Advertisement
E-Paper

চড়াইপাখি মেরে হাত পাকিয়েছিলেন তিনি

ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। পাখি  ও প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে তাঁর খুব প্রিয় ছিল মোটরসাইকেল। আজ তাঁর ১২১ তম জন্মদিন।ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। পাখি  ও প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে তাঁর খুব প্রিয় ছিল মোটরসাইকেল। আজ তাঁর ১২১ তম জন্মদিন।

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:০০
বার্ডম্যান: সেলিম আলি

বার্ডম্যান: সেলিম আলি

১৯০৬/০৭ বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি।...’

নয়-দশ বছর বয়সে এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছিলেন সেলিম আলি! উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয়দের কাছে ‘পক্ষী সংরক্ষণ’ ব্যাপারটা ছিল কল্পনাতীত। বরং পশুপাখি শিকারে যে যত কামাল দেখাতে পারবে সে তত বড় পুরুষসিংহ। শিকার-শিকার খেলতে খেলতেই সেলিম হয়েছিলেন বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া।

মাত্র তিন বছর বয়সে সেলিম মা-বাবাকে হারান। অনাথ হয়েও পাঁচ ভাই ও চার বোনের সঙ্গে সেলিম নিঃসন্তান মামা-মামির কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মামা আমিরউদ্দিন ছিলেন বড় শিকারি। সাহেবরা তাঁকে নেকনজরে দেখতেন। নয় বছরের ছোট্ট সেলিমকে তিনি একটি এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই মাসে ২ টাকা হাতখরচ পেতেন সেলিম। সেই টাকা জমিয়ে মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের পাখির বাজার থেকে নানা ধরনের পাখি কিনে, তারের জাল ও প্যাকিং বাক্স জুড়ে খাঁচা বানিয়ে তাতে পাখিগুলিকে রাখতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে মেহমানদের জন্য বস্তাবন্দি তিতির বা বটের পাখি এসেছে। সে সব সুস্বাদু পদ হওয়ার আগেই বস্তা খুলে জ্যান্ত পাখি চুপিসারে সরিয়ে ফেলতেন। সেই সব পাখিদের জায়গা হত খাঁচায়। বড়দের অলক্ষে খুদেদের এই সব কাজে সাহায্য করত বাড়ির পুরনো ভৃত্য নান্নু। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে সেলিম লিখেছেন, তিনি বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না খাঁচার বন্দি পাখিগুলিকে। তার পরেই হাতে আসে এয়ারগান। সেলিমের বাড়ির ভিতরে ছাদে বারান্দায় ছিল অগুনতি চড়াইয়ের বসবাস। চোখের সামনে এত চড়াই ছিল প্রশিক্ষণের জন্য মোক্ষম। তিনি জেনে নিয়েছিলেন, মুসলমান সন্তান হিসেবে চড়াইয়ের মাংস গ্রহণে পাপ নেই। কিন্তু তা উপযুক্ত হালাল হওয়া চাই। মৃত চড়াইকে হালাল করার পদ্ধতি, কী ভাবে তেল মশলা দিয়ে এদের সদগতি করতে হবে, সবই শিখেছিলেন নান্নুর কাছেই!

এমনই এক দিন, শিকারের পর এক চড়াইপাখি হালাল করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল পাখির গলায়। এ তো ঠিক পরিচিত চড়াইয়ের গলার মেটে দাগ নয়। তা হলে? মৃত পাখিটির গলায় ঝোল পড়ার দাগের মতো হলদে ছাপ। হালাল না করে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গেলেন মামার কাছে। মামাও এর বিহিত করতে না পারায় একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন অবৈতনিক সেক্রেটারি ডব্লু এস মিলার্ড-এর কাছে। সোসাইটির ভিতরে দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো কেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেওয়ালে টাঙানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি... প্রথম বার এই সব দেখে সেলিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সেলিমের জীবন বদলে দিয়েছিল। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এটা নিশ্চয় ১৯০৮ সালের কোনও একটা সময়ে ঘটে থাকবে। বি এন এইচ এস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’

পাখি ও প্রকৃতির বাইরে সেলিম আলি পাগল ছিলেন আর একটি ব্যাপারে। সেটি হল মোটরসাইকেল! কাজের সূত্রে মায়ানমারে গিয়ে প্রথম তাঁর হাতে আসে মোটরসাইকেল, ‘জেনিথ’। ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’ এবং ‘মেক’... সেরা কোম্পানিগুলির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল বিএমডব্লু-র মোটরসাইকেল ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বলে! বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরবাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নাল আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। নতুন মোটরসাইকেল হাতে এলেই, তিনি তার ইঞ্জিন খুলে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোম্পানি নতুন কী যন্ত্রপাতি তাতে দিল এবং কেন দিল। সপ্তাহান্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন মোটরসাইকেলের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে।

১৯৫০-এ সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেস-এ তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাইক ‘সানবিম’। একটাই উদেশ্য, ওই বাইকে করে গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ানো। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।

Salim Ali Birdman of India সেলিম আলি বার্ডম্যান Indian ornithologist Salim Moizuddin Abdul Ali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy