Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ভারতমাতা

শুঁটকো আর্টের ঠাকুর নই!

আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: ভারতমাতা

ভারতমাতা, এখন যেমন। ঘোমটা সরাতে রাজি না হওয়ায়, ভাল ছবি তোলা যায়নি।

ভারতমাতা, এখন যেমন। ঘোমটা সরাতে রাজি না হওয়ায়, ভাল ছবি তোলা যায়নি।

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

প্রতিবেদক: প্রশ্নটা অনেকটা ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’-এর ডায়ালগের মতোই শোনাবে, কিন্তু আপনি অ্যাইসা ঘোমটা টেনে বসে আছেন, জিজ্ঞেস না করেও পারছি না— আপনি কে গো মাতা? মানে, আপনি কোন ভারতমাতা? সেই বঙ্গভঙ্গের আমলে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা গেরুয়াবসনা, শুকনো মুখের সাধ্বী-টাইপ? না কি সঙ্ঘপরিবার যেমনটি ভাবে তেমনই, ভারতের মানচিত্রের মাঝখানে তেরঙা সিল্কের শাড়ির লম্বা আঁচল-ওড়ানো, তির-ধনুক-বর্শা-টর্শা হাতে, সিংহের ওপর স্টাইল মেরে দাঁড়ানো মাতা শেরাওয়ালি?

ভারতমাতা: কোন কালে পড়ে আছিস রে! ভারতমাতা কোন দুঃখে ওবিন ঠাকুরের আঁকা হাড়-জিরজিরে খ্যাংরাকাঠি-মার্কা মেয়েমানুষ হবে! মাথার পিছনে ডাব্‌ল জ্যোতি, কাঁধে দুটো এক্সট্রা হাত লাগিয়ে যত দেবী-টেবী বানানোর চেষ্টা করুন না কেন, ওই মহিলা হাড়ে-মাংসে তোদের বাঙালি ঘরের মেয়েই! ও রকমই অপুষ্টি, অ্যানিমিয়ায় ভোগা, ফ্যাকাশেপানা। স্বদেশি আমল তো, ম্যালেরিয়া বা টিবি হলেও অবাক হব না। মুখটাও কেমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছে দ্যাখ! সারা পৃথিবীর সব মনখারাপ যেন ওর একার! ভারতমাতা অমন ন্যাতানো-মিয়োনো ভেজা মুড়ির মতো হলে চলে!

প্রতি: কী মুশকিল! ১৯০৫ সালের ভারতমাতার মুখে বাংলা-ভাগের কষ্ট থাকবে না? তখনকার দুঃখ-দারিদ্রের ছাপ মায়ের চেহারায় সাজগোজে পড়বে না?

ভা.মা.: আরে ভারতমাতা কি তোদের আর্ট ফিলিম নাকি! টিমটিমে আলো, ডি-গ্ল্যাম লুক দেখিয়ে রিয়েলিটি কপচাবি? ওই তো তোদের সত্যজিৎ রায়, স্বাধীন ভারতে সরকারি টাকা বাগিয়ে প্রথম ছবিতেই আর্টের নামে দারিদ্রের প্যাকেজিং বানিয়ে নাম কিনলেন। অবশ্য বলিউডের আসলি ‘মাদার ইন্ডিয়া’ নার্গিসজি সে জন্য ওঁকে আচ্ছাসে ডেঁটে দিয়েছিলেন! আচ্ছা, সত্যজিতের বাপ-ঠাকুরদা সব ব্রাহ্ম ছিলেন না? এই ওবিন ঠাকুর লোকটাও তো তাই শুনছি! যদিও রাজপুতদের কীর্তি-কাহিনি নিয়ে একটা বই লিখেছেন শুনি, তাতে নাকি দেবী পদ্মিনীর মাহাত্ম্যও আছে। কিন্তু হিন্দু তো নয়! তাই ভারতমাতার মহিমা উনি বুঝবেন না। ওরে, ভারতমাতার চোখে তেজ, গায়ে গত্তি, হাতে অস্ত্র না থাকলে দেশের লোক মান্যি করবে কেন— প্রতিবেশী দেশের লোকেরাও ভয়ে-ভক্তিতে সিঁটিয়ে থাকবে কী করে? ও-সব শুঁটকো আর্টের ঠাকুর-ফাকুর চলবে না! মা হবেন শুধ্‌ দেশি— খোলা চুল আর লম্বা আঁচল উড়তে উড়তে ডান দিকে পাকিস্তান ছেয়ে ফেলেছে! পা দু’খানি শ্রীলঙ্কার মাথায়! ছড়ানো বাঁ হাত সোজা অনুপ্রবেশ করে গেছে বাংলাদেশের অন্দরে। এই না হলে ভারতমাতা! শুধু মা যা আছেন, সে কথা বলে না— মা যা হইবেন, সে গপ্পও ঝড়াকসে বলে দেয়। আরে, যিনি ভারতের মাতা, তাঁকে তো ‘সার্ক’ গোষ্ঠীর দেশগুলোরও ‘মাতা’ হতেই হবে! নইলে দক্ষিণ এশীয় সন্তানদের দেখভাল করবে কেডা!

প্রতি: কিন্তু এ তো মারাত্মক ব্যাপার! আপনার এমন রূপ ভাবলেন কে?

ভা.মা.: কেন, আমার সেরার সেরা সন্তান দীননাথ বাত্রা! বিদ্যাসাগরের পরে এ দেশে শিক্ষা আন্দোলনে এত বড় বিপ্লবী আসেনি রে! স্মৃতি ইরানির দীক্ষাগুরু! আরএসএস-এর শিক্ষাগুরু! এ দেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে যত ছদ্ম সেকুলার বকবকাচ্ছে না, ওদের সব্বার দু’বেলা ওর পা-ধোয়া জল খাওয়া উচিত! ওর লেখা ‘মা কা আহ্বান’ বইটার কভারটা এক ঝলক দেখে নিস, মাতৃভক্তি কাকে বলে বুঝবি।

প্রতি: আরে আপনি ভারতমাতা, না আরএসএস-এর মাতা? মা কি কারও একার?

ভা.মা.: আলবাত একার! যে ছেলে মা-কে ঠিকঠাক করে দেখে, মা-ও তো তার পাতেই দুধের সরটা, মাছের মু...! এই ছি-ছি-ছি! ভারতমাতার সুসন্তানরা তো সব নিরামিষ খায়। মাছ খাওয়া তো শুধু বাঙালি আর মালয়ালিদের কারবার! যাকগে, মা’কে দেখাশোনারও ব্যাপার নয়, স্রেফ এক বার গলা ছেড়ে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলতেও তোরা কুড়ি বার ভাববি, একশো কুড়িটা ফ্যাকড়া তুলবি, কঠিন-কঠিন তত্ত্বের পাঁক গুলোবি— তার পরেও আশা করবি যে আমি আমার স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-পুত্তুরদের ছেড়ে তোদের কোল দেব! নেভার! মনুস্মৃতি-টৃতি ঘেঁটে ভারতমাতার যে মডেল কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করে দিয়েছি, তোরা সেকুলার-লিবারালরা তার একটাও মানিস? কলেজের ক্যান্টিনে বিফ-উৎসব করছিস, তোদের মেয়েগুলো হটপ্যান্ট পরে ভ্যালেনটাইন্স ডে-তে ঢলাঢলি করছে, ছেলেরা-ছেলেরা, মেয়েরা-মেয়েরা বর-বউয়ের মতো এক সঙ্গে থাকবে বলে মিছিল করছে! আফজল গুরু-র মৃত্যুদিনে বুক চাপড়ে শোক করছিস, অম্বেদকরের নাম করে হিন্দুত্বের দাড়ি ওপড়াচ্ছিস, আবার ‘মা কেন একচোখোমি করে’ বলে গালও পাড়ছিস! ঢঙ! বেশ করব, করব! একচোখোমি করব, দলবাজি করব। হাজার লক্ষ বার করব! দেশটাকে ভারতমাতার সুসন্তান আর কুসন্তানে মেরুকরণ করে দেব!

প্রতি: কিন্তু এটা কি সত্যিকারের মায়ের কাজ হবে? আপনি যে শাস্ত্র মানেন, তাতেই বলা হচ্ছে— কুপুত্র যদি-বা হয়, কুমাতা কদাপি নয়!

ভা.মা.: মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব একেবারে! শাস্তর শেখাতে এয়েচে! কুপুত্রকে ঢিট করতে আমি কু-কু-কু-কু-মাতা হব! ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে হিসেব বুঝে নেব! আগের সব জনতা-ইউপিএ জমানায় তোদের ঠিকমত শাসন না করে মাথায় তুলে দিয়েছিল! কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, দেশের কোণে কোণে সন্ত্রাসবাদীদের আড়ত হয়েছে। ‘বন্দে মাতরম্’, ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলতে তেনাদের জিভ খসে যায়! কেন রে? গাঁধীজি বলেছেন, মানে, শুনেছি বলেছেন, দীনদয়াল উপাধ্যায় বলেছেন, অন্না হজারেরা গলা কাঁপিয়ে বলেছেন, মোদী বলেছেন, কেজরী বলেছেন, শাবানা-জাভেদ জুটি অবধি বলেছেন! তোদের বলতে এত কী প্রেস্টিজ যায়? এ সব আর বরদাস্ত করা হবে না! এ বার থেকে দেশে ভারতমাতার শাসন চলবে। দিকে দিকে দেশপ্রেমের সিন্ডিকেট বানিয়ে, সেখান থেকে জবরদস্তি জাতীয়তাবাদী ইট-বালি-লোহা-সিমেন্ট সাপ্লাই করা হবে। হিন্দুত্বের উড়ালপুল আফগানিস্তান-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অবধি চলে যাবে, দীননাথ বাত্রার ভারতমাতার ছবি সত্যি হয়ে উঠবে!

প্রতি: আপনি দেশ-বিদেশ যেতে চাইছেন, ও-দিকে কানহাইয়া কুমার তো বলছে, সঙ্ঘ পরিবারের ভারতমাতা এত ফরসা কেন? তাঁর গায়ে এত গয়না, হাতে এত অস্ত্র কেন? ও চায়, ভারতমাতার গায়ের রং হবে শ্যামলা, পোশাক হবে দলিত নারীর মতো...

ভা.মা.: আর দু’হাতে থাকবে কাস্তে-হাতুড়ি, তাই না? ব্যাটা কমিউনিস্ট, অ্যান্টি-ন্যাশনাল। ভারতমাতা হওয়ার জন্য আমায় এখন রোদে পুড়ে চামড়া ট্যান করে আসতে হবে! ওকে গুলি করে মারলেও হবে না! আমার সিংহ দিয়ে খাওয়াব! যেখানে যত মাওবাদী, মুসলিম দেশদ্রোহী আছে, সব্বাইকে সিংহ লেলিয়ে দেব! ইয়ার্কি হচ্ছে...!

[ভারতমাতা এত ক্ষণের ঘোমটা-ফোমটা সরিয়ে বিকট চেঁচাতে লাগলেন। দূরে বাঁধা ওঁর বাহন সিংহটাও গর্জন শুরু করল। ইন্টারভিউয়ের দফারফা!]

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Robibashoriya Santunu chakroborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE