E-Paper

শপিং কার্ট

এ ধরনের কথা বৈদুর্য বলেই থাকে। মৈত্রেয়ী কেনাকাটা করতে ভালবাসে। ঘরে বসে অনলাইনে প্রচুর জিনিস কেনে।

সোমজা দাস

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৮:২৭
ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল।

মোবাইলে শপিং অ্যাপ খুলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে মৈত্রেয়ী।

ছবিগুলো চোখের সামনে ঝাপসা দেখাচ্ছে। একটি পণ্য আর একটার সঙ্গে জড়িয়েমড়িয়ে স্ক্রিনের উপর দুর্বোধ্য জাল রচনা করেছে। ইন্দ্রিয়গুলি ছুটি নিয়েছে এই মুহূর্তে। সম্ভবত সে জন্যই বার বার বাজতে থাকা ডোরবেলের শব্দ কানে ঢুকছে না তার।

বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে চমক ভাঙল। খালি গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে বৈদুর্য। কপালে ভ্রুকুটি। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে জলের ফোঁটা। পঞ্চাশ পেরিয়েও সুঠাম শরীর। মৈত্রেয়ী মুগ্ধ হয়। বিস্মিত হয়।

“কখন থেকে ডোরবেল বাজছে, দরজা খুলছ না কেন?” বৈদুর্যর কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।

উত্তর দিল না মৈত্রেয়ী।

“ধ্যাত্তেরি!” বলে তোয়ালে পরা অবস্থাতেই ড্রয়িংরুমের দিকে এগোল সে। দরজার আইহোলে চোখ রাখল ক্ষণমুহূর্তের জন্য। তার পর লক ঘোরাল। পার্সেল এসেছে। শোয়ার ঘরে ঢুকে প্যাকেটটা ছুড়ে দিল বিছানার উপরে।

চোখদুটো চকচক করে উঠল মৈত্রেয়ীর। ফোনটা বিছানার উপর ফেলে পার্সেলটা নিল ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপরের সাদা প্যাকেটটা ছিঁড়ল ব্যগ্র হাতে। ভিতরে আর একটা প্যাকেট। সেটা খুলতেই বেরোল ঝলমলে রঙিন একটি বস্ত্রখণ্ড।

“কী এটা?” জিজ্ঞেস করল বৈদুর্য।

“স্কার্ফ। কাশ্মীর থেকে আনিয়েছি। একদম অথেন্টিক পশমিনা।”

তোয়ালের ভিতর দিয়ে পাজামা গলাতে গলাতে বৈদুর্য হাসল। বাঁকা হাসি।

“কত পড়ল?”

“চার হাজার,” স্কার্ফটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল মৈত্রেয়ী।

“চার হাজার!” চকিতে ঘুরে তাকাল বৈদুর্য। তার পর বলল, “তোমার এই অথেন্টিক পশমিনা গড়িয়াহাটের ফুটপাতে চারশো টাকায় পেয়ে যাবে।”

এ ধরনের কথা বৈদুর্য বলেই থাকে। মৈত্রেয়ী কেনাকাটা করতে ভালবাসে। ঘরে বসে অনলাইনে প্রচুর জিনিস কেনে। শাড়ি, সালোয়ার, হাতে বানানো প্রসাধন থেকে শুরু করে গৃহস্থালির টুকিটাকি। সারা দিন ধরে টুকটাক করে পার্সেল আসতেই থাকে বাড়িতে। ঠকেও হামেশাই। বৈদুর্য বাড়িতে থাকলে কখনও আজকের মতো দু’-একটা মন্তব্য করে। বেশির ভাগ সময়েই বলে না কিছু। অবশ্য ও বাড়িতে থাকেই বা কতটুকু সময়!

বিছানা থেকে নামল মৈত্রেয়ী। স্কার্ফটাকে নিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। তার পর সেটি জড়িয়ে আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল। বৈদুর্য কখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, খেয়াল রইল না।

*****

“এ ভাবে টাকা নষ্ট করিস?” প্রায়ই বলে মৈত্রেয়ীর দিদি গার্গী।

স্কুলমাস্টার বাবা খুব শখ করে দুই মেয়ের নাম রেখেছিলেন বিদুষীদের নামে। দিদি উচ্চ মাধ্যমিকে পর পর দু’বার ব্যাক পেয়ে লেখাপড়ায় ক্ষান্ত দিল। বাবাও সাত-তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পার করলেন। লেখাপড়ার মতো বিয়ে নিয়ে অবশ্য বেগ পেতে হয়নি। পাত্র নিজেই ঠিক করে রেখেছিল গার্গী। সুশান্তদা পাড়ার ছেলে। রানাঘাট বাজারে রেডিমেড পোশাকের দোকান।

মৈত্রেয়ী বরাবরই লেখাপড়ায় ভাল ছিল। দেখতে শুনতেও বেশ। বাবার খুব আশা ছিল তাকে নিয়ে। কলেজে পড়াকালীন সম্বন্ধ আসা শুরু। প্রথম দিকে রাজি ছিলেন না বাবা। আত্মীয়স্বজন বোঝাল, “এখন কম বয়সের চটক আছে। পরে আর সেটাও থাকবে না।”

বাবা দুর্বল স্বরে প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করেছিলেন, “একটা চাকরিবাকরি পাক। তার পর না-হয়…”

বড় জেঠিমা এনেছিল বৈদুর্যর সম্বন্ধটা। ছেলে বড় কোম্পানিতে উঁচু পদে চাকরি করে। প্রচুর রোজগার। প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়। বাবার দ্বিধাটুকু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “তুমি হাসালে ঠাকুরপো। মেয়ে চাকরি করলে কি মেয়ের টাকায় বসে খাবে? অমন ছেলে আর পাবে দুটো? নেহাত আমার ভাগনির বিয়েতে মিতুকে দেখে চোখে লেগে গেছে ছেলের মায়ের…”

চোখে লেগে গেছে। কথাটা মনে হতেই দুলে দুলে হাসতে থাকে মৈত্রেয়ী। চোখে তো ধুলোও লাগে! বিয়েটা হয়েছিল অবশ্য। অমন পাত্র হাতছাড়া করার মতো মনের জোর মৈত্রেয়ীর মধ্যবিত্ত বাবার ছিল না বলেই হয়েছিল। তার পর শুধু সুখ আর সুখ। চাকরি করার ইচ্ছেটা কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বৈদুর্য অবশ্য বলেছিল, “কিছু একটা কাজ-টাজের চেষ্টা করলে তো পারো! বিয়ের আগে তো চাকরি করতে চেয়েছিলে!”

মৈত্রেয়ী উত্তর দেয়নি। বৈদুর্য বোঝেনি, স্বপ্নও বদলায়। মাস্টার বাবার মধ্যবিত্ত সংসারে লালিত স্বাবলম্বনের স্বপ্ন-আঁকা ক্যানভাসে সুখের রং চেপেছে তত দিনে। হিউ অরেঞ্জ, লেমন ইয়েলো, ক্রিমসন রেড। পুরনো যত ধূসর, এলেবেলে, ম্যাড়মেড়েরা গেছে হারিয়ে। কে বলেছে স্বপ্নও রদ্দি হয় না! নতুন নতুন আধুনিক ধাঁচের সব আসবাব আসছে। বাপের বাড়িরগুলোর মতো জগদ্দল, রংচটা নয়। হালকা, মসৃণ। নতুন ফ্ল্যাট বায়না হচ্ছে। পনেরো তলার উপর থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়। রাস্তা, ব্রিজ, পিঁপড়ের মতো মানুষ।

“জানো মা, তোমার জামাই বলছিল, ক্রিসমাসে ব্যাংকক বেড়াতে যাবে। ফ্লাইটের টিকিট কাটতেহবে এখনই।”

“ব্যাংকক! এরোপ্লেনে যাবি?” মৈত্রেয়ীর মায়ের নিষ্প্রভ চোখে ঘোর লাগে। সাদা সাদা মেঘেরা ঢুকে পড়ে তার রংচটা ঘরের ভিতর।

“আর বলিস না দিদি… হি হি… বৈদুর্যটা না একদম যা-তা! গেল-বার টুর থেকে ফিরতে দু’দিন দেরি হয়েছে। আমার রাগ ভাঙানোর জন্য একটা ফ্রেঞ্চ পারফিউম কিনে এনেছে, জানিস? আট হাজার টাকা দাম। ভাব কেমন পাগল!”

“তোরা এত বাজে খরচ কেন করিস?” ফোনের অপর প্রান্ত থেকে গার্গীর গম্ভীর গলা শোনা যায়।

মৈত্রেয়ী নিঃশ্বাস ছাড়ে। চাপা। গভীর। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে এক চিলতে হাসি। কোষে কোষে মাইটোকন্ড্রিয়ার শক্তিকেন্দ্রে ঢেউ জাগে। শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা। মনে পড়ে যায় বিয়ের আগের রাতে গার্গীর বলা কথাগুলো। ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব।

“বড় চাকরি করে নাকি! তাও যদি সরকারি চাকরি হত! বাবা তো চমক-ঠমক দেখেই ভুলে গেল। ভাল করে খোঁজও নিল না।”

বড়মাসি বলেছিল, “তোরা তো ছিলি। তুই, তোর বর। খোঁজখবর নিতে তো পারতিস!”

ঠোঁট উল্টেছিল গার্গী, “আমরা? তোমার জামাই সময় পায়? ওর তো আর পরের গোলামি নয়, নিজের ব্যবসা।”

সে দিন মৈত্রেয়ী ছিল নীরব শ্রোতা। আজ অবস্থা বদলেছে। তাই সে উদার হয়। হালকা গলায় বলে উঠতে পারে, “আহ্‌ দিদি, অত টাকা-টাকা করে কী হবে? তোর বিবাহবার্ষিকীতে তোকেও একটা পারফিউম গিফ্ট করব।”

*****

সে-সবও আজকের কথা নয়। মৈত্রেয়ীর শরীরের উপর দিয়ে সময় বয়ে গেছে ঢেউয়ের মতো। মিহি এসেছে। তার পর রিখি। মিহি মাস্টার্স শেষ করেছে সদ্য। রিখি বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং।

“বাবা রে বাবা, তুমি পারোও মা, এত জিনিস কী করতে কেনো? বাড়িতে তো পা রাখার জায়গা নেই!” মিহি রাগ করে।

“কাজে তো লেগেও যায়।”

ঠোঁট বাঁকায় মিহি, “কাজ! গত চার বছরে এক বারই কেক বানিয়েছিলে আভেনে। আর ওই যে হুইস্কারটা কিনলে গত বছর, আজও বাক্স থেকে বেরোয়নি। আলমারি-ভর্তি শাড়ি। কতগুলোর ভাঁজই খোলোনি এখনও। সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ দেখে হাবিজাবি কসমেটিক্স কিনছ। স্কিনটার বারোটা বাজাচ্ছ। টাকারও নয়ছয়!”

সাধারণত এ-সব অভিযোগের উত্তর দেয় না মৈত্রেয়ী। আজ মিহির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, ও একদম ওর মাসির মতো দেখতে। কথাও বলে একই সুরে। কী আশ্চর্য! মৈত্রেয়ীর গর্ভজাত সন্তান, অথচ হল তার সহোদরার মতো। একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার কাঁটা বিঁধতে লাগল।

“আচ্ছা মা, একটা কথা ছিল।”

“কী? বল...”

একটু ইতস্তত করে মিহি। তার পর বলে, “সৌরভ বলছিল, ওদের বাড়ি থেকে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে চায়।”

“এত তাড়াতাড়ি? তোর বয়সই বা কী?”

“আরে, কথাবার্তা বলে রাখতে অসুবিধে কোথায়? দেখাসাক্ষাৎ করো। কথা-টথা বলো। তা ছাড়া সৌরভ আগামী বছর অফিস থেকে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছে লং-টার্ম অনসাইটে। ও চায়, তার আগে বিয়েটা হয়ে যাক। ভিসা প্রসেসিং-এ সময় লাগে। তার জন্য ম্যারেজ সার্টিফিকেট লাগে।”

আরও অনেক কিছু বলে চলে মিহি। মৈত্রেয়ী তাকিয়ে থাকে আত্মজার মুখের দিকে। পাতলা ঠোঁট, ধারালো চোয়াল। গার্গী, একদম গার্গী। একই রকম আত্মকেন্দ্রিক, হিসেবি।

“বেশ। আমি কী বলব? তোর বাবাকে বলিস।”

মিহির মুখে হাসি ফুটল এ বার। বলল, “বাবা জানে। বলেছে, টুর থেকে ফিরেই ওদের চায়ে নেমন্তন্ন করবে।”

বৈদুর্য জানে। স্বাভাবিক। ছেলেমেয়েও বাপ অন্ত-প্রাণ। হবে না-ই বা কেন? বৈদুর্যর মতো সুদর্শন, সফল পুরুষ তাঁদের বাবা, এই অনুভবটুকুতেই মৈত্রেয়ীর ছেলেমেয়েরা কৃতার্থ হয়। রোমাঞ্চিত হয়। শুধু ওরাই বা কেন, মৈত্রেয়ী কি হয় না? বৈদুর্যকে নিয়ে তার নিজের গর্ব কম?

“বাব্বা, তোর মতো বর-পাগলা দেখিনি…”

“আবার শুরু হল বরের কথা। মৈত্রেয়ী প্লিজ়, এ বার ক্ষ্যামা দে…”

“যাই বলিস, বৈদুর্যদা কিন্তু এই বয়সেও নিজেকে দারুণ মেনটেন করেছে।”

এ-সব কথাবার্তা মৈত্রেয়ীর বান্ধবীদের মধ্যে প্রায়ই হয়। মৈত্রেয়ী শোনে। মুচকি হাসে। গালে এই বয়সেও নিখুঁত লালচে ছোপ পড়ে তার।

*****

আজকের দিনটা বিশেষ দিন। আজ সৌরভদের বাড়ি থেকে ওর বাবা-মা, দাদা ও বৌদি আসবে কথা বলতে। সকাল-সকাল গার্গীও এসেছে। মৈত্রেয়ী একা সামলাতে পারবে না। মৈত্রেয়ী জানে, বৈদুর্যই ওকে আসতে বলেছে। গার্গী গোছালো মানুষ। ওর উপরে ভরসা করে বৈদুর্য। মৈত্রেয়ীর মেয়েরাও। গার্গী প্রায়ই ধমক লাগায় তাকে, “তোর এত আছে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আছে, তাও কেন একটু গুছিয়ে রাখতে পারিস না?”

মৈত্রেয়ী নীরব।

“আসলে বাবার দোষ। বিদ্যেধরী মেয়ে। ছোট থেকে সংসারের কাজে তোকে জড়ায়নি। কেন? না, মিতু পড়াশোনাটা মন দিয়ে করুক। তা এখন তো আর পড়াশোনা করছিস না। বৈদুর্যদা চাওয়ার আগেই ঢেলে দেয়। তুইও কিনেই চলিস। ঘর ভরাস। এত সুন্দর ফ্ল্যাটটার কী অবস্থা করেছিস মিতু!”

সৌরভের বাড়ির লোকেরা এসে গেছে। তাই আর উত্তর দেওয়ার দরকার হয় না। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে মৈত্রেয়ী। ড্রয়িংরুমের এক কোণে বসে থাকে। সৌরভের বাবা, দাদা ও বৌদি সকলেই ডাক্তার। মা অধ্যাপিকা। সৌরভ একটি বহুজাতিক সংস্থায় বেশ উঁচু পদে আছে। ওর পাশে বসে লাজুকমুখে উজ্জ্বল হাসছে মিহি।

বৈদুর্যর মুখের দিকে তাকাল মৈত্রেয়ী। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে আজ। ক্লিন শেভ করেছে। গলায়, ঘাড়ে পাউডার। সৌরভের দাদা কিছু বলছে। স্মিতমুখে মাথা নাড়ছে বৈদুর্য।

“দিদি আপনি কিছু বলুন? সৌরভকে আপনাদের পছন্দ তো?” জিজ্ঞাসা করলেন সৌরভের মা। মৈত্রেয়ী একটু অন্যমনস্ক ছিল। আচমকা প্রশ্নে একটু সময় নেয় নিজেকে গুছিয়ে নিতে। তার পর মাথা নেড়ে বলল, “আমি কী বলব? আমার পছন্দে কী যায় আসে?”

মিহির মুখের হাসিটুকু মুছে গেল নিমেষে। বৈদুর্যর মুখ থমথমে। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল এ ভাবেই। গার্গী মুখে হাসি টেনে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ও মা, ও কী কথা! পাত্রীর মা তুই। তোর পছন্দ তো হতেই হবে।”

সামনের টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা টেনে নিল মৈত্রেয়ী। পুরো গ্লাসটা শেষ করল সময় নিয়ে। ঘরের প্রত্যেকে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। এই অখণ্ড মনোযোগ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল সে। তার পর বলল, “সকলের পছন্দই আমার পছন্দ।”

কথাটুকু বলে উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলে ভিতরের ঘরে চলে গেল সে। ও ঘর থেকে কথা, হাসির শব্দ ভেসে আসছে। অর্থাৎ মৈত্রেয়ীর অভদ্রতাটুকুর উপর পর্দা টেনে দিয়েছে বৈদুর্য বা গার্গী। খোলা জানলার সামনে দাঁড়াল মৈত্রেয়ী। নীচে আলোর মেলা। অথচ শব্দটুকু, প্রাণের সাড়াটুকু এসে পৌঁছয় না পনেরো তলা অবধি। যেন নির্বাক চলচ্চিত্র। পুরোটাই অভিনয়। বৈদুর্যর মতো। মিহির মতো। গার্গীর মতো।

মনে পড়ে যায় মিহির কলেজের সেই ছেলেটির কথা। কী যেন নাম! ভাসা-ভাসা চোখে চেয়ে থাকত। মিহি তাকে সরিয়ে দিতে দু’বার ভাবেনি। মৈত্রেয়ী জিজ্ঞেস করলে হি হি করে হেসে বলেছিল, “পাগল নাকি! যার-তার সঙ্গে ঝুলে পড়লেই হল?”

আর বৈদুর্য! একের পর এক প্রেমিকা বদলেছে। টুরের পর টুরে গেছে নতুন নতুন মেয়ে সঙ্গে নিয়ে। প্রথম প্রথম মৈত্রেয়ীর থেকে লুকোতে চেষ্টা করত। পরে আর সেই আড়ালটুকুরও প্রয়োজন বোধ করেনি। পরিবর্তে মৈত্রেয়ীর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে হাতখরচের নামে প্রতি মাসে মোটা টাকা। ক্ষতিপূরণ আর কী!

গার্গীর ছোট থেকেই হাতটান আছে, জানে মৈত্রেয়ী। এক বার একটা দোকানে শাড়ি কিনতে গিয়ে তিনটে শাড়ি লুকিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়েছিল গার্গী। ধরা পড়ে ঝগড়া করেছিল উল্টে। লজ্জায় সেই রাতেই গলায় দড়ি দেয় সুশান্তদা। বাইরের লোকে কখনও জানতে পারেনি আসল কারণটা। আজও মৈত্রেয়ীর আলমারি গোছাতে গিয়ে একটা সোনার বলচেন সরিয়েছে গার্গী।

বাইরের ঘরে ওরা হাসছে এখন। হাসির শব্দ পনেরো তলার ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে মৈত্রেয়ীর। শীত করছে খুব। বুকের ভিতর আটকে আছে কী যেন! তাড়াতাড়ি মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিল সে। কলোরাডো অ্যাপে আজ স্পেশাল ডে সেল চলছে। মহার্ঘ সব কিছু মিলবে আশ্চর্য সস্তায়। একের পর এক সুন্দর, মহার্ঘ জিনিস কার্টে যুক্ত করতে থাকে মৈত্রেয়ী। করেই চলে।

ব্যথাটা কমে আসছে।

ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy