Advertisement
E-Paper

ও তো মেয়ে, সায়েন্স পড়বে কী

এই মানসিকতার মূর্তিমতী প্রতিবাদ ছিলেন উ চেং-শুন। বিজ্ঞানজগতে মেয়েরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, লক্ষ রেখেছিলেন সে দিকে। এই মানসিকতার মূর্তিমতী প্রতিবাদ ছিলেন উ চেং-শুন। বিজ্ঞানজগতে মেয়েরা যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, লক্ষ রেখেছিলেন সে দিকে।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০০:০৮
বিজ্ঞানী: উ চেন-শুং। পদার্থবিদ্যার দুনিয়া তাঁকে চেনে ‘ফার্স্ট লেডি অব ফিজিক্স’ নামে

বিজ্ঞানী: উ চেন-শুং। পদার্থবিদ্যার দুনিয়া তাঁকে চেনে ‘ফার্স্ট লেডি অব ফিজিক্স’ নামে

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর টুইট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। মন্ত্রী গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের গ্রামে, সেখানে স্থানীয় মহিলারা স্যানিটারি প্যাড তৈরির ইউনিট চালাচ্ছেন। দেখে মন্ত্রীর টুইট: এই মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করে বেশ লাগল, ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছবি। অমনি জবাবি টুইটের বান: বেশ কথা, কিন্তু ছবিতে এই কর্মযজ্ঞের কান্ডারি মহিলারা কোথায়? মন্ত্রীমশাই নিজে সপার্ষদ (সকলেই পুরুষ) অকুস্থলে বসে আছেন, সহাস্যবদন! এক জনের ঠাট্টা: এই ছবিতে মেয়েদের খুঁজে বার করুন, সফল হলে একটি প্যাড এক টাকায়... মন্ত্রী তড়িঘড়ি আর একটি ছবি দিলেন, এ বার সেই কর্মী নারীদের সঙ্গে।

ছোট ঘটনা। কিন্তু বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনও করায়, স্পষ্ট করে দেয় একুশ শতকে মেয়েদের দেখার চোখকে। এ তো নাহয় ভারতের অজগ্রামের শ্রমজীবী নারী, কিন্তু মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের ছবি খাস বিলেতেও কম কি? বিখ্যাত ওয়েব-সিরিজে খোদ রানি এলিজ়াবেথের চরিত্রে অভিনয় করছেন যে অভিনেত্রী, জানা গেল, রানির স্বামীর চরিত্রে রূপদানকারী পুরুষ অভিনেতাটির চেয়ে তাঁর পারিশ্রমিক পর্ব-পিছু ১০ হাজার পাউন্ড কম! অথচ মেয়েটিরই মুখ্য চরিত্র! জানাজানি হতে প্রযোজকরা ঢোক গিললেন, ইয়ে মানে... কিছু টাকা বাকি ছিল, দিয়ে দিচ্ছি। দু’লক্ষ পাউন্ড ‘বকেয়া’ পাওনা পেলেন অভিনেত্রী! খবর চাউর না হলে পেতেন কি?

মেয়েদের ‘সমান প্রাপ্য’ কাড়তে প্রথম কি তৃতীয় বিশ্ব দুইই সমান। আর পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া আছে এই ফর্মুলা: মেয়ে=দুর্বল; বুদ্ধিশুদ্ধির দিক দিয়েও কমজোরি। সেলাইফোড়াই বাদে সেকেলে বাংলায় মেয়েদের অবসর বিনোদন ছিল ‘নাটক-নভেল পড়া’, উদাহরণ বাংলা সাহিত্যেই ভূরি ভূরি। ভাবটা এই, সাহিত্য নরমসরম, মেয়েদের সঙ্গে যায় ভাল। মেয়ে হয়ে অঙ্ক করছে, বিজ্ঞানে মুখ গুঁজে আছে, নিতান্ত বেখাপ্পা। বিশ শতকের আমেরিকা যেমন উ চেন-শুং’কেও ছেড়ে কথা বলেনি। ইতিহাস তাঁকে ‘ফার্স্ট লেডি অব ফিজিক্স’ ডাকে বটে, কিন্তু এও সত্য, তাঁর করা এক্সপেরিমেন্টের সূত্রে অন্য দুই পদার্থবিদ নোবেল পেলেও, চেন-শুং পাননি!

চিনা ভাষায় ‘চেন-শুং’ কথাটার অর্থ ‘নির্ভীক নায়ক’। ১৯১২ সালে চিনের এক ছোট্ট শহরে জন্মানো মেয়েটার নাম বাবা এমনটাই রেখেছিলেন। বাবাও আসলে এক নির্ভীক নায়ক, নিজেই তৈরি করেছিলেন শুধু মেয়েদের পড়ার জন্য একটা স্কুল। মনে রাখতে হবে, তখনও পর্যন্ত চিনে ‘ফুট বাইন্ডিং’ চালু, কি না, মেয়েদের পা সুন্দর থাকবে। চেন-শুং’এর ‘হেডমাস্টার’ বাবা সেখানে ছোটবেলাতেই মেয়েকে ধরিয়ে দিচ্ছেন বিজ্ঞানের মজা। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে আমেরিকায় রিসার্চ করতে যাওয়া— সবই হয়েছিল অনায়াসে।

১৯৩৬। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে এসে চেন-শুং অবাক হয়ে দেখলেন, ঝাঁ-চকচকে ‘স্টুডেন্ট সেন্টার’-এর সদর দরজা দিয়ে মেয়ে পড়ুয়াদের যাওয়া-আসার অনুমতি নেই! ঢুকতে হবে পাশের একটা দরজা দিয়ে। অথচ এটা আমেরিকা! এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রতিভা আর কাজই মানুষের পরিচয়, জাতপাত বা লিঙ্গ-পরিচিতি নয়— এমনই ধারণা ছিল তাঁর। ঘটনাচক্রে বার্কলে-র ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়ায় গেলেন, সেখানে ‘রেডিয়েশন ল্যাবরেটরি’-র ডিরেক্টর, বিখ্যাত পদার্থবিদ আর্নেস্ট লরেন্স-এর সঙ্গে পরিচয়। এখানে কাজের পরিবেশ খোলামেলা, চেন-শুং পড়ুয়া-গবেষক হিসেবে যোগ দিলেন। গবেষণার কাজ দ্রুতি পেল, সফল হল। ১৯৪০-এ ডক্টরেট হলেন চেন-শুং। কিন্তু খুব ভাল প্রোফাইল থাকা সত্ত্বেও, আর্নেস্ট লরেন্সের শংসাপত্রের পরেও, কী এক অজানা কারণে বার্কলে তাঁকে চাকরি দিল না!

এই ‘অজানা কারণ’ পরেও তাঁর পিছু ছাড়েনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৪ সালে চেন-শুং যোগ দেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই বিশেষ ধরনের তেজস্ক্রিয়তা (বিটা কণা নিঃসরণ) নিয়ে তাঁর কাজ হয়ে ওঠে বিশ্ববন্দিত। অথচ এই কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিই অন্তত আট বছর সময় নিয়েছিল তাঁর যোগ্য মর্যাদা দিতে। ১৯৫৬ সালে দুই চিনা-আমেরিকান পদার্থবিদ— সুং দাও লি ও চেন নিং-ইয়াং— তাঁদের কাজের সূত্রে চেন-শুং’কে অনুরোধ করেন একটা এক্সপেরিমেন্ট করার। ‘বিটা কণা নিঃসরণ’-এর সময় পদার্থবিদ্যার ‘ল অব কনজ়ার্ভেশন অব প্যারিটি’ (প্রকৃতি সাম্য ব্যাপারটা মেনে চলে) যে খাটে না, সেই নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। তাবড় বিজ্ঞানীরা সন্দিহান ছিলেন এই এক্সপেরিমেন্টের সাফল্যের হার নিয়ে (রিচার্ড ফাইনম্যান ৫০ ডলার বাজি লড়ে হেরেছিলেন), স্বয়ং চেন-শুং বলেছিলেন, সাফল্যের সম্ভাবনা দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তাঁর সেই এক্সপেরিমেন্ট সফল হল, পাল্টে দিল এত দিন যাকে ‘ল অব নেচার’ ভাবা হত, তাকে। নিউইয়র্ক পোস্ট লিখেছিল: ‘এই ছোটখাটো, নিরভিমান মহিলাটি এমনই শক্তিময়ী, যে, একটা সৈন্যবাহিনী যা পারে না, তিনি তা পারেন। প্রকৃতির একটা সূত্র ধ্বংস হয়েছে তাঁর হাতে; আর কে না জানে, প্রকৃতির সূত্রগুলো তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ীই, নিত্য, নিরবচ্ছিন্ন, অপরিবর্তনীয়, অক্ষয়!’

১৯৫৭ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন সুং দাও লি ও চেন নিং-ইয়াং। অদ্ভুত ব্যাপার, যাঁর করা এক্সপেরিমেন্টের জোরে তাঁদের তত্ত্ব মান্যতা পেল, সেই চেন-শুং নোবেল পেলেন না! স্বভাববিনয়ী চেন-শুং এ নিয়ে কিছু বলেননি। কয়েক বছর পর এমআইটি-র এক সম্মেলনে শুধু এটুকু বলেছিলেন, ‘‘কী জানি, ক্ষুদ্র অণু বা নিউক্লিয়াস, বা ম্যাথমেটিক্সের সিম্বল, বা ডিএনএ পরমাণু— পুরুষ না নারী কে তাদের নিয়ে নাড়াচাড়া করল তা নিয়ে ওদের কোনও পছন্দ-অপছন্দ আছে কি না!’’

বক্তৃতা দিতে সারা বিশ্ব ঘুরেছেন। মেয়েরা বিজ্ঞানের জগতে আসুক, চাইতেন খুব। কাজ ভালবাসতেন এতটাই যে বলতেন, ‘‘ল্যাব থেকে ফিরে সিঙ্ক-ভর্তি নোংরা বাসনপত্র মাজার থেকে খারাপ জিনিস শুধু আর একটাই হতে পারে— আর কখনও ল্যাবে না যাওয়া।’’ আর নিজের দীর্ঘ বিজ্ঞান-জীবনে যে চোরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তা যেন আর কোনও মেয়ের জীবনে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, লক্ষ রাখতেন। বলতেন, ‘‘নারীদের বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি বোঝার মতো বোধবুদ্ধি নেই— কোনও প্রকৃত মুক্তমনা ব্যক্তি যে সত্যিই এই ধারণায় বিশ্বাসী হতে পারেন, সে নিয়ে তীব্র সন্দেহ আছে আমার।’’

Chien-Shiung Wu First Lady of Physics Nuclear physicist Dragon Lady Madame Wu Chinese Marie Curie উ চেং-শুন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy