Advertisement
E-Paper

জলসা মানেই তখন কিশোর

আমার মতো ভক্তেরা তখন তাঁকে দেখার টানে সমস্তিপুর, শান্তিপুর থেকেও বারবার ছুটে গিয়েছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। জলসায় তাঁকে দেখার রোমাঞ্চই ছিল অন্য রকম। সারা ক্ষণই দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন। আগামী শনিবার নব্বই বছরে পা দিচ্ছেন কিশোরকুমার।আমার মতো ভক্তেরা তখন তাঁকে দেখার টানে সমস্তিপুর, শান্তিপুর থেকেও বারবার ছুটে গিয়েছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। জলসায় তাঁকে দেখার রোমাঞ্চই ছিল অন্য রকম। সারা ক্ষণই দর্শকদের মাতিয়ে রাখতেন। আগামী শনিবার নব্বই বছরে পা দিচ্ছেন কিশোরকুমার।

সুরে, গানে আর কথায় জলসা জমিয়ে দিতেন কিশোরকুমার

সুরে, গানে আর কথায় জলসা জমিয়ে দিতেন কিশোরকুমার

সুমিত্র গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share
Save

প্রথম ঘটনাটা ১৯৭৭ সালের। তখন আমি কলেজে পড়ি। থাকতাম উত্তর বিহারের সমস্তিপুরে। শীতকাল এলেই আমাদের ওখানে জলসা হত। আমরা বলতাম শীতের জলসা। মূলত ‘মাচা শিল্পী’রাই আসর জমাতেন। মাঝেসাঝে নামকরা শিল্পীরাও আসতেন কলকাতা থেকে। এক দিন আমার জেঠতুতো দাদার চিঠি পেলাম। সংক্ষিপ্ত চিঠি। ‘চলে আয়, তোর জন্য কিশোরকুমার নাইটের টিকিট কেটেছি। সঙ্গে রফি সাবও আছেন।’ দাদা জানত আমি কিশোরের বিরাট ফ্যান। আমার তো তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। নামী শিল্পী বলতে বহু কাল আগে এক বার বনশ্রী সেনগুপ্ত এসেছিলেন। তখন তিনি সবে নাম করছেন। তাই অন্য শিল্পীর গানই বেশি গেয়েছিলেন। ওঁর কণ্ঠেই প্রথম শুনি ‘জনি মেরা নাম’ ছবির গান, ‘ও মেরে রাজা’। একটা বাংলা গানের কথাও মনে পড়ছে, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ একী কাণ্ড করেছি’। বনশ্রীর পর সোজা কিশোরকুমার! ভাবাই যায় না। তড়িঘড়ি টিকিট কেটে সুদূর বিহার থেকে কলকাতা পাড়ি দিলাম।

আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। দিনটা ছিল ১০ ডিসেম্বর। দাদার সঙ্গে গেলাম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। অত বিশাল স্টেডিয়াম আগে দেখিনি। স্টেডিয়ামে আমার ছোট মামার সঙ্গে দেখা। মামা থাকতেন শিবপুরে।

মঞ্চটি স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে। মঞ্চের মাঝখানে বিশাল একটা ব্যানারে লেখা ‘একই মঞ্চে প্রথম বার রফি-কিশোর’। অনুষ্ঠানের শুরুতে এলেন শাকিল আনসারি। তিনি রফি সাবের ঘোষক। এসেই উর্দু-মিশ্রিত হিন্দিতে ঘোষণা করলেন, ‘দোস্তো জ্যায়সা কি আপ জানতে হ্যায় আজ রফি সাহাব কে সাথ অউর এক মশহুর গুলোকার (গায়ক) মওজুদ হ্যায় অউর জিনকা নাম হ্যায় কিশোরকুমার। এমন একটা সময় ছিল যখন মহম্মদ রফিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইতে হত কিশোরকুমারের জন্য। সেই গানগুলির মধ্যে একটা গান কিশোর অভিনীত ‘কল্পনা’ ছবির ‘মন মোরা বাওরা’। এই গান দিয়ে রফি সাহেব তাঁর সে দিনের অনুষ্ঠান শুরু করলেন। দর্শকদের কাছে এ এক আলাদা চমক। রফি সাহেব সাধারণত ফাংশন শুরু করেন, ‘বড়ি দূর সে আয়ে হ্যায় প্যার কা তোফা লায়ে হ্যায়’ অথবা ‘মধুবন মে রাধিকা নাচে রে’ দিয়ে, সেখানে তিনি কিনা কিশোরকুমারের গলায় লিপ দেওয়া গান গাইবেন!

মহম্মদ রফি মূলত এক জায়গায় দাড়িয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। কিন্তু তাঁর অনন্য গায়কি এবং অনবদ্য গানের নির্বাচনের জন্য ফাংশন জমে যেত। সেই সময় সবে দেশে জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে। ইমার্জেন্সি চলাকালীন কিশোরকুমারের গান নিষিদ্ধ ছিল। আমার মতো অনেক কিশোর-ভক্ত ভাবতেন, এই সুযোগেই বুঝি রফি সাবের অনেক গান হিট করে। একই ছবি ‘হাম কিসিসে কম নেহি’-তে রফির ‘চাঁদ মেরা দিল’ গানটা ব্যাপক হিট, অথচ তার পরের গান, কিশোরের কণ্ঠে ‘আ দিল কেয়া মেহফিল হ্যায় তেরে’-র সম্প্রচার বন্ধ থাকায় গানটি তেমন প্রচার পায়নি।

সে দিন রফি যেমন ‘মধুবন মে রাধিকা’ গাইছেন, তেমনই ‘পর্দা হ্যায় পর্দা’ও গাইছেন। একটু থেমে পর পর দুটি বাংলা গান, ‘তোমাদের আশীর্বাদে এই শতদল মাথায় রাখি’ এবং তাঁর আরও একটি বিখ্যাত গান ‘তার চোখে নেমে আসা রঙে রঙে ভালবাসা’ গাইলেন। এর পর ‘লায়লা মজনু’ ছবির গান ‘তেরে দর পে আয়া হু’ গাওয়ার পরেই ধরলেন সুপারহিট গান ‘মস্ত বাহারো কা ম্যায় আশিক’। পরের পর গান গেয়ে ফাংশন জমিয়ে দিলেন। জনতা তখন ‘গুরু গুরু’ রব তুলেছে। দর্শক যখন রফির মাদকতাময় কণ্ঠে বুঁদ হয়ে আছেন, তখনই তিনি শুরু করলেন ‘পিতে পিতে কভি কভি ইউ জাম বদল যাতে হ্যায়’। দর্শক তত ক্ষণে সত্যিই রফিসাবের গানের নেশায় বুঁদ।

এত আনন্দ-উন্মাদনার মধ্যেও আমার উৎকণ্ঠা কিছুমাত্র কমেনি। তার কারণ, মঞ্চ থেকে মহম্মদ রফির প্রস্থানের পর আমি তখন কিশোরকুমারকে দেখার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ঝলমলে নীল শাড়িতে উজ্জ্বল রুনা লায়লা উপস্থিত হলেন। তখন ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’ গানটি বিরাট হিট। এই গান শুরু হতেই উপস্থিত অধিকাংশ দর্শক নাচতে লাগলেন। পরের দুটি গান ‘দমাদম মস্ত কলন্দর’ ও ‘তুম হো না হো মুঝকো তো’ গেয়ে আসর জমিয়ে দিলেন রুনা। তত ক্ষণে গায়ক ভুপিন্দর সিংহ মঞ্চে উঠে পরেছেন। রুনা লায়লার সঙ্গে তাঁদের হিট গান— ‘ঘরোন্দা’ ছবির ‘দো দিওয়ানে শহর মে’— পরিবেশন করলেন। এর পর দুজনে মিলে গাইলেন ‘পরিচয়’ ছবির ‘বিতি না বিতায়ে রৈনা’ ও ‘মৌসম’ ছবির বিখ্যাত গান ‘দিল ঢুঁঢতা হ্যায় ফির ওহি’। প্রমাণ হয়ে গেল, ফাংশন জমাতে এঁরাও কিছু কম যান না!

ভুপিন্দর ও রুনা লায়লা মঞ্চ থেকে নেমে যাবার পর বোঝা গেল এ বার সত্যিই কিশোরকুমার আসছেন। গুরু এলেন একটু অন্য মেজাজে, ঘোড়ায় চেপে! এবং তখন তাঁর কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে তাঁর বহুশ্রুত জনপ্রিয় শব্দগুলো, ‘‘পেয়ারে বন্ধুয়ো, সঙ্গীতকে প্রেমিয়ো, মেরে চাচা চাচিয়ো, মেরে মামা মামিয়ো আপ সবকো কিশোরকুমার কা সপ্রেম নমস্কার।’’ গান শুরুর আগেই তিনি আসর জমিয়ে দিলেন।

আমি তখন উত্তেজনায় থরথর। মঞ্চে উঠে কিশোর নিজেই ঘোষকের কাজ শুরু করে দিলেন। ‘প্রেম পুজারী’ ছবির ‘ফুলো কে রং সে দিল কি কলম সে’ গান দিয়ে শুরু করলেন অনুষ্ঠান। একের পর এক তাঁর অজস্র হিট গানের ডালি মেলে ধরলেন। পরের গান, ‘মুসাফির হু ইয়ারোঁ’, পাবলিক তখন আবেগে ভাসছে। ঘোষক কিশোরকুমারের কথা বলার ভঙ্গিও যে অন্যদের চেয়ে আলাদা। মাইক হাতে নিয়ে বললেন, ‘‘পেয়ারে সাথিয়ো অব পেশে খিদমত হ্যায় ফিল্ম ‘জহরিলা ইনসান’ কা ওহ হসিন নগমা ‘ও হন্‌সিনি মেরে হন্‌সিনি’।’’

সারা স্টেডিয়াম ওঁর ভরাট গলার সুরে গমগম করতে লাগল। এর পর একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে ধরলেন একটা বাংলা গান। ‘এই যে নদী’, তার পর ‘আমার মনের এই ময়ূরমহলে’। একটু জল খেয়ে এ বার আবার হিন্দি গান, ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’। গান শুনে প্রেক্ষাগৃহ স্তব্ধ। একটু হেসে বললেন, ‘‘কী সবাই এত চুপচাপ কেন? এ বার একটু শচীনকত্তার গান হয়ে যাক!’’ তার পরই ধরলেন, ‘ধীরে সে জানা খটিয়ন মে ও খটমল ধীরে সে জানা খটিয়ন মে’। সে সময় রুনাজি হয়তো মগ্ন হয়ে মাথা নিচু করে গান শুনছিলেন ভিআইপি বক্সে বসে। কিশোর তখন গেয়ে চলেছেন ‘সোই হ্যায় রাজকুমারী দেখ রহি মিঠি স্বপ্নে’। তখনই লাইটম্যান রুনাকে ফোকাস করতে, সবাই প্রবল উৎসাহে রুনাকে এমন ভাবে দেখতে লাগলেন যেন রুনা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওই হুল্লোড়ের মধ্যেই গুরু গাইছেন ‘যা যা ছুপ যা শরিয়ন মে ও খটমল’, রুনাজি তখন সত্যিই ব্যস্তসমস্ত। এই দেখে পাশে বসা এক দর্শক বলতে লাগলেন, এই না হলে কিশোর! গানের সঙ্গে কী ভাবে বিনোদন আর মনোরঞ্জনকে মেশাতে হয়, একমাত্র গুরুই জানেন। সে দিন শেষ গান ছিল ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখ না’।

তখন ফাংশন শেষ হতে বেশ রাত হত। সবাই ঘরমুখী, এ দিকে কোনও যানবাহন নেই। থাকবে কি করে, সে দিন রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। মামা বললেন, চল এই ভিড় থেকে একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়াই। একটু দূরে দাঁড়াতেই হঠাৎ শিবপুর যাওয়ার একটা মিনিবাস দেখে আমরা লাফিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। বসার জায়গাও পেলাম। ইতিমধ্যে ফাংশন-ফেরত কিছু লোক ওই বাসে চড়লেন। বেশির ভাগই সালকিয়ার প্যসেঞ্জার, তাঁরা সবাই ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরকে চাপ দিতে লাগলেন সালকিয়া যাওয়ার জন্য। এই নিয়ে শিবপুরের যাত্রীদের সঙ্গে বচসা। পুলিশ পেট্রলিং-এর গাড়ি দেখে ড্রাইভার বাস দাঁড় করিয়ে দিল। পুলিশ আমাদের বাস নিয়ে গেল শিবপুর থানায়। সেই রাতে শেষ পর্যন্ত আমাদের শিবপুরের যাত্রীদের পুলিশ ভ্যানে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। জীবনে প্রথম একটা জমজমাট জলসা দেখা, স্বচক্ষে কিশোরকুমারকে দেখা, শেষে বাড়ি ফেরার ওই অভিজ্ঞতা।

নক্ষত্র: কিশোরকুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর, আর ডি বর্মণ ও আসা ভোঁসলে।

১৯৮২ সালে আবার একটা জম্পেশ জলসা দেখার সুযোগ এসে গেল। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লতা আর কিশোর নাইট। টিকিটের দাম ১০০ টাকা। তবু ঠিক করলাম, দেখতে যাব। এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। প্রথমে লতা শুরু করলেন গীতার শ্লোক দিয়ে। পরের গান শচীনকত্তার সুরে ‘মেঘা ছায়ে আঁধি রাত’। একের পর এক গান— আর ডি’র সুরে ‘রয়না বিতি যায়ে’, তার পরেই লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সুরে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, তার পর ‘যশোমতী মাঈয়া সে বোলে নন্দলালা’। এখানেই শেষ নয়। সলিল চৌধুরীর সুরে ‘বাঁশি কেন গায়’ আর ‘আ যা রে পরদেশি’ গান দুটি শেষ হতে না হতেই আবার ‘সাত ভাই চম্পা’। শ্রোতারা তখন ‘লতা লতা’ রব তুলেছেন। আর আমার চিন্তা, সব হাততালি যদি লতাই নিয়ে যান, কিশোরকুমার এলে তো তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হবে!

আমার এই চরম টেনশনের মধ্যেই হঠাৎ গুঞ্জন, কিশোর আসছেন। তত ক্ষণে লতা নিজে ঘোষণা করে দিয়েছেন কিশোরের আগমনবার্তা। নিজের কিছু অভিজ্ঞতাও বললেন মাইকে— কী ভাবে তিনি আর কিশোরকুমার স্টুডিয়োপাড়ায় যেতেন গান রেকর্ড করতে। তিনি কিশোর কুমারের থেকে দু মাসের ছোট, তাই ওঁকে ‘কিশোরদা’ বলেন।

স্টেডিয়ামের প্রায় সব আলো নেভানো। শুধু একটা স্পটলাইট কিশোরকুমারের উপরে। হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে কিশোর তাঁর বিখ্যাত গান ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ গাইতে গাইতে স্টেজে উঠছেন। লতা এক ধাপ নেমে কিশোরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। কিশোর গান গাওয়ার ফাঁকে বললেন, ‘জিতি রহো লতা।’ অসাধারণ এক দৃশ্য, নিজের আবেগ ধরে রাখা কঠিন। সারা স্টেডিয়াম তখন আপ্লুত। লতার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন হরিশ ভিমানি। কিশোরকুমার মঞ্চে এসেই তাঁকে বাংলায় বললেন, ‘‘বাবা হরিশ তুমি এ বার এস, এটা কলকাতা, আমার বাড়ি, আর দর্শকরা সবাই আমার বাড়ির লোক।’’ হরিশ ভিমানি হেসে শুধু বললেন, ‘‘জি কিশোরদা।’’ উপস্থিত সব দর্শককে প্রথমেই ঘরের লোক করে নিতেন কিশোর, তার পর একাই উপস্থাপনার কাজটি সামলাতেন।

একের পর এক দুজনের কালজয়ী ডুয়েট! কখনও ‘হম দোনো দো প্রেমী দুনিয়া ছোড় চলে’ তো পরক্ষণেই ‘ওয়াদা করো নহী ছোড়োগে তুম মেরা সাথ’, শচীনকত্তার সুরে ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রয়না’, আর ডি’র সুরে ‘অব কে সাবন মে জী ডরে’। একটু পরেই যখন গাইছেন ‘তুম আ গয়ে হো, নুর আ গয়া হ্যায়’, সবার সামনে তখন যেন ‘আঁধি’ সিনেমা, সূর্যাস্তের দৃশ্যে সঞ্জীবকুমার-সুচিত্রা সেনের প্রেম।

লতাজি মঞ্চ থেকে নেমে গেলে শুরু হল কিশোরকুমারের একক অনুষ্ঠান। শুরু করলেন ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’ দিয়ে। পরের দুটি গান তো ওঁর গলায় ইতিহাস হয়ে আছে— ‘আনেওয়ালা পল জানেওয়ালা হ্যায়’ আর ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। গান শেষে দর্শক চুপ, কিশোর তখন যন্ত্রীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কী কথা বলছেন। হটাৎ আমার কী মনে হল, চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘‘নমকহলাল!’’ উনি শুনতে পেলেন, বললেন, ‘‘লাইটম্যান, উস তরফ ফোকাস করো।’’ তার পর বললেন, ‘‘কে বলল?’’ সবাই মিলে প্রায় পাঁজাকোলা করে আমাকে তুলে ধরল। তখন যদিও বলেছিলেন, ‘‘এত বড় গান গাইতে পারব না’’, তবু অনুষ্ঠানের শেষ লগ্নে এসে ধরলেন, ‘কে পগ ঘুঙরু বাঁধ মিরা নাচি থি’। আমার, আমার চারপাশের দর্শক-শ্রোতাদের উল্লাস তখন দেখার মতো। মনে আছে, সে বার একটা টেপ রেকর্ডারে কিছু গান রেকর্ড করেছিলাম।

ফাংশন শেষে কোনও রকমে হাওড়া স্টেশনে এসে দেখি, লাস্ট ট্রেন চলে গেছে। তাতে কী, স্টেশনেই খবরের কাগজ পেতে বসে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ফাংশনের গান শুনেই রাত কেটে গিয়েছিল।

১৯৮৬ সালে আবার একটা দারুণ জলসা দেখার সুযোগ এসেছিল। সেই নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম। এ বার আশা, আর ডি আর কিশোর নাইট। অনুষ্ঠান শুরু করলেন আশা ভোঁসলে। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে ‘রাত বাকি বাত বাকি’ গেয়ে আসর জমিয়ে দেন। আশাও অনেকটা কিশোরকুমারের মতো নিজের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা নিজেই করেন। পর পর দুটো বাংলা গান করলেন— ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দুজনে’ আর ‘কথা দিয়ে এলে না’। আবার হিন্দি গানে ফিরলেন, ‘উমরাওজান’ ছবির ‘দিল চিজ কেয়া হ্যায় আপ মেরি জান লিজিয়ে’, ‘ইয়ে লেড়কা হায় আল্লা’, ‘ইয়ে মেরা দিল ইয়ার কা দিওয়ানা’ ইত্যাদি সুপারহিট গান। শ্রোতারা তখন আনন্দে নাচছে। এই হইচইয়ের মধ্যেই হঠাৎ গান থামিয়ে মাইক হাতে ঘোষণা করলেন, পার্ক স্ট্রিটে রাহুলকে ট্র্যাফিক পুলিশ ধরেছে। তাই তিনি আসতে পারছেন না। এই বলে একটু কাঁদো কাঁদো গলায় গান ধরলেন, ‘স্বপ্না মেরা টুট গয়া তু না রহা কুছ না রহা’। আমরা তখন সত্যিই ভাবছি, আর ডি এখন কোথায়! ও মা, তখনই স্পট লাইটে দেখা গেল আপাদমস্তক সাদা পোশাক রাহুল দেববর্মণ মাইক হাতে গাইছেন ‘আজা মেরি বাহো মে আ পেয়ার ভরি রাহো মে আ’। পরে বুঝেছিলাম, এ সব ওঁদের আসর জমানোর টেকনিক। জলসা এর পর জমে গেল, জ্বলে উঠল স্টেডিয়ামের সব কটা আলো। রাহুল ও আশাজি বেশ কয়েকটি ডুয়েট গাইলেন। ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’, ‘পিয়া তু অব তু আজা’ আজও কানে লেগে আছে। আর ডি একা গেয়েছিলেন ‘শোলে’ ছবির ‘মেহবুবা মেহবুবা’, ‘কিতাব’ ছবির ‘ধন্নো কি আঁখো মে’। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গেয়ে আসর মাতিয়ে দিলেন। সবাই তখন ‘আর ডি, আর ডি’ আওয়াজ তুলেছে।

শেষ বেলায় এলেন কিশোরকুমার। এসেই আশাজির সঙ্গে প্রথম গান ‘এক ম্যায় অউর এক তু’, আর ‘লে কর হম দিওয়ানা দিল’। গলা মেলালেন আর ডি’ও। কিশোর-আশার অসামান্য রসায়নের কথা শুনেছিলাম, সে দিন নিজের চোখে দেখলাম। দুর্দান্ত বোঝাপড়া ছাড়া এই সব অসাধারণ ডুয়েট গাওয়া যায় না।

১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছিল অনুষ্ঠান ‘পুলিশ হোপ’। কিশোরের সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ী। কিশোরকুমার সে দিন বাপ্পি লাহিড়ীর সুরের গানই বেশি গেয়েছিলেন। স্থানীয় শিল্পীর সঙ্গে ‘জলতা হ্যায় জিয়া মেরা ভিগি ভিগি রাতো মে’, ‘নয়নো মে স্বপ্না’, ‘তাকি ও তাকি’ গেয়ে জমিয়ে দিলেন। বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে জমিয়ে গাইলেন ‘দে দে পেয়ার দে’, আবার ‘গুরু, গুরু’ রব স্টেডিয়াম জুড়ে। গেয়েছিলেন ‘এই তো জীবন, যাক না যে দিকে যেতে চায় প্রাণ’।

সে দিন অনুষ্ঠান শেষে বলেছিলেন, ‘‘যদি বেঁচে থাকি, আবার আসব। আপনাদের গান শোনাব।’’ তা আর হয়নি। সেটাই ছিল কিশোরকুমারের শেষ কলকাতা সফর। ১৩ অক্টোবর ১৯৮৭ ওঁর মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকলে আগামী শনিবার পা দিতেন ৯০ বছরে। জানি, ইউটিউব ঘাঁটলে আজকাল স্মার্টফোনেই দেখা যায় তাঁর গান। কিন্তু জলসায় কিশোরকুমারকে দেখার রোমাঞ্চ সেখানে কোথায়!

Kishore Kumar Kishore Kumar Birth Anniversary Playback Singer Bollywood Celebrities Live Performance কিশোরকুমার

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।