১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় সমগ্র বাংলায় যখন প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠল, স্বদেশি আন্দোলন তখন মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বিদেশি বস্ত্রের দহনগন্ধকে দূর করে নিজের মাটির ঘামে ভেজা খদ্দরবস্ত্রের কাছে ফেরার ডাক উঠল চার দিকে। খদ্দরের মোটা কাপড়ে লুকিয়ে ছিল সেই সময়ের আত্মমর্যাদার গন্ধ, যা বিদেশি মসৃণ সিল্কের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এই অগ্নিগর্ভ দিনগুলিতে, বাংলার ঘরের ভিতর নীরব অথচ অমিত শক্তির এক বিপ্লবী স্রোত বইতে লাগল। কলকাতা, কৃষ্ণনগর, ঢাকা সর্বত্র, নিরালায় বসে নারীহৃদয় সুচ ও সুতোর মর্মস্পর্শী মেলবন্ধনে তৈরি করতে লাগল পতাকা। খদ্দরের উপর সূচিকর্মে ফুটে উঠতে লাগল চক্রের দৃপ্ততা, পদ্মফুলের নির্মলতা, বাঘের গর্জন। মাঝে মাঝে সেই পতাকার বুকে জ্বলজ্বল করত একটি স্লোগান— ‘বন্দে মাতরম্’, সেলাই করা অক্ষরগুলিও প্রাণ পেয়ে হাওয়ায় উড়ত স্বাধীনতার গান গেয়ে।
এ কেবল এক-এক খণ্ড কাপড় নয়— ঘরের আঁধারে, পর্দার অন্তরালে জন্ম নেওয়া এক-এক টুকরো বিপ্লব। রক্ষণশীল ঘরের মেয়েরা, যারা দিনের আলোয় রাজপথে নামার সুযোগ পেত না, তারাও সুচের ডগায় নিজেদের প্রতিবাদের কথা বলেছিল নিঃশব্দে। কোমল হাতে বোনা একটি সুতোও হয়ে উঠেছিল সাহসের প্রতীক, প্রতিরোধের অস্ত্র।
১৮৫৭ সালের উত্তাল হাওয়ায় যখন উত্তর ভারতের মাঠ, নদী, বনভূমি জ্বলছিল বিদ্রোহের আগুনে, তখন ঘরের অন্তঃপুরেও চলছিল আর একটি নিঃশব্দ যুদ্ধ। বন্দুকের শব্দের বিপরীতে, কাঁথার কাপড়ে সুচ ফোঁড়ার টুপটাপ ছিল বিদ্রোহের গোপন সঙ্গীত।
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের সৈনিকদের জন্য রাতে রুদ্ধদ্বার ঘরে বসে সেলাই করতেন শহরের মেয়েরা। কখনও যুদ্ধের পোশাক, কখনও রক্তের মতো লাল সুচের ফোঁড়ে আঁকা পতাকা। তরোয়াল, পদ্ম বা উদীয়মান সূর্যের প্রতীকে তাঁরা চিহ্নিত করতেন নিজেদের অদৃশ্য, গোপন অংশগ্রহণ। প্রতিটি কাপড়ের আঁচড় যেন ছিল এক নীরব চিৎকার, ‘আমরা আছি।’
গোপন সভায় বিদ্রোহীরা যে পতাকা বহন করতেন, তার অনেকগুলি তৈরি হত মা, বোন, স্ত্রীদের হাতে। পিতৃপ্রদত্ত উত্তরাধিকার নয়, বরং নিজের হাতে সেলাই করে গড়া এক অনমনীয় প্রতিজ্ঞা। এ সব পতাকায় সূচিকর্মে ফুটে উঠত স্বাধীনতার স্বপ্ন, পুষ্পের নকশা, ধর্মীয় প্রতীক, তলোয়ারের আকৃতি— যেন অক্ষরে অক্ষরে রচিত নতুন ভারতের গল্প। বিদ্রোহীরা যখন পথে যেতেন, পিছনে রয়ে যেত মেয়েদের আঙুলে ফুটে যাওয়া সুচের দাগ। এক অদৃশ্য যুদ্ধচিহ্ন, যা ইতিহাসের পাতায় মিশে গেছে, অথচ হারায়নি।
ঐতিহাসিক ভাবে সূচিশিল্প একটি গৃহস্থালি কার্য বলে বিবেচিত হলেও, এর মধ্য দিয়েই নারীসমাজ বহু সময়ে তাদের অভিজ্ঞতা, আবেগ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে মহিলারা নিজেদের জীবনের যন্ত্রণা, ধর্মীয় অনুভূতি বা পারিবারিক ইতিহাস সুচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন। নির্বাক মনে হলেও, সুচ আর সুতোর শিল্প বহু যুগ ধরে বয়ে এনেছে নানা অনুভব, প্রতিবাদ আর অস্তিত্বের কথা। সেলাই, সূচিকর্ম, এমব্রয়ডারি— নাম যা-ই হোক না কেন, তা নিছক নিপুণতার প্রদর্শনী নয়। বরং ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা এক নীরব উচ্চারণ, যেখানে প্রতিটি সুতোর ফোঁড় এক-একটি গল্প বলে। কখনও নিপীড়নের, কখনও প্রতিবাদের, কখনও বা এক নিঃশব্দ বিপ্লবের।
অষ্টাদশ শতকে নারীরা ক্রস স্টিচের মাধ্যমে লিখতেন নৈতিক শিক্ষাবাক্য ও মর্মস্পর্শী কবিতা, যা এক ধরনের রাজনৈতিক ভাষ্য হয়ে উঠেছিল। বিশ শতকের সূচনালগ্নে ব্রিটেনে নারী ভোটাধিকার আন্দোলনে সূচিশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘সুফ্রাগেত্তে’ অর্থাৎ ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনকারী নারীরা বন্দি অবস্থাতেও সুচে-সুতোয় তাঁদের প্রতিবাদ প্রকাশ করতেন, ‘ভোটস ফর উইমেন’ লেখা ব্যানার, পতাকা বা ব্যাজ তৈরি করতেন হাতে। অনেক সময় জেলখানায় তাঁরা সূচিকর্মের মাধ্যমে নিজেদের নাম, তারিখ এবং ‘হাঙ্গার স্ট্রাইক’ বা ‘পলিটিক্যাল প্রিজ়নার’ লিখে রাখতেন, যা আজ ইতিহাসের মহামূল্য দলিল।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু নার্স বা হাসপাতালে তাঁদের সহকারীরা সুচের মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই সব সূচিকর্ম শুধু তাঁদের মানসিক অবস্থা নয়, যুদ্ধের অভিঘাতও তুলে ধরে।
১৯৪২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, জাপানি বাহিনীর কাছে সিঙ্গাপুর আত্মসমর্পণ করে। এর পর প্রায় চারশো নারী ও শিশু চাঙ্গি কারাগারে বন্দি হন। এই কঠিন সময়ে, কানাডীয় বন্দিনী এবং প্রাক্তন রেড ক্রস প্রতিনিধি এথেল মুলভ্যানি বন্দিদের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাঁথা তৈরির উদ্যোগ নেন। ‘চাঙ্গি কুইল্টস’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি কারাগারে বন্দি নারী ও শিশুদের দ্বারা তৈরি সূচিকর্মের অনন্য নিদর্শন। তিনটি কাঁথা তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান এবং জাপানি রেড ক্রসের জন্য, যাদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, একঘেয়েমি দূরীকরণ এবং অন্যান্য ক্যাম্পে তথ্য প্রেরণ। প্রতিটি কাঁথায় ৬৬টি সূচিকর্মের স্কোয়ার ছিল, যেখানে প্রতিটি বন্দিনী নিজের নাম এবং ব্যক্তিগত অনুভূতি বা প্রতীক অন্তর্ভুক্ত করতেন। কিছু স্কোয়ারে গোপন বার্তা, প্রতীক বা চিত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘চাঙ্গি কুইল্টস’ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল এবং ব্রিটিশ রেড ক্রস মিউজ়িয়মে সংরক্ষিত আছে।
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হমং জনগণের ‘হমং স্টোরি ক্লথ’ একটি অনন্য সূচিকর্ম শিল্প, যা তাঁদের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা চিত্রিত করে। ১৯৭০-এর দশকে, লাওস ও তাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে হমং নারীরা এই সূচিকর্ম তৈরি শুরু করেন। তাঁরা তাঁদের গ্রামীণ জীবন, কৃষিকাজ, উৎসব ও ‘সিক্রেট ওয়ার’ চলাকালীন অভিজ্ঞতা চিত্রিত করতেন। হমং স্টোরি ক্লথ-এ কিছু সূচিকর্মে ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় টেক্সটও অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট করে। মিনেসোটার সেন্ট পল শহরে অবস্থিত হমং কালচারাল সেন্টার মিউজ়িয়মে এই সূচিকর্মগুলি প্রদর্শিত হয়।
‘বর্ডাডোস পোর লা পাজ়’— মেক্সিকোতে ২০১১ সালে নারীহত্যা এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে শুরু হয়। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সাদা কাপড়ে লাল সুতো দিয়ে জনগণ নিহত ও নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের নাম বোনেন। এটি শান্তির প্রতীক এবং মানবাধিকার আন্দোলনের অংশ, যেখানে যে কোনও ধর্ষণ বা গুমখুনের শিকার হওয়া ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
প্রথমে, ‘বর্ডাডোস পোর লা পাজ়’ উদ্যোগটি মেক্সিকো সিটির ফুয়েন্তেস রোজা নামে একটি সংগঠন দ্বারা শুরু হয়, যা জ়াভিয়ের সিসিলিয়া পরিচালিত ‘মুভমেন্ট ফর পিস উইথ জাস্টিস অ্যান্ড ডিগনিটি’-র সঙ্গে যুক্ত। পরে, এই উদ্যোগ মেক্সিকোর বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও গড়ে ওঠে। লাল সুতো রক্তের প্রতীক এবং সাদা কাপড় মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করতে সবুজ সুতো ব্যবহার করা হয়, যা জীবিত অবস্থায় তাঁদের ফিরে আসার আশা প্রকাশ করে। বর্ডাডোস পোর লা পাজ় প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল ভুক্তভোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, নিহত বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের জীবন্ত মানুষ হিসেবে চিনতে সাহায্য করা। বর্ডাডোস পোর লা পাজ় শুধু মেক্সিকোতে নয়, বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই উদ্যোগটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন পেয়েছে। এর প্রতিটি সুতো হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ, প্রতিশ্রুতি এবং শান্তিপূর্ণ ন্যায়বিচারের আহ্বান।
চিলির ‘আরপিলেরা’ হল রঙিন কাপড়ের উপর সূচিকর্মের মাধ্যমে তৈরি কোলাজ বা কাঁথাচিত্র, যা ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অগুস্তো পিনোচে-র সামরিক শাসনের সময় চিলির নারীরা তৈরি করেছিলেন। এই সূচিকর্মগুলি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নিখোঁজ স্বজনদের স্মরণ এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে এক শক্তিশালী ভাষ্য হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৩ সালে চিলির গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল পিনোচে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হন, গ্রেফতার হন বা নির্যাতনের শিকার হন। নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী, ভাই বা সন্তান নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাঁরা ‘আরপিলেরা’ তৈরি করে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করতেন। এই সূচিকর্মগুলিতে তাঁরা নিখোঁজ স্বজনদের পোশাকের টুকরো ব্যবহার করতেন, যা তাঁদের স্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলত।
‘আরপিলেরা’ শুধু শিল্প নয়, এক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের মাধ্যম। এই সূচিকর্মগুলিতে চিলির নারীরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট, নিপীড়ন ও নিখোঁজ স্বজনদের স্মৃতি তুলে ধরতেন। এই সূচিকর্মগুলির খবর বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে, চিলির মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করে। ‘আরপিলেরা’ তৈরি করাটা ছিল নারীদের পক্ষে একটি থেরাপিউটিক প্রক্রিয়া। এই সূচিকর্মগুলি তাঁদের মানসিক প্রশান্তি দিত এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার একটি নিরাপদ পরিসর তৈরি করত। এই প্রক্রিয়াটি তাঁদের মধ্যে সংহতি ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। ‘আরপিলেরা’ সূচিকর্মগুলি আমাদের শেখায়, শিল্প ও সৃজনশীলতা কী ভাবে সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
প্যালেস্টাইনি ‘তাত্রিজ়’ একটি প্রাচীন শিল্প যা হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে। এটি কেবল একটি সজ্জা-বিষয়ক কৌশল নয়, প্যালেস্টাইনের জনগণের সাংস্কৃতিক পরিচয়, প্রতিরোধ এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। তাত্রিজ়ের উৎপত্তি প্রায় তিন হাজার বছর আগে। তা ছিল সেখানকার নারীদের প্রতিরোধ ও অস্তিত্বের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে মেয়ে, এই ভাবে প্রজন্মান্তরে এটি শেখানো হয় এবং ইজ়রায়েলি সামরিক দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০২১ সালে ইউনেস্কো এই শিল্পকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
প্যালেস্টাইনের প্রতিটি অঞ্চলের তাত্রিজ়ের নকশা ও রঙের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। হেবরনের নারীরা সবুজ রঙের ব্যবহার করতেন, যা তাদের যুবাবস্থা নির্দেশ করত। বর্তমানে তাত্রিজ় প্যালেস্টাইনি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মশালা, ডিজ়াইনারদের ডিজ়াইন এবং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে এটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। তাত্রিজ় প্যালেস্টাইনের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রতিরোধের অমূল্য অংশ।
প্যালেস্টাইন যুদ্ধে তাত্রিজ় হয়ে উঠেছিল এক গোপন ভাষা, এক সাংস্কৃতিক অস্ত্র, এবং সর্বোপরি এক দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিরোধ। ইজ়রায়েলি দখলদারিত্বের সময় প্যালেস্টাইনি নারীরা যখন অস্ত্র ধরেননি, তখন তাঁরা সুচ-সুতোর মধ্যেই বুনে নিয়েছিলেন তাঁদের ইতিহাস, পরিচয় এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তাত্রিজ়ের প্রতিটি মোটিফ পাহাড়, পাখি, গাছ, তারা— তাদের নিজস্ব তাৎপর্য বহন করে। কোন গ্রামে কোন মোটিফ প্রচলিত, তা দিয়েই বোঝা যেত কারা কোন অঞ্চল থেকে এসে সমবেত হয়েছে।

সূচিশিল্প: ‘চাঙ্গি কুইল্ট’ এর চৌখুপি কাঁথাচিত্র।
১৯৪৮ সালে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের পরে যখন লক্ষ লক্ষ প্যালেস্টাইনি মানুষ উদ্বাস্তু হলেন, তখন তাঁদের গায়ে থাকা সূচিকর্মই হয়ে উঠল তাঁদের হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের স্মারক। তাত্রিজ় তখন আর শুধু শিল্প নয়, হয়ে উঠল ‘আইডেন্টিটি স্টিচড ইন এগজ়াইল’। এই সূচিকর্মের পোশাক পরেই নারীরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে যোগ দেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে প্যালেস্টাইনি জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বও করেন। বহু সূচিশিল্পী তাঁদের কারাগারে থাকা স্বজনদের নাম সুচের মাধ্যমে কাপড়ে ফুটিয়ে তুলে পাঠিয়েছেন, যা হয়ে উঠেছে এক অনন্য যোগাযোগের মাধ্যম।
বর্তমানে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজ়া এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্যালেস্টাইনি প্রবাসী নারীরা তাত্রিজ়ের মাধ্যমে তাঁদের ইতিহাস ও প্রতিরোধের কাহিনি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছেন। অনেক শিল্পী এই সূচিশিল্পকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের অঙ্গ করেও তুলেছেন।
২০০০-এর দশকে বেটসি গ্রির-এর ‘ক্র্যাফটিভিজ়ম’-এর ধারণাটি সূচিশিল্পকে এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা দেয়। এখানে সূচিশিল্প, বুনন, কুইল্টিং-এর মতো হস্তশিল্পকে ব্যবহার করা হয় সমাজের পুঁজিবাদ, বর্ণবৈষম্য, নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ‘মিনি প্রটেস্ট ব্যানার’, ‘স্টিচড পোয়েট্রি’ রাস্তার ব্যানারে নারীবাদী সূচিচিত্র আজ বিশ্ব জুড়ে নানা ক্ষেত্রে প্রতিবাদের ক্যানভাস হয়ে উঠেছে।
ভারতের সূচিকর্মের প্রতিফলনও কেবলমাত্র নান্দনিকতা ও কারিগরি দক্ষতার ঊর্ধ্বেও বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত। এই সূচিকর্মগুলি বিভিন্ন সময়ে নারীর ক্ষমতায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলার কাঁথা-সূচিকর্ম মূলত নারীদের দ্বারা গৃহস্থালির পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরি হত, যাতে তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব ছবির আকারে ফুটে উঠত। কাঁথার মাধ্যমে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করতেন। পঞ্জাবের ফুলকারি সূচিকর্ম নারীদের আবেগ ও অভিজ্ঞতার প্রকাশের একটি মাধ্যম ছিল। দেশভাগের সময়, পঞ্জাবি নারীরা সূচিকর্মের মাধ্যমে তাঁদের যন্ত্রণার কাহিনি, উদ্বাস্তু জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক পরিবর্তন চিত্রিত করতেন। গুজরাতের ‘রাবারি’ সম্প্রদায়ের সূচিকর্ম তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। উত্তরপ্রদেশের লখনউ শহরের চিকনকারি সূচিকর্ম মোগল যুগ থেকে শুরু হয়ে আজও জনপ্রিয়। এই সূচিকর্মে সূক্ষ্ম সাদা সুতো দিয়ে মসলিন কাপড়ে নকশা করা হয়, যা ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।
সূচিশিল্প, যা আপাত ভাবে শুধুই গৃহস্থালির সৌন্দর্যবর্ধনের কৌশল বলে মনে করা হয়, তা আজ এক বহুমাত্রিক প্রতিরোধের ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নারী সমাজ সুচ ও সুতোর মাধ্যমে নিপীড়নের ইতিহাস লিখেছেন, যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রেখেছেন এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন।
এই সূক্ষ্ম শিল্প নিছক শৈল্পিকতা নয়, এ এক বিকল্প ইতিহাসরচনা এবং এক গোপন, কিন্তু সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক চেতনাবিন্দু। সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে লেখা এই গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিরোধ সব সময় গর্জন নয়, কখনও কখনও তা নিঃশব্দে বোনা যায় সুতোয়— সময়ের চৌকাঠে, সাহসিকতার নিভৃত কারুকার্যে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)