Advertisement
E-Paper

‘মেয়েদেরও এক টুকরো ছেলেবেলা থাকে বইকী’

ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর সঙ্গে ছায়া মিশে আশ্চর্য আলপনা। হাইড্র্যান্টের জল উপচে রাস্তা কখনও নদী, জল সরে গেলে জেগে থাকত ধবধবে সাদা গঙ্গামাটির পলি। কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় দিনে দু’বার মেঘ জমত আকাশে।ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর সঙ্গে ছায়া মিশে আশ্চর্য আলপনা। হাইড্র্যান্টের জল উপচে রাস্তা কখনও নদী, জল সরে গেলে জেগে থাকত ধবধবে সাদা গঙ্গামাটির পলি। কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় দিনে দু’বার মেঘ জমত আকাশে।

নবনীতা দেব সেন।

নবনীতা দেব সেন।

নবনীতা দেব সেন

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০০:৫১
Share
Save

প্রথমেই ধন্যবাদ দিই, আমার ছেলেবেলা নিয়ে লিখতে বলেছেন বলে, আমার মেয়েবেলা নিয়ে নয়। ইদানীং কথাটি আদেখলেপনা করে প্রায়ই না বুঝে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘মেয়েদের ছেলেবেলা’ বোঝাতে। আমার বিপুল আপত্তি তাতে। মেয়েবেলা শুরু হয় মেয়ে হয়ে ভুমিষ্ঠ হওয়া মাত্র, আর সমাপ্ত হয় মরণে। দুর্বৃত্তরা সেটা আমাদের ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। অতএব আমরণ মেয়েবেলার বোঝা বইলেও মেয়েদেরও এক টুকরো ছেলেবেলা থাকে বইকী! ছেলেবেলা সেই সময়টি, যখন আমরা নিশ্চিন্তে ছেলেখেলায় মেতে থাকি। ছেলেখেলাতে ছেলেমেয়ে সকলের ছেলেবেলার সমান অধিকার (‘মেয়েখেলা’টা যে ঠিক মেয়েদের খেলা নয়, সকলেই তা জানি)। অতএব ভূমিকা সমাপ্ত। ছেলেবেলার পাতা ওলটানো শুরু।

শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। জানালা খোলা। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে গেছেন মা। কিন্তু আমার চোখ আবার খুলে গেছে। সামনের সাদা দেওয়ালে এখন সিনেমা হচ্ছে। মুগ্ধ চোখে তা-ই দেখছি। রাস্তা দিয়ে গাড়ি গেলেই অমনি আমার দেওয়ালে আশ্চর্য সব চলন্ত ছায়াছবি ফুটে উঠছে। আমাদের ঘুলঘুলিগুলো বাবার এঁকে দেওয়া সুন্দর ডিজাইনের সিমেন্টের কারুকাজ করে তৈরি। রাস্তা দিয়ে কোনও আলো গেলেই কোনও উপায়ে সেই আলো এসে চুপিচুপি ঢুকে পড়ত আমাদের ঘুলঘুলি দু’টোর ফাঁকে, আর এই ঘরের সঙ্গে জড়িয়ে যেত বুঝি ক্ষণিকের জন্য। মুহূর্তের মধ্যে চলন্ত আলোয় আশ্চর্য ছায়া-আলো আলপনার চলচ্চিত্র তৈরি হত ছাদের কাছাকাছি দেওয়ালের পটে, কখনও সোজা, কখনও তেরছা। গাড়ি চলে যেত, দেওয়ালের আলোকিত ছায়াচিত্র মিলিয়ে যেত তার পিছু পিছু। চিহ্ন না রেখে। যেন ঘটেনি কখনও। আবার গাড়ি আসত, আবার তৈরি হত ছায়া-আলোর বাজনাবিহীন নাচ, আমার নিবে-আসা চেতনার সঙ্গে খেলা করত সেই চলন্ত আলো-ছায়ার জাদুকরি চকরাবকরা, মাঝে মাঝে গাড়ির বেসুরো হর্ন আমার ছায়াচিত্রের ছন্দ ভেঙে দিয়ে যেত। আলো-ছায়ার এই নাচ দেখতে দেখতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়তুম। কিন্তু এই আলোর সঙ্গে ছায়ার খেলা দেখার গল্পটা মা’কেও বলিনি, জানতুম বোঝাতে পারব না কথা বলে। মা নিজে না দেখলে হবে না। আর মা ঘরে থাকলে তো ব্যাপারটাই হবে না! বলবেন, চোখ বুজে রাখো!

চাঁদের আলোর বান ডেকেছে। আহা, হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি-ঘর সব দুধে ধোওয়া। মনে হচ্ছে অচিন দেশ, কোনও স্বপ্নপুরী। আমাদের গরমের ছুটি। শরীর মন হালকা।

কলেজ-শেষের সমাবর্তনের পোশাকে

রাস্তার ধারে ধারে মাঝে মাঝেই যে ফুটপাতে গর্ত করে বসানো গঙ্গাজলের চ্যাপটা কল আছে, মা বলেছেন, কখনও কোথাও আগুন লাগলে দমকল ওইখান থেকে জল নেবে বলে ওগুলো তৈরি। আসল গঙ্গানদীর সঙ্গে মাটির তলা দিয়ে নাকি যোগ আছে ওই রাস্তার ধারের কলগুলোর। ভেবে আমার তো বুক গুড়গুড় করতে থাকে, হঠাৎ এক দিন যদি গঙ্গানদীতে বিরাট বন্যা আসে আর এই সবগুলো হাইড্র্যান্ট একসঙ্গে খুলে যায়? আর সারা শহর ডুবে যায়? অতটা হয়নি বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে হাইড্র্যান্টেও বান ডাকত। সারা দিন ধরে ফুলে ফুলে জল বেরিয়ে আসত, ঢাকনি খুলে রাখা হাইড্র্যান্ট থেকে। উপচে পড়ত রাস্তায়। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে সারা দিন-রাত কী চমৎকার ঘোলা জলের বন্যা বইয়ে দিত! ঠিক যেন ছোট্ট একটা নদী ঠিকানা ভুলে এসে পড়েছে হিন্দুস্তান পার্কে। ওই ব্যাপারখানাতে আমার খুব আগ্রহ ছিল। বুড়োদা বলেছিলেন, ওর মধ্যে নাকি গামছা দিয়ে বাঁধ দিয়ে বসে থাকতে পারলে কুচো মাছ ধরা পড়ে। আমি সে চেষ্টা করিনি, অত ক্ষণ চুপ করে বসে থাকতেই পারি না আমি! যা ছটফটে স্বভাব! মা বলেন, ধৈর্য বলে কিছু আমার শরীরে নেই। মাছ ধরার জন্য অন্য রকম মন চাই। মাছের কথা অপ্রাসঙ্গিক, আসল কথা, অত জল বয়ে যাচ্ছে বাড়ির সামনে দিয়ে, পাড়ার মধ্যে দিয়ে, জলে নামতে হবে না? জুতো-মোজা খুলে রেখে যত ক্ষণ সম্ভব ছপছপ করে খালি পা ডুবিয়ে সেই জলের মধ্যে খেলা করতুম, ফ্রকের নীচটা গুটিয়ে নিয়ে, জলের ছিটে লাগবে তো? নদী! নদী! কী মজা! আমাদের বাড়ির সামনেই একটা নদী এসেছে। মধুপুরের বালিসর্বস্ব রোগা-পাতলা নদীটার কথা মনে পড়ত, তার মধ্যে পা ডুবিয়ে আমাদের সে কী ছুটোছুটি! তেমনই নর্দমার ধারের সেই বহমান ধারাস্রোতের মধ্যে কৃষ্ণা, শুক্লা, রানি, মন্তালি, আমরা সবাই মনের আনন্দে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ছপছপিয়ে খেলে বেড়াতুম, যত ক্ষণ না বাড়ির লোক এসে কান ধরে টেনে নিয়ে যেত।

আরও পড়ুন:সুরের ওপর গান লেখার আশ্চর্য গুণ

ওই যে চাঁদের আলোর কথা তুলেছিলুম না? এক রাত্তিরে হল কী, অনেক ক্ষণ সেই গঙ্গার জল ঝরার পরে নর্দমার ধারে ধারে রাস্তা জুড়ে বানের জল শুকিয়ে গিয়ে ধবধবে সাদা, চাঁদের আলোর রঙের পলিমাটির প্রলেপ পড়ে গেল। জোছনায় সেই চন্দনের মতো মাটি ঝলমল করছে! আহা, কী সুন্দর কী নরম সেই গঙ্গামাটির পলি! ঠিক ট্যালকম পাউডারের মতো সূক্ষ্ম, মোলায়েম, যেন ময়দার মধ্যে হাঁটছি। আমরা ছোটর দল অস্থির হয়ে তো আবার ছুটে বেরুলুম রাস্তায়। সেই চন্দনবাটা গঙ্গামাটির মধ্যে নেমে খেলা করব বলে। তখন খুব কম গাড়িঘোড়ার দিনকাল, সব বাড়িতে বাচ্চাদের রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছে। গুনিয়াভাই নীচে এসে পাহারায় দাঁড়িয়ে রইল। কৃষ্ণা, শুক্লা, রানি, মন্তালি, আমরা সবাই সেই ধবধবে পলিমাটিতে নেমে গঙ্গামাটি নিয়ে খেলতে থাকি, চটি খুলে রেখে খালিপায়ে ছুটোছুটি করি। মা-বাবারা কিছু বললেন না। এক সময়ে ‘‘বস, ঢেরঅ হই গলা, এব্বে ইশটপ! আউ বাহিরে নাহি, ঘরকু চল,’’ বলে ডিক্রি জারি করে খড়্গহস্ত গুনিয়াভাই আমাদের যে যার বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। সেই চাঁদের দুধে ধোয়া হিন্দুস্তান পার্কে ঠিক চাঁদের আলোর মতোই সাদা নরম পরিষ্কার পলিমাটিতে পা ডুবিয়ে মুঠো ভরে সিল্কের মতো মোলায়েম মাটি তুলে সেই যে খেলা, সেই স্পর্শটুকু আজও স্মৃতিতে ছুঁয়ে আছে।

মধ্যমণি: বাবা নরেন্দ্র দেবের কোলে বসে ছোট্ট নবনীতা। পাশে মা রাধারাণী দেবী।

ওই হাইড্র্যান্টের আর একটা জরুরি ব্যবহার ছিল। ঢাকনি খুললেই তো বুড়বুড়িয়ে জল বেরুত, রাস্তাঘাটে, মাঠে বাদাড়ে খেলার শেষে অনেক সময়ে ওই জলে আমরা পা ধুয়ে নিতুম। পায়ে ময়লা লাগতই। আর খোলা হাইড্র্যান্টে ইট চাপা দিয়ে ফোয়ারা বানানো যেত। সেই ফোয়ারা বানাত গয়লারা, আর মহিষদের ঘষে ঘষে চান করাত সেই ফোয়ারায়। গরুদের চান করানো কিন্তু কই দেখিনি! আমারও খুব ইচ্ছে করত ওই হাইড্র্যান্টের ফোয়ারায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে চান করি, গুনিয়াভাইকে বলেছিলুম ইট চাপা দিয়ে ও রকম ফোয়ারা বানিয়ে দিতে। তাতে গুনিয়াভাই বলল, ‘‘তা হলে তো তোকে গরুর খাটালে রেখে দিয়ে আসতে হবে। ওখানেই থাকবি।’’ আমাদের পাড়ার গয়লাদের বাথানে গরু মহিষ দুই-ই থাকত। কী সুন্দর কাঠের টবের মধ্যে তাদের খাবার দেওয়া হত! ঘুঁটেকুড়ুনিরা গোবর আনত বাথান থেকে। তখন গলিঘুঁজিতে দেওয়ালের গায়ে ঘুঁটে দেওয়ার চল ছিল, উনুন ধরাতে ঘুঁটে ছিল অত্যাবশ্যক দ্রব্য। মধ্যবিত্ত, স্বল্পবিত্ত, অতিবিত্ত, সকলের রান্নাঘরেই সে কালে ঘুঁটের জরুরি ভূমিকা ছিল। যেমন ছিল কাঠকয়লার। ভোরে আর সন্ধ্যাবেলায় উনুন জ্বালানোর সময়টাতে যতই উচ্চবিত্ত পাড়ার আকাশ হোক, ধোঁয়ার মেঘ সেখানে দিনে দু’বার জমবেই। বেশি করে শীতকালে। শহরে সিলিন্ডার গ্যাসের রাজত্ব তখনও আসেনি। ঘুঁটে কয়লার বাইরে ইলেকট্রিক হিটার, কেরোসিনের স্টোভের কেরদানি। আর সায়েবি কায়দায় কল থেকে নলের গ্যাসওয়ালা টেবিলে বসা উনুন সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগে হাতে-গোনা দু’-একটি মাত্র বাড়িতে ছিল। আমাদের ভাঁড়ারঘরের ওই নলের গ্যাসের উনুনে রান্না হত না, কেবল মা এটা-ওটা শখের জলখাবার তৈরি করতেন। রান্না হত রান্নাঘরের দেয়ালে গাঁথা ডবল কয়লার উনুনে। ফ্রিজও তো প্রায় ছিলই না! আমাদের প্রথম এল একটি ফ্রিজ। ফুলরেণু গুহরা নতুন ফ্রিজ কিনলেন বলে পুরনোটা বেচে দিলেন। সেটাই বাবা কিনে আনলেন। ফ্রিজের ডালার ওপরে আমাদের একটি অতিপরিচিত কুকুর ফোনোগ্রামের সামনে বসে তাঁর প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনছেন! হিজ মাস্টার’স ভয়েস কোম্পানির রেফ্রিজারেটর। ফ্রিজ আসতে বন্ধুরা সবাই খেলার মধ্যে ছুটে ছুটে বরফ-ঠান্ডা জল খেতে আসত, আর মা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ফলের আইসক্রিম বানিয়ে রাখতেন বন্ধুদের জন্য। সেটা ছিল অভাবনীয় সমাদর! কত কিছুই না ছিল আমাদের ছেলেবেলাতে!

ছেলেবেলার দুই পুষ্যিকে কোলে নিয়ে।

যেমন ধরুন টেলিফোন। এক সময়ে এই ‘ভালো-বাসা’-র গোটা পাড়াতে একটি মাত্র টেলিফোন ছিল। আশপাশের সব বাড়ির খবর এই ফোনেই আসত। আমার আর গুনিয়াভাইয়ের কাজই ছিল ছুটে ছুটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয় তাদের ডেকে আনা, নয় তো খবর দিয়ে আসা। এতে আমাদের কোনও ক্লান্তি বোধ হয়নি, প্রতিবেশীদেরও কোনও সংকোচের কারণ ছিল না। তখনও তো ফোনে আড্ডার অভ্যাস হয়নি, দূরভাষ বলে কথা! বিনা প্রয়োজনে কেউ ফোন করতেন না। ফোন মানেই জরুরি। আরও একটা কথা! সে যুগে ফোনে সবাই প্রবল চিৎকার করতেন। এক দিন পুলিনবিহারী সেন এসেছেন একটা ফোন করতে। তখন হিন্দুস্তান পার্কের দুই গলিতে নরেন্দ্র দেব আর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘ভালো-বাসা’ থেকে ‘সুধর্মা’য় এমনই বজ্রনির্ঘোষে কথা বলছিলেন যে পুলিনকাকু টিপ্পনী কাটলেন, ‘‘কেন অযথা অর্থব্যয়, এ তো বিনা টেলিফোনেই শোনা যাচ্ছে!’’

শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল দক্ষিণের জানালাটা খোলা, আহ্‌, ফুরফুর করে কী মিষ্টি দক্ষিণের হাওয়া আমার চুলে বিলি কাটছে, আমার সারা গায়ে পালক বুলিয়ে দিচ্ছে, নরম চাঁদের আলো এসে আদর করে আলতো শুয়ে পড়েছে আমার পাশে। মাথার কাছে বসে মা গুনগুন করে গাইছেন, ‘আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী...’ আমার চোখ বুজে আসছে, আমি যুদ্ধ করছি চোখের পাতার সঙ্গে, মা’র গানটা মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছি, মায়ের হাতটা ছুঁতে চেষ্টা করলুম, তার পর স্পষ্ট হল সব। কোথায় দক্ষিণের জানালা? সেটা তো কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই যে, পাশের বাড়ি ভেঙে যখন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠল! জানালা বন্ধ করে সেখানে এয়ার কন্ডিশনার লাগানো হয়ে গিয়েছে, সেও তো পনেরো বছর হবে? কোলের কাছটিতে সোনার চাঁদ নাতনিধন হিয়ামন অঘোরে ঘুমুচ্ছে, আমি তো তাকেই ঘুম পাড়াচ্ছিলুম... এসি থেকে ফুরফুর করে সুন্দর বাতাস এসে আমাদের আরাম দিচ্ছে, চোখ দু’টো বোধহয় লেগে গিয়েছিল...

Nabaneeta Dev Sen Childhood Memories নবনীতা দেব সেন

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}