে নির্দয় ওই জেসিবি মেশিনের শব্দ তিনি সহ্য করতে না পেরে দ্রুত এগোলেন বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কাকা-কাকিমার যত্ন-আদরকে আবিষ্ট করে বাড়িটার দুঃখ তাঁকে যন্ত্রণা দিতে থাকল। এক সময় রেগে উঠলেন তিনি। কাকা-কাকিমা যেন তাঁদের ইতিহাস নিয়ে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছেন। মনে মনে তিনি বলতে লাগলেন, ‘কাকার বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে। প্রোমোটিং-এ দিচ্ছে তাঁর অক্ষম, অযোগ্য, অশিক্ষিত উত্তরপুরুষেরা।’ তাঁর মনে এল প্রচুর অভিসম্পাত, কিন্তু মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা মাত্র শব্দ— “ছিঃ!”

আয়ুষ আজ খুব ফুরফুরে মন নিয়ে বসে আছে প্রিন্সেপ ঘাটে। সঙ্গে রিয়া। আয়ুষের পিএইচ ডি-র কাজ শেষ। এখন শুধু পেপার জমা দেওয়ার কাজটা বাকি। রিয়ার পেপারের একটু দেরি আছে। আরও কয়েক মাস লাগবে। তার পর পোস্ট-ডক্টরেট করতে দু’জনেই ইংল্যান্ড অথবা অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। হয়তো বা সেখানেই থেকে যাবে স্থায়ী ভাবে। বাড়িতে এ সব জানায়নি তারা কেউই।

“আমরা আর দেশে ফিরব না?” বলল রিয়া।

আয়ুষ হাসল, বলল, “দাঁড়াও, আগে ঠিক হোক সব! তা ছাড়া দেশে কেন আসব না? বাবা যত দিন আছেন, আসা-যাওয়া করব। তার পর মাকে নিয়ে চলে যাব।”

“যদি না যেতে চান তিনি?”

“তখন দেখা যাবে। এ দেশে থেকে কিচ্ছু হবে না। এই ফালতু দেশে পোস্ট-ডক করার কোনও দাম নেই।”

রিয়া একটু চুপ করে বসে থেকে বলল, “চলো, আজ নৌকোয় উঠব।”

আয়ুষ চমকে উঠল, “কোনও দিন তো রাজি হওনি! আজ হঠাৎ ?”

“সেলিব্রেশন!” বলে রিয়া আয়ুষের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল।

ওরা নৌকোয় উঠল। ভাসতে থাকল আসন্ন সুখের সাগরে। আয়ুষের বাবা সমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায় জানতেও পারলেন না, তাঁর সুন্দর একতলা বাড়িটা এক দিন নিত্যানন্দবাবুর বাড়িটির মতো হয়তো ভাঙা হবে, এ রকম নির্দয় ভাবে। হবেই। এ অমোঘ।

নৌকো এখন মাঝনদীতে। তার ছলাৎছল জল এক সময় ধমকে উঠল আয়ুষ আর রিয়াকে। বলল, “ছিঃ !”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy