মেঘমালা রাগ জমাতে ভালবাসে।
কত লোক কত কী জমায়! কেউ ডাকটিকিট জমায়, কেউ দেশলাই বাক্সের লেবেল, কেউ শাড়ি, কেউ গাড়ি, কেউ নানা ধরনের মুদ্রা, কেউ নেহাতই টাকাপয়সা। মেঘমালার সে-সবে আগ্রহ নেই, ও রাগ জমায়। ওর একটা রাগের খাতা আছে। সেই খাতায় সাল-তারিখ দিয়ে রাগের ঘটনাগুলো লিখে রাখে, যাতে ভুলে না যায়।
এই রাগের তালিকায় কিছু ঘটনা আছে একেবারে চরম। সেগুলো মেঘমালা আলাদা করে লাল কালিতে চিহ্নিত করে রাখে। বিগত চার-পাঁচ বছরে, বেশির ভাগ রাগের মূল কারণ, ঘুরেফিরে সেই বিশ্বম্ভর। অনেকটা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো। অভিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে, বিশ্বম্ভর মেঘমালার বর। এবং বছর পাঁচেক হতে চলল, ওদের বিয়ে হয়েছে।
সে হয়তো ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকেলের ঘটনা। পরেশতলি মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে একা একা রসগোল্লা খাচ্ছিল বিশ্বম্ভর। পাশ দিয়ে মেঘমালা চলে গিয়েছিল, বিশ্বম্ভর তাকে দেখতেও পায়নি, রসগোল্লা খাওয়ানো তো দূরের কথা! তখন অবশ্য ওদের বিয়ে হয়নি, দু’বাড়ির কথাবার্তা চলছে, সামান্য চেনা-পরিচয় হয়েছে সবে। কিন্তু সেদিন বিশ্বম্ভর বেচারার সম্পূর্ণ ফোকাস ছিল রসগোল্লায়, সে পারিপার্শ্বিক সব ভুলে রসগোল্লা খেতেই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সে ঘটনা মেনে নিতে পারল না মেঘমালা। পৃথিবীর সব পুরুষ তার হবু স্ত্রীর জন্য জান হাজির করে, আর বিশ্বম্ভর! সে কিনা মেঘমালাকে খেয়ালই করতে পারল না!
সে দিনের কথা মনে পড়লেই মেঘমালার মাথা ঝিমঝিম করে, দাঁত কিড়মিড় করে, ইচ্ছে করে দুনিয়া উল্টে দেয়। গত সাড়ে চার বছরে অন্তত নিরানব্বই বার সে জিজ্ঞেস করেছে, “সে দিন একা একা রসগোল্লা খেলে কেন?”
বিশ্বম্ভরও পূর্বাপর কিছুই মনে রাখতে পারে না, প্রত্যেক বার নির্দ্বিধায় বলে, “খেয়াল করিনি।”
“খেয়াল করোনি? না খেয়াল করতে চাওনি? এ-সব মিথ্যাচার আমি বুঝি না? আমি কি বোকা?”
ব্যস! মেঘমালার মাথায় বিদ্যুৎ স্পর্শ করে।
বিশ্বম্ভরের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে। প্রতি বার এই ভুলটা করে। আসলে ঠিক ভুলও নয়, পাকা উকিলের মতো মেঘমালা প্রশ্নের পর প্রশ্ন এমন ভাবে সাজিয়ে নেবে যে, এই উত্তরে উপনীত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
এর পর আর কিছু হাতে থাকে না। ভোকাট্টা হয়ে যাওয়া ঘুড়ির মতো সেই ঘটনা, লাটাইয়ের নাগালের বাইরে চলে যায়। বিশ্বম্ভর জানে, আজ রাতে মেঘমালা খাবে না। রাগের আগুনে বাতাস লাগানোর জন্য হয়তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, এলোমেলো ঘুরে বেড়াবে, কখন ফিরবে কেউ জানে না। প্রতিবেশী বৌদি-বান্ধবীদের বাড়ি যাবে। পাড়ার প্রান্তেই লেক। সেখানে রাত অবধি লোকজন থাকে, জোরালো আলো জ্বলে। তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
শেষের সে বারও তা-ই হল। বিশ্বম্ভরের আজকাল আর তেমন কিছু মনে হয় না। বেরিয়ে যখন প্রতি বার ফিরে আসে, এ বারও আসবে। একা একা সে রাতে, বিশ্বম্ভর ডিনারের জন্য রেখে দেওয়া ডাল ভাত তরকারি মাছের কালিয়া খেল। খুব ইচ্ছে ছিল, না খেয়ে থাকবে। কিন্তু খিদে বড় বালাই। ঠিক ন’টায় ওর পেটে রাবণের চিতার মতো দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। বলতে নেই, মেঘমালার রান্নার হাত চমৎকার। তার পর আজ বেশ তেল-মশলা দিয়ে কাতলা মাছও রেঁধেছে। বিশ্বম্ভর আর কী করে? বাধ্য হয়ে অনেকটা ভাত খেতেই হল।
সে রাতে মেঘমালার বিরহে সে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পেটে ভাত পড়লেই কুম্ভকর্ণ ভর করে। খাঁ-খাঁ ঘরে বিছানায় একা-একাই শুয়ে পড়ে। তখন বাঘ ডাকলেও বিশ্বম্ভরের ঘুমের ব্যাঘাত হওয়ার জো নেই। বরং তার নাকের ডাকে বাঘও থমকে যেতে পারে।
গাঢ় অভিমানের মতো, গাঢ় ঘুমেও অন্য কিছু নজরে পড়ে না। কাল বিশ্বম্ভর জানতেই পারেনি, একটু রাতে মেঘমালা দরজা খুলে ঘরে ফিরে এসেছে, তার কাছে চাবি থাকে। সকালে ঘুম ভেঙে, বিশ্বম্ভর নিজের নিয়মে দাড়ি কামায়, ব্রাশ করে। অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বাইরের ঘরে আসতেই দেখে, সোফার উপর মেঘমালা গুটিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তবুও বেরনোর আগে এক বার সে ঘুমন্ত মেঘমালার দিকে তাকায়। শিশুসুলভ সারল্য মুখে লগ্ন হয়ে রয়েছে। মাথায় আলতো হাত রাখে।
ঝপ করে চোখ মেলে মেঘমালা। গরম তেলে মাছ ছাড়ার মতো চড়াং করে রাগটা ফিরে আসে। বিস্ফারিত চোখে, আঙুল তুলে, তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, “বিশ্বম্ভর, ভেবো না আমি ফিরে এসেছি। কাল যে অপমান করেছ, তার পর আমার ফেরার কথা নয়। আমি এসেছি শুধু জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য।”
বিশ্বম্ভরের তখন ট্রেন ধরার তাড়া। আলগোছে বলে, “আচ্ছা। টাকাপয়সা কিছু দেব? বাসভাড়া?”
“তুমি যাও তো! যাও, যাও! চোখের সামনে থেকে চলে যাও। দূর হও!” গগনভেদী চিৎকার। বিশ্বম্ভরের মনের গভীরে সেই গঞ্জনা ঘাই মারে।
আর কথা না বাড়িয়ে সে স্টেশনের পথে ছুটতে থাকে। ট্রেনটা পেতেই হবে। পরেশতলির দু’নম্বর স্টেশনে সিগন্যাল সবুজ হয়ে গিয়েছে। শেষ ল্যাপে বিশ্বম্ভর দৌড় শুরু করে। গার্ডের কামরার কাছে এসে হাত বাড়ায়। সহযাত্রীরা টপাটপ হাত ধরে ভিড়ের ভিতর টেনে নেয়। পরের দুটো স্টেশন হাঁপিয়ে তবে স্বাভাবিক হতে পারে।
ট্রেনের কামরায় প্রতিদিনের সহযাত্রীরা টীকা-টিপ্পনী করে। রতন বদ-রসিকতায় সিদ্ধ। পট করে বলে, “বিশুকে আজ কে ভর করল?”
রামবিলাস তাস ভাগ করছিল, “বাদশা ইয়া গুলাম, দিন বিতে বিবি কে নাম।”
সকলে একচোট হেসে নেয়। সবাই যেন টের পেয়ে গেছে, ওর বাড়িতে কী ঘটেছে।
অফিস পৌঁছেও চুপচাপ থাকে বিশ্বম্ভর, যেন কিছুই হয়নি। সত্যিই কি কিছু হয়েছে? এমন তো নিত্যদিনের ঘটনা।
দুপুরে ম্যানেজার কুন্তল ঘোষের ঘরে ডাক পড়ল। স্বভাব-গোমড়া কুন্তলকে কখনও হাসতে দেখা যায়নি। কোম্পানির বটমলাইন আর টপলাইন করেই তার জীবন কেটে গেছে। বিশ্বম্ভরের দিকে না তাকিয়ে সে বলে চলে, “একটা জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট আছে, আমাদের শ্যামপুরের সাইট অফিসে কাল সকালের মধ্যেই রিপোর্ট করতে হবে।”
বিশ্বম্ভর যেন এমন কিছুই চাইছিল। অনায়াসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়। বাড়িতে মেঘমালা থাকবে না, চিরতরে চলে যাবে বলে দিয়েছে। ফাঁকা বাড়িতে সে ফিরবেই বা কেন! তার ভাল লাগবে না।
কুন্তল বলে চলে, “আমি ট্রাভেল ডেস্কে বলে দিচ্ছি। আজ রাতের ট্রেনেই বেরিয়ে যান।”
বিশ্বম্ভর ব্যাগ গোছাতে বাড়ি আসে। মেঘমালা নেই। সে খসখস করে মেঘমালার জন্য একটা চিঠি লিখে ফ্রিজের উপর চুম্বক দিয়ে আটকে দেয়— “অফিস ট্যুরে যাচ্ছি। ফিরে এলে ফোন কোরো।”
পাড়ার একটা হোটেলে ডিনার সেরে ঠিক সময় স্টেশনে পৌঁছয়। ট্রেনেও ওঠে। লাগেজপত্র সিটের নীচে চালান করে শোওয়ার ব্যবস্থা করে। কুম্ভকর্ণের কৃপায় ঘুম নিয়ে ওর কখনও সমস্যা হয় না, তবে আজ হচ্ছে। কী যেন একটা নেই! অথচ সব কাগজপত্র, ল্যাপটপ ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছে।
এ দিকে সারা দিন বাইরে কাটিয়ে মেঘমালা বাড়ি ফিরে আসে। এখন তার মাথা অনেক শান্ত। বাইরের পোশাক ছেড়ে কিছু খাওয়ার জন্য ফ্রিজের কাছে আসে। ঠিক যখন ভাবছে বিশ্বম্ভরকে আপাতত মাফ করে দেওয়া যায়, তখন ফ্রিজের দরজায় আটকানো কাগজটা চোখে পড়ে। মেঘমালা বুঝতে পারে, তাপমাত্রা ফের বাড়তে চলেছে।
কিছু না খেয়ে স্নানঘরে ঢুকে শাওয়ার চালিয়ে দেয় মেঘমালা। অঝোরে ভিজতে ভিজতে কত ক্ষণ কেটেছে, মনে নেই। এ দিকে তোয়ালে নিয়েও ঢোকেনি। ভিজে শরীরে বাইরে আসে। সমস্ত দেহ থেকে ঝরে পড়া জলে মেঝে থইথই। সেই অবস্থায় শুকনো তোয়ালে খুঁজে গা মুছে পোশাক পাল্টায়। তার পর মাটিতে পড়া জলে পা পিছলে দড়াম করে পড়ে। মেঘমালার কান্না পায়। মাটিতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে ছোটদের মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে।
খানিক পরে ধাতস্থ হয়, খাওয়া সারে। রাগের খাতা নিয়ে বসে। ফ্রিজের চিঠিটা আজ নতুন সংযোজন। লাল কালিতে দাগ দিয়ে, প্রমাণস্বরূপ আঠা দিয়ে চিঠিটিকেও খাতার ভিতর সেঁটে রাখে।
শ্যামপুর জায়গাটি বড় মনোরম। ছোট ছোট টিলায় ঘেরা আধা-গ্রাম আধা-শহর। এক দিকে এলোমেলো পাথরে ঢাকা পথ, মাঝে মাঝে চাষের খেত। বিশ্বম্ভর এখানে আসতে পারলে খুব খুশি হয়। ওদের একটা প্রজেক্ট চলছে। সাইট অফিসে তিরিশ জন সহকর্মী কাজ করে। মাঝেমধ্যে হেড অফিস থেকে বিশ্বম্ভরকে আসতে হয়। অফিস থেকেই হোটেল বুক করে দিয়েছে।
সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, এমন সময় বিশ্বম্ভর এসে তার হোটেলে চেক-ইন করে। এক প্রস্ত ঘুমিয়ে, স্নান প্রাতরাশ সেরে কাজের জায়গায় চলে যায়। প্রথমে ম্যানেজার কুন্তল ঘোষকে ফোনে রিপোর্ট করে, তার পর কাজে মন দেয়। কাজ শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
দিনের শেষে আর এক বার কুন্তলের সঙ্গে কথা হয়। কাজের কথা শেষ করে, কুন্তল বলে, “হোটেলটা কেমন?”
বিশ্বম্ভরের অবাক লাগে। পোড় খাওয়া কর্পোরেট-বস কুন্তল কাজ ছাড়া খেজুরে আলাপ করছে! খুব আবেগহীন গলায় সে বলে, “ভালই স্যর। বিজ়নেস হোটেল যেমন হয়।”
“কাছাকাছি ভাল রিসর্ট আছে। হেল্প-ডেস্কে বলে দেব, সেখানে চলে যাবেন।”
অফিসের কাজে এসে রিসর্টে থাকবে? বিশ্বম্ভরের মাথা কাজ করে না। তবে ওইটুকুই, কুন্তল ফোন রেখে দেয়।
সাইট থেকে বেরিয়ে বিশ্বম্ভর হোটেলে ফিরে আসে। গত রাতের রেলযাত্রায় ঘুম হয়নি এতটুকু। শরীর ক্লান্ত, মনটাও ভারী। আগের দিনের ঝড়ঝাপটার রেশ শরীর মন থেকে মুছে ফেলতে চায় বিশ্বম্ভর। ঘরে ঢুকে প্রথমে চমৎকার স্নান প্রয়োজন।
রিসেপশন থেকে চাবি নিতে গিয়ে, অবাক হয়ে গেল! ডেস্কের মেয়েটি বলে, “আপনার চেক-আউট হয়ে গেছে। আপনার লাগেজ এখানে রাখা আছে।”
“সে কী! আমায় না জানিয়ে চেক-আউট!”
“আমাদের তেমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, স্যর। তবে আপনি ঘরে গিয়ে এক বার দেখে নিতে পারেন। এখনও ঘর রিফ্রেশ করা হয়নি।”
“কিন্তু তা হলে, আমি থাকব কোথায়?”
“স্যর, পাশেই স্টার রিসর্ট। সেখানে আপনার বুকিং করা আছে। আপনি বললেই আমরা লাগেজ ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেব।”
বিশ্বম্ভরের সব কেমন গুলিয়ে গেল। একটু আগে কুন্তল ফোনে এ রকম একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল বটে, কিন্তু বাধ্যতামূলক কিছু তো বলেনি। বোঝাই যাচ্ছে অফিসের ট্রাভেল ডেস্কের ব্যবস্থাপনায় এ-সব হচ্ছে, শুধু কেন হচ্ছে সেটা ধরতে পারছে না। সে ভাল কাজ করে বলে ইনসেনটিভ গোছের কিছু হচ্ছে কি? হঠাৎ কোম্পানি হোটেলের বদলে রিসর্টের জন্য বেশি খরচ করবে কেন?
নিজের ঘরে গিয়ে এক বার চোখ বুলিয়ে নেয়, তার পর হোটেল রেজিস্টারে সই করে ওদের গাড়িতে চড়ে বসে। রিসর্টটা কাছেই। আসতে-যেতে এটার বিশাল তোরণ চোখে পড়ে। শ্যামপুরে কাজে এসে কখনও এই রিসর্টে থাকতে হবে, ভাবেনি।
তোরণের ভিতর দিয়ে ঢুকতেই মনটা যেন বেদখল হয়ে গেল। যত্নে সাজানো বাগানের ভিতর দিয়ে ওর গাড়ি, একটা প্যাগোডার মতো বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে রিসর্টের রিসেপশন। আর এক দফা সইসাবুদ। ওকে নামিয়ে দিয়ে হোটেলের গাড়িটি ফিরে গেল।
একটি ব্যাটারি-চালিত গল্ফ কার্ট সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই গাড়িতে চড়ে সাজানো বাগান, ছোট ছোট জলাশয়, তার উপর ঝুঁকে পড়া বাঁশঝাড় পেরিয়ে একটা ছোট্ট কটেজের সামনে এসে উপস্থিত হয় বিশ্বম্ভর। চালক ছেলেটি ওর ট্রলি আর ল্যাপটপ ব্যাগটি তুলে কটেজের ছোট বারান্দার উপরে রাখে। হাতে ঘরে ঢোকার অ্যাকসেস-কার্ডটা দিয়ে, অভিবাদন জানিয়ে ফিরে যায়।
বিশ্বম্ভর যন্ত্রচালিতের মতো নির্দিষ্ট ঘরের সামনে পৌঁছয়, তার পর দরজায় কার্ড ছোঁয়ায়। পিঁক করে আওয়াজে দরজা আলগা হল। ভিতর থেকে এসির ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে রুম-ফ্রেশনারের সুঘ্রাণ ভেসে আসে। হালকা আলোয় সে বুঝতে পারে, এ ঘরের বিছানা-বালিশ থেকে অন্যান্য আসবাব খুবই মহার্ঘ।
কিন্তু এ কী! বিছানায় কেউ শুয়ে আছে! আলোছায়ায় নারীশরীরের আদল স্পষ্ট। বিশ্বম্ভর ছিটকে বেরিয়ে আসে। কোম্পানি কি তার জন্য এসকর্টেরও ব্যবস্থা করেছে নাকি... ছি! ছি! বিশ্বম্ভরের চোয়াল শক্ত হয়।
বাইরে বেরিয়ে এসেও কাউকে দেখতে পায় না বিশ্বম্ভর যে জিজ্ঞেস করবে। এই রিসর্টের ভিতরটা গাছগাছালিতে ঢাকা, অতিরিক্ত নিরিবিলি। বিশ্বম্ভরের বিরক্তিই লাগছে। এখন রিসেপশন অবধি হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। রিসেপশনের নম্বরও জানা নেই যে ফোন করবে। শেষে নিজের অফিসের ট্রাভেল ডেস্কে ফোন করে।
হারাধনবাবু কোম্পানির পুরনো লোক। যুগ যুগ ধরে ওদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিশ্বম্ভরের সমস্যার কথা শুনে হেসেই অস্থির, “বিশুবাবু, হোটেলের ঘরে কোন অফিসার কাকে নিয়ে যায়, তা কি আমি কলকাতায় বসে জানতে পারি? না জানা উচিত?”
বিশ্বম্ভরের রসিকতা ভাল লাগল না, শরীর যথেষ্ট ক্লান্ত। ঘর পেয়েও ঢুকতে পারছে না, অবসন্ন গলায় বলে, “আপনি শুধু স্টার-এর নম্বরটা দিন।”
স্টারের রিসেপশনে ফোন করে সমস্যার কথা বলতেই, ও-পাশ থেকে উত্তর আসে, “স্যর, ওটাই আপনার ঘর। আপনি আসার কিছু ক্ষণ আগে ম্যাডাম চেক-ইন করেছেন।”
“ম্যাডাম! কোন ম্যাডাম?”
উত্তর শুনে বিশ্বম্ভর হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তখন কটেজের দরজা ফাঁক হয়ে যায়। বিশ্বম্ভর অবাক চোখে দেখে, মেঘমালা দাঁড়িয়ে। এক নিমেষে চতুর্দিক যেন থমকে যায়। বিশ্বম্ভরের বুকের ভিতর হাতুড়ির শব্দ হতে থাকে।
একটা নরম হাসি ঠোঁটে সাজিয়ে মেঘমালা বলে, “ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে? নাকি ঘরে আসবে!”
সেই কথায় বাড়িঘর গাছপালা, সব যেন স্লো-মোশনে প্রাণ ফিরে পেল। বিশ্বম্ভর সিঁড়ির তিন ধাপ টপকে ঘরে চলে আসে, “তুমি এখানে?”
“পৃথিবীতে শুধু তুমিই তেজ দেখাতে পারো?”
“আমি আবার কী করলাম?”
“ফ্রিজের গায়ে চিঠি লেখোনি?”
“সে তো সত্যি কথা! অফিসের কাজ।”
“আমিও সত্যি বললাম। বললাম, আমার উপর তেজ দেখিয়ে চলে গেছ।”
“কাকে বললে?”
“কে আবার? তোমার বস!”
“কুন্তল ঘোষ? তুমি অফিসে গিয়েছিলে?”
“হুঁ। গেছিলাম।”
“ওই গোমড়াথেরিয়াম তোমার কথা শুনল?”
“শুনবে না কেন? এমন করে হাসলে একমাত্র তুমি ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষই শুনবে!” মেঘমালা হাসলে গালে টোল পড়ে।
“তা কী বললে?”
“কী আর বলব? রিসর্টের এক্সট্রা টাকাটা দিয়ে দেব বলেছি।”
বিশ্বম্ভর আবেগে দরজা বন্ধ না করেই মেঘমালাকে জড়িয়ে ধরতে যায়। এসির বাতাসে ফ্রেশনারের ঘ্রাণে সুখের জারণ হতে থাকে।
বিশ্বম্ভরের এগিয়ে আসা ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে মেঘমালা জিজ্ঞেস করে, “আগে উত্তর দেবে, তার পর কাছে আসবে।”
বিশ্বম্ভর কাতর হয়ে অনুনয় করে, “আবার কিসের প্রশ্ন?”
“ঘরে এসে তুমি আমায় চিনতে পারলে না? কেন? এত দিনের সম্পর্ক! তাও চিনতে পারলে না? ঘরে আলো কম ছিল তাতে কী হয়েছে, তা বলে তুমি আমাকে চিনতেই পারবে না?”
ওরা দু’জনেই অনুভব করে, এসি-তে যথেষ্ট ঠান্ডা হচ্ছে না। ফের তাপমাত্রা বাড়ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)