তখনই সেই অদ্ভুত মারণরোগ, অর্থাৎ সিনড্রোম কে-র প্রাদুর্ভাবের শুরু। নাৎসিদের হাত থেকে আশ্রিতদের বাঁচানোর জন্য অভিনব এক পরিকল্পনা করলেন চিকিৎসকরা। বোরোমেয়ো প্রচার করতে শুরু করলেন, এক বিরল এবং সংক্রামক রোগ হঠাৎ নতুন স্ট্রেন নিয়ে ফিরে এসেছে। রোমানদের মধ্যে সাংঘাতিক ছড়িয়ে পড়েছে রোগটা। হাসপাতালের ‘কে ওয়ার্ড’-এ যারা ভর্তি আছে তারা প্রত্যেকে এই রোগে আক্রান্ত। কী হয় এই রোগে? জানানো হল, এই রোগে সারা শরীরে খিঁচুনি, স্মৃতিভ্রংশ, ক্রমশ পক্ষাঘাত হয়ে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু। ওই এলাকার ধারেকাছে যারা যাবে তাদেরও সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা। আর এ এমন জটিল অসুখ যে, এক বার কেউ আক্রান্ত হলে মৃত্যু অবধারিত।
‘সিনড্রোম কে’ নামটাও দেওয়া হয়েছিল বিদ্রুপাত্মক রসিকতায়। ‘কে’ শব্দটা এসেছিল অ্যালবার্ট কেসেলরিং আর হার্বার্ট কেপলারের নাম থেকে। নাৎসি সেনাধ্যক্ষ অ্যালবার্ট কেসেলরিং-এর নির্দেশে রোমের নাৎসি পুলিশ অধিকর্তা কেপলার, আর্ডেটাইন কেভে ৩৩৫ সাধারণ নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। এই দুই ভয়ঙ্কর অত্যাচারী নাৎসির হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচানোর জন্য এদের উপহাস করে এদেরই নামে দেওয়া হল ‘ভয়ঙ্কর’ অসুখটার নাম। প্রত্যেক রোগীর নামে তৈরি হল ভুয়ো কাগজপত্র। যখনই কোনও ইহুদি পালিয়ে আসত হাসপাতালে, তার ভর্তির কাগজে অসুখের জায়গায় লেখা হত ‘সিনড্রোম কে’। এর মাধ্যমে চিকিৎসকরা বুঝতে পারতেন কে আসল রোগী, আর কে হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছেন।
শুধু ইহুদি নয়, ইটালির বহু বিশিষ্ট ফ্যাসিস্ট-বিরোধী মানুষ সেই সময় রোগী সেজে এই হাসপাতালে আশ্রয় নেন এবং ভুয়ো রোগশয্যা থেকেই তাঁদের নাৎসি-বিরোধী কর্মকাণ্ড চালু রাখেন। এর মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিক গিউসেপ্পে রোমিতা, ক্যাথলিক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অ্যাসচিলা গ্রান্ডি, পেরোত্তি পাস, গিউসেপ্পে স্প্যাতারো-সহ আরও অনেকে। পোপকে নিয়ে যত অভিযোগই থাক এই হাসপাতালের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন ফাদার মাউরিজিয়ো বাইলেক। এখানকার ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি-বিরোধী সমস্ত কাজে তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। তাঁর সাহায্যেই ইহুদি চিকিৎসক ভিত্তোরিয়ো ইমানুয়েল সাচেরদোতি-কে ভুয়ো কাগজে হাসপাতালে কাজ দেন বোরোমেয়ো। ধর্মের জন্য আগের চাকরিটা খুইয়েছিলেন তিনি। ‘কে সিনড্রোম’ নিয়ে এই বিরাট আর বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডে ভিত্তোরিয়ো ইমানুয়েল ছিলেন অন্যতম প্রধান সহায়ক। তিনি টিবার আইল্যান্ডের পাশের ইহুদি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত রোগী নিয়ে আসতেন এখানে উন্নত চিকিৎসার জন্য। এখানেই শেষ নয়, মাউরিজিয়ো এবং বোরোমেয়ো হাসপাতালের নীচে বসান বেআইনি রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। এর মাধ্যমে তাঁরা ইটালিয়ান রয়্যাল এয়ার ফোর্সের জেনারেল রবার্ট লর্ডির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
এ ভাবেই চলছিল সব। কিন্তু এক দিন ঘটল দারুণ বিপদ। ফাতেবেনেফ্রাতেল্লির বেসমেন্টে থাকা রেডিয়ো ট্রান্সমিটারের সন্ধান পেয়ে গেল নাৎসিরা। এক ডাবল এজেন্ট মারফত অতি গোপনে খবর এল, সেই দিনই তল্লাশি চালাতে আসছে নাৎসি মিলিটারি বাহিনী।
ইহুদি বন্দি শিবিরের খুব কাছে হওয়ায় হাসপাতালটির উপর দীর্ঘ দিন ধরে নজর ছিল নাৎসিদের। তল্লাশি প্রত্যাশিতই ছিল, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলেন চিকিৎসকরা। প্রথমেই রেডিয়ো ট্রান্সমিটার টিবারের জলে ফেলে দেওয়া হল। যথাসময়ে হাজির হল নাৎসিরা। হাসপাতালের সমস্ত ওয়ার্ডে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে এক সময় তারা এসে পৌঁছল কে ওয়ার্ডের সামনে। তত ক্ষণে সেখানকার বাসিন্দাদেরও সতর্ক করে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। ভিত্তোরিয়ো সাচেরদোতির ভাইঝি দশ বছরের লুসিয়ানা-সহ আরও কিছু বাচ্চাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ওই ওয়ার্ডে। তাদের বলা হল, ক্রমাগত কেশে যেতে। বড়দের বলা হল, গলা দিয়ে এমন বিকৃত আওয়াজ করতে, যেন প্রচণ্ড শারীরিক কষ্ট পাচ্ছে তারা। নাৎসিদের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার আগে বোরোমেয়ো খুবই নিস্পৃহ গলায় তাদের বললেন যে, এই ওয়ার্ডে ঢুকলে জীবনসংশয়ের আশঙ্কা প্রবল। অসুখটা অতি ছোঁয়াচে। কোনও ভাবে হাসপাতালের রোগীদের থেকে এক জনের হলে পুরো নাৎসি বাহিনীতে মড়ক লেগে যেতে পারে। ভিতর থেকে আসা ভয়ানক সব শব্দ, চিকিৎসকের ঠান্ডা সতর্কবার্তা, সব মিলিয়ে আতঙ্কিত হয়ে গেল নাৎসিরা। চিকিৎসক সাচেরদোতি পরে এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সিংহের মতো বুক চিতিয়ে এসেছিল গেস্টাপোরা। কিন্তু কে ওয়ার্ডে ঢোকার কথা হতেই সব খরগোশের মতো পালাল। ওরা ভেবেছিল, যক্ষ্মা বা ক্যানসারের মতোই কোনও মারাত্মক অসুখ কে সিনড্রোম।’
সেই প্রথম আর সেই শেষ। এর পরেও কয়েক বার হাসপাতালে তল্লাশি চালালেও মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কে ওয়ার্ডের ধারেকাছে ঘেঁষেনি নাৎসিরা। হাসপাতাল থেকেই এখানে আশ্রয় নেওয়া ইহুদিদের সময় সুযোগ মতো অন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হত। পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত কে ওয়ার্ড যতটা সম্ভব রক্ষা করে গিয়েছে ইহুদিদের। ইহুদিদের রক্ষা করে গিয়েছেন আদ্রিয়ানো ওসিসিনি, জিয়োভানি বোরোমেয়ো, ভিত্তোরিয়ো সাচেরদোতির মতো চিকিৎসকরা, যাঁরা মনুষ্যত্বের প্রতি সীমাহীন অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা এবং এর সঙ্গে জড়িত অন্য মানুষরা জানতেন, সামান্য ভুল, একটু অসতর্কতা প্রাণসংশয় ঘটাতে পারে। তাও তাঁরা মাথা নোয়াননি ফ্যাসিস্টদের কাছে। আদ্রিয়ানো ওসিসিনি পরে ইটালির স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সমন্বয় দফতরের মন্ত্রী হন। চরম দুঃসময়ের আশ্রয়দাতা বোরোমেয়োকে ইহুদিরা ভোলেননি। তাঁর কাজ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়। হলোকাস্টের স্মৃতিরক্ষা সংস্থা ইজ়রায়েলের ইয়াদ ভাসেম তাঁকে মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করে।
কে সিনড্রোম বলে যে আসলে কোনও অসুখই নেই, সবটাই যে ভিত্তিহীন আর ভুয়ো, তা কোনও দিনই জানতে পারেনি নাৎসিরা। সেই প্রথম বার সংক্রামক আর মারণ এক ‘অসুখ’ বাঁচিয়ে দিয়েছিল বহু মানুষের প্রাণ।