বডিলাইন!
ম্যাচ গড়াপেটার অভিশাপ।
বর্ণবিদ্বেষের কালো ইতিহাস।
অস্ট্রেলিয়ায় হরভজন-সাইমন্ডস বিবাদের ‘মাঙ্কিগেট’!
জাভেদ মিয়াঁদাদের ব্যাট উঁচিয়ে ডেনিস লিলির দিকে তেড়ে যাওয়া।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে রমন লাম্বা-রশিদ পটেলের কুখ্যাত হাতাহাতি।
গ্রেগ চ্যাপেলের ভাই ট্রেভরকে দিয়ে আন্ডারআর্ম বল করানো।
এ ছাড়াও উগ্রতম স্লেজিংয়ের নানা উদাহরণ। ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করার মতো ঘটনার অভাব নেই। তা বলে পরাজয়ের জ্বালা মেটাতে প্রতিপক্ষের জার্সিতে আলকাতরা লেপে দিয়ে যাওয়া!
অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনই ঘটেছিল বাংলার মহিলা ক্রিকেট দলের সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে প্রথম বার যখন তারা ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়েছিল। তার আগের বছরেই চালু হয়েছিল এই প্রতিযোগিতা। সে বার বাংলা কোনও দল পাঠাতে পারেনি। তারা যোগ দেয় দ্বিতীয় বছরে।
সদ্য দল-টল বানিয়ে কয়েক জন ‘দুধেভাতে মেয়ে’ খেলতে এসেছে। কেউ বাংলাকে পাত্তাই দেয়নি। গো-হারান হেরে বাড়ি ফিরবে, আর কী করতে পারে? তার উপর দ্বিতীয় ম্যাচই মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে। ট্রেনের ফিরতি টিকিট কেটে রাখার পরামর্শ দিলেন কেউ কেউ। পরে যদি না পাওয়া যায়।
প্রথম ম্যাচে বুন্দেলখণ্ডকে (তখনও রাজ্য ভাগাভাগি হয়নি) হারানোর পরে সামনে তারকা-ঝলমলে মুম্বই। যাদের অধিনায়ক সুনীল গাওস্করের বোন নূতন গাওস্কর। আর ডায়না এডুলজিও এসে গিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটিয়ে মুম্বইকে মাত্র ২৯ রানে শেষ করে দিল বাংলা। তখন বাংলার মেয়েদের হাতে এমন দুর্ধর্ষ মুম্বই-বধ মানে বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের শিশুদের দৈত্য হয়ে ওঠার চেয়েও বড় ক্রিকেট-বিস্ময়।
সময়টাও ৫২ বছর আগের। এখনকার হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মন্ধানা, জেমিমা রডরিগ্সদের বিশ্বকাপ জয়ের বিজয়োৎসবের আলোর দ্যুতিতে দেখতে গেলে মারাত্মক ভুল হবে। মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে ২ নভেম্বরের রাত এসেছে অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে। অনেক নির্মম কটাক্ষ সহ্য করে, অনন্ত সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে। সত্তরের গোড়ায় ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মহিলা ক্রিকেট খেলা হতে থাকলেও প্রথম পাকাপোক্ত প্রয়াস মহেন্দ্রকুমার শর্মার হাত ধরে। তাঁকেই এ দেশে মহিলা ক্রিকেটের জনক মনে করা হয়। ভুলভুলাইয়ার শহরে মেয়েদের ক্রিকেটের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তিনি। লখনউয়ে ১৯৭৩ সালে প্রথম মহিলা ক্রিকেট সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন মহেন্দ্রকুমার। সোসাইটি অ্যাক্টে তা রেজিস্ট্রিও করা হয়। শোনা যায়, মেয়েদের ক্রিকেটকে জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মহেন্দ্রকুমার নিজে রিকশায় চড়ে মাইক নিয়ে প্রচার করতে বেরোতেন। “কন্যারা ক্রিকেট খেলবে, কন্যারা ক্রিকেট খেলবে, তোমরা সবাই দেখতে এসো,” ঘোষণা করতে করতে যেতেন তিনি। ১৯৭৩-এর শুরুতে তাঁর উদ্যোগেই পুণেতে মেয়েদের প্রথম জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয়। তাতে অংশ নিয়েছিল তিনটি দল। মুম্বই, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ। পরের বার, ১৯৭৩-’৭৪ মরসুমে বারাণসীতে হওয়া জাতীয় প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় বাংলা। সে বার আটটি দল অংশ নিয়েছিল। অনেকেই জানেন না, বাংলা প্রথম বছর না খেললেও শুরুর দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল মহিলা ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। তৃতীয় বর্ষে জাতীয় প্রতিযোগিতা হয়েছিল কলকাতায়।
বারাণসীর প্রতিযোগিতায় প্রথম বার খেলতে গিয়ে একই সঙ্গে আলো এবং আঁধারের খোঁজ পেলেন বাংলার মেয়েরা। মহিলা ক্রিকেট তখন ভারতে সদ্য জন্ম নিচ্ছে, হামাগুড়িও দিতে শেখেনি। জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলতে যাওয়া মেয়েদের সম্বল বলতে একটিই ট্রাউজ়ার্স, জার্সি। রিজ়ার্ভেশন ছাড়া ট্রেনে চেপে খেলতে যেতে হত। এখনকার মতো হাতের মুঠোয় উড়ান-টিকিট বা বিদেশে খেলতে গেলে বিজ়নেস ক্লাসের বরাতের কোনও গল্পই নেই। ষোলো জনের দল থাকলে হয়তো সাত-আটটা ‘কনফার্মড’ টিকিট পাওয়া যেত। আটটা খোপ-খোপ রেলের খাবারের প্লেট ভাগাভাগি করে ষোলো জন খাও। থাকার জায়গা বলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্কুলবাড়ি, হস্টেল, ডরমিটরি। এমনকি কখনও-সখনও স্টেশনের ওয়েটিং রুমও। খাওয়াদাওয়া? দরিদ্রনারায়ণ-সেবার মতো বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, বড় বড় হাতা দিয়ে তা তুলে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের প্লেটে। প্রতিযোগিতায় খেলতে আসা সকলের জন্য একই রকম বন্দোবস্ত। তবে ব্যতিক্রম কি একেবারে ছিল না? মুম্বই— দিনের শেষে তারা তো মুম্বই-ই। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পীঠস্থান মনে করে নিজেদের। তারা কি যেমন-তেমন ভাবে থাকবে, যাতায়াত করবে?
বলিউডের ঝলমলে শহরের এমন ঠাটবাটওয়ালা দলকে কি না গুঁড়িয়ে দিল প্রথম বছরে খেলতে আসা আনকোরা কতগুলো মেয়ে? কী লজ্জা! সেরা অঘটন ঘটিয়ে ডরমিটরির ঘরে ফিরে নিজেদের জামাকাপড় কেচে ছাদে শুকোতে দিয়ে এলেন বাংলা দলের সদস্যরা। দ্বিতীয় কোনও খেলার পোশাক তো নেই, পরের দিন ওটা পরেই যে আবার খেলতে হবে। পরের সকালে ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে তাঁদের তো মাথায় হাত। সব সাদা জামাকাপড়ে কারা যেন আলকাতরা মাখিয়ে কালো করে দিয়েছে। কারা এমন করল? এখন কী ভাবে ওঁরা এগুলো পরে ম্যাচ খেলতে যাবেন?
বাংলার মেয়েরাও কম যান না। তাঁরা গোয়েন্দার চোখ দিয়ে জরিপ করে দেখলেন, ছাদে আলকাতরার কালো ছোপ-ছোপ হয়ে রয়েছে। সেই ছোপ অনুসরণ করে গিয়ে দেখা গেল, তা শেষ হয়েছে মুম্বই ক্রিকেট দলের ঘরের সামনে। তার মানে এরাই করেছে। ম্যাচ হারার জ্বালা এ ভাবে মেটাতে চেয়েছে! বোঝো অবস্থা। সেই বাংলা দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য কেয়া রায় এই ঘটনার কথা শুনিয়ে বলছিলেন, “আমরা ভাবতেও পারিনি, ২৯ অল আউটের শোধ এ ভাবে তুলবে! বুঝতেই পারছিলাম না, কী ভাবে দল মাঠে নামবে। কেডসের সাদা চকের রং দিয়ে সবাই মিলে এর পর জোরে জোরে ঘষে আলকাতরার কালো রং তুলতে থাকলাম। কিছুটা উঠল, সব কি আর যায়?” কিন্তু যাবতীয় আক্রমণের জবাব বাংলার মেয়েরা দিল মাঠে গিয়ে। ডায়না এডুলজির মুম্বইকে শুধু নয়, আর এক কিংবদন্তি শান্তা রঙ্গস্বামীর তামিলনাড়ুকেও উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল।
বঙ্গ ক্রিকেটে পরবর্তী কালে অনুচ্চারিতই থেকে গিয়েছে রাজ্য মহিলা দলের এই ঐতিহাসিক অভিযান। হরমনপ্রীত, জেমিমা, রিচাদের বিশ্বকাপ জয়ের এমন মায়াবী পরিবেশেও কাউকে বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু তখন বাংলার হৃদয়ের খেলা ফুটবলের জগৎকেও এই জয় আলোড়িত করেছিল। লখনউয়ে ফুটবল প্রতিযোগিতার মাঝখান থেকে বারাণসীতে এসে বাংলার মহিলা দলকে তাঁর বিখ্যাত ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছিলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাবসিদ্ধ, তুরীয় ভঙ্গিতে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা ও জিমন্যাস্টিক্সে প্রথম ‘পারফেক্ট টেন’ করা নাদিয়া কোমানিচের উদাহরণ টেনে বাংলা দলের রক্ত টগবগে করে দিয়ে যান।
পি কে-র স্ত্রী আরতি বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় মেয়েদের ক্রিকেট চালুর সময় থেকে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কুমকুম দেব, অলোকা উকিল, ডক্টর রমা চৌধুরী, বুলবুল গায়েনরা। পি কে-র ‘ভোকাল টনিক’-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও আগ্রাসী ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার মেয়েরা। প্রথম বারজাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলতে নেমে তাদের চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরা ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথায় স্থান করে নিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। বাংলার পুরুষ দল যেখানে আজ পর্যন্ত মাত্র দু’বার রঞ্জি ট্রফি জিতেছে, সেখানে বাংলার মেয়েরা ইতিহাস সৃষ্টি করে বসে আছেন, পর-পর সাত বার ঘরোয়া প্রতিযোগিতা জিতে। শুরুর দিনের সেই বাংলা দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা শ্রীরূপা বসু, সন্ধ্যা মজুমদার, রুনা বসু, ইলা রায়চৌধুরী, শর্মিলা চক্রবর্তী, লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মজুমদাররা পরবর্তী কালে ভারতের হয়ে খেলেছেন। মোট পনেরো জন বাঙালি ক্রিকেটার ভারতীয় মহিলা দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ঝুলন গোস্বামী নিঃসন্দেহে বঙ্গ মহিলা ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি এবং মুখ। ২৫ ম্যাচে দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন। ১২টি টেস্টে ৪৪ শিকার, ২০৪টি এক দিনের ম্যাচে ২৫৫ উইকেট। একাধিক নজির গড়েছেন। পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে রিচা ঘোষ একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার, যিনি বিশ্বকাপ জিতেছেন! বাংলা দলে কয়েক জন পার্সি ক্রিকেটারের উল্লেখযোগ্য অবদানও ছিল। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম শিরিন কনট্রাক্টর। যিনি তিনটি খেলায় আন্তর্জাতিক জার্সি পরার বিরল অধিকারী ছিলেন— ক্রিকেট, হকি এবং ভলিবল। ডাকাবুকো শিরিন সম্পর্কে শোনা যায়, এক বার বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করা মেয়েদের কিছু ছেলে উত্ত্যক্ত করছে দেখে লাঠি তুলে তাড়া করেছিলেন।
প্রথম বার যখন জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলতে যাচ্ছে বাংলা, আরও কত কী নাটক! দল গড়ার পরে প্রশ্ন দেখা দিল, অধিনায়ক কে হবেন? শ্রীরূপা বসু তখন হকি খেলতেন। তাঁকে নিয়ে আসা হল। কনভেন্ট-শিক্ষিত, চলনে-বলনে অন্য রকম ঝলক, তুখোড় ইংরেজি বলেন। কে জানত, হকিস্টিকে অভ্যস্ত এক মেয়ে বঙ্গ ক্রিকেটের কিংবদন্তি হয়ে যাবেন! তখনকার দিনে বাঁ-হাতি স্পিনারকে দিয়ে বোলিং শুরু করার অভিনবত্ব দেখিয়েছিলেন। শিরিনকে নিয়ে আসা হয় পরের বছর।
যাত্রাপথ: বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌরকে জড়িয়ে ধরে কান্না ঝুলন গোস্বামীর। উপরে, ১৯৭৩-’৭৪-মরসুমে জাতীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন বাংলার প্রথম মহিলা-ক্রিকেট দল।
১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-২৫ দল ভারত সফরে আসে। সেটাই দেশের মাঠে হওয়া প্রথম বড় কোনও আন্তর্জাতিক মানের সিরিজ়। ঐতিহাসিক সেই দ্বৈরথে প্রথম বলটি করেন বাংলার রুনা বসু। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেই সিরিজ়ের ফলাফল, স্কোর কার্ডকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা। যে-হেতু দলটা ছিল অনূর্ধ্ব-২৫। নইলে চিরকালীন ইতিহাসে ঢুকে থাকত এই তথ্য যে, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক বলটি করেছিলেন এক বাঙালি।
পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৬-এর শেষ দিকে ভারত সফরে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় মহিলা দল। সরকারি ভাবে সেটাই ভারতের মেয়েদের প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ়। মোট ছ’টি টেস্ট হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে বেঙ্গালুরুতে শুরু হয়েছিল প্রথম টেস্ট। ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে কাপ জয় যদি জ্যোৎস্নারাত হয়, তা হলে আকাশের প্রথম চাঁদ দর্শন প্রায় অর্ধশতক আগে চিন্নাস্বামীতে দাঁড়িয়ে। একটা দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এলইডি জায়ান্ট স্ক্রিন হলে, অন্যটা সাদা-কালো ঢাকনা দেওয়া টিভি। কিন্তু প্রথমটা না এলে পরেরটার আবিষ্কার হয় না। ২ নভেম্বরের মতোই ঐতিহাসিক তারিখ হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটে থেকে যাবে ৩১ অক্টোবর। আর এটাও থেকে যাবে যে, সরকারি ভাবে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরুর সেই সিরিজ়ে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার তিন ক্রিকেটার। রুনা বসুর প্রথম বল সরকারি স্বীকৃতি না পেলেও এটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না যে, ভারতীয় মেয়েদের পক্ষে সরকারি ভাবে টেস্টে প্রথম বলটি খেলেছিলেন এক বাঙালি— সন্ধ্যা মজুমদার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় প্রথমে ব্যাট করেছিল, এর পর ভারত যখন ব্যাট করতে নামে, ওপেন করতে নামেন সন্ধ্যা এবং শোভা পণ্ডিত। ‘ফেস’ করেন সন্ধ্যাই।
তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুই বাঙালি। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাস যাঁদের ছাড়া লেখা সম্ভবই নয়। রুনা বসু এবং শর্মিলা চক্রবর্তী। রুনাকে সেই সময় সংবাদমাধ্যম বলত ‘মহিলা ক্রিকেটের আদ্যাশক্তি’। তার কারণও আছে। সেই তরুণ বয়সেই তিনি সিএবি-কে পত্রাঘাত করে বসেন যে, মেয়েদের ক্রিকেটকে আপনারা স্বীকৃতি দেবেন না কেন? সিএবি প্রশাসনের মাথায় তখন বিশ্বনাথ দত্ত। রুনার আর্জিতে বৈঠক করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মেয়েদের ক্রিকেটকে তক্ষুনি পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যা আসে অনেক অনেক পরে। অনেক দেরিতে। কিন্তু রুনার বাউন্সার ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল পুরুষ ক্রিকেট-প্রশাসকদের। আর শর্মিলা চক্রবর্তীকে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের বিষাণ সিংহ বেদী বললে অত্যুক্তি হবে না। ১৯৮২-তে মেয়েদের বিশ্বকাপে শর্মিলার সঙ্গে খেলেছিলেন আরও দুই বাঙালি— গার্গী বন্দ্যোপাধ্যায় ও লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য। একটি ম্যাচে আম্পায়ারিং করছিলেন ডিকি বার্ড। শোনা যায়, শর্মিলাকে দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, “এ রকম বাঁ-হাতি স্পিনার আমি ছেলেদের ক্রিকেটেও খুব কম দেখেছি।” রুনা বসুর মুখে শোনা গেল, এক বার বাংলা দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পরে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় চায়ের আসরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গোটা দলকে। সেখানে তিনি প্রথম খোঁজ করেছিলেন, “ওই ন্যাটাটা কোথায়?” বাঁ-হাতি স্পিন বোলিংয়ে সকলকে এতটাই সম্মোহিত করে ফেলেছিলেন শর্মিলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬ থেকে পটনায় শুরু হওয়া চতুর্থ টেস্ট ভারত জেতে পাঁচ উইকেটে। ভারতীয় মেয়েদের প্রথম টেস্ট জয়। শর্মিলা চক্রবর্তীর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল সেই ঐতিহাসিক জয়ে। দুই ইনিংস মিলিয়ে পাঁচ উইকেট নেন। সেই ম্যাচেও ছিলেন বাংলার তিন কন্যা। শর্মিলা, সন্ধ্যা, রুনা। এর পর পটনার কলেজে পুরো দলকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রথম টেস্ট জয়ের অধিনায়ক শান্তা রঙ্গস্বামী বলছিলেন, “রাস্তার দু’ধারে লোক জমে গিয়েছিল আমাদের অভিনন্দন জানাতে।”
এক-এক সময় সংশয় জাগছে, মেয়েদের ক্রিকেটের চেয়ে ছেলেদের ক্রিকেট সংগঠনকে এগিয়ে রাখব কী ভাবে? কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেদের ক্রিকেটে বাণিজ্যিক বিপ্লব অনেক আগে ঘটেছে। তিরাশিতে কপিল দেবের দলের বিশ্বকাপ জয় ভারতীয় ক্রিকেটকে চিরকালের মতো পাল্টে দিয়েছে। টিভি সম্প্রচারের স্বত্ব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় পুরুষ ক্রিকেটারদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স অকল্পনীয় সংখ্যায় পৌঁছেছে। সেখানে মেয়েরা এই সে দিন পর্যন্তও নিজেরা টাকার জোগাড়যন্তর করে ক্রিকেট চালিয়েছেন। দু’টো ব্যাট পর্যন্ত জুটত না। স্ট্রাইকারের হাতে প্রকৃত ব্যাট থাকত, নন-স্ট্রাইকারকে ধরিয়ে দেওয়া হত পার্চমেন্ট ব্যাট। পাল্টে পাল্টে খেলতে হত। এমন অনেক হয়েছে যে, ট্রেনে কোনও রকমে ঠেলেঠুলে নিজেরা উঠে পড়েছেন, বেডিং তুলতে দেওয়া হয়নি। পরের ট্রেনে কেউ সেগুলো নিয়ে এসেছেন। তত দিন ঠান্ডার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে স্কুলবাড়ির মেঝেতে শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে।
হাতখরচটুকুও জুটত না সংস্থার তরফে। ২০০৫-এও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে আটটা ম্যাচের জন্য ঝুলন গোস্বামী, মিতালি রাজেরা পেয়েছিলেন আট হাজার টাকা। কত সফর আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে অর্থের অভাবে! ক্রিকেটারদের মধ্যে যে দু’জনের অবদান ছাড়া ভারতে মহিলা ক্রিকেটের রূপকথা লেখা সম্ভব নয়, তাঁদের এক জন শুভাঙ্গী কুলকার্নি। অন্য জন ডায়না এডুলজি। দু’জনেই কিংবদন্তি ক্রিকেটার। শুভাঙ্গী মেয়েদের ক্রিকেট সংস্থার প্রধান থাকার সময় নিজে ঘুরে-ঘুরে টাকা তুলতেন। এক বার মন্দিরা বেদীকে গিয়ে দুঃখের কথা জানিয়েছিলেন যে, মেয়েদের সফরে পাঠাতে পারছি না টাকার অভাবে। তখন একটি হিরের সংস্থার মডেল মন্দিরা। বিজ্ঞাপনের চুক্তি থেকে পাওয়া টাকাটা শুভাঙ্গীর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “ওদের খেলতে পাঠাও।” এই আবেগের পাশে কোনও আইসিসি বা বোর্ডের লেখা চেকবইয়ের রক্তচক্ষু আসতে পারে? ডায়না আর এক জন। মেয়েদের ক্রিকেটের মহাকাব্য তাঁকে ছাড়া লেখাই হয় না। বলের আঘাতে সামনের ক’টি দাঁত উড়ে যাওয়ার পরেও ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন আবার। মেয়েদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠের বাইরেও ছিলেন একই রকম ডাকাবুকো। একটি ম্যাচে মাধবরাও সিন্ধিয়া ছিলেন প্রধান অতিথি। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিতে স্টেজে উঠে সিন্ধিয়াকে সটান বলে দেন ডায়না, “মেয়েদের চাকরি দিন। খেলার জন্য চাকরি কি শুধু ছেলেদের একচেটিয়া অধিকার?” সিন্ধিয়া অবাক। কিন্তু ডায়নার সেই অন্তরের আকুতি অগ্রাহ্য করতে পারেননি। বার্তা পাঠিয়েছিলেন, মেয়ে-খেলোয়াড়দের চাকরির দিকটা যেন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির অন্যতম হয়ে বোর্ড পরিচালনায় যুক্ত হন ডায়না। তখন পুরুষশাসিত বোর্ডের অন্দরমহলে প্রচুর লড়াই করেছেন মহিলা ক্রিকেটারদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ডিএ চালু হওয়ার পর, বিদেশ সফরে গিয়েও সর্বোচ্চ পাওয়া যেত দৈনিক ১০০০ বা ১৫০০ টাকা করে। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় এক কাপ কফি পান করতে গেলে পকেট ফাঁকা হয়ে যাবে। ডায়না বোর্ডে এসে সেগুলো নিয়ে লাগাতার লড়েছেন। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন পুরুষ ও মহিলারা সমান ম্যাচ-ফি পান, দৈনিক ভাতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু আকাশে উড়ছি বলে যদি টানা-রিকশাকে ভুলে যাই, ঘোর অন্যায় হবে।
বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে এখনও কোনও তুলনাই চলে না হরমনপ্রীত কৌর বা স্মৃতি মন্ধানাদের। আবার মনে হচ্ছে, টাকাটাই কি একমাত্র মানদণ্ড? নিউ জ়িল্যান্ডে খেলতে গিয়ে ভারতীয় দলের মেয়েদের থাকার জায়গা নেই। তাঁদের দেশেও তো একই রকম অর্থাভাব। কে এগিয়ে আসবে খরচা দিতে? শেষ পর্যন্ত নিউ জ়িল্যান্ড দলের মেয়েরা নিজেদের বাড়িতে ভাগাভাগি করে রাখলেন ভারতীয় মেয়েদের। রিচার্ড হ্যাডলির স্ত্রী ক্যারেন তখন ক্রিকেট খেলতেন। এখন যেমন খেলেন মিচেল স্টার্কের পত্নী অ্যালিসা হিলি। স্বয়ং হ্যাডলি মাঠে আসতেন মহিলা ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিতে। এত সব আবেগের বলয়ের মধ্য দিয়ে যে মহিলা ক্রিকেট পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে করতে ২ নভেম্বরের পূর্ণিমা রাত দেখল, তাকে অস্বীকার করার উপায় কোথায়?
পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হয় ১৯৭৫-এ প্রুডেনশিয়াল কাপ দিয়ে। তার দুই বছর আগে, ১৯৭৩-এ হয় মেয়েদের বিশ্বকাপ। উলভারহ্যাম্পটনের দুই বাসিন্দা, ব্যবসায়ী জ্যাক হেওয়ার্ড এবং ক্রিকেটার র্যাচেল হেহো ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। তাঁদের হাতে হয়তো পুরুষ ক্রিকেটের চাকচিক্য ছিল না, ছিলেন না ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, রোহন কানহাইদের মতো কেউ। চ্যাপেল ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন না। রবার্টস, লিলি, টমসন ছিলেন না। কিন্তু স্বপ্ন ছিল। দূরদর্শিতা ছিল। সেগুলোকেই বা দেখব না কেন? আর যেমন-তেমন করে নয়, মেয়েদের প্রথম বিশ্বকাপে সাতটি দল অংশ নিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেওয়া হয়নি। বর্ণবিদ্বেষের কারণে তারা তখন নির্বাসিত এবং একঘরে। এর পর থেকে মোট তেরোটি বিশ্বকাপ হয়েছে পাঁচটি দেশে। অস্ট্রেলিয়া জিতেছে সাত বার, ইংল্যান্ড চার বার। অন্য আর যে দু’টি দল জিতেছে, তারা নিউ জ়িল্যান্ড ও এ বারে ভারত। ১৯৭৩-এর পরে দ্বিতীয় বারেই মেয়েদের বিশ্বকাপ হয় ভারতে, ১৯৭৮ সালে। সেখানে ছেলেদের বিশ্বকাপ আনতে জগমোহন ডালমিয়াদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৮৭ পর্যন্ত। ভারতে ছেলেদের বিশ্বকাপ হয়েছে মোট চার বার। ১৯৮৭, ১৯৯৬, ২০১১, ২০২৩। মেয়েদের বিশ্বকাপও হয়েছে চার বার। ১৯৭৮, ১৯৯৭, ২০১৩, ২০২৫। ১৯৯৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছিল ইডেনে। যে ম্যাচে বল গার্ল হিসেবে মাঠের ধারে বসে বেলিন্ডা ক্লার্ককে দেখে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখা শুরু ঝুলন গোস্বামীর।
অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব বাধাবিঘ্নের কাছে পরাস্ত হয়েছে আবেগ। মহেন্দ্রকুমার শর্মা মেয়েদের ক্রিকেটকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু জগমোহন ডালমিয়ার মতো ব্যবসা বুঝতেন না। দেশের মাঠে প্রথম বিশ্বকাপ করতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল। চেক বাউন্স করে, প্রচুর ধারদেনা হয়। আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়। ১৯৭৮ থেকে অনেক দিন মেয়েদের ক্রিকেট বন্ধ ছিল। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদ, স্বার্থ-সংঘাত যুক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ১৯৮৮ বিশ্বকাপে ভারত খেলতে পারেনি নিজেদের মধ্যে এই লড়াইয়ের জন্য। সেই সময়ে মেয়েদের ক্রিকেটের প্রধান কর্তার সঙ্গে তদানীন্তন ক্রীড়ামন্ত্রী মার্গারেট আলভা-র সম্পর্ক ভাল ছিল না বলে শোনা যায়। সময় মতো এন্ট্রি-ফি পাঠানো হয়নি বলে নাম বাতিল হয়ে যায় ভারতের। শান্তা রঙ্গস্বামী এই ঘটনার সাক্ষী। বলছিলেন, “রাজীব গান্ধীর কাছে যাওয়া হয়েছিল। উনি পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মেয়েরা খেলতে যাবে। সরকার অর্থের ব্যবস্থা করবে।” তার পর? “আবার বিশ্বকাপের জন্য নাম পাঠানো হল। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সংগঠক ছিল। ওরা বলল, ‘এখন শেষ মুহূর্তে তোমাদের যোগ করতে হলে অনেক কিছু পাল্টাতে হবে। অত সময় আর নেই।’” সে বার আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি ভারতের মেয়েদের। আইনজীবী অনুরাধা দত্ত মহিলা ক্রিকেট সংস্থার দায়িত্বে আসার পরে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ১৯৯৭-এ ভারতে বিশ্বকাপ আয়োজন হয় ‘হিরো হন্ডা’কে টাইটল স্পনসর রেখে। পরবর্তী কালে শুভাঙ্গী এবং ডায়না মহিলা ক্রিকেট প্রকল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। এর পর বোর্ড সচিব হিসেবে জয় শাহ পুরুষ-মহিলাদের সমান বেতনের ব্যবস্থা করেন। শান্তাদের মুখে শোনা যায় শরদ পওয়ারের নামও। “পুরুষশাসিত বোর্ডের মধ্যে আমাদের জন্য প্রচুর লড়াই করেছেন পওয়ার সাব। কয়েকটা ক্ষেত্রে আমি নিজে জানি, পুরো বোর্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে উনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন,” বলছিলেন শান্তা, যাঁর ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সবচেয়ে বীভৎস অভিজ্ঞতা মহিলা কামরায় মাঝরাতে পুরুষ-দুর্বৃত্তদের হানা। পুরো দল কাঁপছে ভয়ে। চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে পুলিশ ডেকে কোনও রকমে রক্ষা!
বাংলায় মেয়েদের ক্রিকেট-জনক কাকে বলা হবে? নির্দ্বিধায় এই প্রশ্নের উত্তর, নথু কোলে। যাঁর ছেলে বাবলু কোলে এখন সিএবি সচিব। কালীঘাট ক্লাব বঙ্গনারীদের ক্রিকেট-যাত্রার পথিকৃৎ। আর তার নেপথ্যে নথু কোলে। বাংলা প্রথম বার ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ফোন করে বলেছিলেন, “মেয়েদের ভাল হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াও। যা টাকা লাগে আমি দেব।” তিনশোর উপর মেয়েকে নিয়ে প্রথম যে শিবির হয়েছিল, যেখান থেকে বাংলার প্রথম দল তৈরি করা হয়েছিল, তা-ও হয়েছিল কালীঘাট মাঠে। আর সেখানে তখন ভিড় জমে যেত ইলা রায়চৌধুরীর উইকেটকিপিং দেখতে। লোকে দাঁড়িয়ে বলত, “এ কী কিপার রে বাবা। কোনও বলই তো ওর নাগালের বাইরে নয়!”
মেয়েরা ট্রেনে কষ্ট করে রিজ়ার্ভেশন ছাড়া খেলতে যাচ্ছে। খাবার জোটে না ঠিকমতো। বাড়ি থেকে মা হয়তো গুড় বেঁধে দিয়ে দিয়েছেন, পৌঁছে দুটো রুটি কোনও মতে জোগাড় করে তা-ই খেয়ে হয়তো শুয়ে পড়তে হবে। সব শুনে নিজের সংস্থায় নথু কোলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “যখনই মেয়েরা খেলতে যাবে, সঙ্গে দু’তিনটে কোলে বিস্কুটের বড় বড় টিন যাবে। অন্তত বিস্কুট খেয়ে তো পেটটা ভরুক ওদের।” কালীঘাট তাঁবুতে মেয়েদের অনুশীলনের পরে বিনা খরচায় চিকেন স্টু, পাউরুটি আর ডিমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। দেশের বাকি অঞ্চলের তুলনায় কলকাতায় ভারতীয় দল এলে অনেক ভাল আতিথেয়তা পেত। তাদের জন্য বিজলি গ্রিলের খাবার যেত, ভাল হোটেলে রাখা হত।
যত মনে পড়ছে ২ নভেম্বরের ওই মায়াবী রাত, যত ফিরে দেখছি ঝুলন গোস্বামী-মিতালি রাজদের ডেকে তাঁদের হাতে হরমন-স্মৃতিদের বিশ্বকাপ তুলে দেওয়ার চোখে জল এনে দেওয়া সেই দৃশ্য, তত মনে হচ্ছে— আরও কত অদৃশ্য মুখ, কত অদৃশ্য হাত ওই সোনার ট্রফিকে ছুঁয়ে ছিল। যাঁরা না থাকলে যাত্রা সম্পূর্ণ হওয়া দূরের কথা, যাত্রা শুরুই হয় না। আর রিজ়ার্ভেশন ছাড়া কামরায় ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে, ঘষটে-ঘষটে, মুড়ি-খই-গুড় খেতে-খেতে, স্টেশনের নোংরা জলে তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে সেই যাত্রার সঙ্গে যত একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করছি, তত মনে হচ্ছে, ভুল হচ্ছিল। খুব ভুল হচ্ছিল। কোনও ক্রিকেট ট্রফির সঙ্গে এর কোনও তুলনা হয় না। এমনকি তিরাশিতে কপিলের দলের বিশ্বকাপ জয়ও নয়। যদি একান্তই কোনও কিছুকে টানতে হয়, দু’টো মুখ স্মরণ করা যেতে পারে— তেনজিং নোরগে ও এডমান্ড হিলারি।
এটা শুধু বিশ্বকাপ জয় কী করে হয়, এ তো ক্রিকেটের মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ। যাঁরা এখন সর্বোচ্চ শৃঙ্গে তেরঙ্গা পুঁতলেন, তাঁদের মতোই কৃতিত্ব প্রাপ্য তাঁদেরও, যাঁরা বেস ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন। এ এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রার জয়। দুঃসাহসিক অভিযানের জয়। এক নিবিড়, নিমগ্ন আরাধনার সিদ্ধিলাভ!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)