সবে মাংসের ঝোল-মাখা ভাতের গ্রাসটা মুখে দিয়েছে, এমন সময় ডোরবেল।
“এখন আবার কে এল?” বিরক্তি ঝরল বিভাসের গলায়।
দিয়া তখনও খাবারে হাত দেয়নি। বলল, “কে আবার? নগেন নিশ্চয়ই! মাল দিতে এসেছে দেখো!”
ডোরবেলের আওয়াজের পর সত্যি সত্যিই “জেঠু, মাল নিয়ে এসেছি, দরজা খুলুন...” বলে চেঁচিয়ে নিজেকে জানান দিল নগেন।
নগেনের এই এক দোষ। সকালে যত তাড়াতাড়িই স্লিপ দিয়ে আসা হোক না কেন, মাল দুপুরের আগে দেয় না। আর দুপুরেও দেয় ঠিক এমন সময়, যখন হয় বিভাস খেতে বসেছে, অথবা স্নানে ঢুকেছে কিংবা ঠাকুরঘরে প্রণাম করছে।
মুদির মাসকাবারি বাজারের স্লিপ সাধারণত ছুটির দিনেই দেওয়া হয়। আজ রবিবার বলেই স্লিপটা দিয়ে এসেছিল বিভাস। দোকানে ম্যানেজার এক জন থাকলেও নগেনই সব। বিশেষ করে মাসকাবারের দিকটা ও-ই সামলায়। কাছেপিঠের বাড়িগুলোর ডেলিভারিও করে।
বিভাস নগেনকে বলেছিল, “একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে যেয়ো!” কিন্তু যথারীতি সেই লেট।
স্লিপে দাম লেখা আছে। চটপট সেটা দেখে টাকা মেটাতে হবে। ঝামেলার ব্যাপার। এ সব ঝামেলা দিয়া পছন্দ করে না মোটেই। তাই এটা বিভাসের ডিপার্টমেন্ট।
পুলিন মাংসের একটা হাড় চিবোনোর চেষ্টা করছিল। ওই অবস্থাতেই, বিভাসকে উঠতে দেখে বলল, “বাবা, দেখে নিয়ো তো আমার বিস্কুটটা দিয়েছে কি না!”
বিভাস হাত ধুয়ে দরজা খুলল। স্লিপে লেখা দামগুলো ঝটপট দেখে নিয়ে টাকা মিটিয়ে দিল। পুলিন ভিতর থেকে আবার চেঁচাল, “ও বাবা, আমার বিস্কুটটা?”
নগেন যেতে যেতে বলল, “দিয়েছি বাবু, দিয়েছি! তোমার কিরিম বিস্কুট একেবারে উপরেই আছে!”
পুলিনের ঠাকুমা মনোরমা দেবী পাশের ঘরে শুয়েছিলেন। অনেক ক্ষণ আগে তাঁর খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মুদির দোকান থেকে মাল দিতে এসেছে শুনে তিনিও উঁকি দিলেন, “বিভু, তিলের নাড়ুর দুটো প্যাকেট লিখেছিলি ফর্দে, দিয়েছে?”
বিভাস বলল, “অপেক্ষা করো একটু, খেয়ে উঠে দেখছি!”
আবার খেতে বসতেই দিয়া বলল, “আজ একটা নতুন ডাক শুনলাম যেন!”
“কী, জেঠু!” হাসল বিভাস, “সকালে যখন স্লিপটা দিই, তখনও কাকু বলেছে কিন্তু! এখন হয়তো
ভুল করে…”
দিয়া হাসল না। তার মুখ গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, “অ্যান্টি-এজিং ক্রিমটা কি মুখে লাগাচ্ছ না?”
“অ্যান্টি-এজিং ক্রিম দিয়ে কি আর বয়স পুরোপুরি ঢাকা পড়ে? পঞ্চাশ হয়ে গেল। এখন তো মুখে বুড়োটে ভাব আসবেই!”
“তোমার একটু বেশিই আসছে। কিন্তু এখনই এত বুড়ো হলে চলবে? ছেলেটা তো ছোট!”
ছেলের জন্য বুড়ো হওয়া কিছুটা হলেও যে আটকাতে হবে, এটা বিভাস বোঝে। এই তো সে দিন! পুলিন গিয়েছিল সায়েন্স অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা দিতে। দিয়া দিয়ে এসেছিল। আনতে গিয়েছিল বিভাস। পরীক্ষার পরে বিভাস যখন পুলিনকে ডেকে নিচ্ছে, তখন কানে এসেছিল, ছেলেকে ওর এক বন্ধুর জিজ্ঞাসা, “উনি তোর দাদু?”
একটু অস্বস্তি হলেও ঘটনাটা বিভাস পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ফিরে হাসতে হাসতেই দিয়াকে বলেছিল, পুলিনের আড়ালে।
দিয়া কিন্তু সে দিনও হাসেনি। বলেছিল, “পুলিন আর একটু বুঝতে শিখলে হয়তো লজ্জা এড়াতে তোমাকে নিয়ে রাস্তায় চলতেই চাইবে না! সময় থাকতে সতর্ক হও!”
অ্যান্টি-এজিং ক্রিমটা পরের দিনই কিনে এনেছিল দিয়া।
“অল্পবয়সে শুগারে ধরলে বোধহয় এ রকমই হয়!” পুলিন খাওয়া শেষ করে ঘরে যেতেই নিচুগলায় বলল বিভাস।
“শুগার এখন কার নেই? সবাই কি এই বয়সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে! দেখোই না ক্রিমটা লাগিয়ে!” দিয়া বেশ চিন্তিত বোঝা যায়।
প্রসঙ্গ চাপা পড়ল মনোরমা উঠে আসায়, “এক কালে আশ্বিন মাস পড়লেই নাড়ু করা শুরু হত। তিলের নাড়ু কিন্তু খুব বেশি করা হত না। লক্ষ্মীপুজোর সময়ে কেবল তৈরি হত কিছু। আমরা বেশি করতাম গুড়ের আর চিনির নাড়ূ।”
অ্যান্টি-এজিং ক্রিম ছেড়ে বিভাস মায়ের কথায় ভিড়ল। পুরনো দিনগুলো চোখের সামনে ঘাই মেরে উঠল হঠাৎ, “পুজোর আগে বাবা তখন নারকেলও কিনত অনেক। পুরো চৌকির তলা ভর্তি, তাই না মা!”
“অত নারকেলেও শেষে কম পড়ে যেত। বিজয়ার সময়ে তখন বাড়িতে কম লোক আসত নাকি! তার পর লক্ষ্মীপুজো। কালীপুজোর আগেও আর এক প্রস্ত নারকেল কিনত তোর বাবা। সে-নারকেল দিয়ে ভাইফোঁটার নাড়ু হত।”
কথা বলতে বলতে মনোরমা এগিয়ে যান। গিয়ে মুদির মালের ব্যাগটা ফাঁক করেন, “আরে দিয়েছে তো মোটে দু’প্যাকেট তিলের নাড়ু! এগুলো স্বাদে কেমন হবে জানি না, দেখতে কিন্তু বেশ!”
“দেখতে বেশ হলে হবে না। খেয়েও দেখতে হবে বেশ কি না!” খাওয়া শেষে বাসনপত্র গোছাতে গোছাতে বলল দিয়া।
পুলিন ঘর থেকে এসে মনোরমাকে জড়িয়ে ধরল, “ঠাকুমা, তুমি তো এখনও ফিট। সেই আগের মতো বানাও না তিলের নাড়ু!”
দিয়া বলে উঠল, “তিলের নাড়ু করতে কত খাটনি জানিস? ঠাকুমা এখন আর পারে ওই সব!”
মনোরমা এখানে কয়েক দিনের অতিথি। উনি থাকেন গ্রামের বাড়িতে। এখানে মহালয়ার দিন এসেছেন। পুজো শেষ হলেই চলে যাবেন। গত ফাল্গুনে সত্তর পার করেছেন, কিন্তু এখনও নিজের রান্না নিজেই করেন। বাড়িতে অন্যান্য কাজের জন্য বিশ্বস্ত এক জন আছে, মালতী। রোগপীড়া বিশেষ নেই, যতটুকু কালেভদ্রে হয়, নিজেই সামলে নেন। ছেলে-ছেলের বৌ এখানে পাকাপাকি চলে আসতে বলে, কিন্তু স্বামীর ভিটে ছেড়ে আসবেন না বলে পাশ কাটান। একা থাকেন, নিজের মতো থাকেন। এটাও হয়তো গ্রামের বাড়ি না ছাড়তে চাওয়ার একটা কারণ।
এখানে ঠিকমতো জিনিসপত্র পেলে তিলের নাড়ু যে মনোরমা তৈরি করতে পারবেন না, তা নয়। কিন্তু অন্যের রান্নাঘরে কি সাবলীল ভাবে কিছু করা যায়? এ সব জিনিস করতে গেলে রান্নাঘরটাকে নিজের করে পেতে হয়। দিয়া অবশ্য ভাল। এলে যত্ন-আত্তি করে। ওর ‘মা’ ডাকটাও বেশ আন্তরিক। তবু ওর সাজানো-গোছানো রান্নাঘরটায় কি নিজের বাড়ির মতো স্বাচ্ছন্দ্য আসে? বরং মনোরমার মতো গেঁয়ো মানুষের ওখানে কাজ করতে গেলে একটু থতমত খেয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
এ দিকে পুলিন একটাই নাতি। আবদার করেছে, ঠাকুমার তিলের নাড়ু খাবে। হয়তো সে জন্যই তিনি জড়তা ঝেড়ে বলে ওঠেন, “দিয়া, তোমার আপত্তি না থাকলে আমি দাদুভাইয়ের জন্য তিলের নাড়ু তৈরি করে দেব!”
“আপত্তি কেন থাকবে? কিন্তু এখানে কয়েকটা দিনের জন্য বেড়াতে এসে আবার কেন রান্নাঘরে ঢুকবেন মা?” দিয়া জানায়।
তার মানে বোঝা গেল, দিয়া রাজি নয়। মনোরমা চুপসে যান। কিন্তু এ বার জোর ধরে বিভাস, “না মা, তুমি করো। আমি সব জিনিসপত্র এনে দেব!”
পঞ্চমীর রাতে অনেকটা সময় ধরে তিলের নাড়ু বানালেন মনোরমা। নাড়ু একটু ঠান্ডা হতে ডাকলেন পুলিনকে, একটা খেয়ে দেখার জন্য। কিন্তু পুলিন খাবে কী, নাড়ু দেখে হেসে বাঁচে না। প্যাকেটের নাড়ুগুলো কী সুন্দর, তুলনায় এ কী নাড়ু বানিয়েছে ঠাকুমা! রং দেখলেই তো ভক্তি আসে না, আর গোলও তেমন হয়নি।
“কী রে? হাসছিস কেন?”
“নাড়ুগুলো কেমন যেন দেখতে হয়েছে ঠাম্মা...”
“খেয়ে দেখ একটা আগে...”
মুখে দিয়েই পুলিন বলল, “ঠাকুমা, আর একটা দাও!”
মনোরমার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। তার মানে তাঁর তৈরি নাড়ু দেখতে যেমনই হোক, স্বাদে খুশি করেছে নাতিকে!
রাতে মুখে অ্যান্টি-এজিং ক্রিমটা মাখছিল বিভাস।
দিয়া বলল, “তোমার মা নাড়ু তো করলেন! কিন্তু কড়াইটা মাজবে কে? যা অবস্থা হয়েছে ওটার!”
“কেন, কাজের মাসি আসবে না কাল কাজ করতে?” বিভাস একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আসবে না কেন? কিন্তু এ রকম কড়াই মাজতে দিলে মাসি কাজ ছেড়ে চলে যাবে। কী রকম পুড়েছে দেখেছ!” দিয়ার গলায় মৃদু ঝাঁঝ।
“তা হলে কে মাজবে?”
“আমাকেই মাজতে হবে!”
বিভাস মাসিকে জানে। এক দিন এ রকম কড়াই দিলে সে কিছুই বলবে না। কিন্তু দিয়া দেবে না। নিজে মাজবে ইচ্ছে করে, যাতে মা অস্বস্তিতে পড়ে। এর আগের বার মা এসে বিভাসের জোরালো আবদারে এঁচোড় রান্না করতে গিয়েছিল। কিছুটা তেলঝোল পড়েছিল গ্যাসের চার পাশে। দিয়া সেগুলোও মাসিকে পরিষ্কার করতে দেয়নি। যতটা সময় লাগার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে ঘষে ঘষে তুলেছিল সব। মা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল বিব্রত মুখে।
বিভাসের ধারণা, দিয়া কিংবা কোনও নারীই, তার রান্নাঘর আর কারও হাতে ছাড়তে চায় না। যদি পরিস্থিতির চাপে সে রকম করতেও হয়, তখন অন্য ভাবে বিরক্তি প্রকাশ করে। সূক্ষ্ম ভাবে বাকিদের অপরাধবোধে নিমজ্জিত করতে চায়। দাম্পত্য পুরুষমানুষকে পরিণত আর বিচক্ষণ করে তোলে। পরিণতবোধ সংসারের এই সব সমীকরণ চোখের সামনে তুলে ধরে, আর বিচক্ষণতা এই সব সমীকরণ বিষয়ে মুখ না খোলার শিক্ষা দেয়।
কড়াই মাজার সমস্যাটা হয়তো আগাম অনুমান করতে পেরেছিলেন মনোরমা। পরের দিন সকালে দিয়া ঘুম থেকে উঠে দেখল কড়াইটা মাজা হয়ে আছে। ও বুঝে গেল সব।
“মা, এ কী করলেন আপনি? শেষে ছেলের কাছে এসে, এই বয়সে কড়াই মাজলেন? লোকে জানলে আমাকে কী বলবে বলুন তো!” অনেক ক্ষণ ধরে পোড়া কড়াইটা মাজতে না পারায় হতাশা আর বিরক্তি ফুটে ওঠে দিয়ার গলায়।
মনোরমাও অভিজ্ঞ। উত্তর তাঁর তৈরি করাই ছিল। বললেন, “আর বোলো না, তোমাদের শহরে যা সব কাজের লোক, এইটুকু পোড়াতেই হয়তো কথা শোনাবে! তাই নিজেই মেজে রাখলাম।”
দিয়া আর কথা বাড়ানোর সুযোগ পায় না।
ঠিক ছিল, লক্ষ্মীপুজোর পরদিন মনোরমা গ্রামের বাড়িতে ফিরবেন। মালতীর ছেলে ঋতম দিয়ে গিয়েছে, ফোন করে দিলে নিতেও আসবে। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর দিন দুয়েক আগে থেকে প্রচণ্ড ঝড়জল শুরু হল। শোনা গেল প্রবল নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম চলবে দিন সাতেক।
দিয়া রাতে শোওয়ার সময় গজগজ শুরু করল। ভেবেছিল, মনোরমা চলে গেলে বাপের বাড়ি যাবে। মা-বাবা নেই তো কী হয়েছে! অন্যরা তো আছে। বৌদি যাওয়ার জন্য বলছিলও খুব!
বিভাস বলার চেষ্টা করেছিল, এই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এতটা পথ...
খরগলায় দিয়া জানিয়ে দিয়েছিল, নিম্নচাপে ওর যেতে কোনও সমস্যা নেই। এখানে ট্রেনে উঠবে, সোজা শিয়ালদা নামবে। কিন্তু মনোরমা এখানে আটকে গেলে সে বাপের বাড়ি চলে যায় কী করে!
রাতের দিকে ফোনও এল মালতীর, “এ দিকের আবহাওয়া খুব খারাপ। সারা বাড়ি জলে-ঝড়ে তছনছ। একটু না কমলে মাকে পাঠিয়ো না। আমি বাড়িতে থাকছি রাতে। চিন্তার কিছু নেই। আবহাওয়া ভাল হলে ফোন কোরো। ঋতমকে পাঠিয়ে দেব।”
“নিম্নচাপটা আর সময় পেল না! ভেবেছিলাম, বাড়ি যাব। আর যাওয়া হল না! সব দিক থেকে আটকে গেলাম!” দিয়ার গলায় আক্ষেপ ঝরল। ওর আক্ষেপ প্রকাশের সময়, হয়তো বা বেখেয়ালে, কিংবা হয়তো নয়, গলার স্বরটা একটু উঁচুগ্রামে
হয়ে গেছিল।
পরের দিন সকালে বিভাস উঠে দেখল, মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে, শাড়িটাড়ি পরে একেবারে তৈরি।
বিভাস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার?”
মনোরমা বললেন, “আমাকে একটু স্টেশনে দিয়ে আয়! মালতীকে ফোন করেছিলাম। ঋতম আগের ট্রেনে এসে স্টেশনে দাঁড়াবে। সেই কবে বাড়ি থেকে এসেছি, ঘরদোর এই দুর্যোগে কী অবস্থায় যে আছে! আমার খুব চিন্তা হচ্ছে...”
কাল রাতে দিয়া আর ওর কথোপকথন কানে গিয়েছে নাকি মায়ের! বাথরুমে যেতে গেলে ওদের শোয়ার ঘর ডিঙিয়েই যেতে হয়! মা কি সে সময়…
বিভাস বলল, “খেপেছ, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে দেশে
পাঠাব আমি!”
“কিচ্ছু হবে না। বৃষ্টি তো নেই। ঝড়ও কম। ঋতম আছে, চলে যাব।”
বিভাস তবু বাধা দিল। দিয়াও আলগা বারণ করল। মনোরমা শুনলেন না। বিভাসকে স্টেশনে যেতেই হল। ঋতম আছে, তবু ট্রেনে মাকে তুলে দিয়েই বাড়ি ফিরল।
তিলের নাড়ুর বয়ামটা এখনও অনেকটাই ভর্তি। বিভাস একটা তিলের নাড়ু মুখে দিল। সত্যিই খুব চমৎকার স্বাদ! প্যাকেটের তিলের নাড়ুও পাশে পড়ে আছে। পার্থক্য বোঝার জন্য প্যাকেট ছিঁড়ে ওখান থেকেও একটা মুখে দিল। ভাল লাগল না! মায়ের সঙ্গে ওর যে সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছে, কিছুটা কি মিল আছে, বাজারের তিলের নাড়ুর সঙ্গে। সবাই দেখছে মা আসছে, থাকছে, কুটোটি নাড়তে দিচ্ছে না ছেলে-ছেলের বৌ, কিন্তু সম্পর্কের ভিতরের চেহারাটা কি একই রকম? ওখানে কি বাঁধন সেই আগের মতোই আছে? তা হলে এই যে মাকে যেতে বারণ করল, মা শুনল না তো!
“তুমি কি আজ তিলের নাড়ু খেয়েই অফিসে যাবে নাকি?” দিয়া টিপ্পনী ছুড়ল।
নাড়ু চিবোতে চিবোতে স্নানে ঢুকল বিভাস। ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই নজরে পড়ল অ্যান্টি-এজিং ক্রিমের টিউবটা। কাল রাতেও মুখে লাগিয়েছে। কিন্তু আর লাগাবে না। যা সত্যি তাকে আড়াল করতে যাওয়ার মানে হয় না। যত পয়সা নষ্ট আর ন্যাকাপনা! মা চলে যাওয়ার পর থেকেই বিভাসের মেজাজটা তিতকুটে হয়ে আছে।
দিয়া রান্নাঘরে ব্যস্ত। ক্রিমের টিউবটা হাতে নিয়ে বিভাস জানলায় এল। তার পর ওটা ছুড়ে ফেলল নীচের আবর্জনার স্তূপটায়।
অফিস যাওয়ার সময় দিয়া নির্দেশ দিল, “তুমি অফিসে যাওয়ার সময় একটা চাবি নিয়ে যাও। আমি পুলিনকে নিয়ে ও-বাড়ি যাব। এখন টিউশন নেই, মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুক ক’দিন। তুমি দুপুরটা অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়ো আর রাতে হোম সার্ভিসে রুটি বা যা খাবে নিয়ে নিয়ো। আচ্ছা, তোমার তো অনেক ছুটি জমে আছে। ওখানে চলে যেয়ো না কাল বা পরশু!”
হ্যাঁ-না কিছুই বলল না বিভাস। অফিসে কাজের চাপে, মা ঠিকঠাক পৌঁছেছে কি না খবর নেওয়াও
হল না। মনে চাপা বিরক্তি, এখন মুখ খুললে ঝামেলা বেধে যেতে পারে।
বিকেলে অফিসে হঠাৎ ফোন এল দিয়ার, “দেশের বাড়ি চলে এসো! তোমার মা পড়ে গেছেন। তবে চিন্তার কিছু নেই। আমি আছি।”
দিয়া ফোন কেটে দিল। জানা হল না দিয়া মায়ের কাছে কী ভাবে গেল।
কারণটা জানা গেল বাড়ি পৌঁছে।
“আমরা শিয়ালদারই টিকিট কেটেছিলাম। কিন্তু পুলিন ট্রেন এখানে আসার আগে বলল, ‘মামার বাড়ি তো প্রতি বারেই যাই। এ বার চলো না মা ঠাকুমার কাছে!’ পুলিনের কথায় আমারও কী হল, নেমে পড়লাম। দুর্যোগ পুরো কাটার আগেই মা চলে এলেন তাড়াহুড়ো করে, মনটা খুঁতখুঁত করছিল। নেমে দেখছি ভুল কিছু করিনি। মা পিছল রাস্তা দিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন!” বিভাস বাড়ি ঢুকতেই দিয়া বলল।
মার পায়ের ব্যথা তেমন কিছু নয়। বিভাস মার পায়ে হাত দিয়ে বলল, “এই আবহাওয়ায় তোমাকে এত করে বারণ করলাম আসতে। ঋতম অতটুকু ছেলে, তোমার ব্যাগ সামলাবে না তোমাকে! যদি আরও বড়
কিছু হত!”
মনোরমা হাসলেন। তিনি জানেন কিছু সংশয় নিরসন করা যায় না।
দিয়া বিভাসের দিকে একটা টিফিনকৌটো এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেবে নাকি একটা!”
বিভাস অবাক হয়ে বলে, “কী?”
“মা-র করা সেই তিলের নাড়ু। পুলিন সঙ্গে নিয়েছিল। আমি আজ প্রথম খেলাম, অপূর্ব!”
“জানি,” দিয়ার হাত থেকে তিলের নাড়ুর কৌটোটা নিতে নিতে বলল বিভাস।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)