প্রথমেই ধন্যবাদ দিই, আমার ছেলেবেলা নিয়ে লিখতে বলেছেন বলে, আমার মেয়েবেলা নিয়ে নয়। ইদানীং কথাটি আদেখলেপনা করে প্রায়ই না বুঝে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘মেয়েদের ছেলেবেলা’ বোঝাতে। আমার বিপুল আপত্তি তাতে। মেয়েবেলা শুরু হয় মেয়ে হয়ে ভুমিষ্ঠ হওয়া মাত্র, আর সমাপ্ত হয় মরণে। দুর্বৃত্তরা সেটা আমাদের ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। অতএব আমরণ মেয়েবেলার বোঝা বইলেও মেয়েদেরও এক টুকরো ছেলেবেলা থাকে বইকী! ছেলেবেলা সেই সময়টি, যখন আমরা নিশ্চিন্তে ছেলেখেলায় মেতে থাকি। ছেলেখেলাতে ছেলেমেয়ে সকলের ছেলেবেলার সমান অধিকার (‘মেয়েখেলা’টা যে ঠিক মেয়েদের খেলা নয়, সকলেই তা জানি)। অতএব ভূমিকা সমাপ্ত। ছেলেবেলার পাতা ওলটানো শুরু।
শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। জানালা খোলা। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে গেছেন মা। কিন্তু আমার চোখ আবার খুলে গেছে। সামনের সাদা দেওয়ালে এখন সিনেমা হচ্ছে। মুগ্ধ চোখে তা-ই দেখছি। রাস্তা দিয়ে গাড়ি গেলেই অমনি আমার দেওয়ালে আশ্চর্য সব চলন্ত ছায়াছবি ফুটে উঠছে। আমাদের ঘুলঘুলিগুলো বাবার এঁকে দেওয়া সুন্দর ডিজাইনের সিমেন্টের কারুকাজ করে তৈরি। রাস্তা দিয়ে কোনও আলো গেলেই কোনও উপায়ে সেই আলো এসে চুপিচুপি ঢুকে পড়ত আমাদের ঘুলঘুলি দু’টোর ফাঁকে, আর এই ঘরের সঙ্গে জড়িয়ে যেত বুঝি ক্ষণিকের জন্য। মুহূর্তের মধ্যে চলন্ত আলোয় আশ্চর্য ছায়া-আলো আলপনার চলচ্চিত্র তৈরি হত ছাদের কাছাকাছি দেওয়ালের পটে, কখনও সোজা, কখনও তেরছা। গাড়ি চলে যেত, দেওয়ালের আলোকিত ছায়াচিত্র মিলিয়ে যেত তার পিছু পিছু। চিহ্ন না রেখে। যেন ঘটেনি কখনও। আবার গাড়ি আসত, আবার তৈরি হত ছায়া-আলোর বাজনাবিহীন নাচ, আমার নিবে-আসা চেতনার সঙ্গে খেলা করত সেই চলন্ত আলো-ছায়ার জাদুকরি চকরাবকরা, মাঝে মাঝে গাড়ির বেসুরো হর্ন আমার ছায়াচিত্রের ছন্দ ভেঙে দিয়ে যেত। আলো-ছায়ার এই নাচ দেখতে দেখতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়তুম। কিন্তু এই আলোর সঙ্গে ছায়ার খেলা দেখার গল্পটা মা’কেও বলিনি, জানতুম বোঝাতে পারব না কথা বলে। মা নিজে না দেখলে হবে না। আর মা ঘরে থাকলে তো ব্যাপারটাই হবে না! বলবেন, চোখ বুজে রাখো!
চাঁদের আলোর বান ডেকেছে। আহা, হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি-ঘর সব দুধে ধোওয়া। মনে হচ্ছে অচিন দেশ, কোনও স্বপ্নপুরী। আমাদের গরমের ছুটি। শরীর মন হালকা।