Advertisement
E-Paper

গায়ে এসে লাগছে বই-পোড়া ছাই

ফেব্রুয়ারি ৩, ১৯৯৭। তখন বইমেলা হত ময়দানে, সে দিন কলেজ থেকে সোজা মেট্রো চেপে বইমেলা গিয়ে, মিঠে রোদ পিঠে লাগিয়ে ঘুরছি। একটা দোকানে ‘প্রিজনার্স অব জেন্ডা’ বইটা চোখে লেগে গেল।

শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
মাঠ ভর্তি পোড়া, আধপোড়া বইয়ের স্তূপ, দূরে আগুন জ্বলছে তখনও। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, কলকাতা বইমেলার ছবি।

মাঠ ভর্তি পোড়া, আধপোড়া বইয়ের স্তূপ, দূরে আগুন জ্বলছে তখনও। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, কলকাতা বইমেলার ছবি।

ফেব্রুয়ারি ৩, ১৯৯৭। তখন বইমেলা হত ময়দানে, সে দিন কলেজ থেকে সোজা মেট্রো চেপে বইমেলা গিয়ে, মিঠে রোদ পিঠে লাগিয়ে ঘুরছি। একটা দোকানে ‘প্রিজনার্স অব জেন্ডা’ বইটা চোখে লেগে গেল। কিনে ফেললাম। পরের স্টলে বই ঘাঁটছি, হঠাৎ মাইকে রবীন্দ্রসংগীত থেমে গিয়ে ঘোষণা: ‘দমকল কোথায় আছেন, এক্ষুনি আসুন, গিল্ড অফিসের পাশের স্টলে আগুন লেগেছে।’

গো়ড়ায় পাত্তা দিইনি। কোথায় না কোথায় একটু আগুন লেগেছে, সেই হুজুগে ছোটার চেয়ে বই দেখাটা ঢের কাজের। কিন্তু, এর পরেই হঠাৎ স্টলের আলো নিভে গেল। এক জন বলল, আগুন লেগেছে বলে ইলেকট্রিক লাইন অফ করে দিয়েছে। বুঝলাম, এ বার আর বাইরে না বেরিয়ে উপায় নেই। একটু সামনের দিকে এগোতেই দেখতে পেলাম, একটা দোকানে আগুনের শিখা লকলকাচ্ছে ঠিকই, তবে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বইমেলায় হাজির-থাকা দমকলও এসে গেছে দ্রুত। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, এ আগুন ছড়াবে না, বড়জোর দু-একটা দোকানের ক্ষতি হবে, তার মধ্যেই আগুন নিভিয়ে ফেলা যাবে।

অবাক কাণ্ডটার শুরু এর পর। মেরেকেটে মিনিট পাঁচেক পাইপে জল দিয়ে, দমকল জল দেওয়া বন্ধ করে দিল। জল নাকি ফুরিয়ে গেছে! শুনে সবাই হতবাক! ঢিল-ছোড়া দূরত্বে ময়দানের বিশাল দিঘি, আর দমকলের জল ফুরিয়ে গেছে! আয়রনিটা বুঝে উঠতে অবশ্য সময় লেগেছিল। জলাশয় আছে, কিন্তু জল বয়ে আনার কোনও বন্দোবস্ত নেই দমকলের। দমকলের রথী-মহারথীরা ভেবে রেখেছিলেন, সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডে তাঁরা পাম্প চালু করে দিঘি থেকে জল নেবেন, কিন্তু আগুন লাগলে শুরুতেই যে বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা রীতি, আর তা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা যে পাম্পও চালাতে পারবেন না, এত দূর কেউ ভেবে দেখেননি।

সুতরাং যা হওয়ার, তা-ই হল। ছোট-বড়, দেশি-বিদেশি, সব স্টলকে দ্রুত গিলে নিতে লাগল আগুন। মানুষ স্তম্ভিত। একটার পর একটা স্টলকে পুড়ে যেতে দেখে আমার শুধু মনে হচ্ছিল, যে স্টলগুলো বাইরে থেকে দেখতে এত কেতাসর্বস্ব আর বাহারি, ভেতরে ভেতরে সেগুলোও আসলে এতটাই পলকা? কোনও অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থা নেই? কেউ নিরাপত্তার প্রাথমিক শর্তগুলোকে পাত্তা দেয়নি? তখন আগুন ছড়াচ্ছে অসম্ভব দ্রুত। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে এক-একটা কাঠামো, সবাই চমকে উঠে দেখছে সেই বহ্ন্যুৎসব।

বুকফাটা কান্না এর আগে শুধু খবরকাগজের ছবিতে দেখেছি। সে দিন চাক্ষুষ দেখলাম। যে-সব ছোট বই-ব্যবসায়ী বছরের সব সঞ্চয় জড়ো করে বইমেলায় এসেছিলেন, হাহাকার ছাড়া তাঁদের আর কী-ই বা করার ছিল? কেউ কেউ স্টল থেকে বই বের করে সামনে ডাঁই করছেন, আর সুযোগ বুঝে সেই বই ঝপাঝপ টেনে নিচ্ছে বইচোরেরা। বেশির ভাগ দোকানিই অবশ্য অভিব্যক্তিহীন নির্বাক মুখে বাইরে বেরিয়ে কোলাপসিব্‌ল গেট টেনে স্টলে তালা মেরে দিচ্ছিলেন। তালাবন্ধ স্টলের ভেতর, মেঝেতে-তাকে থরে-থরে বই গিলে নিচ্ছে আগুনের শিখা। মনে হচ্ছিল, ভুল দেখছি।

হঠাৎ টের পেলাম, তীব্র উত্তাপে আমার গায়ের চামড়া জ্বলছে। কিন্তু আমি তো আগুন থেকে দূরেই। তা হলে? চার পাশে তাকাতে বুঝলাম, আগুন দেখার নেশায় এমন জায়গায় এসে পড়েছি, আমার সামনে, তিন দিকের সমস্ত স্টলে আগুন। বাকি শুধু পেছনের স্টলগুলো, সে দিকেও আগুন এগোচ্ছে দ্রুত। একটা শিরশিরানি লাগল মনে। বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলছি? দৌড়ে একটা সরু গলি দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সেখানে তখন জনতা আর প্রিন্ট মিডিয়ার (তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে মূলত দূরদর্শন আর খাস খবর) হুলুস্থুলু ভিড়। সামনে মাঠ ভর্তি পোড়া বইয়ের স্তূপ। আগুনের তাপে বাতাসেও একটা বদল এসেছে যেন, সামনের চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল বিল্ডিংটা এঁকেবেঁকে কাঁপছে। গায়ে এসে পড়ছে বই-পোড়া ছাই।

সে দিন সন্ধের নিউজে জানা গেল, এই অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন এক জন। আগুনে পুড়ে নয়, হুড়োহুড়ির মধ্যে সম্ভবত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। শুনলাম, রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় বইমেলা ফের শুরু হবে ৭ ফেব্রুয়ারি, চলবে ১৬ অবধি। নতুন করে শুরু হওয়া বইমেলায় প্রথম দিন ঢুকতে টিকিট লাগল না। আবার গেলাম। পুরোটা ঘুরে বুঝতে পারলাম, যে স্টলগুলো বরাতজোরে আগুন থেকে বেঁচে গেছে, নতুন করে শুরু মেলার ফায়দাটা নিতে পারছে তারাই। যে-সব স্টল আগের দিন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে একটু বড় প্রকাশকরা কিছু বই সাজিয়ে বসলেও, ছোটরা নিশ্চিহ্ন।

নতুন বইমেলার এক কোণে বানানো মুক্তমঞ্চের নাম রাখা হয়েছিল বইমেলায় প্রয়াত সেই মানুষটির নামে— ‘যতীন্দ্র শীল মুক্তমঞ্চ’। ছোট্ট একটা প্রকাশনা সংস্থার মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। নিঃস্ব, দু’চোখে শোক, ক্ষোভ। ‘বই তো আমার সব পুড়ে গেছে, এখন স্টল সাজাব কী দিয়ে? বাঁধাইকাররা পর্যন্ত বই বাঁধানোর রেট আড়াই টাকা থেকে চার-পাঁচ টাকা করে দিয়েছে। এত টাকা কোথায় পাব? নতুন স্টল বানিয়ে দিয়েছে গভর্নমেন্ট, ওগুলো স্টল? দেড়খানা তাক মোটে, বই রাখব কোথায়? আবার নিয়ম শুনিয়ে গেল, প্রতি স্টলে বালতি রাখতে হবে। কে দেবে? বাড়ি থেকে বইমেলায় বালতি বয়ে নিয়ে আসব?’ রাগে, উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। ‘বলছে নাকি ক্ষতিপূরণ দেবে! সব ভেতরের যোগসাজশ। বড় কোম্পানিগুলো পুরো শাঁস খেয়ে যাবে, আমাদের ৫০ টাকা বেকারভাতা ধরিয়ে দেবে!’

যা শুনেছি, সে বার মেলায় আগুনটা লেগেছিল বইয়ের স্টলের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া সব খাবারের দোকানের কোনও একটা থেকে। বইয়ের সঙ্গে স্টোভ-গ্যাস-কেরোসিনের অমন অনৈতিক বসবাস সেই থেকেই পাকাপাকি ভাবে নিষিদ্ধ। এখন বইমেলায় যে ফুড কোর্টের বন্দোবস্ত, সেও শুরু হল তার পরের বছর থেকেই।

ভাস্কর রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড, কলকাতা

bhaskar.film@gmail.com

নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

book fair Fire Rabibashariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy