Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Farrukhsiyar

সম্রাটের ফোড়া কেটে অবাধ বাণিজ্য

মুঘল দরবারের হাকিমদের নাজেহাল অবস্থা, তাঁদের সামর্থ্যমতো সম্ভাব্য সমস্ত রকম চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়েছে। তা হলে এখন উপায়?

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২১ ০৮:০৪
Share: Save:

মসনদে তখন আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফারুখশিয়র। তাঁকে তুমুল ভোগাচ্ছে ঊরুসন্ধি আর পায়ুদ্বারের বিষফোড়া। দরবারে উপস্থিত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিদল। দিল্লীশ্বরের অসুস্থতার খবর শুনে সেই দলের প্রধান দেখলেন, সুবর্ণসুযোগ। এই তুরুপের তাস খেললে পাওয়া যেতে পারে অভাবনীয় সুবিধে।

যন্ত্রণা বলে যন্ত্রণা! ফিনকি দিয়ে ওঠা বিষের মতো যন্ত্রণা। যার তার যন্ত্রণা তো আর নয়, শাহেনশা-এ-হিন্দুস্তান, স্বয়ং দিল্লীশ্বর আবুল মুজাফফর মইনুদ্দিন মুহম্মদ শাহ ফারুখশিয়র-এর যন্ত্রণা বলে কথা। আসমুদ্রহিমাচল প্রায় সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশের একছত্র অধিপতি আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র, প্রথম বাহাদুর শাহের পৌত্র, একদা সুবে বাংলার শাসক আজিম-উস-শানের পুত্র, মুঘল সম্রাট ফারুখশিয়র।

শাহজাদা অসামান্য রূপবান, কিন্তু শরীর-স্বাস্থ্য কোনও দিনই বিশেষ সুবিধের নয়। মাঝে মধ্যেই ছোটখাটো নানা ব্যারাম লেগেই থাকে, তবে এই সমস্যাটা খুব ভোগাচ্ছে। তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ ঠিক হয়ে আছে জোধপুরের রাজপুত, মহারাজা অজিত সিংহের কন্যা ইন্দিরা কানোয়ারের সঙ্গে। বিজিত রাজা দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করে বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি করতে চাইলে এই বিয়ের প্রস্তাবনা। কিন্তু নতুনতম এই উপসর্গটার জন্য বিবাহ-অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিতে হয়েছে। পরিস্থিতি যেমন ঘোরালো, তাতে বিয়ের মতো বিশাল সমারোহের কেন্দ্রীয় চরিত্র হতে পারা তো দূরের কথা, ঊরু আর তলপেটের সন্ধিস্থলে বড়সড় এই মাংসস্ফীতির কারণে বাদশাহ ঠিক মতো উঠতে বসতে পর্যন্ত পারছেন না। তদুপরি গোদের উপর বিষফোড়া সদৃশ পায়ুদ্বারে প্রবল ব্যথা, মলত্যাগ করতে গেলে রীতিমতো রক্তপাত হচ্ছে।

আশু নিরাময় খুবই জরুরি, কিন্তু কোনও ওষুধই কাজে আসছে না। মুঘল দরবারের হাকিমদের নাজেহাল অবস্থা, তাঁদের সামর্থ্যমতো সম্ভাব্য সমস্ত রকম চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়েছে। তা হলে এখন উপায়?

সময়টা ১৭১৫ সালের মাঝামাঝি। বেশ কিছু কাল হল বাদশার কাছে তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত বেশ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্রতিনিধি দল এসে পৌঁছেছে দিল্লিতে। সঙ্গে পর্যাপ্ত উপঢৌকন যার দাম তখনকার হিসেবে এক লাখ দু’হাজার টাকার কিছু বেশি ও এক হাজার একটি সোনার মোহর নজরানা। এর সঙ্গে দরবারের ওমরাহদের নানা ধরনের উৎকোচ, যার অর্থমূল্য এক লাখ আট হাজার টাকার কিছু বেশি। এই সব কিছু দিয়ে বাদশাহ-ই-হিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তারা পেশ করেছে কলকাতার গভর্নরের আর্জিপত্র। আলোচনার চূড়ান্ত কোনও রফাসূত্র না বেরনো পর্যন্ত বাদশাহি মেহমান হয়ে রয়ে তারা রয়ে গেছে এই রাজধানীতেই।

স্বয়ং ফারুখশিয়রের অসুস্থতার খবর কান এড়ায়নি এই ইংরেজ প্রতিনিধি দলের প্রধান, ক্যাপ্টেন জন সারমনের। তাঁর আর্মেনিয়ান দোভাষী, খোয়াজা সারহেদ মারফত অনেক গোপন কানাঘুষোই গোচরে আসে তাঁর। শোনা যায়, সম্রাট নাকি ঈষৎ খামখেয়ালি, তাঁর বাবার মতো তিনিও বেশ পছন্দ করেন ইংরেজদের। বিলিতি খেলনা খুব ভালবাসেন, বড় হয়েও নাকি ছোটবেলার মতো বিচিত্র সব খেলনার লোভ ছাড়তে পারেননি। তার উপর বর্তমানে স্ফোটক এবং মাংসস্ফীতির দুরূহ সমস্যা একেবারে পেড়ে ফেলেছে সম্রাটকে। উড়ে উড়ে আসা এই সব নানা কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভিতর তাস ছড়িয়ে পড়ে ধুরন্ধর ক্যাপ্টেনের। সহসা নজরে পড়ে, তাঁর হাতেই রয়েছে তুরুপের তাস! বৃথাই এত দিন আকাশপাতাল ভেবে মরছিলেন তিনি। তাঁর দলেই যখন রয়েছেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হ্যামিলটনের মতো এক জন অসাধারণ শল্য চিকিৎসক, তখন আর চিন্তা কী!

ওমরাহদের মুখে-মুখে বাদশাহের খাস লোকজনের কাছে খবর পৌঁছয়, ইংরেজদের ওই প্রতিনিধি দলে এক জন ডাক্তার আছেন, যিনি এই ধরনের অসুখের চিকিৎসা করতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু দরবারের হাকিমরাই বা এমন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া মেনে নেবেন কেন? ইংরেজ ডাক্তার যদি সত্যি সত্যিই বাদশার রোগ সারিয়ে দিতে পারেন, তা হলে তো লজ্জায় তাঁদের নাক-কান কাটা যাবে। সম্রাটের কানে খবর দেওয়া হল, কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না এই সব লালমুখো সায়েবগুলোকে। না জানি কী সব বিষটিশ মেশানো আছে ওদের ওই সব ওষুধে। কিন্তু সে সব বিরোধিতা শেষমেষ ধোপে টিকল না, সন্দেহ নিরসন করতে পরীক্ষামূলক ভাবে হ্যামিলটনের ওষুধ আগে খাওয়ানো হল বাদশাহের খানসামা তকারাব খানকে। কোনও কুপ্রভাব ধরা না পড়ায় অবশেষে ওই বছরেরই অগস্ট মাস নাগাদ বাদশাহের অন্দরমহলে ডাক পড়ল হ্যামিলটনের।

বাদশা ফারুখশিয়র-এর কুঁচকির চিকিৎসা শুরু করলেন সাহেব ডাক্তার। মাসখানেকের মধ্যে ব্যথাটাকে কব্জাতেও এনে ফেললেন। কিন্তু মাস ফিরতে না ফিরতে এ বার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল পায়ুদ্বারের ব্যথাটা।

ডাক্তার বুঝলেন, কুঁচকির আগের ব্যথা আর পায়ুদ্বারের এই প্রদাহ সম্ভবত পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। এই ব্যথাটা নিশ্চয়ই নালি-ঘা বা ভগন্দর, পশ্চিমি চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে ফিশচুলা। হ্যামিলটনের চিকিৎসা কার্যকরী হল এ ক্ষেত্রেও। যন্ত্রণার প্রকোপ কমে এল কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। কয়েক মাসের মধ্যেই উপশম পেয়ে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শাহজাদা। এমন যন্ত্রণাদায়ক রোগ থেকে আরোগ্য পাওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু হতে পারে না এই দুনিয়ায়। এক মাস ধরে উৎসব লেগে গেল সারা দিল্লি জুড়ে, আর সেই সঙ্গে তোড়জোড় লেগে গেল রাজপুতকন্যার সঙ্গে বাদশাহের বিলম্বিত বিবাহ অনুষ্ঠানের। বিয়ের পরের রাতে বাদশাহ নিজে নববিবাহিতা বেগমকে নিয়ে ভুবনবিখ্যাত লালকেল্লায় প্রবেশ করলেন প্রধান ফটক লাহোরি দরোয়াজা দিয়ে। ইতিহাস বলছে, ১৭১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সেই বিবাহের মতো বর্ণাঢ্য ও ব্যয়বহুল বিবাহ-সমারোহ নাকি সে সেময়ে রাজা-বাদশাদের মধ্যেও ছিল বিরল। বিশেষ এক ধরনের পাঁচটি সমকেন্দ্রিক গোলাকার খোপবিশিষ্ট একটি সোনার থালা নির্মিত হয় সেই উপলক্ষে। থালাটির প্রথম খোপে ভরা ছিল হিরে, দ্বিতীয় খোপে চুনি, তৃতীয়টিতে পান্না, চতুর্থটিতে পোখরাজ এবং মাঝখানে ছিল বহুমূল্য সব মুক্তো।

হ্যামিলটনের চিকিৎসার উল্লেখ করে যে সব ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায়, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই সাহেব ডাক্তারকে বাদশাহের শরীরে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল কি না। তখন সেই অর্থে অ্যানাস্থেশিয়া আবিষ্কার হয়নি। সহজেই অনুমেয় যে, অজ্ঞান বা অবশ না করে কাটাছেঁড়া কী ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য আফিম খাইয়ে রোগীর চেতনা লুপ্ত করে অস্ত্রোপচার করার দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু যুদ্ধে জখম সেনানায়কের ক্ষতস্থানে অস্ত্র চালানো আর সজ্ঞানে থাকা ভারত-সম্রাটের শরীরে অস্ত্রোপচার তো এক কথা নয়। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে করা হয়, এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন হ্যামিলটনকে অস্ত্রোপচারের আশ্রয় নিতে হয়েছিল, আর ভাল সার্জেন হওয়ার শর্ত মেনে অপারেশন সারতে হয়েছিল খুব কম সময়ের মধ্যে। না হলে বাদশাহ পুরস্কার হিসেবে সাহেবের অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামগুলি সোনায় বাঁধিয়ে দেবেনই বা কেন! প্রসঙ্গত, সেই সঙ্গে সাহেবকে বাদশাহি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল একটি হাতি, একটি আরবি ঘোড়া, নগদ পাঁচ হাজার টাকা, দু’টি হিরের আংটি এবং একটি মণিমাণিক্যখচিত শিরোভূষণ, যা টুপিতে পালক লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।

একে সাহেব ডাক্তারের জোর বরাত ছাড়া আর কী বলা যায়। আসলে তেমন একটা বড় দরের ডাক্তার তিনি ছিলেন না। ডাক্তারি পাশ করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাবিকদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে ভারতের উদ্দেশে ভিড়ে পড়েছিলেন জাহাজের ডাক্তার হয়ে। তিনি স্কটল্যান্ডের ল্যানার্কশায়ারের মানুষ, লেখাপড়া সম্ভবত গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে। প্রথম মাদ্রাজে আসা ১৭০৯ সালে। তার পর অধুনা তামিলনাড়ুর কাড্ডালোরে কয়েক বছর কাটিয়ে চলে আসেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান ঘাঁটি কলকাতায়। তখনকার কলকাতা রোগভোগের ডিপো। অতিরিক্ত আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ুর এই দেশে নানা সংক্রমণ, জ্বর, ম্যালেরিয়া, ওলাউঠা, আন্ত্রিক তখন ইংরেজদের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক। সেই পরিবেশে তিন পাউন্ড মাস মাইনের সেকেন্ড ডাক্তারের কাজ করে তাঁর দিন চলছিল, এমন সময়ে ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি প্রসন্ন হলেন। ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কাউন্সিলের কেউ রাজি না হলে জন সারমন, হিউ বারকার আর এডওয়ার্ড স্টিফেনসনের সঙ্গে দিল্লির বাদশাহের দরবারে পাঠানো প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে রওনা দিলেন ভারতের রাজধানীর দিকে।

আরোগ্য পেয়ে বাদশাহ, হ্যামিলটনকে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পদ দিতে চেয়েছিলেন, সাহেব রাজি হননি। তবে তিনি সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচও করেননি। কথা দেন, নিজের দেশে পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আর আরও ভাল ওষুধ নিয়ে ফিরে সম্রাটের খাস চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দেবেন, কিন্তু সে সুযোগ তাঁর জীবনে আসেনি। কলকাতায় ফিরে কয়েকটা বছর কাটানোর পর ১৭১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই সাহেব ধন্বন্তরির মৃত্যু হয়। কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চের গোরস্থানে তাঁর সমাধিটি আর নেই, কিন্তু তার উপরের সাদা পাথরের সমাধিফলকটি আজও রক্ষিত আছে জোব চার্নকের সমাধিমন্দিরের চাতালে। তাতে ফার্সি অনুবাদ-সহ ইংরেজিতে যে কথাগুলো লেখা আছে তার মূল বক্তব্য, এই পাথরের নীচে যিনি শায়িত আছেন, তাঁর স্মৃতি এই দেশের কাছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ তিনি হিন্দুস্থানের সম্রাট ফারুখশিয়রকে এক মারণব্যাধি (ম্যালিগন্যান্ট ডিস্টেম্পার) থেকে আরোগ্য দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই কীর্তিবলে তিনি যে শুধু সেই মহান বাদশাহের সভায় উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিলেন তা-ই নয়, নিজের দেশ গ্রেট ব্রিটেন-সহ সমগ্র ইউরোপ মহাদেশকে গৌরবান্বিত করেছিলেন।

রাজার অসুখ তো সারল, কিন্তু তাতে হলটা কী? উত্তরে বলতে হয়, তাতে কী না হল! একটা ঘটনা যদি একটা উপমহাদেশের ভাগ্য চিরকালের জন্য বদলে দিতে পারে, তাকে আমরা যুগান্তকারী ছাড়া কী-ই বা বলতে পারি! বাদশাহ সেরে উঠে হ্যামিলটনের সুচিকিৎসার চূড়ান্ত ইনাম হিসেবেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে বসলেন বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলা বিহার ওড়িশায় নিঃশুল্ক ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র, যা ইতিহাসে ‘ফারুখশিয়রের ফরমান’ নামে খ্যাত। সময়টা ছিল ১৭১৭ সালের এপ্রিল। এই ফরমানে ইংরেজরা হাতে আকাশের চাঁদ পেল। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে জুটে গেল পূর্ব-করায়ত্ত সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নামের তিনটি গ্রামের পাশাপাশি আরও আটত্রিশটি গ্রাম কেনার, নিজেদের টাঁকশাল খোলার, পণ্য আমদানি-রপ্তানির দস্তক দানের এবং সর্বোপরি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সীমারেখা বাড়ানোর অনুমতি। এত দিন ধরে বাদশাহের কাছে দরবার করেও ইংরেজরা যে ব্যাপারটায় মোটেও সুবিধে করতে পারছিল না, তার সমাধান যে এই ভাবে হবে, সে আর কে ভাবতে পেরেছিল?

সারা ভারতে তখন জটিল পরিস্থিতি। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের ভয়ানক দুর্দিন। ফারুখশিয়র শাসক হিসেবে নিতান্তই দুর্বল। তিনি নামে বাদশাহ-ই-হিন্দুস্থান হলেও আসল ক্ষমতা ছিল ‘সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়’ নামে পরিচিত তাঁর উজির আবদুল্লা আর সেনাধ্যক্ষ হুসেন আলির হাতে। চার দিক থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মরাঠা, শিখ, নিজাম ইত্যাদি আঞ্চলিক শক্তি, তাদের পাশাপাশি আওয়ধ আর বাংলার নবাবরা। নির্মম হাতে জাঠ ও শিখ বিদ্রোহ দমন করেছেন ফারুখশিয়র, নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছেন শিখ গুরু বান্দা বাহাদুরকে। তাতে সুবিধে হয়নি। এ দিকে বাংলায় দিল্লির মসনদের অধীন হয়েও নিজের মতো শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ আর ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একেবারে আদায় কাঁচকলায়। এই রকম পরিস্থিতিতে ফারুখশিয়রের ফরমানের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হাজার হোক ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যে জাঁকিয়ে বসার পক্ষে যে সেটা একটা কেন্দ্রীয় অনুমোদন, তা না মেনে তো আর উপায় নেই। এ যেন ইংরেজদের কাছে আরও এক দফা ‘ম্যাগনা কার্টা’ লাভ, যা তাদের সামনে খুলে দিতে লাগল একের পর এক সম্ভাবনার দরজা।

সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল বুদ্ধিমান ইংরেজরা। যে ভাবে ফুটবল-মাঠে দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার বল পায়ে পেলে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে জালে বল ঠেলে দিতে ভুল করে না, সে ভাবেই বাজিমাত করল ইংরেজ বণিকরা। কয়েক দশকের মধ্যে তারা ফুলে-ফেঁপে হয়ে দাঁড়াল বাংলার অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি। বিলিতি কোম্পানির রমরমা এমনই বাড়তে শুরু করল যে, অচিরেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল বঙ্গ-অধীশ্বর মুর্শিদ কুলি খাঁ-র নাতি সিরাজদৌল্লার কপালে। আর তাই ইংরেজদের শায়েস্তা করতে মসনদে সদ্য বসা তরুণ নবাব আক্রমণ করে বসলেন ইংরেজ রাজধানী কলকাতা। সেই থেকে যে প্রত্যক্ষ শত্রুতার জন্ম, তার অবসান ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ে। তার পর বণিকের মানদণ্ডের রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হওয়া।

পলাশির রণাঙ্গনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেই যে খুঁটি পোঁতা হল, তার পর থেকে আর তাদের পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জিডিপি বা গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে তখনকার ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যতম ধনী ও সম্পদশালী দেশ। সেই দেশে দুশো বছরের কাছাকাছি শাসন ও শোষণ করে ইংরেজরা হয়ে উঠেতে পেরেছিল বিশ্বের বৃহত্তম ঔপনিবেশিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। সেই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনই আমূল বদলে দিয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতির আদল ও অভিমুখ। এরই উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি আজও। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যদি এই পাল্টে যাওয়া দেশ-কালের বাস্তবটাকে মানি, তা হলে তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে এত বড় পালাবদলের মূল বীজ সন্নিহিত ছিল ১৭১৭ সালের সেই ফারুখশিয়রের ফরমানেই। আর সেই বীজ থেকেই পরবর্তী কালে ব্রিটিশবৃক্ষ ভারত ছেয়ে ফেলে। এই সম্পূর্ণ ঘটনার মূল কারিগর কিন্তু সেই স্কটিশ ডাক্তার উইলিয়াম হ্যামিলটন। কারণ তাঁর শল্যবিদ্যায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট সম্রাট আরোগ্যের সুখ পান এবং সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই প্রত্যাশার অধিক প্রাপ্তিযোগ ঘটে সাহেবদের। পাঠ্যবইয়ে এই মানুষটিকে আজ হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও, কিন্তু কালান্তরের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে তাঁর নামটি না থেকেও আরও বেশি করে থেকে যাবে অনুসন্ধিৎসুদের নজরে।

তথ্যসূত্র: ১. ইতিহাসের কথা—প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত

২. দ্য ট্রুথ বিহাইন্ড দ্য লেজেন্ড : ইওরোপিয়ান ডক্টরস ইন প্রি-কলোনিয়াল ইন্ডিয়া— রাজেশ কোচ্ছর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

East India Company Mughal Empire Farrukhsiyar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE