E-Paper

মণি বাইজির হাত ধরেই শুরু পুরুলিয়ার রথযাত্রা

তখন তিনি আর রাজা নীলমণি সিংদেওয়ের নাচঘর আলো করা পরমা সুন্দরী মণিবাইজি নন। দীক্ষিতা বৈষ্ণবী মনমোহিনী দাসী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দের জন্যই তিনি পৌরসভার অনুমতি নিয়ে নির্মাণ করান পিতলের রথ। এ বার ১১২ বছর পূর্ণ করবে সেই রথযাত্রা।

স্মৃতিবাহী: পিতলের পাত দিয়ে মোড়া নবরত্ন চূড়াবিশিষ্ট মণি বাইজির রথ।

স্মৃতিবাহী: পিতলের পাত দিয়ে মোড়া নবরত্ন চূড়াবিশিষ্ট মণি বাইজির রথ।

ভাস্কর বাগচী

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৯:৪২
Share
Save

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে ঢেউ খেলানো রাঙামাটির দেশ পুরুলিয়া। এক দিকে অযোধ্যা পাহাড়। জঙ্গল, বামনি-টুরগা ঝরনা, হাতির পাল, হরিণের ঝাঁক, বাঘ— এরই মাঝে সমতলভূমি। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কাঁসাই নদী। এই লালমাটি, পাহাড় আর বনের দেশ পুরুলিয়ার আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভাদু-টুসু গান। এখানকার শিকড়ে লেপ্টে থাকা এই লোকগানের সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাস ও কিংবদন্তির রূপকথারা।

পুরুলিয়ার ইতিহাসে রাজা ও রাজবংশের ইতিহাস বলতেই উঠে আসে প্রায় দু’হাজার বছরের প্রাচীন পঞ্চকোট রাজবংশের কথা। পঞ্চকোট রাজবংশের সপ্তম ও শেষ রাজধানী ছিল কাশীপুর, আর এই রাজবংশের সব চেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন রাজা নীলমণি সিংদেও। ১৮৩২ থেকে শুরু করে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাশীপুর রাজবাড়ির বিশাল পরিবর্তন হয়। রাজা নীলমণি সিংদেও এবং তাঁর সুযোগ্য পৌত্র রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংদেও-এর হাত ধরে এক অনন্ত কৃতিত্বের নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায় কাশীপুর রাজবাড়ি।

আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে পঞ্চকোটের সংযোজন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছ’টি সনেটের মধ্য দিয়ে। বাংলা সাহিত্যে ‘পুরুলিয়া’ শব্দটি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। জীবনসায়াহ্নে কবি মধুসূদন কাশীপুরে কাটিয়েছিলেন মহারাজা নীলমণি সিংদেওয়ের রাজদরবারে। এই নীলমণি সিংদেওয়ের সভাগায়ক ছিলেন যদুভট্ট এবং তাঁর পিতৃদেব মধুসূদন ভট্টাচার্য। যদুভট্টকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধি দেওয়া হয়। ভাদুগানেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নীলমণি সিংদেও। সে সময় রাজবাড়ির দরবার থেকে ভেসে আসত ঝুমুর, ভাদু-সহ বিষ্ণুপুরের উচ্চাঙ্গ ঘরানার বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। মৃদঙ্গের বোল আর বাঁশির মিঠে সুরে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে থাকত। জনশ্রুতি আছে যে, সেই সময় লখনউ থেকে বাইজিরা আসতেন সঙ্গীতরসিক রাজা নীলমণি সিংদেওকে গান শোনাতে। সে রকমই এক জন সুন্দরী বাইজি এসেছিলেন সূদুর লখনউ থেকে, যার নাম ছিল মুন্নিবাই। তাঁর রূপ ও কণ্ঠের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল রাজপরিবারের বাইরেও।

পঞ্চকোট রাজবংশের প্রাচীন রাজবাড়ি।

পঞ্চকোট রাজবংশের প্রাচীন রাজবাড়ি।

প্রতি সন্ধ্যায় রাজবাড়ির সান্ধ্যবাসরকে অপরূপ রূপমাধুরী, অসাধারণ নৃত্য ও সঙ্গীতের মাধুর্যে মুগ্ধ করে রাখার জন্যই রাজা নীলমণি সিংদেও মুন্নিবাইকে আশ্রয় দিয়েছিলেন রাজবাড়ির রাজমহলে। মুগ্ধ রাজা তাঁকে মুন্নিবাই না বলে মণিবাই বলে ডাকতেন। তবলার বোল, সানাইয়ের মূর্ছনা, সারেঙ্গীর সুর, আড়বাঁশির আওয়াজ, মণি বাইয়ের পায়ের নূপুরধ্বনি এবং তাঁর অসাধারণ নাচ-গান রাজমহলকে মুখরিত করলেও রাজদরবারের আভিজাত্য ও শৃঙ্খলা রাজা আর মণির প্রেমকে পূর্ণতা দেয়নি শেষ পর্যন্ত। শিক্ষিত ও পরাক্রমী রাজা নীলমণি সিংদেও ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করে পুরুলিয়া ট্রেজারি লুটের অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কাশিমবাজারের মহারানি স্বর্ণময়ী তাঁকে ৪৪ বিঘা জমির পরিবর্তে মুক্ত করেন।

১৮৫২ সালে রাজসিংহাসনে বসার পরেই সম্ভবত রাজা নীলমণি তাঁকে লখনউ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তবে তাঁর কোনও ছবি পাওয়া যায় না। লোকমুখে শোনা যায়, তিনি সম্ভবত বাঁকুড়ারবৈতল গ্রামের এক হিন্দু রমণী ছিলেন। বৈতল গ্রামের জমিদারের নাম ছিল সূর্যনারায়ণ অগস্তি। তাঁর ছোট ভাই চন্দ্রনারায়ণ অগস্তির মেয়ের নাম ছিল মণিকা অগস্তি।

আবার কেউ কেউ বলেন, গড় মান্দারণের পাশের কোনও গ্রামে তাঁর বাড়ি ছিল। এই পরমাসুন্দরী মণিকাকে বৈতল গ্রাম থেকে এক মুসলিম দর্জি প্রেমের অভিনয় করে লখনউ নিয়ে যায়, তার পর বাইজি কোঠিতে বিক্রি করে দেয়।

মণিবাইজির সঙ্গে প্রেম পূর্ণতা না পাওয়ায়, রাজপরিবারের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষার্থে রাজা নীলমণি সিংদেও তাঁর বড় আদরের মণিকে পুনর্বাসনের নামে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন পুরুলিয়া শহরে। বর্তমান চকবাজারের কাছে তৎকালীন শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁকে প্রচুর অর্থ, আবাস ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রাজা। তাঁর সেই বসতবাটীর এখন প্রায় ভগ্নদশা। দোতলায় ওঠার জন্য ১৭টি সিঁড়ি থাকায়, বাড়িটিকে এখনও ‘সতেরো সিঁড়ি’ বলা হয়। বসতবাটীর সীমানা-নির্দেশক রাস্তাটির নাম আজও মণি বাইজি লেন।

পুরুলিয়া শহরে থাকতে থাকতেই তিনি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন, তাঁর নাম হয় মনমোহিনী দাসী। তাঁর বাড়ির উল্টো দিকে তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে আজও নিত্যপুজো হয়। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৯৮ সালে, তখন তাঁর বয়স ছিল ষাট। সেই হিসেবে তাঁর জন্ম ১৮৩৮ সালে। অর্থাৎ তিনি তাঁর ১৬ বছর বয়স থেকে ১৯ বছরের মধ্যে কাশীপুরে আসেন। রাজা নীলমণি সিংদেও যখন তাঁকে পুনর্বাসন দেন পুরুলিয়া শহরে, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩২ বছর। মণি বাইজি লেনে ঘোড়া বাঁধার মোটা মোটা লোহার কড়া দেখে অনুমান করা হয় তিনি তখনও বিগতযৌবনা হননি এবং তাঁর কাছে বহু রাজা, জমিদার-সহ বিশিষ্ট লোকদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তাঁরা ঘোড়ায় চড়ে আসতেন শুধু তাঁর নৃত্যগীত ও রূপমাধুরীর টানে ।

এ বারে আসি মণি বাইজি প্রতিষ্ঠিত পুরুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী পিতলের রথ প্রসঙ্গে, যা আজও পুরুলিয়াবাসীর গর্বের বস্তু। ১৯১১ সালে তিনি পুরুলিয়া পৌরসভার কাছে আবেদন করেন একটি রথ নির্মাণের জন্য। পুরুলিয়া শহরে যখন তিনি রথযাত্রার অভাব অনুভব করেন, তখন তাঁর বয়স ৭৩ বছর। পৌরসভা রথ নির্মাণের অনুমতি দিলে তিনি ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ২৬ পৌষ, ইংরেজি ১৯১২ সালে রথ নির্মাণের কাজ শুরু করান বাঁকুড়া পাতলাপুর নিবাসী শিল্পী শ্রীআশুতোষ কর্মকারকে দিয়ে। রথের সামনের তোরণের উপরে লিখিত আছে ‘মনমোহিনী বৈষ্ণবীর রথ’, যা লোকমুখে আজও মণি বাইজির রথ।

রথযাত্রার সূচনা হয় ১৩২০ বঙ্গাব্দ রথযাত্রার দিন, ইংরেজি ১৯১৩ সালে। তখন রথটির উচ্চতা ছিল প্রায় ২৫ ফুট। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১২/১২ ফুট। বর্গাকার রথটির দশটি চাকা ছিল, বাইরের কাঠামোর আয়তন ১৪৪ বর্গ ফুট । শিল্পী আশুতোষ কর্মকার তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক নৈপুণ্যে লোহার কাঠামোর উপরে পিতলের পাত বসিয়ে তৈরি করেন এই দৃষ্টিনন্দন রথটি। এটি একটি নয় চুড়োর নবরত্ন রথ। রীতি অনুযায়ী রথটিতে গর্ভগৃহ, বহিরাঙ্গণ, প্রদক্ষিণ পথ, শ্রীমুখশালা সবই আছে। রথযাত্রায় মনমোহিনী বৈষ্ণবীর আরাধ্য দেবতা রাধাগোবিন্দের বিগ্রহ রথে অধিষ্ঠান করেন। আর রথের শীর্ষে থাকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার ছবি। প্রথম দিকে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় সূর্যাস্তের পূর্বে রথযাত্রা শেষ করতে হত। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা করতালি দিয়ে হরিনাম করতে করতে রথের পুরোভাগে চলতেন। ২০ জন বলশালী লোক যথেষ্ট পারিশ্রমিকের পরিবর্তে রথ টানত। ১৯৬৩ সাল থেকে গ্যাসবাতির আলোয় সজ্জিত হয়ে রথযাত্রা আরম্ভ হয় সূর্যাস্তের পরে। আরও পরে ১৯৭১ সাল থেকে বৈদ্যুতিক আলোর সংযোজনে রথ আরও ঝলমলে ও আধুনিক হয়ে ওঠে। শহরের রাস্তা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় ১৯৬৯ সালে রথটির আমূল সংস্কার করা হয়। চাকার সংখ্যা ১০ থেকে ৮ করা হয়। বাইরের কাঠামো ১০০ বর্গ ফুট করা হয়, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ২ ফুট করে কমিয়ে দেওয়া হয়। ২০০২ সাল থেকে যন্ত্রচালিত ট্রাক্টরের সাহায্যে রথ টানা হয়।

১৯১১ সালের উইল মোতাবেক রথ পরিচালনার দায়িত্ব মনমোহিনী বৈষ্ণবী এক অছি পরিষদের হাতে দিয়ে গেছেন। রথ উৎসবের ব্যয়ের অর্থ আসে মনমোহিনী দেবীর স্থাবর সম্পত্তির ভাড়া থেকে। রাধাগোবিন্দপ্রেমী, পুরুলিয়ার রথ উৎসবের সৃষ্টিকর্ত্রী মনমোহিনী দাসীর মৃত্যু হয় ১৯১৬ সালে ৭৭ বছর বয়সে, রথযাত্রা শুরু হওয়ার তিন বছর পরে। বৈষ্ণবীয় রীতি অনুসারে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা হয় স্থানীয় ধবঘাটা অঞ্চলে। পুরুলিয়ার বুকে শেষ হয় ‘মুন্নি বাইজি’ থেকে পরিবর্তিত হওয়া ‘মনমোহিনী বৈষ্ণবী’ নামের এক বর্ণবহুল চরিত্রের। এই রথই তাঁর উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

purulia Zamindar House rajbari

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।