Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সিন্ধু বারোয়াঁ

বুকপকেটে ঢুকল একশো টাকার নোট

আমার প্রথম বই তথা প্রথম উপন্যাস ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তখন আমার বয়স কুড়ি। সদ্য স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় এসেছি। এটিই অবশ্য আমার প্রথম মুদ্রিত রচনা নয়। তার আগে ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গল্প ‘ছন্দপতন’, আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায়। পরের বছর সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প ‘নিয়ম’।

দিব্যেন্দু পালিত
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আমার প্রথম বই তথা প্রথম উপন্যাস ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তখন আমার বয়স কুড়ি। সদ্য স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় এসেছি। এটিই অবশ্য আমার প্রথম মুদ্রিত রচনা নয়। তার আগে ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গল্প ‘ছন্দপতন’, আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায়। পরের বছর সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প ‘নিয়ম’। সত্যি বলতে, প্রথম বই প্রকাশের আগেই প্রকাশিত হয় আমার বিভিন্ন গল্প— সবই ভাগলপুর থেকে ডাকে পাঠানো।
ভাগলপুর কলেজে পড়বার সময়েই এই সব গল্প যেমন লিখি, তেমনই লেখক হওয়ার উচ্চাশায় তখনই আমি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিই। দিনের পর দিন পরীক্ষার পড়া এড়িয়ে আর রাত জেগে শেষ করি ফুলস্ক্যাপের প্রায় তিনশো পৃষ্ঠা ব্যাপী এক দীর্ঘ পাণ্ডুলিপি। বিষয়: প্রেম, যে-প্রেমে ব্যর্থতা বৈধ থেকে অবৈধে যেতে এবং যুবক-যুবতীর জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে প্রকাণ্ড এক জগাখিচুড়ি পাকাতে একটুও দ্বিধা করেনি। আজ এত দিন পরে ওই উপন্যাস নিয়ে ঠাট্টায় প্রবৃত্ত হলেও সে দিন কিন্তু সদ্য-বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি নতুন স্বামীর আগ্রহে সমস্ত আবেগ ও পরিশ্রম বিচ্ছুরিত হয়েছিল তার প্রতি। আমার প্রথম উপন্যাস এবং প্রথম প্রকাশিত বই ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ যদি ভবিষ্যতের সমালোচকদের চোখে এক অসামান্য দৈন্যের প্রতিভূ হয়ে দেখা দেয়, তাতে বিচলিত হব না। লেখক হওয়ার জন্য সেই আঠেরো-উনিশ বয়সে আমি এতই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, পাণ্ডুলিপিটি পরিমার্জনা করার ও আদ্যন্ত ফিরে লেখার কথা ভাবিনি। সমালোচকহীন সেই মফস্সল শহরে এমন কেউ ছিল না, যে আমাকে দ্বিতীয় মত গ্রহণে সাহায্য করবে। আমি লেখক, আমিই তার পাঠক, ইতিমধ্যেই পিঠে পড়ে গেছে পরিচয়ের ছাপ, সুতরাং তর যে সইবে না, তাতে আর আশ্চর্য কী!

অসুবিধে হল, উপন্যাস তো লিখলাম, ছাপবে কে? মফস্সলে থেকে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, যোগাযোগের অভাব অনেক সময়েই তাঁদের আত্মপ্রকাশের পক্ষে একটি বড় অন্তরায়। ইতিমধ্যে আমার যে সব গল্প, কবিতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তার সবই ডাকে পাঠানো ও পোস্টাপিসের মাধ্যমে হলেও, অপরিচয় সেতু-বন্ধনে বাধা সৃষ্টি করেনি কোনও। কিন্তু, উপন্যাসও কি ছাপানো যাবে ওই ভাবে? চিন্তাটা কিছু দিন ভারাক্রান্ত করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত আবার পোস্টাপিসেরই শরণ নিতে হল। ‘আভেনির’ নামে একটি নতুন প্রকাশন সংস্থা সেই সময় নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী প্রমুখের কয়েকটি বই শোভন ভাবে ছেপে বেশ নাম করেছিল। কপাল ঠুকে এক দিন রেজিস্ট্রি ডাকে পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়ে দিলাম সেই ঠিকানায়।

আশ্চর্য, অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে সেটি গ্রহণ করলেন আমার কাছে তখনও অপরিচিত তরুণ প্রকাশক অমলেন্দু চক্রবর্তী। মুদ্রিত অবস্থায় যদিও তিনশো পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি কেটেকুটে সওয়াশো পৃষ্ঠায় কমিয়ে আনা হয়েছিল, তাতে তার অঙ্গহানি ঘটেনি।

সেটা ১৩৬৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস (ইংরেজি ১৯৫৯ সালের জুলাই)। ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে আমি তত দিনে কলকাতায় এসেছি। এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় বিডন স্ট্রিট অঞ্চলের এক অন্ধগলির দপ্তরিখানা থেকে দু’বগলে দু’প্যাকেট বই ও সঙ্গে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন অমলেন্দু। আমার হাতে বই দেওয়ার আগে শার্টের বুকপকেটে গুঁজে দিলেন একটা আনকোরা একশো টাকা নোট। অভিভূত আমার মুখে কথা ফোটেনি কোনও। টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় করে আমরা হাঁটছিলাম কলেজ স্ট্রিটের দিকে।

‘যাক, আপনার প্রথম বই তা হলে বের করতে পারলাম!’ অমলেন্দু হঠাৎ বললেন, ‘আপনি যখন বড় লেখক হবেন, তখন আজকের দিনটির কথা মনে থাকবে তো?’

সিন্ধু বারোয়াঁ: প্রথম পরিচ্ছেদ

শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। মাঝে হলিউড, ক্রিকেট, রুশীয় সমাজব্যবস্থা, ব্রিজিট বার্ডোট ইত্যাদির অনায়াস ও বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই এতক্ষণে, অপরাহ্ন তিনটে বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট একুশ সেকেন্ডে, বিদেশি সাহিত্যে এসে থেমেছে। ডিলান টমাসের কজন প্রেমিকা ছিল, এই প্রশ্নটা উঠতে গিয়েও উপযুক্ত সমর্থনের অভাবে চাপা পড়ে গেল। আপাতত সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ নিয়ে শূন্য ও শুষ্ক কফির পেয়ালায় তুমুল তর্কের ঝড় উঠেছে।

কফি হাউসের রহস্যই এই। বনেদি আলোচনা ছাড়া কেউ স্বাভাবিক হতে পারে না। গতি দেখে মনে হয় সার্ত্রেও আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন না। আলোচকদের আন্তরিক রসদ ফুরিয়ে এসেছে। সিগারেটে টান দিয়ে একজন গভীর ও গম্ভীর হতে চেষ্টা করল। খাপছাড়াভাবে একজন প্রশ্ন করল, ‘সৌম্য, তুমি কি অসামু দাজাই-য়ের শেষ উপন্যাস পড়েছ?’

প্রশ্নটা শুনেও শুনল না সৌম্য। কপালে দু-তিনটে সরু সরু খাঁজ ফেলে ও মলিনাকে লক্ষ করছিল।

দর্শনের ছাত্রী মলিনা। আজকের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে এবং সাহিত্যের প্রসঙ্গটা তখনও বাঁচিয়ে রাখার করুণ চেষ্টা করছে। ওটা এক ধরনের আত্মপ্রসাদ। জিজ্ঞেস করলে বলবে, সাহিত্যিকরা কি দার্শনিক নন! বলে একটু হাসবে। যেন হাসিটাই ওর সৌন্দর্য।

(প্রথম পৃষ্ঠা থেকে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE