Advertisement
E-Paper

৪৩ বছরে মিলল বিচার

ভারতে নয়, বিলেতে। মিথ্যে অভিযোগে নিরপরাধ মানুষকে পুলিশের ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে সেখানেও। ন্যায়বিচার পেতে পেরিয়ে যায় প্রায় গোটা জীবনটাই।ভারতে নয়, বিলেতে। মিথ্যে অভিযোগে নিরপরাধ মানুষকে পুলিশের ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে সেখানেও। ন্যায়বিচার পেতে পেরিয়ে যায় প্রায় গোটা জীবনটাই।

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
স্টিফেন সিমন্স, এত বছর পর ‘নির্দোষ’

স্টিফেন সিমন্স, এত বছর পর ‘নির্দোষ’

গাড়ি ছুটছে সাঁ সাঁ করে। হেডলাইটের তীব্র আলোয় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে জমাট অন্ধকার। ভিতরে বসে জনাকয়েক যুবক। গভীর রাতে দক্ষিণ লন্ডনের রাস্তায় সেই গাড়ি থামালেন ব্রিটিশ ট্রান্সপোর্টের পুলিশকর্মী ডেরেক রিজওয়েল। কেন? না, গাড়িতে বসে থাকা স্টিফেন সিমন্স ও তাঁর সঙ্গীরা নাকি মেলব্যাগ চুরির চেষ্টা করেছিলেন। থানায় নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ জেরা করা হল। গাড়ির মধ্যে কিন্তু মেলব্যাগ মিলল না।

পুলিশ অফিসারটি নানা ভাবে চেষ্টা করলেন স্টিফেনদের দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নিতে যে তাঁরাই চুরি করেছেন। স্টিফেনদের জন্য নিযুক্ত আইনজীবী আবার বলে দিয়েছিলেন, তোমরা বাপু আদালতে গিয়ে বোলো না যে পুলিশ মিথ্যে বলছে। তা হলে সাজার মেয়াদ আরও বেড়ে যাবে।

১৯৭৫-এর জুন মাসের ওই ঘটনা যে একটা ‘ষড়যন্ত্র’, তা বুঝতে লন্ডনের সময় লেগেছিল অনেক দিন। স্টিফেন ও তাঁর সঙ্গীরা তো বুঝতেই পারেননি। তাঁরা আদালতে সটান জানালেন, আমরা নির্দোষ, আমরা চুরি করিনি। এ দিকে পুলিশকর্মী ডেরেক রিজওয়েল আদালতে দাবি করলেন, স্টিফেন নাকি কবুল করেছেন, ‘আমরাই মেলব্যাগ চুরি করেছি। কিন্তু সেটা গাড়িতে তোলার সুযোগ পাইনি।’ সত্যি কথা বলেও স্টিফেন ও তাঁর সঙ্গীদের সাজা হল।

শিকারী: পুলিশ অফিসার ডেরেক রিজওয়েল।

স্টিফেনকে পাঠানো হল সাফোক-এর একটি সংশোধনাগারে। আট মাস জেল খাটার পরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর বাবা তখন যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে বাড়িতে। মা হাসপাতালের ‘ক্লিনার’। ছয় সন্তানকে নিয়ে টানাটানির সংসার। স্টিফেনের এমন ‘অপরাধের’ কথা শুনে ভেঙে পড়েন তাঁরাও।

পুলিশে সেই সময় মানুষের এতটাই আস্থা ছিল যে, স্টিফেন নিজেকে নির্দোষ বলার পরেও তাঁর মা-বাবা তাঁকে বিশ্বাস করেননি। এই সে দিন পর্যন্তও স্টিফেনের নিজের ভাই তাঁকে ‘রেল ডাকাত’ বলে খেপিয়েছেন। গোটা বিষয়টি নিয়ে স্টিফেন এতটাই লজ্জিত ও মর্মাহত যে, পরে তাঁর মেয়েকেও জীবনের এই অধ্যায়টি কখনও বলতে পারেননি। সেই রাতের পরে স্টিফেনের এক সঙ্গী মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে পানাসক্ত হয়ে মারাও যান।

জীবনের এই অপমানজনক ইতিহাস স্টিফেন কখনও ভোলেননি। আর সেই কারণেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। বছর চার-পাঁচেক আগে রেডিয়োতে একটি আইন বিষয়ক অনুষ্ঠান চলছিল। ব্যারিস্টার ড্যানিয়েল বার্নেট ফোনে নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। ফোন করেন স্টিফেনও। ব্যারিস্টার তাঁকে পরামর্শ দেন, লন্ডনের যে পুলিশ অফিসার তাঁকে গ্রেফতার করেছিল, তাঁর নাম এক বার গুগল করে দেখতে।

আর সেটা করার পরেই হাঁ হয়ে যান স্টিফেন। জানতে পারেন, লন্ডনের সেই পুলিশকর্মী ডেরেক রিজওয়েল নিজেই রয়্যাল মেলের ব্যাগ ডাকাতির ষড়যন্ত্রে জড়িত! ১৯৮০ সালে তাঁর সাত বছরের সাজা হয়। সংশোধনাগারেই ১৯৮২ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার।

স্টিফেন একা নন। সত্তরের দশকে উইনস্টন ট্রিউ ও তাঁর তিন বন্ধুও ঠিক একই ভাবে অন্য এক ঘটনায় ‘ধরা পড়েন’ এবং তিন বছর সংশোধনাগারে কাটাতে বাধ্য হন। ‘ওভ্যাল ফোর’ নামে সে গল্প আজ সকলেরই জানা। সম্প্রতি ‘ব্ল্যাক ফর এ কজ়’ বইয়ে উইনস্টন লিখেছেন সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তথ্য জানার অধিকার আইনে তিনি জানতে পারেন রিজওয়েলের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার কথা। কালো চামড়ার ডজনখানেক লোককে মিথ্যে চুরি-ডাকাতির ‘কেস’ দিয়ে গ্রেফতার করেছিল এই পুলিশকর্মী। তার ‘স্টাইল’ ছিল সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানো। পাতালরেলে কালো চামড়ার কোনও কিশোর বা যুবককে দেখলে এই অফিসারটি তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যে চুরি কিংবা ডাকাতির মামলা দিয়ে দিত। তাঁদের ভয় দেখিয়ে, জোর করে ‘স্বীকারোক্তি’ আদায় করে ছাড়ত। যাঁরা তার এই ফাঁদে পড়েছিলেন তাঁরা আজও ‘স্টকওয়েল সিক্স’, ‘ওয়াটার লু ফোর’ কিংবা ‘টটেনহ্যাম কোর্ট রোড টু’ নামে পরিচিত। একের পর এক এমন ঘটনায় সন্দেহ হয় বিচারকদের। শুরু হয় অন্য তদন্ত। ধরা পড়ে ডেরেক।

বছর বাষট্টির স্টিফেন সিমন্স এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস রেডিয়োর অনুষ্ঠান শুনে সে দিন ওই ব্যারিস্টারকে ফোন করেছিলাম! না হলে সত্যিটা সত্যি সত্যিই জানা হত না। আমাকে আর অবসাদে ভুগতে হবে না। খেতে হবে না ঘুমের ওষুধও। এখন আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব। সব্বাইকে বলতে পারব, আমি চুরি করিনি। আমি অপরাধী নই। ওই পুলিশ অফিসার তিনটে জীবন তছনছ করে দিয়েছে। আমার মতো আরও যাঁরা এই একই ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তাঁরাও এ বার নতুন করে নিজেদের নিয়ে ভাবতে পারবেন।’’

চার দশক পরে স্টিফেনের ‘কেস’ আবার আদালতে ওঠার পরে বিচারপতিও এটাকে ‘ব্যতিক্রমী ঘটনা’ বলেছেন। স্টিফেনের আইনজীবী আদালতে জানিয়েছেন, ‘‘এই দিনটার জন্য আমার মক্কেলকে প্রায় ৪৩ বছর অপেক্ষা করতে হল!’’ দক্ষিণ লন্ডনের বাসিন্দা উইনস্টন ট্রিউ এখন সমাজবিদ্যার অধ্যাপক। সিমন্স যে দিন আদালতে আপিল করেন, উইনস্টনও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বলেছেন, ‘‘আমাদের মামলাটা নিয়েও এ বার নতুন করে লড়তে পারব। এখন বুঝতে পারছি, স্টিফেনের সঙ্গে যা হয়েছে তা আমাদের সঙ্গেও হয়েছিল।’’

নিন্দুকেরা বলে, পুলিশ নাকি ছাইয়েরও দড়ি পাকাতে পারে! স্টিফেন সিমন্স, উইনস্টন ট্রিউরা বলবেন, ‘আলবাত পারে!’ কখনও সিনেমায় প্রায়ই দেখা যায়, ভিলেনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা পুলিশ অফিসার বিপাকে পড়া নায়ককে বলছেন, ‘যা বলছি তা-ই কর। নইলে এমন কেস দিয়ে দেব,
সারা জীবন জেলের ঘানি টানবি।’ কখনও উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অভিযোগ ওঠে রাজ্য বা কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধেও। তবে লন্ডনে স্টিফেনের সঙ্গে পুলিশ যা করেছে তাতে লজ্জা পাবে লন্ডন হতে চাওয়া কলকাতাও!

Stealing Mailbags Google Arrest Justice Derek Ridgewell Stephen Simmons
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy