প্রথম ছবিতে অভিনয় করার আগে আমি মোটেই ফিল্ম নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম না। পুরোদস্তুর বড়পরদায় যাওয়ার কথা কখনও ভাবিইনি। এ দিকে ’৯৬ সালের শেষের দিক থেকেই আমার ক্যামেরার সঙ্গে নিয়মিত মোলাকাত হচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাহান্ন এপিসোড’ করেছি। ওই সময়ই রানাদা (গুহ), সুদেষ্ণাদি (রায়)-র সঙ্গে আমার আলাপ। আসলে, সুদেষ্ণাদিই আমাকে প্রথম ঋতুদার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঋতুদা আগে থিয়েটার দেখে আমায় পছন্দ করেছিলেন, তার পর সুদেষ্ণাদি আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে যান। কিন্তু সিনেমা করার কথা ভাবতাম না। কারণ, সে সময় বাংলায় কমার্শিয়াল ছবিই রমরম করে চলছে। অথচ ছোট পরদায় আমি যে কাজগুলো করতাম, বিশেষ করে টেলিফিল্মগুলো, সেখানে আমাকে ভেবেই গল্প তৈরি করা হত। সেগুলো নারীকেন্দ্রিক গল্প ছিল, অভিনয়ের সুযোগও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তখন যে কমার্শিয়াল ছবিগুলো তৈরি হচ্ছিল, সেগুলো আদৌ নারীকেন্দ্রিক ছিল না। অভিনয়ের সুযোগও ছিল কম।
তা হলে আমি রানাদা আর সুদেষ্ণাদির পরিচালনায় ‘শুধু তুমি’-তে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম কেন? কারণ, আমার চরিত্রটা অসম্ভব ভাল ছিল। তত দিনে ওঁদের সঙ্গে আমি অনেকগুলো টেলিফিল্ম করে ফেলেছি। আর ওঁরাও প্রমাণ করে ফেলেছেন যে, ওঁদের একটা অন্য রকম ঘরানা আছে। একটা নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তখন ওঁরা কাজ করতেন, এখনও করেন। তা ছাড়া ছবিটা যাঁরা প্রযোজনা করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তখন আমি একটা সাপ্তাহিক সিরিয়াল করছি। ফলে প্রত্যেকটা সমীকরণই মিলে গেছিল— রানাদা, সুদেষ্ণাদি, অমন সুন্দর চরিত্র, বুম্বাদার বিপরীতে অভিনয়, চেনা প্রোডাকশন হাউস... না বলার কোনও জায়গাই ছিল না। তা ছাড়া ছবিটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এটা কিন্তু পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছিল না। আমি বলি, ওটা ছিল সেমি-কমার্শিয়াল ছবি। কারণ, তখনও নিউ এজ ছবির জমানা শুরু হয়নি। ফলে, ছবিটা চরিত্রের দিক থেকে এক দিকে কমার্শিয়াল আর অন্য দিকে নিউ এজ ফিল্মের মাঝের অংশটুকুতে পড়ে গিয়েছিল। মনে আছে, সুনেত্রা ঘটক ছবিটার রিভিউ করেছিলেন আনন্দবাজারে, তাতে লেখা ছিল— পোসেনজিত থেকে প্রসেনজিৎ। এই শব্দগুচ্ছ আমার এখনও মনে আছে। কারণ ওটাই আমার প্রথম ছবি, প্রথম ভাললাগা।
রানাদা, সুদেষ্ণাদিরও এটাই প্রথম ছবি ছিল। বুম্বাদার বিপরীতে কোয়েল আর আমি অভিনয় করেছিলাম। কোয়েলের সম্ভবত ওটা দ্বিতীয় ছবি। ছবির গল্পটা অন্য রকম। অভিনয়েরও যথেষ্ট সুযোগ ছিল। একটা ত্রিকোণ সম্পর্ক (ত্রিকোণ প্রেম নয় কিন্তু) নিয়ে গল্প। আমার যেটা চরিত্র, সেই মেয়েটিকে গল্পের গোড়ায় খুব একটা বোঝা যায় না। তাকে মনে হয় নায়কেরই প্রেমিকা। সেকেন্ড হাফের একটু আগে সে অ্যাপিয়ার করে। সে একটি স্কুলে পড়ায়। নায়কের সঙ্গে তার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পরে কিন্তু জানা যায়, এরা আসলে ছোটবেলার বন্ধু। এক কলেজে পড়ত। এই মেয়েটির হবু স্বামীকে মাওবাদীরা তুলে নিয়ে যায়। তখন থেকেই নায়কের সঙ্গে মেয়েটির এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব, একটা নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে দেখা যায়, নায়ক আসলে ভালবাসে অন্য মেয়েটিকে। আগের মেয়েটিই ভুল বুঝেছিল। এবং সেখানে ভারী সুন্দর একটা সমাপ্তি হয়। সাধারণ গল্প। কিন্তু ট্রিটমেন্টটা ভীষণ অন্য রকম। একটা অদ্ভুত বাঙালিয়ানা ছিল তার মধ্যে। এই কারণেই আরও আমি ছবিটা করতে সায় দিয়েছিলাম।
অরুণাচলের শিলাটপকে বেছে নেওয়া হয়েছিল শুটিংয়ের লোকেশন হিসেবে। অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার একটা প্রচণ্ড সিডাকটিভ নাচ ছিল এই রকম অপূর্ব পরিবেশে। শিলাটপে তখন ভয়ংকর ঠান্ডা। তাপমাত্রা মাইনাসের তলায়। ঠকঠক করে কাঁপছি সকলে। প্রচুর গরমজামা চাপিয়েছি গায়ে। রাস্তায় বরফ জমে গেছে। তার মধ্যে প্রায় ক্যাটওয়াক করে চলতে হচ্ছে গানের তালে তালে। থেকে থেকেই হাতে গ্লিসারিন ঘষে, গরম জল খাইয়ে আমাদের চাঙ্গা করে তুলতে হচ্ছে। মজাও হচ্ছে দেদার।
এক বার তো সাংঘাতিক রেগেও গেলাম। আমি, সুদেষ্ণাদি, রানাদা, কোয়েল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গাড়ি করে আসছি। বুম্বাদা এগিয়ে গেছে। হুডখোলা একটা জিপ। হু হু করে ঠান্ডা ঢুকছে। সবাই আমরা রেগে আগুন। রাগটা নিজেদের ওপরেই হচ্ছে। কারণ আমরাই তো ঠিক করেছি ওই রকম একটা জায়গায় ওই রকম একটা গাড়িতে যাব। তাই, সবাই সবার ওপর রাগ করে চলেছি, কেন এ রকম একটা বোকামি করলাম। কিন্তু পরে যখন বড় পরদায় ওটা দেখি, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। বরফের ছবি তুলতে এখন তো কত জায়গায় যাওয়া হয়। কিন্তু শিলাটপের মতো সুন্দর বড় একটা চোখে পড়ে না।
‘শুধু তুমি’ রিলিজ করল ২০০৩ সালে। প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিল ছবিটা। কিন্তু এটার পর আমি দীর্ঘ দিন কোনও ছবি করিনি। তার পর রানাদা আর সুদেষ্ণাদি এল ‘তিন ইয়ারি কথা’ নিয়ে। তত দিনে আমিও বেশ খানিকটা অভিজ্ঞতা জমিয়ে ফেলেছি।
তিন ইয়ারি কথা-কে বলা হয় নিউ এজ ফিল্মের প্রথম সফল ছবি। অসম্ভব অন্য রকম একটা ছবি। বুম্বাদার হাউস থেকে ছবিটা প্রোডিউস করা হয়েছিল। এটা আমার কেরিয়ারেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি। আমার চরিত্রটা সেখানে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। ছবিতে ‘দোলা’ নাম ছিল আমার। এক মফস্সলের মেয়ে, যে ফিল্মে নামতে চায়। এবং সে সেই স্ট্রাগলটা করছে। একটা ডায়ালগ ছিল... এই জন্যই তো থিয়েটার ‘করে’, আর ফিল্মে ‘নামে’। নামতে নামতে আমি কোথায় নেমেছি দ্যাখ।
চরিত্রটার সঙ্গে আমার নিজের মিল ছিল অনেক। একটা মেয়ে, থিয়েটার যার ব্যাকগ্রাউন্ড, হঠাৎ সে ভাবল সিনেমা করবে। এ রকম অনেকেই আছে, যারা সত্যি সত্যি শহরে কাজ করতে এসে গ্ল্যামারের মোহে ডুবে কোথায় যেন হারিয়ে যায়! তো, ছবিতে পরমব্রত এই মেয়েটি, অর্থাৎ তার দোলাদির প্রেমে পড়ে। ‘দোলাদি’ বলতে সে অজ্ঞান। সেও থিয়েটার করে।
এ দিকে তার থেকে তিন-চার বছরের বড় দোলাদি ছিল দলের মক্ষিরানির মতো। দোলার ডায়ালগগুলো খুব চোখা চোখা ছিল। সময়ের চেয়ে ঢের এগিয়ে বলা কথা।
ছবিটায় আমি ছাড়াও পরমব্রত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, জুন মাল্য, নীল, রুদ্রনীল, রিমঝিম ছিল। এটা রিলিজ করতে একটু দেরি হয়। কিন্তু তার মধ্যেই ইউটিউবে এর ভিউয়ার লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy