E-Paper

রেস্তরাঁর বিলের উপরে লেখা লতার জন্য গান

এ ভাবেই চলতে ফিরতে গানের কথা আসত তাঁর মাথায়। যে কোনও সুর শুনে তাতে বসিয়ে দিতে পারতেন কথা। কৈশোর থেকেই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৫ ০৭:৫২
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মাত্র তেরো কী চোদ্দো বছর বয়স ছেলেটির। সে কিনা লুকিয়ে লুকিয়ে লিখছে ভালবাসার গান! কাউকে দেখানোর সাহসই নেই। বাবা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাক যুগের অভিনেতা। তাঁকেও বলা যায় না। ধরা পড়লে বিষম বকুনি জুটবে। শেষে ছেলেটি গান নিয়ে গেল প্রযোজক জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গান পছন্দ হল তাঁর। বললেন, তাঁর পরবর্তী সিনেমায় গানগুলি ব্যবহার করবেন, যদি সুরকার রামচন্দ্র পালের সেগুলি পছন্দ হয়। রামচন্দ্র পাল গানগুলি দেখে গীতিকারকে ডেকে পাঠালেন। ছেলেটির ম্যাট্রিক পরীক্ষার আর ক’দিন মাত্র বাকি। তাঁর বয়স দেখে সুরকার অবাক। এত বাচ্চা ছেলে! যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বাচ্চা ছেলেটির গান নিয়েই মুক্তি পেল ‘অভিমান’। জামাইবাবুর আরও কিছু সিনেমায় গান লিখল ছেলেটি। চুক্তিপত্রে ছেলেটি নিজের নাম সই করল, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। মিঠে-কড়া রোদের মতো কথার আলো মেখে আত্মপ্রকাশ ঘটল এমন এক গীতিকারের, এক দিন যাঁর লেখার প্রেমে পড়বে বাংলা ছবি আর আধুনিক গানের তামাম শ্রোতারা।

১৯৩১ সালের ২ মে এই গীতিকারের জন্ম। অল্প বয়সেই বেতারে গীতিকারদের তালিকায় নাম উঠে যায় তাঁর। স্কটিশ চার্চ কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র তখন। এক দিন ভবানীপুরে দিদির বাড়িতে গিয়ে দেখেন, এক সুদর্শন তরুণ মলিন মুখে বসে আছেন। তাঁর ‘ওরে যাত্রী’ আর ‘কামনা’ নামে দুটো সিনেমা ফ্লপ। তিনি নাকি অপয়া, তাই তাঁকে আর কোনও সিনেমায় নিতে চাইছেন না কেউ। শেষ পর্যন্ত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর ভাগ্নের অনুরোধে নাম পাল্টে অভিনয়ের শর্তে, তাঁকে নিজের সিনেমা ‘মর্যাদা’য় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন প্রযোজক সরোজ মুখোপাধ্যায়। সেই যুবকের নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, ভবিষ্যতের মহানায়ক। তাঁর প্রথম বড় হিট সিনেমা ‘বসু পরিবার’ আসতে তখনও কয়েক দিন বাকি। কিন্তু যে সখ্য উত্তমকুমার আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে তৈরি হল, তা আজীবনের। অনেক পরে এই বন্ধুত্বের দাবিতেই উত্তমের লিপে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একচেটিয়া আধিপত্য, তখন ধারা ভেঙে মান্না দে-কে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন পুলক। উত্তম ভেবেছিলেন, তাঁর লিপে মান্নার গলা মোটেই চলবে না। কিন্তু ‘শঙ্খবেলা’র গান এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, পরের বছর ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র গানের জন্য মান্নাকেই চেয়েছিলেন উত্তম।

এক বার লতা মঙ্গেশকর বললেন, তিনি পুজোর বাংলা গান করতে চান পুলকের কথায়। হাতে চাঁদ পেলেন গীতিকার। তত দিনে শ্যামল মিত্রের জন্য ‘চৈতালি চাঁদ যাক ডুবে যাক’, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ‘তারাদের চুমকি জ্বলে আকাশে’ লেখা হয়ে গিয়েছে। ভূপেন হাজারিকার সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, ‘কন্যা তোমার কাজল ধুলো কিসে’। ভূপেন হাজারিকার সুরেই লতা বলেছিলেন, তাঁর জন্য গান লিখে দিতে। রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে বিলের উপরেই লিখে ফেললেন লতার জন্য গান, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’। চলতে ফিরতে গানের কথা আসত পুলকের মনে। এ ভাবেই লেখা হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, নির্মলা মিশ্রের জন্য ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’, সুমন কল্যাণপুরের গলায়, ‘মনে করো আমি নেই বসন্ত এসে গেছে’, অখিলবন্ধুর গলায়, ‘ও দয়াল বিচার করো’। পাল্লা দিয়ে চলছে সিনেমার গান লেখা-ও। জনতা গুনগুন করছে তাঁর লেখা গান।

সুরকার নচিকেতা ঘোষের দুই প্রিয় গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।। এক দিন নচিকেতা ঘোষ পুলককে শোনালেন গৌরীপ্রসন্নের লেখা, ‘মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি’, সেই গান শোনার পর পুলক লিখে ফেললেন, ‘বেঁধো না ফুলমালা ডোরে’‌। এক দিন নচিকেতা গেয়ে শোনালেন ‘সূর্য ডোবার পালা’, সেই গান শুনে পুলক লিখলেন, ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনার’। দুই গীতিকার মজা করে বলতেন, নচিকেতা ঘোষের হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা থাকে। তাতে তিনি দু’জনের তুল্যমূল্য বিচার করেন।

সঙ্গীতকার সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে কাজ করেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘তিন ভুবনের পারে’র গান তৈরির সময় সুধীনবাবু বললেন এমন একটা গান লিখে দিতে, যেখানে সাউন্ড অন সাউন্ড টেকনিক ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ গানের মধ্যে শব্দের স্তর ঘুরেফিরে আসবে। পুলক লিখে ফেললেন, ‘দূরে দূরে/ কাছে কাছে/ এখানে ওখানে/ কে ডাকে আমায়’। গানটিতে প্রথম দূরে দূরে-র প্রতিধ্বনি হয়েছিল দূরে দূরে। কাছে কাছে-র প্রতিধ্বনি হয়েছিল কাছে কাছে।

সুরের উপর গান লিখতে পারতেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন অনেক বার হয়েছে, সুরকার সুর শুনিয়েছেন তাঁকে, গীতিকার পুলক কথা বসিয়ে দিয়েছেন। এক বার আলি আকবর খান এলেন কলকাতায়। তাঁর সুরে গান বাঁধতে হবে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর হৈমন্তী শুক্ল গেলেন তাঁর বাড়িতে। খাঁ সাহেব নিজের তৈরি একটা রাগ সরোদে বাজিয়ে শোনালেন। পুলক ধরে ফেললেন সুরটা। তৈরি হল ‘স্মৃতিই শুধু থাকে/ সেই তো পিছু ডাকে’। একই ভাবে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে তিনি লিখলেন, ‘আর যেন সেদিন ফিরে না আসে’।

এক বার গান রেকর্ডিং হচ্ছে ‘প্রতিশোধ’ ছবির। গান গাইবেন কিশোরকুমার। ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’ এবং ‘মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ’ এই গান দু’টির রেকর্ডিং বাকি। তখন কিশোর অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়ক। তাঁর ডেট পাওয়াই মুশকিল। আর তেমনই ‘মুডি’ তিনি। তাঁকে দিয়ে এক দিনে দুটো গান রেকর্ড করানোই অসম্ভব। পুলক আর প্রযোজক ঠিক করলেন মেহবুব স্টুডিয়োর সিঁড়িতে পাহারা দেবেন, যাতে একটা গান রেকর্ডিং করে কিশোর পালাতে না পারেন। ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’ গেয়ে কিশোর পালাতে গিয়েও ধরা পড়লেন। বাধ্য হয়ে ‘মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ’ গাইতে এলেন বিরক্ত কিশোর। কিন্তু গানটা গাইবার পর তাঁর সব বিরক্তি উধাও। পুলককে বললেন, “একেবারে তালমিছরির মতো মিষ্টি গান বানিয়েছেন আপনি।”

এক বার মান্না দে’র রান্না করা দেখে পুলক লিখে ফেলেছিলেন ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না’। এমনই এক দিন ট্যাক্সিতে ফেরার পথে গুনগুন করে ঠুংরির সুর ভাজতে ভাজতে মান্না দে বললেন, এমন একটা গান লিখে দিতে। কথা এসে গেল পুলকের মনে। স্থানীয় গানের স্কুল বাণীচক্র সাক্ষী রইল সেই গান তৈরির, ‘ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল না’। পুলকের কলমে গান আসত নানা ভাবে, নানা পরিস্থিতিতে। প্লেনে এক সুন্দরী এয়ারহোস্টেসকে দেখে লিখেছিলেন, ‘ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘কত দিন পরে এলে’। এক আত্মীয়ের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে এক অচেনা সুন্দরী দরজা খোলায় লিখলেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল’!

পুলকের লেখা প্রথম ‘নন-ফিল্মি’ গান ছিল শ্যামাসঙ্গীত, ‘এবার আমি মা চিনেছি’। আর ১৯৯৮-এ মান্না দে গাইলেন তাঁর লেখা শেষ গান, ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’। এটিও মাতৃসঙ্গীতই। এ ছিল এক আশ্চর্য সমাপতন।

সুরলোকে কোথাও যে বেসুর বাজছিল, বোঝেনি কেউ। ১৯৯৯-এর ৭ সেপ্টেম্বরে লঞ্চ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন পুলক। এতই আকস্মিক সেই ঘটনা যে, সহযাত্রীরা যখন বুঝে উঠতে পারলেন, তত ক্ষণে গঙ্গায় তলিয়ে গেছেন তিনি। কেন জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েছিলেন, তা আজও স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর কাছের লোকেরা বলেন যে, জীবনের প্রতি আস্তে আস্তে ভালবাসা হারাচ্ছিলেন তিনি।

কথা হারানো গীতিকারের অশ্রুত বাণী গঙ্গার প্রবল হাওয়ায় চিরদিনের মতো ভেসে গেল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

famous personality

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy