২৭ অক্টোবর, ২০২৫
পুজোর বেশ কিছুটা আগে যখন বিএলও হিসেবে নিয়োগপত্র পাই, তখন থেকেই জানতাম, ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হচ্ছেই এ রাজ্যে। আজ সেই ঘোষণা হয়েও গেল জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে। কমিশন জানিয়েছে, কাল থেকেই এসআইআর-এর কাজ শুরু হচ্ছে। আমি এই প্রথম বিএলও হয়েছি। তবে, যাঁরা এর বহু আগে থেকে বিএলও হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় এবং নিজস্ব উপলব্ধি থেকে টের পাচ্ছি, কাজটা মোটেও সহজ হবে না।
আসলে মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলগুলির একাংশের এসআইআর-এর বিরোধিতা, বিএলও-দের উপরে নানাবিধ চাপ, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নানা খবরে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। সংশয় থাকছে নিরাপত্তা নিয়েও। পরিচিত কয়েক জন বিএলও-র সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, সংশয় এবং উদ্বেগে তাঁরাও। ইতিমধ্যেই ২০০২-এর ভোটার তালিকার সঙ্গে ২০২৫ সালের ভোটার তালিকার ম্যাপিংয়ের কাজটা করেছি। তবে, ঘরে বসে করা সে কাজ আর মাঠে নেমে করা এসআইআর-এর কাজের মধ্যে বিস্তর তফাত। শুনেছি প্রশিক্ষণ হবে। প্রশাসনের তরফে কবে আমাদের প্রশিক্ষণে ডাকে, এখন সে অপেক্ষায় রয়েছি। এসআইআর নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর কি পাব প্রশিক্ষণে, জানা নেই। শুধু এইটুকু জানি, যে কাজ দেওয়া হয়েছে, তা থেকে পালানো যাবে না। খুবই গুরুদায়িত্ব। ফলে তা যে ভাবেই হোক পালন করতে হবে।
২৯ অক্টোবর
এসআইআর-এর জন্য প্রশিক্ষণের ডাক এখনও পাইনি। শুনেছি, কমিশনের নির্দেশ মেনে এসআইআর-এর জন্য এনুমারেশন ফর্ম ছাপাতে দিয়েছে। ম্যাপিং-এর কাজ করার অভিজ্ঞতায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, ২০২৫ সালে যে সব ভোটারের নাম রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে ফর্ম পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু, সেই ভোটারের সঙ্গে ২০০২-এর ভোটার তালিকার সংযোগ থাকতে হবে। ওই ভোটারের নাম যদি ২০০২-এর তালিকায় না থাকে, তা হলে তাঁর বাবা-মা অথবা দাদু-ঠাকুমার নাম থাকতে হবে। নইলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। আমার এলাকায় বসবাসকারী কয়েকটি পরিবার সম্পর্কে জানি, যাঁরা এলাকার আদি বাসিন্দা নন। ভোটার তালিকায় নাম বর্তমানে থাকলেও যদি ম্যাচিং বা লিঙ্কিং ঠিক ভাবে না হয়, সে ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গেলে আমাকে কোপে পড়তে হবে না তো!
৩১ অক্টোবর
কাল, ১ নভেম্বর এসআইআর সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে ডাক পেলাম। দেখি কী হয়। কমিশন বলেছে, এসআইআর ২৪ ঘণ্টার কাজ। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিএলও-র দায়িত্ব কী ভাবে সামলানো যাবে, অন ডিউটি হবে কি না— কিছুই জানি না। মাঠে নেমে কাজ করতে গেলে যদি কোনও সমস্যা হয়, নিরাপত্তা কে দেবে, তা-ও জানা নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নথি চাইতে গেলে কী প্রতিক্রিয়া হবে, কাজ করতে নেমে ভোটারদের হাজারো প্রশ্নের কী উত্তর দেব, ভাবতে বসে সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন রয়েছে বিএলও অ্যাপের ঠিক মতো কাজ না করা নিয়েও।
১ নভেম্বর
আজ প্রশিক্ষণ হল। প্রশিক্ষক ও আধিকারিকেরা প্রোজেক্টরের মাধ্যমে দেখালেন, কী ভাবে কাজটা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট নির্দেশিকা ধরে প্রতিটি বিষয় ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন তাঁরা। তবে, সেই প্রশিক্ষণে বিএলও অ্যাপে আপলোড কী ভাবে হবে, সেটা-সহ বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। উত্তর মিলল না, স্কুলের কাজ বজায় রেখে এসআইআর-এর মতো এত বড় কাজ এই সীমিত সময়ে শেষ করা যাবে কী করে? নিরাপত্তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আমাদের তরফে প্রশিক্ষণ শিবিরে তোলা হয়নি। তবে, সত্যি সত্যিই বিএলও-র কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলে বা মানসিক-শারীরিক হেনস্থার শিকার হলে কী করণীয়, সে ব্যাপারে কমিশনের তরফে কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশিকাও আসেনি।
প্রশিক্ষণে প্রাথমিক ভয় কাটল এটা জানার পরে, এনুমারেশন ফর্ম বিলির সময় কোনও নথি নিতে হচ্ছে না ভোটারদের থেকে। আপাতত ভোটার-পিছু দু’টি করে এনুমারেশন ফর্ম পৌঁছে দেওয়া এবং পূরণ করা একটি ফর্ম সংগ্রহ করে সেটা অ্যাপে আপলোড করার কাজ করতে হবে। সঙ্গে ভোটারের একটি করে সাম্প্রতিক ছবি লাগবে। আরও জানা গেল, আমাদের কাজ করতে সমস্যা হলে অন্য কাউকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হবে। সমস্যা হলে প্রশাসনের তরফে আমাদের ফোন করতে বলা হয়েছে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ মাত্র পাঁচটি (পাঁচ জন ভোটার-পিছু এক জোড়া) এনুমারেশন ফর্ম দেওয়া হল। আমার বুথে সাড়ে আটশোরও বেশি ভোটার। এই ক’টি ফর্মে কী হবে! এইআরও-র তরফে জানানো হল, ৪ তারিখ কাজে নামার আগেই হাতে এনুমারেশন ফর্ম পৌঁছে যাবে।
৩ নভেম্বর
নির্দেশ ছিল, প্রশিক্ষণ শুরুর আগে স্থানীয়দের নিয়ে একটি বৈঠক করে রেজ়োলিউশন করে নেওয়ার। বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্ট বা বিএলএ ২-দের নাম ও ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। যোগাযোগ করে নিতে হবে তাঁদের সঙ্গেও। সে সব করা হল আজ। কিন্তু, এনুমারেশন ফর্ম তো পেয়েছি মোটে পাঁচটি। পর দিন সকালে শুরু করব কি না ধন্দ ছিল। তার মধ্যেই খবর পেলাম, সকালে ব্লকে গিয়ে এনুমারেশন ফর্ম নিতে বলা হয়েছে। বিএলও সুপারভাইজ়ারও সেটা জানালেন। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ৪ তারিখ সকালে নয়, বরং সব এনুমারেশন ফর্ম হাতে পাওয়ার পরে বিলি করার কাজ একটু বেলার দিকে শুরু করব।
৪ নভেম্বর
আজ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ব্লক অফিস থেকে ৩০০টি এনুমারেশন ফর্ম পেলাম। ফর্মের গোছা ফাইলে ভরে বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম আমার বুথের মধ্যে থাকা একটি পাড়ায়। আমার গ্রামের বাড়ি যেখানে, সেই এলাকার বুথই আমার দায়িত্বে। ফলে মোটরবাইক আর পায়ে হেঁটেই কাজ চালাতে পারব। বাবা-মা গ্রামেই থাকেন। ছেলের লেখাপড়ার জন্য আমি ও আমার স্ত্রী শহর ঘেঁষে ভাড়াবাড়িতে থাকি। বড় পিচরাস্তা থেকে আমাদের গ্রাম বাঁ দিকে গিয়েছে। ওই রাস্তার ধারের জনবসতিই আমার এসআইআর-এর ক্ষেত্র। সামনের দিকের কিছুটা বাদ দিলে দু’দিকে পাকা ধানের খেত। এখন ধান কাটার সময়। মাঠে কাজ করছেন প্রচুর পুরুষ-মহিলা। একটু এগিয়েই প্রাথমিক স্কুল। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট একেবারে গ্রামের শেষ পর্যন্ত গিয়েছে।
এলাকায় ছোট থেকে বড় হয়েছি। ফলে পরিচিতির অভাব নেই। সকলেই আমাকে চেনেন। সেখানে প্রথম দিন বিএলও হিসেবে আমাকে দেখামাত্রই নানা জিজ্ঞাসা। ‘মাস্টার, (গ্রামীণ এলাকায় এ ভাবেই সম্বোধন করা হয়) আমার নামটা আছে তো?’—জানতে চাইলেন পরিচিত প্রবীণ। এক প্রৌঢ়ার জিজ্ঞাসা, ‘আমার বৌমার ভোটার কার্ডটো এখানেই করিয়েছি। ওর বাবার নাম দিতে হবে নাকি?’ কারও জিজ্ঞাসা, ‘নাম ২০০২-এ নাম না থাকলে ভোটার তালিকায় নাম কাটা যাবে? আজ সবাই ফর্ম পাব?’
প্রশ্ন বেড়েই চলেছে। যতটা পারছি ঠান্ডা মাথায় জবাব দিচ্ছি। সব প্রশ্নের জবাব কি ছাই আমরাই জানি পুরোপুরি!
দেখে মনে হল, ফর্ম বিলির প্রথম দিনে গ্রামীণ এলাকার প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করেছে। তাঁদের কোথাও মনে হয়েছে, এনুমারেশন ফর্ম তাঁর কাছে না পৌঁছলে ভোটার তালিকায় তাঁর নাম হয়তো কাটা যাবে। ফর্ম কে কত তাড়াতাড়ি পাবেন, সেটাই যেন মূল লক্ষ্য। যতটা সম্ভব উত্তর দিয়ে, ওঁদের ভয় ভাঙিয়ে ফর্ম গুছিয়ে বিলি শুরু করলাম। প্রথমেই এক বৃদ্ধার হাতে তাঁর ছেলের এনুমারেশন ফর্ম দিলাম। ধান কাটতে গিয়েছেন তাঁর ছেলে ও বৌমা। দু’টি রাজনৈতিক দলের বিএলএ আমার সঙ্গে ছিলেন। দুপুর থেকে টানা বিকেল পর্যন্ত ৭৮টি ফর্ম বিলি করতে পারলাম।
৫ নভেম্বর
ধাপে ধাপে এনুমারেশন ফর্ম আমাদের দেওয়া হচ্ছে। ফলে ফর্ম বিলির সময় আজ থেকে বাড়ালাম। আজ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে প্রথম হাফে স্কুল করলাম। টিআইসি হওয়ার সুবাদে, মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করার পরে বেরোলাম স্কুল থেকে। এ বার শুরু এসআইআর-এর কাজ। ধান কাটার সময় বলে গ্রামের অধিকাংশ লোকজনকে বিকেল বা সন্ধ্যার আগে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশির ভাগই গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁরা এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করতে পারছেন না। যতটা সম্ভব বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সব কাজ মিটিয়ে বাড়ি ঢুকলাম রাত ১০টার কিছু পরে। আজকের পরে বুঝলাম, আপাতত স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে একটু খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারার যে রুটিন এত দিন আমার চলেছে, তা এ বার বন্ধ। পরিবার, বিশেষ করে ছেলেকে খুব কম সময় দিতে পারছি। তবে, হ্যাঁ, পরিবার আমার পাশে। এসআইআর-এর কাজ চাপের হলেও, আমার পরিবার বিশেষ চিন্তা করছে না। মনে জোর পাচ্ছি।
৭ নভেম্বর
তিনটি এলাকা ছুঁয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে, অনেকটা সকালে উঠে পড়ছি। কারণ, স্কুলে যেতেই হবে। আজ অবশ্য সকালেও কিছু ফর্ম বিলি করতে বেরিয়েছিলাম। সমস্যা একটাই। কৃষিকাজের জন্য পুরুষদের পাওয়া গেল না বাড়িতে। তাঁরা ফসল কাটার জন্য ধানখেতে। বাড়ির মহিলারা অনুযোগের সুরে বললেন, কমিশনের তরফে সময় নির্বাচনটা ভুল হয়েছে। ফর্ম বিলি শেষে স্কুলে পৌঁছলাম। সে-ও এক ঝক্কি, আমার স্কুল ১৫ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতে সময় লাগছেই। স্কুল থেকে ফিরেই আবার ছুটলাম। তবে, যত জনকে ফর্ম বিলির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বেরিয়েছিলাম, তা পূরণ করা গেল না এ দিন। আমার এলাকার এক আদিবাসী মহিলা ভোটার ২০০২-এর তালিকায় তাঁর যে নাম ছিল, সেটা বদলে ফেলেছেন। এবং তার সপক্ষে কোনও নথি নেই বলে জানালেন। তাঁকে বললাম, আপাতত কোনও নথি আমি নিচ্ছি না। বর্তমানের ভোটার কার্ড ধরে ধরে ফর্ম পূরণ করুন। পরে নোটিসপেতে পারেন।
একটাই স্বস্তি, এই কয়েক দিনে ফর্ম বিলি করতে গিয়ে কোথাও কোনও বাধা বা সমস্যায় পড়তে হয়নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও পাইনি। তবে ফর্ম বিলি থেকে ফেরত, এর জন্য যে অ্যাপ খুব প্রয়োজনীয়, সেই অ্যাপই ঠিক ভাবে কাজ করছে না। ব্লকে জানানোর পর সমস্যা কিছুটা মিটেছে। তবে, আপডেটেড অ্যাপ হলে কাজ আরও ভাল ভাবে করা যাবে। বিএলও অ্যাপের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি আগে।
৮ নভেম্বর
যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা-ই হল। এক লপ্তে এনুমারেশন ফর্ম না পাওয়ার জন্য চরম ভোগান্তি হচ্ছে। শুধু আমার নয়, অধিকাংশ বিএলও দুর্ভোগে পড়েছেন। আমার ক্ষেত্রে যেমন একটি পরিবারের চার সদস্যের মধ্যে দু’জনের এনুমারেশন ফর্ম এসেছিল। তাঁদের দিতে পারলাম। বাদ রয়ে গেলেন অন্য দু’জন। আজ এমনও হল, স্রেফ ফর্ম দিতেই একটি পরিবারে তিন বার যেতে হয়েছে। এত সীমিত সময়ে এত ভোটারের কাছে ফর্ম পৌঁছে দেওয়া কি চাট্টিখানি কাজ! কমিশনের সহযোগিতা যে একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না, এমনটা বলাও অবশ্য সত্যের অপলাপ হবে। কাল, রবিবার বসে যেতে হবে শোনার পরে বিডিও নিজে ৫০টি করে ফর্ম প্রিন্ট করিয়ে আমার মতো কয়েক জন বিএলও-কে দিয়েছেন।
৯ নভেম্বর
এনুমারেশন ফর্ম বিলি করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল আজ। এক বয়স্ক মহিলা ভোটারের ফর্ম নিতে অস্বীকার করলেন তাঁরই মেয়ে! ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যে নাম ছিল ওই ভোটারের, সেটা নাকি বদল হয়েছে। মায়ারানি বদলে ছায়ারানি হয়েছেন (পরিবর্তিত)। কিন্তু, এনুমারেশন ফর্ম এসেছে মায়ারানির নামে। কেন নামের বদল হয়নি, সে প্রশ্ন তুলে ফর্ম কিছুতেই নিলেন না মেয়ে। আমি বলেছি, ‘সময় আছে, চিন্তা করে দেখুন।’ নাম বিভ্রাটের আরও সমস্যার কথা শুনছি এলাকায়। ভিন্ এলাকা থেকে আসা যে পরিবারগুলি নিয়ে ভাবনা ছিল, সেখানে আজ ফর্ম দিয়ে এসেছি কোনও বাধা ছাড়াই। জানি ২০০২-এ ওই পরিবারগুলির সদস্যদের নাম বা তাঁদের নিকটাত্মীয়ের নাম নেই পুরনো তালিকায়। পূরণ করা ফর্মে কী উঠে আসে, সেটাই দেখার। মৃত এবং স্থানান্তরিত ভোটারদের নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কমিশনের তরফে বলাহয়েছে, যদি পরিবারের কোনও সদস্য মারা গিয়ে থাকেন, তা হলে ফর্মে মৃত লিখে সই করে দিতে। ফর্ম গ্রহণের সময় যেন তিনি ডেথ সার্টিফিকেট দেখান। সেটা কেউ না দেখাতে চাইলে কী করণীয়, সে নির্দেশ নেই।
আমার ব্লকের অন্য এক বিএলও-র থেকেও শুনলাম, তিনিও প্রায় কাছাকাছি এক সমস্যায় পড়েছেন। তাঁর এলাকায় একটি উদ্বাস্তু কলোনি রয়েছে। সেখানে এমন কিছু ভোটার আছেন, যাঁরা ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় কোনও সংযোগ দেখাতে পারবেন না। তিনি ফর্ম পৌঁছে দিয়েছেন। কোনও স্থানান্তরিত ভোটারের ফর্ম নিয়ে পূরণ করে জমা দিলেও কিছু বলার নেই।
১০ নভেম্বর
বিএলও অ্যাপ ঠিকমতো কাজ করছে না। এখনও ফর্ম বিলির কাজ চলছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পূরণ করা ফর্ম এসে হাতে পৌঁছনোর পরে সেই তথ্য আপলোড করার সময় কী হবে, ভাবতেই ভয় হচ্ছে! আসলে এই কয়েক দিন কাজ করতে গিয়ে একটা বিষয় মনে হয়েছে, যে প্রস্তুতি নিয়ে এসআইআর শুরু হল এ রাজ্যে, তেমন বৃহৎ মাপের কাজে নামার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিতে ফাঁক থেকে গিয়েছে। এমন অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে এক জন শিক্ষককেও বিএলও-র দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আবার এমন অনেক স্কুল রয়েছে, যেখানে প্রধান শিক্ষক এবং সহশিক্ষকদের বড় অংশকে এই কাজের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কথা কেউ ভাবেনি।
১১ নভেম্বর
ফর্ম বিলির কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু, এখনও ধোঁয়াশা আছে বেশ কিছু জায়গায়। ফর্মে সম্পর্ক বলে একটি কলাম রয়েছে। সেটা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। বিএলও-রা ফর্মে সম্পূ্র্ণ সই করবেন না ‘ইনিশিয়াল’ দেবেন, তা-ও স্পষ্ট করে বলা নেই। কারও যদি ভোটার সংখ্যা ১২০০-র বেশি হয়, তাঁকে প্রতি ফর্ম-পিছু দু’টি করে সই করলে কতগুলি সই করতে হবে, ভাবার বিষয়। বিবাহিত মহিলা ভোটারদের জন্য বলা হয়েছে, ফর্মে তাঁর বাবার ভোটার কার্ডের নম্বর দিলেই হবে না। সে ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক বোঝাচ্ছে এমন নথিও দিতে হবে। কিছু না থাকলে স্কুলের শংসাপত্র চাই। কেন এটা লাগবে? আজ এক পরিবারে ফর্ম বিলি করতে গিয়ে আমি এই প্রশ্নের মুখে পড়লাম। এক মহিলা বললেন, “আমার স্বামী যদি তাঁর বাবা বা মায়ের ভোটার কার্ডের নম্বর দিলেই রেহাই পেয়ে যান, তা হলে কেন আমাকে আমি ওই বাবারই মেয়ে, তার নথি বাপের বাড়িতে গিয়ে কষ্ট করে আনতে হবে? এটা তো বৈষম্য!” সকলে কি স্কুলে পড়েছেন?— এ প্রশ্নও এল। কোনও ভাবে বুঝিয়ে বেরিয়ে এলাম।
১২ নভেম্বর
আমার বিধানসভা এলাকার বিএলওদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হচ্ছে। অভিজ্ঞরা বলাবলি করছেন, প্রতি বছর নিয়ম করে ভোটার তালিকায় যে সংযোজন-বিয়োজনের কাজ চলে, এসআইআর-এর সঙ্গে সেই কাজের অনেক পার্থক্য। অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে সতর্ক ভাবে করতে হবে। না হলে কমিশনের কোপে পড়তে হবে। কর্তব্যে গাফিলতির কারণে বেশ কয়েক জন বিএলওকে শো-কজ় করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি। তাই চিন্তা সকলেরই আছে।
এনুমারেশন ফর্ম পেলে ফর্ম পূরণ করার কথা ভোটারদের। না পারলে বিএলও-দের সাহায্য করার কথা। কিন্তু গ্রামীণ এলাকার অধিকাংশ ভোটারই সেটা ঠিক ভাবে পূরণ করতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলের বিএলএ-রা সাহায্য করছেন বটে। তবে, স্কুল থেকে ফিরে আমাকেও প্রতিদিন রাত পর্যন্ত এ কাজ করতে হচ্ছে। আজও তা-ই করেছি। কিন্তু, কাজটা করে ভাল লাগার অনুভূতিও হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় ভোটারদের থেকে যথেষ্ট সম্মান ও সহযোগিতা পাচ্ছি।
১৩ নভেম্বর
আজ এনুমারেশন ফর্ম বিলি পুরোপুরি শেষ হল। এ বার পূরণ করা ফর্ম জমা নেওয়ার পালা। আমার ধারণা, আসল সমস্যা শুরু হবে এখন থেকেই। তার উপরে চিন্তা বাড়িয়েছে বিএলও অ্যাপ। আপডেটেড অ্যাপ নয়। আরও একটি বিষয় নজরে এল, ‘এডিট’ করার কোনও জায়গা নেই। যে বিএলও ফর্ম দেখে অ্যাপে এন্ট্রি করছেন, তার কোনও ভুল হতেই পারে। অ্যাপেই যদি সে ভুল সংশোধন করার সুযোগ না থাকে, তা হলে তো মুশকিল। এটাও লক্ষ করেছি, অ্যাপে এন্ট্রি করার সময় যদি কোনও ভাবে ভোটারের সিরিয়াল বা পার্ট নম্বর দেওয়া বাদ থাকছে, সে ক্ষেত্রে সাবমিট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, তার পরেও সাবমিট হয়ে যাচ্ছে। এই সব ত্রুটির দায় বিএলও-র ঘাড়ে পড়বে। অনেক সময় ভোটারদের ভুল ভাবে পূরণ করা ফর্ম থেকেও এই সমস্যা হতে পারে। ভুল শোধরানোর সুযোগ চাই।
১৪ নভেম্বর
সংগ্রহ করতে শুরু করেছি এনুমারেশন ফর্ম। পাহাড়প্রমাণ কাজ সামনে। তবে প্রথম দিন মোটের উপর সন্তোষজনক কাজ এগিয়েছে। একটা পরিকল্পনা করে এগিয়েছি। এলাকায় গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাঁদের ফর্ম পূরণ করার সমস্যা আছে ধরেই এগোচ্ছি। স্কুল থেকে এলাকায় পৌঁছে এক জায়গায় বসেছিলাম। যে বা যাঁরা ফর্ম পূরণ করেননি, তাঁদের ডেকে নিয়েছিলাম। প্রথমে একটি ফর্ম আমি পূরণ করে দিলাম। তা দেখে দেখে নিজের ফর্ম পূরণ করে নিল এলাকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। তবে, অ্যাপে তথ্য তোলার ক্ষেত্রে সময় লাগছে অনেকটা। আমার বুথের প্রায় ৯০০ ভোটারের জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, অনুমান করা শক্ত নয়। পাশাপাশি অ্যাপে তথ্য তোলার জন্য বিএলও-র কাছে ফাইভ-জি মোবাইল সেট এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড প্রয়োজন। সব বিএলও-র কাছে নেই। আমার নিজের কাছেই তো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নেই।
১৮ নভেম্বর
শনি এবং রবিবার ছুটির দিন মিলিয়ে এবং তার পরের দু’দিন ধরে প্রায় চারশো ফর্ম পূরণ এবং মোবাইল আপলোডের কাজ শেষ করতে পেরেছি। সব ফর্ম আপলোডও করে ফেলেছি। অ্যাপ এখনও ঠিক ভাবে কাজ করছে না। তবু গত কয়েক দিনে এতগুলি ফর্ম পূরণ এবং ডিজিটাইজ় করা হয়েছে। আরও ফর্ম আপলোড করা বাকি।
জানি, যাঁরা ফর্ম জমা দেবেন, সকলের নাম খসড়া তালিকায় থাকবে। কিন্তু বিচ্যুতি হলে, বা লিঙ্কিং ম্যাচিং না হলে নোটিস পাবেন অনেক ভোটার। শুনানি হবে। উপযুক্ত নথি না থাকলে নাম বাদও যেতে পারে। সেই ঝড় সামনে থেকে সামলাতে হবে আমাকে এবং আমার মতো হাজার হাজার বিএলও-কে।
সামনে অনেক কাজ। চাপও অনেক।উদ্বেগ বাড়ছেই।
অনুলিখন: দয়াল সেনগুপ্ত
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)