Advertisement
E-Paper

আগে টাকা ফেলো, তবেই চিকিৎসা

ডাক্তার রোগীকে মাপছেন রোগের বিচারে নয়, অর্থের সামর্থ্যে। ৬০ বছর আগে থ্রিলার-লেখক রেমন্ড শ্যান্ডলার এ নিয়েই লিখেছিলেন এক গল্প।  খুঁজে পাওয়া গেল এক জুতোর বাক্সে। ডাক্তার রোগীকে মাপছেন রোগের বিচারে নয়, অর্থের সামর্থ্যে। ৬০ বছর আগে থ্রিলার-লেখক রেমন্ড শ্যান্ডলার এ নিয়েই লিখেছিলেন এক গল্প।  খুঁজে পাওয়া গেল এক জুতোর বাক্সে।

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০৮:০০
ঐতিহ্য: রেমন্ড শ্যান্ডলার। 

ঐতিহ্য: রেমন্ড শ্যান্ডলার। 

জেনারেল হাসপাতালের অ্যাডমিটিং ক্লার্ক আইরিস কুক, হাসপাতালের করিডরে রাখা স্ট্রেচারে শোয়ানো লোকটার দিকে অবজ্ঞাভরে তাকিয়ে ছিল। নোংরা একটা লোক, মুখে হুইস্কির গন্ধ ভকভক। ট্রাকে ধাক্কা মেরেছে, এ বার বোঝো ঠ্যালা! অন-ডিউটি ডাক্তারেরও সন্দেহ, এ একেবারে হদ্দ হাঘরে রুগি। চেহারাসুরত দেখে মনে হচ্ছে না, ট্যাঁকে পয়সা আছে। নিস্পৃহ গলায় তাই জানিয়ে দেওয়া হয়, এখানে কড়া নিয়ম, ভর্তি হতে গেলে ৫০ ডলার ফি দাও, নইলে মরার পথ দেখোগে।

এ ভাবেই শুরু গল্পটা। নাম ‘ইট’স অল রাইট— হি ওনলি ডায়েড’। মানে ‘সে মারা গিয়েছে মাত্র—ঠিকই আছে।’ লেখক রেমন্ড শ্যান্ডলার। পাল্প ফিকশন আর ক্রাইম স্টোরি যাঁর কলমে খলবল করত, সেই শ্যান্ডলার! ১৯৪০-এর দশকের বিখ্যাত হলিউড-ছবি ‘ডাবল ইনডেমনিটি’-র সহচিত্রনাট্যকার, দু’বার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া শ্যান্ডলার। সেই ডিটেকটিভ-গল্পলেখক, যাঁকে ওয়াশিংটন পোস্ট আখ্যা দিয়েছিল ‘দ্য মোস্ট লিরিক্যাল অব দ্য মেজর ক্রাইম রাইটার্স’! সেই লেখক যে এ হেন গল্প লিখতে পারেন, কে জানত!

সত্যিই জানেনি কেউ। ৬০ বছর পাণ্ডুলিপিটা ঘুমিয়ে ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোডলেয়ান লাইব্রেরির আর্কাইভে, একটা জুতোর বাক্সের মধ্যে। খুঁজে বের করেছেন অ্যান্ড্রু গালি, ‘স্ট্র্যান্ড’ ম্যাগাজিনের ম্যানেজিং এডিটর। ঠিক লোকই খুঁজে পেয়েছেন। যে ম্যাগাজিন একদা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে আর্থার কোনান ডয়েল থেকে আগাথা ক্রিস্টির একের পর এক গল্প, যার পাতায় ‘দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস’ ধারাবাহিক ভাবে বেরনোর সময় দফতরের বাইরে লম্বা লাইন পড়ত, তার বর্তমান সম্পাদকের হাতেই বোধহয় এই আবিষ্কার মানায়!

অ-শ্যান্ডলারোচিত? বটেই তো। রেমন্ড শ্যান্ডলারকে ইতিহাস অ্যাদ্দিন জেনেছে তাঁরই লেখার আলোয়। তিনি গোয়েন্দা-চরিত্র ফিলিপ মার্লোর স্রষ্টা, রুপোলি পরদায় যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন হামফ্রি বোগার্ট-এর মতো অভিনেতা। ফিলিপ দ্রুত গতিতে গাড়ি চালায়, মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে, অপরাধীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে দু’পেগ হুইস্কি উড়িয়ে দেয়! আর স্রষ্টা রেমন্ড শ্যান্ডলার তখনকার হলিউডে বিলি ওয়াইল্ডার-এর সঙ্গে স্ক্রিপ্ট লেখেন, আলফ্রেড হিচককের সঙ্গে বানান ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’, আমেরিকার ‘মিস্ট্রি রাইটার্স’দের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন, প্রেম করেন কখনও জর্জ অরওয়েল-এর বিধবা স্ত্রী সোনিয়া অরওয়েল, কখনও কবি-ঔপন্যাসিক স্টিভেন স্পেন্ডার-এর বউ নাতাশা স্পেন্ডার-এর সঙ্গে। তাঁর কলমে মুচমুচে হয়ে ওঠে খুন-ষড়যন্ত্র-প্রেম, পাঠক নড়েচড়ে বসে, বুকের মধ্যে শুনতে পায় লাব-ডুব। তাঁর কলম সোজা কথা পষ্টাপষ্টি লেখে, ক্রাইম-কাহিনিতেও ঝরায় কবিতা: মৃতরা ভাঙা হৃদয়ের চেয়েও ভারী। ‘ডেড মেন আর হেভিয়ার দ্যান ব্রোকেন হার্টস’!

১৯৪৪-এ ‘ডাবল ইনডেমনিটি’ ছবির পোস্টার

প্রায় ৬০ বছর পর আলো-দেখা এই গল্পে (অনুমান, এটা শ্যান্ডলার লিখেছিলেন ১৯৫৯ সালে তাঁর মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে) পাওয়া যাচ্ছে অন্য এক লেখককে। ১৯৫০-এর দশকের আমেরিকায় হাসপাতাল রুগিকে মাপছে তাঁর রেস্ত-র পাল্লায়। ব্যাংক ব্যালান্স আছে? তবে চিকিৎসা পাবে, নইলে ফক্কা। গল্প পড়ে এখন অনেকে বলছেন, এ তো এখনকার আমেরিকার গল্পও! ট্রাম্পকেয়ার-এ একই চিত্র, ফেলো মার্কিন কড়ি, মাখো ট্রিটমেন্টের তেল! কলকাতাও কি অন্য কথা বলে? বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার জন্য আসা ‘মধ্যবিত্ত’কে প্রথমেই শুধোনো হয়, মেডিক্লেম আছে? আর রোগী যদি দেখতে-শুনতে হন তারও চেয়ে ‘নিচু’, নগ্ন উদ্ধত প্রশ্ন ধেয়ে আসে, টাকাপয়সা আছে তো? গ্রামে জমিটমি? শ্যান্ডলার লিখছেন, যে ডাক্তার (বা চিকিৎসাব্যবস্থা) রোগ-অসুখ ছেড়ে গোড়া থেকেই রোগীকে তাঁর আর্থিক সামর্থ্যের নিক্তিতে মাপজোখ করে, মানুষ হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবে, জীবনরক্ষক হিসেবে সেই ডাক্তার ব্যর্থ। লিখছেন, ডাক্তারি পেশাটা মাঝেমধ্যেই ডাক্তার নামের মানুষটির থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। ডাক্তার নিজেও অনেক আগে থেকেই জানেন যে, এক দিন না এক দিন, পরিস্থিতিবিশেষে তাঁর কাছে এই প্রত্যাশা আসবে— রোগ হয়ে, রোগীর সাজে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ডাক্তারকে অন্য পাঁচটা মানুষের থেকে ‘বেশি ভাল’ হতে হবে, কে বলেছে? শ্যান্ডলার লিখছেন, উত্তরটা সহজ। তিনি যদি তা না হন, তবে তিনি ডাক্তারই নন।

ক্রাইম-লেখক রেমন্ড শ্যান্ডলার এই গল্প কোনও প্রকাশককে ছাপতে দেননি। চুপচাপ গুঁজে রেখেছিলেন অন্য লেখার স্তূপে। যে ধরনের লেখার জন্য তাঁর নামযশ, তার সঙ্গে এই গল্পের ভাব-ভাষা কোনও ভাবেই খাপ খায় না বলেই হয়তো! শ্যান্ডলার-বিশেষজ্ঞদেরও মত, তির্যক শ্লেষ পাওয়া যায় তাঁর লেখায় ছত্রে ছত্রে, কিন্তু ‘ইট’স অল রাইট...’ গল্পে লেখকের যেন এক অন্য অবতার। সমাজে টাকার গরম দেখানো মানুষগুলোর প্রতি তাঁর বিদ্রুপের চাবুক আছড়ে পড়ছে, গলার স্বর হয়ে উঠেছে বিরক্ত।

লেখকের জীবন যদি একটা আয়না হয়, তাতে এই গল্প লেখার সময়টাকে ধরলে দেখা যাবে অসুস্থ, একাকী শ্যান্ডলারকে। ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছেড়ে মার্কিন নাগরিক হয়েছেন তিনি, আর তার পর থেকেই অসুস্থতায় কাবু, হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন কয়েক দফায়। মেজাজি মানুষটা সারা জীবন কাটিয়েছেন নিজ নিয়মে। সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি করেছেন, আবার খবর কাগজের রিপোর্টিং, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সে গিয়ে ট্রেঞ্চে কাটানো— সব। হিচককের সঙ্গে পটেনি বলে ‘ফ্যাট বাস্টার্ড’ বলে গালি দিয়েছিলেন, ‘অমুক স্ক্রিপ্টটার শেষটা লেখেননি কেন’, প্রশ্নের উত্তরে হলিউডের প্রযোজককে বলেছিলেন, ‘মদ খেয়ে তবেই লিখব।’ এই মানুষটাই আবার স্ত্রীর মৃত্যুর পর এক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, পুলিশকে খবর দিয়ে! ১৯৫৯-এ মারা যান হাসপাতালেই। সেই সময়ের রোগ-অভিজ্ঞতাই হয়তো লিখিয়ে নিয়েছিল সেই গল্প, আজও যা প্রাসঙ্গিক। লেখকেরা কখনও কখনও সত্যিই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!

Raymond Chandler It's All Right — He Only Died Novelist Screenwriter রেমন্ড শ্যান্ডলার Double Indemnity
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy