দিশারি: ‘ইনিয়াক’-এর মতো জটিল যন্ত্রকে ঠিকঠাক চালাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন এই মেয়েরা
কম্পিউটার’ চাষির ঘরের সন্তান। পরিবারটি শিক্ষিত। ভাইবোনরা অঙ্কে দারুণ। কম্পিউটারেরও অঙ্ক ভাল লাগে। অঙ্ক নিয়েই স্নাতক। ১৯৪৫ সাল নাগাদ সে জানতে পারল, যুদ্ধকালীন একটা প্রকল্পের জন্য আমেরিকার সেনাবাহিনী অঙ্কে স্নাতকদের নিয়োগ করছে। তক্ষুনি আবেদন, তার পরই দ্রুত চাকরিতে যোগ দেওয়ার ডাক। কম্পিউটার দৌড়ল ফিলাডেলফিয়ার দিকে।
‘কম্পিউটার’ আসলে একটি মেয়ে, নাম জাঁ জেনিংস বার্টিক। শুধু বার্টিকই নন, কম্পিউটার আসলে অনেক মেয়ের আর এক নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকায় ‘কম্পিউটার’ কোনও যন্ত্র ছিল না। ওটা ছিল পেশা, যে জগৎ প্রায় একচেটিয়া ভাবে ছিল অঙ্কে তুখড় মেয়েদের দখলে। বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যোগ দেওয়ার পরই প্রচুর মেয়েকে ‘কম্পিউটার’ হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়। তারা ডেস্ক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে লম্বা লম্বা আঁক কষত, তার পর সেই সব সমাধান দিয়ে তৈরি হত ‘টেব্ল’ আর তার ব্যবহার হত যুদ্ধক্ষেত্রে, কামানের গোলার গতিপথের হিসেবনিকেশ করতে। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেই জায়গা, যেখানে অসংখ্য মেয়ে-ক্যালকুলেটর ঘাড় গুঁজে দিনভর সংখ্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করত।
গর্ব হয়। সঙ্গে যন্ত্রণাও। কম্পিউটার-জমানার গোড়ার দিকে মেয়ে-নির্ভরতার আসল কারণটা যে অন্য। তাদের বেতন দিতে হত কম। তা ছাড়া এ তো ‘কেরানি’র চাকরি! পুরুষদের অপছন্দের। অগত্যা, ভাঙা কুলোর খোঁজ।
সে সময় বিশ্বে কয়েকটা মাত্র কম্পিউটার। হরিণ-গেলা অজগরের মতো অজস্র সময় খরচ করে তারা ধীরেসুস্থে কাজ করে। জনাকয়েক বিশেষ প্রশিক্ষিত মহিলা ‘ডিফারেনশিয়াল অ্যানালাইজার’ ব্যবহার করে হিসেব কষতেন। কিন্তু তাতেও সময় লাগত যথেষ্ট। তাই জন মকলি-র মতো ইঞ্জিনিয়ার ভাবলেন, একটা যন্ত্র বানানো যাক, যা দিয়ে ‘ব্যালিস্টিক টেব্ল’গুলো চটপট করে ফেলা যাবে। জন্ম হল ‘ইনিয়াক’-এর। ইলেকট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটার। পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রনিক ডি়জিটাল কম্পিউটার। যুদ্ধের জন্যই জন্ম, অথচ তৈরি যখন শেষ হল, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষের দিকে। তবে, হালের কম্পিউটার-নির্ভর দুনিয়ায় ঢুকে পড়ার রাস্তাটা ‘ইনিয়াক’-ই প্রথম দেখিয়েছিল। হাতে-কষা হিসেবে যে অজস্র সময় খরচ হত, তাকে ‘ইনিয়াক’ নামিয়ে এনেছিল মাত্র কুড়ি-তিরিশ সেকেন্ডে।
যন্ত্র তো হল। কিন্তু চলবে কী করে? কারওই সে বিদ্যে নেই। সুতরাং, মেয়েরাই ভরসা। ছয় কন্যেকে আনা হল ‘প্রোগ্রামার’ হিসেবে। জাঁ জেনিংস বার্টিক ছিলেন তাঁদেরই এক জন। এর আগে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় ‘ব্যালিস্টিক টেব্ল’ বানানোর কাজ করেছেন বার্টিক। কিন্তু কম্পিউটারের ‘প্রোগ্রামার’ হিসেবে কোনও অভিজ্ঞতাই ছ’টি মেয়ের ছিল না। ‘প্রোগ্রামার’ শব্দটিই তখন অচেনা। তাতে কী! অসাধ্যসাধন করলেন ছ’জন। অঙ্কবিদ্যের সেরাটুকু নিংড়ে তাঁরা খুঁজলেন মেশিন চালানোর নতুন রাস্তা, অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নিজেরাই দিলেন নিজেদের প্রশিক্ষণ। আর নতুন কিছু করার নেশায় হারিয়ে দিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমের ধকলকে। পরিশ্রম তো বটেই। মেশিনটা তো ঘর-জোড়া আর ভয়ানক জটিল। তাকে ঠিকঠাক কাজ করাতে হামেশাই লম্বা তার নিয়ে, ট্রে নিয়ে টানাটানি করতে হয়েছে, হামাগুড়ি দিয়ে সারাতে হয়েছে প্রকাণ্ড কাঠামোর ভেতরের কলকবজা। সব কিছু সুন্দর সামাল দিয়ে ‘ইনিয়াক’ আত্মপ্রকাশ করল। সেটা ১৯৪৬ সাল।
‘ইনিয়াক’ প্রকাশ্যে আসার পর তুমুল হইচই। হইচই মেশিন নিয়ে, হইচই সেই পুরুষদের নিয়েও, যাঁরা এর ডিজাইন তৈরি করেছেন। তাজ্জব ব্যাপার, কোথাও বার্টিকদের নাম শোনা গেল না। এমনকী, সাফল্যের আনন্দে যে ডিনার পার্টির আয়োজন হয়, তাতে ছয় মেয়েকে ডাকার কথাও মনে এল না কারও। তাঁদের কাজ স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক পরে।
স্বাভাবিক। মেয়েদের কাজকে কবেই বা তক্ষুনি সোনার মুকুট দিয়ে বরণ করা হয়েছে?
অন্য দিকে কিন্তু ‘প্রোগ্রামার’ হিসেবে মেয়েরা এগোচ্ছিল তরতরিয়ে। ১৯৫০-এর দশকে ৩০-৫০% প্রোগ্রামারই ছিল মেয়ে। বলা হয়েছিল, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ মেয়েদের দক্ষতা সহজাত। কিন্তু তার পরই ছবিটা বদলাতে শুরু করল। যে কাজকে নাকউঁচু পুরুষরা ‘মেয়েলি’ বলে দেগে দিয়েছিল, তারাই হঠাৎ আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। কারণ, এই কাজে বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সামাজিক সম্মান। তাকে শুধু মেয়েরাই কুক্ষিগত করবে? কেন? মেয়েদের দমিয়ে দিতে এই ক্ষেত্রে যোগদানের নিয়ম হল কড়া, সঙ্গে জুড়ল কুৎসিত পক্ষপাতিত্ব। রটিয়ে দেওয়া হল, এ পেশায় যারাই আসে, তারা একেবারেই অ-সামাজিক। সমাজের কায়দাকেতার ধার না ধারা খ্যাপাটে বাউন্ডুলে লোকজন। সঙ্গে মেয়েদের কাজের ধরন নিয়ে বাঁকা হাসি— ওরা তো স্রেফ গপ্পোগুজবেই সময় নষ্ট করে, আর ভুলভাল কাজ করে।
ফলে, সাফল্যের রেখাটা নামছিল। তার ওপর কম্পিউটার যখন অন্দরমহলে ঢোকার ছাড়পত্র পেল, পেরেক পোঁতার কাজও সম্পূর্ণ হল। কারণ, কম্পিউটার-দিগ্গজ হওয়া মানেই মোটা মাইনে, প্রচুর সম্মান। সুতরাং, সেই ব্যবস্থা থাক বাড়ির ছেলেটির জন্য, পরিবারের ভবিষ্যৎ রুটিরুজি নিশ্চিত করতে। তখন আমেরিকার কলেজেও কম্পিউটার সায়েন্স-এ আবেদনকারীদের বাড়ির কম্পিউটার নাড়াঘাঁটার অভিজ্ঞতা যাচাই করে দেখা শুরু হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটির সে সুযোগ ছিল। মেয়েটির কই? এমনকী কম্পিউটারের বিজ্ঞাপন-কৌশলেও এই ছেলেকেন্দ্রিক-ভাবনাকে সুন্দর কাজে লাগানো হল। ফল, আশির দশকেও যেখানে আমেরিকায় কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতকদের মধ্যে ৩৭ শতাংশই ছিল মেয়ে, ২০১১ সালে তা নামে কুড়িরও নীচে। আগামী দশ বছরে যে সে ছবি একদম বদলে যাবে, আগের মতো মেয়েরাই এ দুনিয়া শাসন করবে, সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তবে, মেয়েরা লড়ছে। শতকরা হিসেব হয়তো কমেছে, কিন্তু অনায়াস চলাফেরা বন্ধ তো হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে ফের যে কাজ থেকে পুরুষরা মুখ ঘুরিয়ে নেবে, সে কাজকে দাঁড় করানোর জন্য, তাকে দিনের আলো দেখানোর জন্য মেয়েদের ডাক পড়বে। এমনই তো চলছে এত কাল। চলুক না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy