E-Paper

ঠগ

হয়তো দেবে। তবে যত ছোট রোলই করি, এই যে বন্ধুদের নিয়ে প্রিমিয়ার শো দেখতে আসি, এতেই বেশ আনন্দ পাই।

সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৫ ০৮:৪৪
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

নন্দন থেকে সিনেমা দেখে আমি আর আমার চার মর্নিংওয়াকের বন্ধু এখন রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনে। আজ প্রিমিয়ার শো ছিল। সিনেমাটায় আমি চারটে সিন মিলিয়ে দশ মিনিট অভিনয় করেছি। আমি প্রফেশনাল অভিনেতা নই। ভাল একটা চাকরি করি। অভিনয়টা আমার শখ। অফিস বা পাড়ার ক্লাবের নাটকে বড়সড় রোল পাই। সিনেমায় অভিনয় করি শুধু অয়নের পরিচালনায়। অন্য কোনও পরিচালক আজ অবধি আমায় ডাকেনি। অয়ন আমার কলেজের বন্ধু। সেই সুবাদে ও সিনেমা করলেই আমাকে ডেকে নেয়। দশ-পনেরো মিনিটের বেশি পার্ট কোনও দিনই দেয়নি। যে কারণে আমার বৌ রণিতা প্রিমিয়ার শো-এ আসতে চায় না। বলে, “দূর! ওইটুকু পার্ট দেখতে কে ঠেঙিয়ে কলকাতা যাবে!” এক বার তো অয়নকে ফোনই করে বসল, “কী মশাই, বন্ধুকে একটু বড় রোল দিতে পারেন না? আত্মীয়-বন্ধুদের তো বলতে পারি না ছবিটা দেখতে যেতে।”

অয়ন খুব হেসেছিল। বলেছিল, “সময় হলে ঠিক বড় রোল দেব।”

হয়তো দেবে। তবে যত ছোট রোলই করি, এই যে বন্ধুদের নিয়ে প্রিমিয়ার শো দেখতে আসি, এতেই বেশ আনন্দ পাই।

অয়ন আর্ট ফিল্ম বানায়। দর্শকদের ওর সিনেমা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ থাকে। সদ্য দেখা ছবিটা নিয়ে এখন আলোচনা করছে বন্ধুরা। একটু আগে একটা দমদম যাওয়ার মেট্রো চলে গেল। আমরা যাব দক্ষিণেশ্বর মেট্রোতে। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে সাত্যকি হঠাৎ আমায় বলল, “অভি, তোকে কিন্তু এ বারের সিনেমায় বেশ মোটা লাগছিল।”

“হ্যাঁ, ঠিক। আমারও চোখে লেগেছে,” সমর্থন জানাল রাজা।

বললাম, “স্ক্রিনে আসলের থেকে থার্টি পার্সেন্ট এনলার্জড লাগে।”

“তা ঠিক। তবে তা হলেও, আগের সিনেমাগুলোয় তোকে কিন্তু এতটা মোটা লাগেনি। এ বার থেকে মাঠে এসে হাঁটা বাড়া আর খাওয়াটা একটু কমা,” বলল সাত্যকি।

মনটা একটু দমে গেলেও, মুখে হাসি এনে বলি, “আমাকে তো আর নায়কের পার্ট দিচ্ছে না। মিছিমিছি খাওয়া কমিয়ে কী লাভ!”

“তবু আপনি গ্ল্যামার-জগতে রয়েছেন, চেহারার দিকটা তো আপনাকে খেয়াল রাখতেই হবে!” আচমকা এই মন্তব্য শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, বত্রিশ-চৌত্রিশের এক মহিলা আমার পাশে এসে কথাটা বললেন। বছর চার-পাঁচেকের একটা মেয়ের হাত ধরে রয়েছেন। আমি তো অবাক। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি সিনেমাটা দেখলেন?”

“না, আপনাদের পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলাম।”

সাত্যকি বলল, “শুনছিলেন ঠিক আছে। কিন্তু হঠাৎ আমাদের আলোচনায় যোগ দিলেন কেন? আপনাকে তো আমরা চিনিই না।”

“আসলে আমি একটা হেলথকেয়ার কোম্পানিতে সার্ভিস করি। আমাদের প্রোডাক্ট হচ্ছে মেডিকেটেড ফুড। যা খেলে ওয়েট লস হবে।”

মহিলার ধান্দাটা এবার বুঝে গেছি। ওই কোম্পানির সেলসে আছেন। বলি, “আপনাদের প্রোডাক্ট মানে প্যাকটেড গুঁড়ো খাবার। বাড়ির খাবার ছেড়ে তিন বেলা ওই খাবার খেতে হবে। যেটা আবার অনেকে প্রোটিন শেকও বলে।”

মহিলা বলে উঠলেন, “না, স্যর। আমরা প্রোটিন শেক বলি না। সাবস্টিটিউট ফুড বলি। প্রোটিন তো আছেই, তার সঙ্গে আরও অনেক কিছুর কম্বিনেশন।”

সোমনাথ ওর শার্টের নীচটা টেনে টুনে মহিলাকে বলে, “আমার কি এই প্রোডাক্ট ট্রাই করা উচিত?”

“করতেই পারেন। আমাদের প্রোডাক্ট স্বাস্থ্যকর খাদ্য ছাড়া তো আর কিছু নয়। তবে এঁর এখনই ট্রাই করা জরুরি। কত হ্যান্ডসাম ফিগার! অযথা মোটা হয়ে যাচ্ছেন। চেহারাটা স্লিম থাকলে নিশ্চয়ই আরও বড় রোল পেতেন।” পরের কথাগুলো আমাকে দেখিয়ে বলা।

মহিলার কথায় বন্ধুরা কী মজা পেল কে জানে! সবাই মিটিমিটি হাসছে। এর মাঝেই রাজা মহিলাকে বলে, “প্রোডাক্ট কি এখন আছে আপনার কাছে?”

“না না, আমি এখন অন্য কাজে বেরিয়েছি। দেখছেন না সঙ্গে মেয়ে আছে? এক কাজ করুন...” বলে মহিলা কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ভিজ়িটিং কার্ড বার করলেন। কার্ডটা রাজাকে না দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, “এতে আমার ফোন নাম্বার আছে। প্রোডাক্ট সম্বন্ধে ডিটেলে কিছু জানার থাকলে, ফোন করবেন। প্রোডাক্ট কিনতে চাইলে বাড়ি বা অফিস যে ঠিকানা বলবেন, কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেব। আপনি অনলাইনে পেমেন্ট করে দেবেন।”

রাজা আমাদের বলল, “আয়, ট্রেন ঢুকছে।”

আমি মহিলার থেকে কার্ডটা নিলাম। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল ট্রেন।

বাড়ি ফিরতেই রণিতা ধরে ফেলল। ড্রয়িং রুমে পড়াচ্ছিল ছেলেকে। দরজা খুলে দিয়েছিল কাজের মেয়ে বুলু। রণিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে, রোল আরও কেটে দিয়েছে নাকি?”

বললাম, “না তো।”

“তা হলে মুখটা ও রকম বেজার করে আছ কেন?”

রণিতার কথার উত্তর না দিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালাম।

ফ্রেশ হয়ে বসেছি ডাইনিং-এর চেয়ারে। টিভি অন করে নিউজ় দেখছি। রণিতা দু’কাপ চা নিয়ে এল। চেয়ারে বসে বলল, “কী হয়েছে বললে না তো!”

বোঝা যাচ্ছে রণিতা সহজে রেহাই দেবে না। তাই সারাংশটুকু বলি, “বন্ধুরা বলছে আমাকে নাকি স্ক্রিনে বেশ মোটা লাগছে। আগে এত লাগত না। সত্যিই কি আমি বেমানান টাইপের মোটা হয়ে যাচ্ছি?”

“মোটা তো একটু হয়েছ। তবে বেমানান মোটেই নয়। তা ছাড়া এই সিনেমাতে তোমার পুলিশের রোল। পুলিশ মোটা হলে বেশি মানায়। যাক, ও সব ছাড়ো। আজকের শো-তে কোন কোন আর্টিস্ট এসেছিল বলো।”

চা খেতে খেতে প্রিমিয়ার শো-এর গল্প বলতে থাকি রণিতাকে। ব্যাক অব দ্য মাইন্ড একটা কথা রিপিট হতে থাকে, আমার মোটা হওয়া নিয়ে রণিতার কিছু যায় আসে না। বারো বছর হল আমাদের দাম্পত্য। এখনই আমার প্রতি সমস্ত আকর্ষণ হারিয়েছে সে। অথচ কলেজে আমাকে পাওয়ার জন্য কী কাণ্ডটাই না করেছিল!

*****

পাঁচ দিন কেটে গেল। প্রিমিয়ার শো-এর পর থেকে আমি ক্রমশ নিজের ফিজ়িক নিয়ে কনশাস হয়ে পড়েছি। অফিস বা বাইরে কোথাও যেতে হলে সময় নিচ্ছি ড্রেস সিলেকশন করতে। বাড়ির আয়নায় তো বটেই, কোনও কাচে মোড়া শো-রুমের পাশ দিয়ে গেলেও দেখছি নিজেকে। ভাবছি, এই মানুষটাই শুধু চেহারার কারণে কত মেয়ের প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে। ঝুটো প্রেম করেছে প্রচুর। এমনকি বিয়ের পরেও… খেয়াল করে দেখলে এখন আর কোনও সুন্দরী আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় না। হেলথকেয়ারের ওই মহিলা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এর মধ্যে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে রোগা হওয়ার প্রোডাক্ট নিয়ে আলোচনা করেছি। আশাব্যঞ্জক কোনও তথ্য পাইনি।

এই ক’দিনের মধ্যে অফিস যাওয়ার পথে দু’বার দেখেছি মহিলাকে। দক্ষিণেশ্বর থেকে মেট্রোয় অফিস যাই আমি। ট্রেনের জানলা দিয়ে এক দিন দেখলাম, মহিলা শ্যামবাজার স্টেশনে দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। সে দিনও মহিলার পাশে তার মেয়েটি। ‍নির্ঘাত মার্কেটিং করছেন। মেট্রো স্টেশনে যে হেতু হকারি করা যায় না, তাই প্রোডাক্ট রাখতে পারেন না সঙ্গে। দ্বিতীয় বার দেখতে পেলাম চাঁদনি চক স্টেশনে। অফিস যাওয়ার জন্য ওখানেই নামি আমি। মহিলা এ দিক-ও দিক তাকিয়ে কাস্টমার খুঁজছিলেন। যাতে চোখে না পড়ি, এমন দূরত্ব রচনা করে আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাই। অফিস যাওয়ার পথটা আমার এখন টেনশনের হয়ে গেছে।

এই মুহূর্তে আমি মেট্রোয়। অফিস যাচ্ছি। ট্রেন ঢুকছে চাঁদনি চকে। দরজার দিকে এগোই। ট্রেন থেকে নামতেই থমকে যায় পা। হাত বিশেক দূরত্বেই হেলথকেয়ারের সেই মহিলা। সঙ্গে বাচ্চাটিও আছে। এক মধ্যবয়সি কাপলের সঙ্গে কথা বলছেন। কেন যেন মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। মহিলাকে বললাম, “আজকেও কি অন্য কোথাও যেতে গিয়ে কাস্টমার পেয়ে গেছেন?”

মহিলা কিন্তু অপ্রস্তুত হলেন না। ওঁর সম্ভাব্য ক্রেতা দু’জন অবশ্য সরে পড়লেন। মহিলা এ বার হাসি মুখে আমাকে বললেন, “কী হল, আপনি তো আর ফোন করলেন না! আমার কার্ডটা নিশ্চয়ই হারিয়ে ফেলেছেন।”

“না, হারিয়ে ফেলিনি।” মিথ্যে বললাম। কার্ডটা সে দিনই মেট্রো স্টেশন বেরিয়ে ফেলে দিয়েছি।

মহিলা বলে ওঠেন, “আজকে আপনার চেহারাটা আরও বেশি বালকি লাগছে। চোখ-মুখ ফোলা ফোলা। এখনই রোগা হওয়ার চেষ্টা না করলে পরে অনেক সময় লাগবে।”

“আচ্ছা, আপনাদের প্রোডাক্টে যা যা উপকরণ ব্যবহার হয়, প্যাকেটের উপর লেখা থাকে?”

“না, থাকে না। ফর্মুলা ফাঁস করতে যাবে কেন কোম্পানি!”

“বড় বড় কোম্পানিগুলো কিন্তু উপকরণ লিখে দেয় প্যাকেটে।”

“ওরা নামী কোম্পানি। বিজ্ঞাপনে চলে ওদের প্রোডাক্ট। আমাদের কোম্পানির অত বিজ্ঞাপন করার ক্ষমতা নেই। এক মাস খেয়ে দেখুন, কাজ না হলে টাকা ফেরত।”

আর একটু প্যাঁচে ফেলতে বলি, “আপনাদের প্রোডাক্টের পেটেন্ট বা লাইসেন্স আছে?”

দু’পাশে মাথা নেড়ে মহিলা বলেন, “আপনি যখন বাজার থেকে লুজ় আটা, চাল, চিনি কেনেন, লাইসেন্স আছে কি না দেখে নেন? নেন না। আমাদের প্রোডাক্টটা ধরে নিন চাল-ডালের মতোই খাদ্যবস্তু। প্যাকেট করে দিই ক্যারি করতে সুবিধে হবে বলে।”

ফাঁপা যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন মহিলা। সম্ভবত কোম্পানি থেকে এই পাঠ পড়ানো হয়েছে। এ বার আমি ডাক্তার বন্ধুর থেকে নেওয়া ফান্ডাটা বলতে থাকি, “ধরুন, আপনাদের প্রোডাক্টে এমন কোনও রোগের ওষুধ মেশানো থাকতে পারে, যা খিদে কমিয়ে দেয় এবং শরীরে প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট প্রবেশ করতে দেয় না। যে রোগ আমার নেই, তার ওষুধ খেয়ে আমাকে রোগা হতে হচ্ছে। এর তো মারাত্মক সাইড এফেক্ট হতে পারে।”

এতেও মহিলাকে কাবু করা গেল না। মিটিমিটি হাসছেন। বলে ওঠেন, “কত ক্লায়েন্ট আমাদের প্রোডাক্ট ব্যবহার করে আপনি জানেন? আমার মতো সেলসপার্সন ওয়েস্ট বেঙ্গলে আছে হাজারের উপর। প্রোডাক্ট যদি এতটাই ক্ষতিকারক হত, চলত আমাদের কোম্পানি?”

“আচ্ছা, আপনাদের প্রোডাক্ট ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন, এমন দু’-এক জন ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমার দেখা করাতে পারবেন? তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝে নিতে চাই জিনিসটা কতটা কার্যকরী।”

মনে হল, মহিলা নিশ্চয়ই চাইবেন না আমি ওঁর ক্লায়েন্টদের মুখোমুখি হই। কিন্তু না, একটু ভেবে মহিলা বললেন, “আপনার ফোন নাম্বার দিন। আমি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেব।”

মহিলা মোবাইল বার করেছেন। আমি নম্বর বললাম। উনি নম্বরটা সেভ করে আমাকে মিসড কল দিয়ে বললেন, “আপনাকে আমি দু’-তিন দিনের মধ্যে ফোন করে জানাচ্ছি।”

বাচ্চাটার হাত ধরে ঘুরে গেলেন মহিলা। পা বাড়াতে যাবেন, বললাম, “আর একটা কথা।”

থেমে গিয়ে আমার দিকে ফিরলেন উনি। বললাম, “বুঝতে পারছি মেয়েকে সঙ্গে রাখলে মার্কেটিং-এ এক্সট্রা অ্যাডডান্টেজ পান। কাস্টমারের মায়া হয়। কিন্তু বাচ্চাটার তো কষ্ট হয় আপনার সঙ্গে এত ঘোরাঘুরি করতে।”

বিশেষ ইঙ্গিতবাহী হাসি-সহ মহিলা বলে উঠলেন, “মেয়েটা মনে হচ্ছে যেন আপনার!”

খুবই অস্বস্তিতে পড়লাম। মহিলা মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

*****

দিন দশেক অপেক্ষার পর হেলথকেয়ারের মহিলা আজ আমায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ক্লায়েন্টদের কাছে। প্রথম দিকে ফোন ধরছিলেন না আমার। এক দিন ধরলেন। বললেন, “আপনাকে ঠিক সময়মতো জানাব।”

গতকাল ফোন করে আজকে সময় দিলেন। এখন আমরা ট্যাক্সিতে চলেছি। অফিস থেকে বেরিয়েছি তিনটে নাগাদ। পূর্ব কলকাতার বস্তি অঞ্চলে এসে পড়েছি।

আচমকাই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে থামতে বললেন মহিলা। আমাকে বললেন, “এসে গেছি।”

আমি তো অবাক! ভেবেছিলাম মহিলা নিশ্চয়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কোনও পাড়ায় বা ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সে নিয়ে যাবেন। ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে ভাড়া মেটাই। মহিলাকে জিজ্ঞেস করি, “ক্লায়েন্টের কি এখানেই বাড়ি?”

কোনও উত্তর না দিয়ে মহিলা সামনের সরু গলিটা ধরে এগোতে থাকলেন। আমি অনুসরণ করলাম। গলিটা এতই সরু, ট্যাক্সি ঢুকত না। এটা আসলে খালপাড়। পাড়ের উপর সার দেওয়া ছিটেবেড়ার ঘর। গলির ডান পাশে গোডাউন, কারখানার শেড। একটা ছিটেবেড়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিলা। পিছন ফিরে আমাকে বললেন, “আসুন।”

চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছলেন ঘরের আধখোলা দরজায়। এখানে সব ক’টা বাড়ির সামনেই সিঁড়ি।

ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন মহিলা। চৌকাঠ ডিঙিয়ে পা রাখি ঘরে। বিছানায় মিশে যাওয়া একটা লোক উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বন্ধ করে দিয়ে যায় দরজা। ধক করে ওঠে বুক। সম্ভাব্য আশঙ্কা গ্রাস করে আমাকে!

একটা চেয়ার দেখিয়ে মহিলা আমাকে বসতে বললেন। বসলাম। উনি বসলেন সামনের মোড়াটায়। ভিতর দিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে মহিলার বাচ্চা মেয়েটি। মায়ের গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়ায়। খুব রোগা লাগছে মেয়েটিকে। পরনে ছেঁড়া ফাটা ফ্রক। মেট্রো স্টেশনে যত বার মেয়েটাকে দেখেছি, পরনে থাকত ফোলা-ফোলা নতুন ফ্রক।

মহিলাকে বলি, “আপনার বাড়ি নিয়ে এলেন কেন আমাকে?”

“কয়েক জন ক্লায়েন্টকে বলেছিলাম। কেউ রাজি হল না অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে। আপনাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। তাই নিজের বাড়িতেই নিয়ে এলাম।”

তখনই বাইরের দরজা ঠেলে ঢুকল সালোয়ার-কামিজ পরা খুব রোগা একটা মেয়ে। মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, চা বসাই?”

“না, দাঁড়া। এক বার শিবুকে ডেকে দে।”

শিবুকে ডাকতে চলে গেল মেয়েটা। আমি বলি, “আপনার বাড়িতে এসে লাভ তো কিছু হল না। আপনাদের প্রোডাক্টটা যে ভাল, কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল না তার।”

“আপনাকে বাড়িতে আনতে পেরে লাভ হয়েছে আমার। আপনি তো বার বার প্রমাণ করতে চাইছেন পাবলিককে ঠকাচ্ছি আমি। এখন দেখুন কে বা কারা কাদের ঠকাচ্ছে।”

“মানে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।

এমন সময় ঘরে ঢুকল একটি ছেলে, এই নিশ্চয়ই শিবু। খুব রোগা। পরনে অপরিচ্ছন্ন পোশাক। শিবু বলল, “ডাকছিলে বৌদি?”

ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে মহিলা বললেন, “দুটো শিঙাড়া, দুটো সন্দেশ নিয়ে আয় তো। পাড়ার দোকান থেকে নিবি না। বড় রাস্তা থেকে নিবি।”

টাকা নিয়ে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল শিবু। মহিলা এ বার আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমার বর, যে শুয়েছিল ঘরে, পাঁচ বছর ধরে বেকার। কারখানা লক আউট। সংসারটা আমি একাই টানছি। আপনারা যাঁরা অতিরিক্ত খেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের রোগা করতে বেরোচ্ছি। অতিরিক্ত খেয়ে আপনারাই কি আমাদের ঠকাচ্ছেন না?”

মহিলা কেন তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, এ বার আমার কাছে পরিষ্কার হল। ফের মহিলা বলেন, “আপনি আরও কিছু স্যাম্পল দেখতে চান? পাড়ার লোকেদের ডাকব?”

আমি মাথা নামিয়ে নিয়ে পকেট থেকে পার্স বার করতে করতে বলি, “দিন আপনার প্রোডাক্ট।”

“না, আপনাকে আমি বিক্রি করব না। জানি, গলি থেকে বেরোনোর আগেই জিনিসটা আপনি ফেলে দেবেন। হাত পেতে সাহায্যও নিতে পারব না। খানিকটা লেখাপড়াও তো করেছি। ফলে আত্মসম্মানে লাগবে...” বললেন মহিলা।

ঘরটা খুব ছোট নয়, তবু আমার দমবন্ধ লাগছে। চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে এগোই। দালানে পা রাখতেই দেখি, গলিতে সারি সারি কঙ্কালসার মানুষ আমার দিকে স্যালুটের ভঙ্গি করে তাকিয়ে আছে। যেন প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড। জানি, এ আমার বিভ্রম। মাথা নিচু করে সিঁড়ি ধরে নামতে থাকি। রাস্তায় এসে হাঁটায় লুকিয়ে দৌড় মিশিয়ে দিই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Short Story Short story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy