Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Dev Anand

শতবর্ষেও অটুট দেব-মহিমা

আজকের ‘রকি অওর রানি’-র গানে তাঁর স্মৃতি। ‘জওয়ান’ ছবির কার্যনির্বাহী প্রযোজনাতেও। দেব আনন্দ বিস্মৃত ইতিহাস নন। ওয়াহিদা রহমানের আত্মপ্রকাশের গাইড, জ়িনাত এবং টিনা মুনিমদের আবিষ্কর্তা।

ছবি কুনাল বর্মণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৩৯
Share: Save:

দম মারো দম

মিট যায়ে গম

বোলো সুবহা শাম

হরে কৃষ্ণ হরে রাম...

নাচছেন জ়িনাত আমন। হাতে হতে ঘুরছে গাঁজার ছিলিম, ধুনকিতে কেউ বা শুয়ে, চোখ বুজে। কাঠমান্ডুতে হিপি-আড্ডা এ রকমই। অতঃপর ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ছবিতে পাহাড়ি পথের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে আসেন লাল শার্টের উপর স্কার্ফ গলায় দেব আনন্দ, ‘দেখো ও দিওয়ানো তুম ইয়ে কাম না করো/ রামকা নাম বদনাম না করো।’ ছেলেবেলায় হারিয়ে-যাওয়া জ়িনাত জানেন না, দেব আনন্দ তাঁর দাদা। বোনকে খুঁজতে এসেছেন এই গাঁজা, চরসের ঠেকে।

আগামী মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ করবেন তিনি। অনেক শ্রদ্ধার্ঘ্য, বহু স্মৃতির ফুলঝুরি ছুটবে, সিনেমা হলে স্পেশাল শোয়ে ফিরে আসবে তাঁর ছবি। কিন্তু সেরা উপহারটা বোধহয় তিনি পেয়ে গিয়েছেন তাঁর আবিষ্কার, জ়িনাত আমনের টুইটে। ‘দু তরফেই ভুল বোঝাবুঝি, বইটা আদৌ পড়িনি। রাগের চোটে বেসমেন্টে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সময় আমাকে ঠিকঠাক পরিস্থিতি বুঝতে, শান্তি খুঁজে পেতে শিখিয়েছে। প্রতিভা আর অভিভাবকত্বের মিশেলেই দেব সাবকে আজ মনে পড়ে। কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা। ওঁকে নিয়ে কোনও অশ্রদ্ধা সহ্য হয় না।’

নায়িকা সংবাদ: দেবানন্দের সঙ্গে সুরাইয়া।

নায়িকা সংবাদ: দেবানন্দের সঙ্গে সুরাইয়া।

বইটার নাম ‘রোম্যান্সিং উইথ লাইফ।’ দেব আনন্দের আত্মজীবনী। কী ছিল সেই বইয়ে? বন্ধু অমরজিতের বাড়িতে এক পার্টিতে জ়িনাতের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। জ়িনাত তখন সদ্য ‘মিস এশিয়া’ হয়েছেন। দেব তাঁর নতুন ছবি ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’-এর জেনিস চরিত্রটিকে খুঁজছেন। তার পর? “জ়িনাত আমার সামনেই এসে বসল। সব কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো উদ্ধত আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। স্ল্যাকসের ওপর চওড়া বেল্ট থেকে একটা পার্সও ঝুলছে। পার্সে কী রয়েছে, ভাবছি। তখনই জ়িনাতের হাত সেখানে চলে গেল। বেরিয়ে এল এক প্যাকেট দামি সিগারেট। হাতব্যাগ হাতড়ে বার করে আনল সোনালি লাইটার। এ মেয়ের গোটাটাই নিজস্ব ছন্দে চলে, কোথায় কে কী দেখছে না দেখছে পরোয়া করে না। সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝোলাল জ়িনাত, আর তখনই ওর নজর পড়ল আমার দিকে। আমি ওকেই দেখে যাচ্ছি যে! মিষ্টি করে হাসল জ়িনাত, হাত বাড়িয়ে আমাকেও সিগারেট এগিয়ে দিল। তার পর এক বারেই লাইটার বার করে আমার সিগারেটটা ধরিয়ে দিল। লাইটারের শিখায় আরও দীপ্তিমান হয়ে উঠছে ওর হাসি-হাসি দুটো চোখ, ফিসফিস করে তারা বলছে, ‘আমিই তোমার জেনিস, দেব।’”

এই প্রথম দর্শনে প্রেম নেই, আছে এক পরিচালক-প্রযোজকের আবিষ্কারের আনন্দ। এই আবিষ্কারের নেশা দেবকে কখনওই ছেড়ে যায়নি। পরবর্তী কালেও টিনা মুনিম থেকে তব্বু, রিচা শর্মা, অনেকেই তাঁর আবিষ্কার। দেব-ঐতিহ্য শতবর্ষেও তাই অম্লান।

আবিষ্কারকে শুধু প্রথম ব্রেক দিলে হয় না। বিভিন্ন ভঙ্গিতে তার ক্ষমতাকে বারংবার তুলে ধরতে হয়। জ়িনাত কি শুধু নায়কের বোন হিসেবেই রয়ে যাবেন? নবকেতন-এর ব্যানারে দেবের পরের ছবি ‘হিরা পান্না।’ পান্না ওরফে জ়িনাত সেখানে বিজ্ঞাপনী মডেল এবং এয়ারহোস্টেস। নায়ক হিরা ওরফে দেব খ্যাতিমান ফটোগ্রাফার। এ বার আর কাঠমান্ডু নয়, হংকং এবং বেঙ্গালুরুর রাস্তায় শুটিং। নায়ক-নায়িকা পরস্পরকে জানায়, ‘পান্না কি তমন্না হ্যায় কে হিরা মুঝে মিল যায়ে/ চাহে মেরি জান যায়ে, চাহে মেরা দিল যায়ে।’ কিশোরকুমার আর লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েটে তখন জনপ্রিয়তার ঝড়।

তখনও সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার আধিপত্যবাদী প্রেম নেই। সেটা শুরু কলকাতার এক সিনেমাহলে। ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ছবির রজতজয়ন্তী। মঞ্চে উষা উত্থুপ ‘দম মারো দম’ গাইছেন। গাইতে গাইতে সামনের সারিতে বসা জ়িনাতকে ডেকে নিলেন। সহস্র কণ্ঠে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ল, নাচতে নাচতে তারাও স্টেজে উঠে নায়িকাকে তুলে নিল কাঁধে। “ভীষণ গর্ব হল, কিন্তু কোথায় যেন হাল্কা ঈর্ষা, অধিকারবোধও রয়ে গেল। জনতা এ ভাবে জ়িনাতকে নেবে কেন? ও তো শুধু আমারই! জানি, বোকা-বোকা ভাবনা, কিন্তু নিজেকে থামাতে পারলাম না।”

জ়িনাত আমনের সঙ্গে দেব আনন্দ।

জ়িনাত আমনের সঙ্গে দেব আনন্দ।

মধ্যবয়সি, খ্যাতিমান পুরুষের তরুণীর প্রতি দুর্বলতা নতুন ঘটনা নয়। সংসার, সমাজের ভয়ে সেই রোম্যান্সকে বেশির ভাগ সময় চাপা দিয়ে রাখতে হয়। আর সেটা প্রকাশের দিনই যদি ঘটে যায় অবাঞ্ছিত কোনও দুর্ঘটনা? “এক দিন বুঝলাম, আমি প্রবলভাবে জ়িনাতের প্রেমে। ওকে না বলে আর উপায় নেই! তাজ হোটেলে ক্যান্ডল লাইট ডিনারের পরিকল্পনা করেই জ়িনাতকে ফোন করলাম, ‘আজ রাতে তোমার সঙ্গে ডেটে যাব।’

‘কিন্তু আমাদের তো এক সঙ্গে আজ একটা পার্টিতে যাওয়ার কথা।’

‘অবশ্যই। কিন্তু ওখানে কিছু ক্ষণ থেকেই আমরা দু’জন কেটে পড়ব।’

অন্য প্রান্তে নীরবতা। আমি আবার বললাম, ‘হ্যালো।’

‘হ্যাঁ, শুনছি।’

‘ডেট তো?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘যখন বলছ। সি ইউ দেন।’ লাইনটা কেটে গেল।

পার্টিতে যখন পৌঁছলাম, জ়িনাতকে প্রথম অভ্যর্থনা করল রাজ কপূর। রঙিন নেশার ঘোরে রাজের কথা জড়িয়ে গিয়েছে, জ়িনাতকে প্রায় আলিঙ্গন করে বলল, ‘এই তো! এসে গিয়েছ।’

আচমকা পুরো ব্যাপারটা খুব চেনা চেনা ঠেকল। জ়িনাত যে ভাবে রাজের উষ্ণতা ফিরিয়ে দিল, সেটা সৌজন্যের থেকে বেশি কিছু। রাজ ভালবাসা জানাতে সজোরে আমার হাত চেপে ধরল, যেন আমাকে লুকিয়ে কিছু করার অপরাধবোধে ভুগছে।

চকিতে মনে একটা সন্দেহ এল। কয়েক দিন আগে গুজব উড়ছিল, রাজের নতুন ছবি ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’-এর জন্য জ়িনাত স্ক্রিন টেস্ট দিতে গিয়েছে। গুজব তা হলে সত্যি! হৃদয় চুঁইয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হল।”

এখানেই দেব আনন্দ! চিরসবুজ, চিরতরুণ এবং চিররোম্যান্টিক! তাঁর সমসাময়িক দিলীপকুমার থেকে পরবর্তী কালে ঋষি কপূর, অনেকেই আত্মজীবনী লিখেছেন, কিন্তু এই বই দু’টি জায়গায় ব্যতিক্রমী। এক, নায়ক-নায়িকারা আত্মজীবনী লেখেন কোনও অনুলেখকের সাহায্যে। কিন্তু ‘রোম্যান্সিং উইথ লাইফ’ কোনও অনুলিখন নয়, লাহোর কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র দেব আনন্দের নিজের লেখা। সিনেমার বাইরে জওহরলাল নেহরু থেকে মকবুল ফিদা হুসেন, সল বেলো, সমারসেট মম, অনেকেই স্বনামে সেখানে উঁকিঝুকি মেরে গিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, দেবের কোনও ব্যক্তিগত সচিব ছিল না, ভক্ত থেকে সাংবাদিক যে কেউ ফোন করলে নিজেই ধরতেন। এই সজীব, প্রাণবন্ত তারুণ্য অনুলেখকের সাহায্য নিতে যাবে কোন দুঃখে?

দুই, অমৃতা প্রীতম, কমলা দাস বা প্রকাশ কর্মকার ছাড়া বেশির ভাগ ভারতীয় আত্মজীবনী ঢেকেঢুকে লেখা। আর ‘রোম্যান্সিং উইথ লাইফ?’ দেব আনন্দের প্রথম সুযোগ ১৯৪৬ সালে ‘হম এক হ্যায়’ ছবিতে। পুণের প্রভাত স্টুডিয়োয় ছবির শুটিং, গেস্ট হাউসে এক তরুণী এই তরুণের স্মার্টনেসে মুগ্ধ। তার বায়নাক্কায় প্রায়শই দু’জনের শরীরী খেলা, শেষে মহিলা এক দিন জানালেন, পরদিন তাঁর স্বামী আসবেন। এই সম্পর্ক তিনি আর টানতে পারবেন না। পুরুষের প্রথম কৌমার্য ত্যাগের কাহিনিও আছে এই বইয়ে।

শেষ দিনে বিবাহিতা সেই তরুণী দেবকে বলেছিলেন, তাঁর সবচেয়ে ভাল পোশাকটা পরে অভিসারে আসতে। কিন্ত ওয়ারড্রোবে অন্য জামা। লন্ড্রিওয়ালার গাফিলতিতে দেবের জামা গিয়েছে অন্য এক জনের কাছে, তার জামা দেবের কাছে। একটু পরে বদলাবদলির লোকটাকেও খুঁজে পেলেন দেব। অতঃপর দুই তরুণের আড্ডা, দেব প্রতিশ্রুতি দিলেন, ছবি করলে তিনি পরিচালক হিসেবে এই বন্ধুকেই ডাকবেন। নতুন বন্ধুর নাম গুরু দত্ত।

ক্লোজ় শটে দেব আনন্দের সংলাপ লক্ষ করলে দেখবেন, দুটো দাঁতের মাঝে ফাঁক। তাঁর প্রথম ছবি ‘হম এক হ্যায়’ ছবির পরিচালক ছিলেন রাজকুমার সন্তোষীর বাবা পি এল সন্তোষী। ক্যামেরা যাতে নায়কের দুর্বলতা ধরে না ফেলে, সে জন্য দাঁতে ফিলার লাগাতে হবে। দু’-এক দিন সংলাপ আউড়ে পরিচালককে বললেন, “কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফিলারটা বাদ দিলে ভাল হয়, স্যর।” সন্তোষী রাজি। এই যে নিজের দুর্বলতা, এটা কোনও নায়কই নিজ হাতে, নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করেন না। নতুন তারুণ্যের প্রতি পরিচালককে কী ভাবে আস্থা রাখতে হয়, সেটাও যেন নিজের জীবন থেকে শেখা দেব-মহিমা।

নিজে ফোন ধরা, নিজের জীবন নিজে লেখার এই তারুণ্যময় অ্যাডভেঞ্চারের নামই দেব আনন্দ। মানুষটা কেমন ছিলেন, সেটা ধরা আছে ঋষি কপূরের আত্মজীবনী ‘খুল্লম খুল্লা’য়। রাজ কপূর তত দিনে প্রয়াত, চিম্পু বা রাজীব কপূরের বিয়ে। মা বলে দিয়েছেন, নিমন্ত্রণের কার্ড নিয়ে রণধীর আর ঋষিকে যেতে হবে দিলীপকুমার আর দেব আনন্দের বাড়ি। দিলীপকুমার বন্ধুপুত্রদের চমৎকার আতিথ্য দিলেন, সারা ক্ষণই পুরনো দিনের পৃথ্বীরাজজি, কারদার সাব ইত্যাদি গল্প হল। সায়রাবানু চিজ় টোস্ট আর চা নিয়ে এলেন, দিলীপ বললেন, “এটা রাজের খুব প্রিয় ছিল।”

অদূরেই দেব আনন্দের বাংলো। সেখানে বসার ঘর ইংরেজি সাহিত্য আর হলিউডের পোস্টারে ঠাসা। একটু বাদেই হলুদ ট্রাউজ়ার্স, কমলা জামা আর সবুজ সোয়েটার গায়ে ঘরে এলেন দেব। বন্ধুপুত্রদের দেখে তিনিও আনন্দিত, “আরে, তোমরা! চিম্পুর বিয়ে? গুড। বৌ হোক, বান্ধবীও থাকুক। তোমরা এত ভাল দেখতে, গার্লফ্রেন্ড নেই?” আত্মজীবনীতে ঋষি দুই পিতৃবন্ধুর বৈপরীত্যের উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ওই প্রাণবন্ত তারুণ্যের স্রোতে সকলেই ভেসে যেতে বাধ্য হতেন।

খোয়া খোয়া চাঁদ

তা হলে শতবর্ষে তিনি শুধুই বেঁচে থাকবেন সেলুলয়েডের পুরনো ছবি আর ব্যতিক্রমী এক আত্মজীবনীতে? তাঁর প্রাপ্য শুধু ওইটুকুই?

হাল আমলে শাহরুখের ‘জওয়ান’ ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘বেটে কো হাত লাগানেসে পহলে বাপসে তো বাত কর’! ছবির প্রাথমিক চিত্রনাট্যে এই সংলাপ ছিল না, শুটিং-এর সময়ে চটজলদি তৈরি। এই ‘জওয়ান’ বা তারও আগে শাহরুখের ‘ওম শান্তি ওম’, ‘ম্যায় হুঁ না’ বা ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবির এগজ়িকিউটিভ প্রোডিউসার কে? গৌরী খান। রাজ কপূর বা দিলীপকুমাররা স্ত্রীদের অন্দরমহলেই রেখেছেন, কাজের দুনিয়ায় আনেননি। অথচ, দেব আনন্দের বেশির ভাগ প্রযোজনাতেই এগজ়িকিউটিভ প্রোডিউসার তাঁর স্ত্রী কল্পনা কার্তিক। এখানেই দেব-প্রভাব! একুশ শতকের শাহরুখ-জমানাতেও তা অটুট।

তাঁর ছবিতে নায়িকারা সকলেই স্মার্ট এবং স্বাধীন। ‘গাইড’-এর বিবাহিতা ওয়াহিদার প্রত্নতাত্ত্বিক স্বামী এক টক্সিক পুরুষ, স্ত্রীকে মঞ্চে নাচতে দিতে নারাজ। গাইড তাকে ঘুঙুর কিনে দেয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ওয়াহিদা গাইডের প্রেমে পড়ে, ‘গাতা রহে মেরা দিল/ তু হি মেরি মঞ্জিল।’ ‘প্রেমপূজারী’ ছবির গ্রাম্য ওয়াহিদা মিস ইন্ডিয়া হয়ে প্রেমিককে খুঁজতে একাই ইউরোপে পাড়ি দেন, অতঃপর পানভোজনের আসরে নাচতে নাচতে, লতার কণ্ঠে ‘রঙ্গিলা রে’। ১৯৬১ সালে তৈরি ‘হম দোনো’ ছবিতে নায়ক আনন্দ যুদ্ধে গিয়েছে। প্রেমিকা মিতা ওরফে সাধনা তাই আনন্দের বাড়িতে এসে থাকে। তার বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করে। মন্ত্র-পড়া বিয়ের ঢের আগেই। ‘বাজ়ি’তে দেব চাকরি-হারানো বেকার, বাড়িতে বৃদ্ধা মা ও ক্ষয়রোগে আক্রান্ত বোন। তাকে অর্থ দিয়ে, নানা ভাবে সাহায্য করে প্রেমিকা কল্পনা কার্তিক। সে নিজে ডাক্তার! ‘কালা বাজ়ার’ ছবিতে দেব সিনেমা টিকিটের ব্ল্যাকার। ওয়াহিদা রহমান কলেজপড়ুয়া ছাত্রী, প্রেমিক বিজয় আনন্দ ব্ল্যাকে টিকিট কিনলে তার আপত্তি। এ দিকে ব্ল্যাকার ওয়াহিদার প্রেমে, তার পিছু পিছু উটি চলে যায়। বিজয় আনন্দ তখন বিদেশে, সে এবং ওয়াহিদা পরস্পরকে চিঠি লেখে। এই ছবিতেই উটির পাহাড়ি প্রেক্ষাপটে দেবের কণ্ঠে মহম্মদ রফির বিখ্যাত গান ‘খোয়া খোয়া চাঁদ, খুলা আসমাঁ’। অতঃপর ওয়াহিদা দেবের প্রতি দুর্বল, বিজয়কে চিঠি লিখে মুক্তি চায় সে। প্রেমই আসল, ছকে বাঁধা বাগদত্তা রূপ নয়। ‘মুঘল-ই-আজ়ম’ ছবির অসহায় আনারকলি বা ‘আওয়ারা’ ছবির ভঙ্গুর বেবি নয়, সেই সময়েও দেব মেয়েদের স্বনির্ভরতার কথাই বলেছেন। পরিবারে রোজগেরে মেয়ে হয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ‘স্ব-ক্ষমতা’ না থাকলে কী হয়, তিনি মর্মে মর্মে জানেন!

একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্প

“…জ়াভেরি বাজারে গিয়ে তখনকার সবচেয়ে দামি আংটিটা কিনলাম। আমার সুরাইয়ার আঙুলে এনগেজমেন্ট রিং হিসেবে এই আংটিটাই মানাবে। বাড়িতে এসে ওর নম্বর ডায়াল করলাম। কিন্তু ফোন ধরলেন ওর দিদিমা। খ্যাঁচাড়েমার্কা গলাটা চিনতে পেরেই রিসিভার নামিয়ে রেখেছি। এক ঘণ্টা পরে আবার ফোন। এ বারেও সেই দিদিমা। সন্ধেবেলা ফোন করলাম, আবারও দিদিমার গলা, ‘হ্যালো।’ বুঝলাম দিদিমা ফোনের সামনেই। প্রত্যেকটা কল নিজে নিয়ে তার পর সুরাইয়াকে দেবেন।

আবার দ্বিভেচাকে ফোন করলাম। আমার সেই সিনেমাটোগ্রাফার বন্ধু। আমার গলা শুনেই দ্বিভেচার প্রশ্ন, “কী ব্যাপার? আবার প্রেমের চিঠি পাঠাতে হবে?”

“না, চিঠি নয়। এ বার এনগেজমেন্টের আংটি।”

“দারুণ,” দ্বিভেচা হাসল, “আমার ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা তা হলে কবে পাচ্ছি?”

আংটিটা নিয়ে দ্বিভেচা সত্যিই সুরাইয়াদের বাড়িতে গেল। ফিরে এসে খুশি আর ধরে না। আমাকে বলল, “সুরাইয়া আংটি দেখে মুগ্ধ। চুপি চুপি ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে গয়নার বাক্সে রেখে দিয়েছে। বার বারই বলছিল, ও তোকে কী দারুণ ভালবাসে, দেব।”

তত ক্ষণে আমি সপ্তম স্বর্গে। এ বার আমরা এনগেজড। এই অপেক্ষা আর সহ্য হয় না, এত দিনে ও সত্যিই আমার। আমি ওকে চাই, আরও আরও বেশি ক্ষণ, সারাটা জীবন দিয়ে ওকে পেতে চাই। কিন্তু দিন গড়িয়ে সপ্তাহ চলে যায়, ও দিক থেকে এতটুকু সাড়া এল না। একটা ফোন, চিরকুট কিচ্ছু না। ওর দিদিমার দৌলতে নায়ক-নায়িকা সেজে আমাদের অভিনয় করা ইতিমধ্যে বন্ধ, কিন্তু এ বার? সত্যিই সুরাইয়ার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না?

আবার দ্বিভেচার শরণাপন্ন হলাম, দ্বিভেচা আমাকে বুঝিয়েসুজিয়ে হরেক স্তোকবাক্য দিয়ে ফের সুরাইয়াদের বাড়ি গেল। কিন্তু এ বার ওকেও ঢুকতে দেওয়া হল না। দরজা আগলে দিদিমা জানালেন, ‘শোনো হে, আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এখন বাড়িতে আর অ্যালাও করছি না।’

দ্বিভেচার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। এখানে ওখানে খোঁজ নিয়ে সে আবিষ্কার করল, সুরাইয়াদের পরিবারে এখন রীতিমতো ফাটল। সুরাইয়ার মা ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ তার প্রেমটা সমর্থন করছেন না। দিদিমা হুমকি দিয়েছেন, সুরাইয়া যদি বাড়ির বিরুদ্ধে যায়, তিনি আত্মহত্যা করবেন। সুরাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির চাপের কাছে মাথা নুইয়েছে। আমার দেওয়া আংটি নিয়ে এক দিন সমুদ্রের ধারে চলে গিয়েছিল। আমাদের ভালবাসার কথা ভাবতে ভাবতে আংটিটা সমুদ্রে ছুড়ে দিয়েছে।…”

এই দ্বারকা দ্বিভেচাই পরবর্তী কালে ‘শোলে’ ছবির সিনেমাটোগ্রাফার। এই প্রেমের সময় দেব উঠতি নায়ক, সুরাইয়া গায়িকা এবং নায়িকা হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে। স্টুডিয়োয় আসেন নিজস্ব মেক-আপ ম্যান, পরিচারিকাকে নিয়ে।

খ্যাতি এবং অর্থের শিখরে থেকেও সে দিন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি সুরাইয়া। পরে বিয়েও করেননি, প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় ২০০৪ সালে মুম্বইয়ের হাসপাতালে মারা গেলেন। সেই ঘটনাই কি দেবের ছবির বিভিন্ন গল্পকে বারংবার স্বনির্ভর নায়িকার দিকে ঠেলে দিয়েছে?

উত্তরাধিকার

লাহোরের মেয়ে সুরাইয়া ধর্মে মুসলমান। গুরুদাসপুরের ছেলে দেব ধর্মে হিন্দু। চমকপ্রদ ভাবে তাঁর ছবিতে বারংবার আসে রাম নাম। ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’-এ ‘রামকা নাম বদনাম না করো’, ‘গাইড’ ছবির শেষে ভণ্ড সাধুর জন্য গ্রামবাসীর ‘হে রাম’ ভজন। ১৯৭০ সালে তৈরি ‘প্রেমপূজারী’র গল্পে নায়কের নামই রামদেব। সে একটা প্রজাপতি মারতেও নারাজ, কিন্তু দেশরক্ষার জন্য নাথু লা সীমান্তে যুদ্ধে যায়। ছবির শেষে গ্রামে শত্রুর সাঁজোয়া গাড়ি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই তাদের বিরুদ্ধে। গাইডেও খরাক্লিষ্ট গ্রামে রামের ভজনের পাশাপাশি ‘আল্লা মেঘ দে’ গান। এই রাম বিজেপি-র রাম নয়, টক্সিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় বিভাজনে বরাবরই নারাজ ছিলেন তিনি।

ধরমদেব পিশোরীমল আনন্দ এই রকমই। ১৯৪৬ সালে সেনাবিভাগে সেন্সর অফিসের চাকরি ছেড়ে এক দিন সটান হাজির প্রযোজক বাবুরাম পাইয়ের অফিসে। বাবুরামের জিজ্ঞাসা, ‘কী নাম?’

‘দেব আনন্দ স্যর।’

‘সে কী? শুধু দেব আনন্দ?’

‘আনন্দ আমার পদবি, স্যর। আগে একটা ধরম আছে। কিন্তু চতুর্দিকে ধর্ম নিয়ে যা হানাহানি, ধরমটা তাই উড়িয়ে দিয়েছি। এখন শুধুই দেব আনন্দ।’

এই অসাম্প্রদায়িক উত্তরাধিকারে গণনাট্য সঙ্ঘ বা আইপিটিএ-এর হালকা ভূমিকা আছে। মুম্বইয়ে নবাগত দেব তখন দাদা চেতন আনন্দের বাংলোয় থাকেন। চেতন সদ্য ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছেন। কিন্তু নৌবিদ্রোহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সেই বাজারে তাঁর পালি হিলের বাংলো অন্য রকম। তাঁর বাঙালি স্ত্রী উমা চট্টোপাধ্যায় লাহোর কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপকের কন্যা। বাংলোয় প্রায়ই বলরাজ সাহনি, খাজা আহমদ আব্বাস, শহিদ লতিফ ও তাঁর স্ত্রী ইসমত চুঘতাইদের আড্ডা। সকলেই লেখালিখি, নাটক বা ছবি তৈরির স্বপ্নে বিভোর। দেব তো চেতনের ছোট ভাই, বাচ্চা বলে কেউ নাটক করতে ডাকে না। পরে শহিদ লতিফ তাঁকে ডেকে বোম্বে টকিজ়-এ নিয়ে গিয়ে অশোককুমারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। দেব কোনও দিনই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না, কিন্তু ছকভাঙা চেতনায় বিশ্বাসী। নায়িকা কল্পনা কার্তিকের সঙ্গে অনাড়ম্বর রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরেছিলেন ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবির শুটিং-এর ব্রেকে। অযথা পুরুত ও প্রেসকে ডেকে হইচই করতে হবে কেন? একদা ‘মিস শিমলা’ কল্পনা আবার দেবের বাঙালি বৌদি উমার আবিষ্কার। আইপিটিএ আজ মৃত, কিন্তু দেব শতবর্ষেও অম্লান।

দেব আনন্দ কি শুধু ওইটুকুই? বরাবর পাহাড়প্রেমী, শিমলা ও ম্যাকলিয়ডগঞ্জের স্কুলজীবনে প্রায়ই ট্রেকিংয়ে যেতেন। ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ছবির শুটিং নেপালে, ‘জুয়েল থিফ’ তৎকালীন চোগিয়ালের রাজ্য সিকিমে। জ়িনাত, শেখর কপূর, শাবানাকে নিয়ে ‘ইশক ইশক ইশক’ ছবি এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের রাস্তায় নামচেবাজার, থিয়াংবোচে গ্রামে। আজ যখন অমিতাভ বচ্চন, অনুপম খেররা ওই রাস্তায় ‘উঁচাই’ ছবি করেন, গড়পরতা বাঙালি পিঠে রাকস্যাক আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাহাড়পথে, সর্বত্র রয়ে যায় দেব-মহিমা।

শুধুই পাহাড়পথ? রাজ কপূর, দেব আনন্দ ও দিলীপকুমারের বিখ্যাত ত্রয়ীর মধ্যে দেবই মারা গিয়েছিলেন প্রবাসে, লন্ডন শহরে। তাঁর শেষকৃত্যও হয়েছিল সেখানেই। দেবের শতবার্ষিকীর বছরে ছেলে সুনীল এখন লন্ডনে, কল্পনা কার্তিক মেয়ে দেবিনার কাছে বেঙ্গালুরুতে।

শেষ দিকে ‘স্বামী দাদা’, ‘সেন্সর’, ‘লাভ অ্যাট টাইমস স্কোয়ার’-এর মতো তাঁর বেশির ভাগ ছবিই ফ্লপ। কিন্তু টিনা মুনিমকে নিয়ে ‘দেশ পরদেশ’? হিন্দি ছবিতে সেই প্রথম বিলেতের বেআইনি অভিবাসী ভারতীয়-আখ্যান। আজকের অমিতাভ ঘোষ, সলমন রুশদিদের বিশ্বজয়েও কি নেই সেই দেব-কাহিনি?

আর কে নারায়ণের কাহিনি ‘গাইড’ এ দেশে হিন্দির পাশাপাশি তোলা হয়েছিল ইংরেজিতেও। পরিচালক আলাদা। ইংরেজি ভার্সনের ছবিটায় সাহায্য করেছিলেন নোবেলজয়ী লেখিকা পার্ল বাক। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক এবং বলিউডের গাঁটছড়া সেই প্রথম এবং শেষ। মনে পড়ছে, দেবের ‘সিআইডি’ ছবিতে দুই নারীর আত্মপ্রকাশ। প্রথম জন ক্যামেরার সামনে, ওয়াহিদা রহমান। দ্বিতীয় জন পিছনে। জে জে স্কুল অব আর্টস থেকে সদ্য পাশ করে বেরোনো এক তরুণী, ভানু আথাইয়া। তিনিই ছবির কস্টিউম ডিজ়াইনার। ‘গাইড’ ছবিতেও এঁরা। পরে অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ ছবিতে কস্টিউম ডিজ়াইনের জন্য ভানু আথাইয়াই প্রথম অস্কারজয়ী ভারতীয়। মেনস্ট্রিম হিন্দি ছবির বিশ্বজয়ে তাই দেবই পথিকৃৎ।

এমনকি প্রতিবেশী দেশেও! আজ ফওয়াদ খান, আলি জ়াফর থেকে হুমাইমা, অনেক পাকিস্তানি অভিনেতা-অভিনেত্রী মুম্বইয়ের ফিল্মে অভিনয় করেন। এরও শুরুয়াত দেব আনন্দ থেকে! ক্রিকেটের গল্পভিত্তিক ‘আওয়াল নম্বর’ ছবির জন্য তিনি নায়কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখনকার সুদর্শনতম ক্রিকেটারকে। ইমরান খান! ক্রিকেট ছেড়ে পরে রাজনীতিতে এলেও ইমরান তখন সিনেমায় আসার সাহস পাননি। চরিত্রটা শেষ অবধি করেছিলেন আমির খান।

শেষ কথা

কেন দেবের আত্মজীবনী ব্যাতিক্রমী? নিঃসঙ্কোচে সব কিছু প্রকাশের জন্য? বইয়ের শুরুতেই ২০০৩ সাল, নিউ ইয়র্কের পাঁচতারা ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া হোটেলে রয়েছেন দেব। টিভিতে জর্জ বুশের ইরাক আক্রমণ। আর একটু আগে যে লবিটা পেরিয়ে ঘরে এলেন? থরে থরে সাজানো হেমিংওয়ে, জেমস জয়েসদের ছবি। কোনও বলিউড-নায়কের স্মৃতিকথায় এ ভাবে হানা দেয়নি ইংরেজি সাহিত্য।

আসলে মানুষটা আজন্ম রোম্যান্টিক। দিন কয়েক আগে ‘রকি অওর রানি’ ছবিতে বৃদ্ধ ধর্মেন্দ্র পুরনো প্রেমিকা শাবানাকে দেখে যে গানটা গাইলেন, ‘আভি না যাও ছোড় কর’, সেটা দেবের ‘হম দোনো’ ছবির গান। এই করণ জোহর যুগেও রোম্যান্সের অন্য নাম দেব আনন্দ!

মৃত্যুর বছর চারেক আগেও এসেছেন কলকাতায়। ২০০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বেরোয় ওই আত্মজীবনী। পরের দিনের আনন্দবাজারে দেখছি, প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আর হিট করে না তাঁর ছবি! সহাস্য উত্তর, “আসল কথাটা কী জানেন? নিজের কাজটা আপনি উপভোগ করছেন কি না! যদি উপভোগ করেন, আপনার লেখা কে পড়ল না-পড়ল, কী আসে যায়! লিখে আনন্দ পাচ্ছেন কি না, সেটাই বড় কথা। আমি ছবি করতে ভালবাসি, ব্যস! কে দেখল না দেখল থোড়াই যায় আসে।”

শতবর্ষের শুভেচ্ছা, দেব সাব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dev Anand Jinat Aman Bollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE