Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
কন্ডাক্টরের হতাশার চিহ্ন বাসের গায়ে চড়থাপ্পড়ের দাগ।
road

তোমার বাস কোথা যে পথিক

মধ্যবিত্ত বাঙালির যানবাহন মানেই বাস। আস্তে চললে ঝগড়া, ভিড় বাড়লে গালি, যত দোষ কন্ডাক্টরের। তাকে টিকিট ফাঁকি দেওয়া অন্যতম অ্যাডভেঞ্চার।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২১ ০৭:৩৩
Share: Save:

বাসের ভিতরে, টিনের দেওয়ালে লেখা ‘তিন বৎসরের ঊর্ধ্বে পুরা ভাড়া লাগিবে’। ঠিক নীচের সিটেই বসেছিলেন এক মহিলা, সঙ্গে তিনটি বাচ্চা। কন্ডাক্টর হাত বাড়ালে বললেন, “চিংড়িহাটা থেকে বাঙুর, একটা।” কন্ডাক্টর বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছুড়ে দিলেন, “আর এগুলো? এদের?” ভদ্রমহিলার সপাট উত্তর ছিল, “চোখে দেখতে পান না? এ দু’ বছর আট মাস, এ সবে দুইতে পড়ল। আর কোলেরটাকে তো দেখতেই পাচ্ছেন। সাড়ে ন’মাস চলছে।” কন্ডাক্টর কী যেন ভাবলেন। তার পরে বললেন, “দিদি, বছরখানেকের তো একটা হিসেব রাখুন। হ্যাচারি না কি!”

পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যেখানে জীবন উল্টো দিকে চলে, তার নাম বাস। জীবনে যতই আমরা সামনের দিকে এগোই, অন্তত এগনোর চেষ্টা করি খানিক, বাসে উঠলেই তার গতি বদলে বদলে যায় পুরোপুরি। কন্ডাক্টর বলেন, বলেই চলেন, “পিছনের দিকে এগিয়ে যান, পুরো ফাঁকা, খালি গাড়ি, চলুন চলুন... গেটের সামনে ভিড় করবেন না।” অফিসফেরত ঘেমো পাবলিক গর্জে ওঠে, “যাবটা কোথায়? জায়গা কই? এ বার কি বাসের মাথায় লোক তুলবে না কি?” কন্ডাক্টর বলেন, “অত পবলেম হলে ট্যাক্সি করে চলে যান...” পাবলিক বলে, “গরম দেখাচ্ছ না কি?” কন্ডাক্টর বলেন, “আস্তে কথা বলুন। থুতু ছিটছে তো মুখ দিয়ে। থুতুতে করোনা।” পাবলিক বলে, “ঘাড় ধরে নামিয়ে দেব তোকে হারামজাদা।” কন্ডাক্টর তত ক্ষণে বাসের হাতল ধরে হাফ ঝুলে ফের চিৎকার শুরু করে দেন, “এই উল্টোডাঙা, লেকটাউন, এয়ারপোর্ট, বিরাটি, চাপ্পাডালি, চাপ্পাডালি, সিট খালি সিট খালি...”

যাঁদের নিজস্ব গাড়ি আছে, তাঁদের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল। অনেকের কাছে শখ করে কেনা বাহন প্রেমিকার চেয়েও প্রিয়। নতুন কেনা কালো পোলো গাড়ির চাকায় পাড়ার কালুকে ঠ্যাং উঁচিয়ে বদকম্ম করতে দেখে লাথি মেরে সেই অবলা চতুষ্পেয়ের এক ঠ্যাং খোঁড়া করে দিয়েছিলেন আমার এক পাড়াতুতো দাদা। স্কুলজীবনে এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে, যার রেসিং সাইকেলের সামনের রডটায় মুখ দেখা যেত। জানতে পেরেছিলাম, ধবধবে সাদা বাহারি সাইকেলের রং যাতে না পুড়ে যায় রোদে, তার জন্য ও দিদির ফেয়ারনেস ক্রিম মালিশ করে প্রতিদিন, সাইকেল-শরীরে। বহু রিকশামালিক তাঁর রিকশার সিটকে পরম মমতায় মুড়ে দিতেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি দিয়ে। আজও দেন। থাকে জিৎ-দেব-নুসরতরাও। রিকশার সিটে সানগ্লাস পরা শাহরুখ, খালি গায়ে সলমন দেখেছি বহু বার। চালকের মুখে বিড়ি, রিকশার পর্দায় জরির ঝালর। গুটিকয় ভলভো ছেড়ে দিলে এই মমতা কোনও বাস কিন্তু পায় না। অনেক বাসের পিছনে লেখা দেখেছি— ‘জন্ম থেকেই জ্বলছি’। কিংবা ‘সুখ স্বপনে, শান্তি শ্মশানে’। কথাটা যে কতটা সত্যি, তা শুধু বাসেরা জানে। যে রুটের বাসে ফিরি রোজ, সে শ্যামবাজারের সিগনালে উর্দি পুলিশের লাথি খায়, চিড়িয়ামোড়ে এসে সিভিক পুলিশের পাইপের ক্রমাগত বাড়ি খায়, দমদম স্টেশনের নীচে পিছনের বাসের কন্ডাক্টরের হুড়কো খায় আর কারশেডে গিয়ে মালিকের গালি খায়। বাস যদি আত্মজীবনী লিখতে পারত কোনও দিন, হয়তো বলত, ‘সবচেয়ে যন্ত্রণা যার থেকে পেয়েছি, সে আমার পরমাত্মীয়। বাস কন্ডাক্টর। আমার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আমার গর্ভগৃহে, আমার ব্রেন হৃৎপিণ্ড ফিমারে, সবচেয়ে বেশি থাপ্পড়ও মেরেছে ও। চড় মারতে মারতে ওর হাত কেটেছে কত বার। তাও মেরেছে। যে জায়গাটা ও ঝোলে, আমার শরীরে ঢোকার মুখের দরজার ডান দিকে, তার উল্টো দিকের টিনটা, আপনাদের ব্যস্ত জীবনে, কখনও সময়ে কুলোলে দেখবেন। থামার জন্য তিন থাপ্পড়, চলার জন্য ছ’টা। কেউ আবার থামার জন্য দুই, চলার জন্য চার। ড্রাইভারের সঙ্গে কন্ডাক্টরের এই টরেটক্কার এক অদ্ভুত, গোপনীয় কেমিস্ট্রি আছে আমি জানি। যা থেকে যায়, তা শুধু থাপ্পড়ের সিগনাল। আমার লাগে। খুব লাগে।’

অনেক বাসের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছাদ বরাবর আগে একটা দড়ি টাঙানো থাকত। ড্রাইভারের সিটের বাঁ দিকে, মাথার উপরে বসানো থাকত একটা ছোট্ট ঘণ্টা। ট্রিং ধ্বনিতে বাস থামত, ডবল ট্রিংয়ে চলত আবার। অজানা কোনও কারণে বহু বাস-শরীর থেকে সেই ঘণ্টাধ্বনি ও তার ব্যবস্থা লোপাট অনেক দিন। এক কন্ডাক্টরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেছিলেন, “এ সব টিংটংয়ে আর কাজ হয় না ভাই, এখন শুধু ধরে ক্যালানোর যুগ। হাঘরের মতো তেল খায়, মালিককে খাওয়ানোর পর আমার পকেটে এই এতটুকু। ক্যালাব না?” কয়েকবার হাওড়া-হাওড়া বলে তাঁর পেটেন্ট নেওয়া কর্কশ মন্ত্রোচ্চারণ করে আবার বললেন, “সারা দিন পাবলিকের খিস্তি... কার উপরে পাল্টা দেব বলুন তো? এই চড়-থাপ্পড়গুলো মারধর নয় আসলে, বলতে পারেন আমার ফাসটেশন। নিজের ওপরে ঘেন্না... বুইলেন?”

অঙ্ক নিয়ে সেকেন্ড ইয়ার অবধি পড়া, পাঁচ জনের সংসার ডুবিয়ে দিয়ে দুম করে হার্ট অ্যাটাকে কেটে পড়া বাবার ছেলে শুনিয়েছিলেন টিকিট ফাঁকি নিয়ে তাঁর নিজস্ব অ্যানালিসিস। সংসারের হাল ধরতে ঢুকে পড়েছিলেন কন্ডাক্টরিতে। বাধ্য হয়েছিলেন। জানলাম, বাসে উঠে খাজনা, মোটে ভাল কাজ না—এই সত্যে বিশ্বাস করেন এমন মানুষের সংখ্যা নাকি প্রচুর। দু’দরজাওয়ালা বাস হল তাঁদের কাছে সোনার খনি। বাসে ওঠার পরেই তাঁরা মাঝামাঝি কোনও জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। যে দরজা দিয়ে বাসে ওঠেন, নামেন তার উল্টো দিকের দরজা দিয়ে। ওই দরজার কন্ডাক্টর প্রশ্ন করলে অন্য দিকের কন্ডাক্টরের দিকে দেখান। কন্ডাক্টর ভুরু কুঁচকোলে নিমেষে ডবল ভুরু কুঁচকে দেন ওই যাত্রী। মুখটা দেখলে মনে হবে যেন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মগনলাল মেঘরাজ— হামি কি আপনাকে মিথ্থা কথা বলছি? বেশ কিছু অবাঙালি টিকিট-ফাঁকিবাজকে বাস থেকে নামার সময় প্রশ্ন করা হলে মুখটা উপরের দিকে তুলে, গুটখার রস চেপে নিয়ে উঁ-উঁ করেন। অনেকে আছেন, বাসের টিকিট জমান। বুক পকেটে রেখে দেন টিকিটের গোছা। কন্ডাক্টর টিকিট দেখতে চাইলেই পকেট থেকে এক তাড়া টিকিট বার করে নিয়ে বলেন, “বললাম তো করেছি, এখন খুঁজব না কি এর মধ্যে? যত্তসব!” বিরক্তি উগরোতে উগরোতে টুক করে নেমে ছুট লাগান। কেউ আবার পুরনো কোনও টিকিট, বাসে ওঠার পরেই ঘড়ির বেল্টের নীচে উল্টো করে ঢুকিয়ে রেখে দেন। নামার সময় কন্ডাক্টরের চোখে প্রশ্ন দেখলে সেই হাতটা ওঁর চোখের সামনে নাড়ান। বেশ কিছু অতি বুদ্ধিমান আছেন, নিজের স্টপেজ চলে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে পকেট থেকে ফোনটা বার করে, কানে ধরে, “সে কী রে, কী করে হল অ্যাক্সিডেন্ট? দাঁড়া আসছি এক্ষুনি...” বলতে বলতে ঝপ করে নেমে যান বাস থেকে। এমন নাট্যরূপে টিকিট চাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না কন্ডাক্টরের। টিকিট চাওয়া হলে কয়েক জন, বিশেষত বয়স্করা, পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন বের করে কন্ডাক্টরের হাতে দিয়ে মুচকি হাসেন। তার পর মাথার সামনে হাত চিহ্ন দেখান। মানে হল, এটা রেখে দাও বাবা, টিকিট লাগবে না। দশ টাকার বাসভাড়ায় পাঁচ টাকা সুপার সেভ। অনেকে আবার হুঙ্কার দেন, “দাদা, বোর্ডিং পাস কি এখন দু’বার করে নাও?”

যাঁরা এ সব ছলচাতুরি শিখে উঠতে পারেননি এখনও, টিকিট চাইলেই তাঁরা বলেন, ‘দিচ্ছি’। বাস মালিকেরাও দূরদর্শী। বাসের বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়ার দিনই তাঁরা টিনের চামড়া রাঙিয়ে দেন সেই চিরায়ত উল্কি দিয়ে— ‘দিচ্ছি দিচ্ছি করবেন না।’ তাও লোকেরা সেটাই করেন। দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরলে দেখেছি, বাসে নিজের নির্দিষ্ট সিটে রাজার মতো বসে থাকেন বাস কন্ডাক্টররা। কোনও যাত্রী বাসে ওঠার পরে সবার প্রথম কন্ডাক্টরের কাছে গিয়ে টিকিটটি কেটে নেন। তার পরে সিট খালি থাকলে বসেন। আমাদের রাজ্যে এমন ভাবনাটাই পাঁচ টাকার চটিবইয়ের চুটকির মতো। এক ‘ভাল কিন্তু বদমাইশ’ যাত্রীর কথা শুনেছিলাম অঙ্ক পাশ ওই কন্ডাক্টর সাহেবের থেকেই। বললেন, “দেখতে শুনতে ভদ্রলোক, কিন্তু টিকিট চাইতেই পাঁইপাঁই করে দৌড়লেন। বাস তখন বাইপাসে। আমিও দৌড়লাম। ভাবলাম, লিমিট টেন্ডস টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি হলেও এর শেষ দেখে ছাড়ব। প্রায় মিনিটখানেক ধরে ধরব-ধরব করছি তবু ধরতে পারছি না। শেষে বাগে পেয়ে কলার চেপে ধরে বললাম, টিকিট? বলামাত্র উনি পকেট থেকে বার করে টিকিট দেখিয়ে দিলেন। তাজা টিকিট। আমি তাজ্জব। বললাম, তা হলে চোরের মতো দৌড়লেন কেন? উনি বললেন, ‘কোন শাস্ত্রে লেখা আছে দৌড়নো মানা? জন্ম থেকেই তো ছুটছি ভাই।’”

ঠেসেঠুসে বাসের পাদানিতে ঝুলে যাওয়ার মতো জেদ যদি স্কুলজীবনে থাকত তা হলে হয়তো অটো গিয়ার আর সানরুফওয়ালা চারচাকা হত আজ। এ পোড়া জীবনে যত ক্ষণ শ্বাস, তত ক্ষণ বাস। আর কোনও গতি নেই, অগত্যা। বাসে ওঠার পর থেকেই উড়ে আসে টিকিট বান্ডিল শাফল করার চিড়িক চিড়িক শব্দ। এক কন্ডাক্টরবাবুকে সে দিন দেখলাম, জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, “দাদা হয়েছে?” এক রসিক কপোত-কপোতী, সম্ভবত সদ্যবিবাহিত, বসে ছিলেন একে অন্যের কাঁধে হাত রেখে। একই হেডফোনের একটা বাড কপোতের কানে গোঁজা, আর একটা কপোতীর। কন্ডাক্টর বারতিনেক জিজ্ঞেস করলেন, “দাদা হয়েছে? ও দিদি, হয়েছে? কী হল, শুনতে পান না? হয়েছে?”

যুবক এ বারে মৃদু লাজুক গলায় বললেন, “সবে তিন মাস তো বিয়ে হল। ঠিক হবে।”

তার পর বৌয়ের দিকে ফিরে গাল টিপে বললেন, “কী গো?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

road Buses
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE