Advertisement
E-Paper

Savitribai Phule: প্রথম দলিত শিক্ষিকা

নাম সাবিত্রীবাই ফুলে। মহারাষ্ট্রের এক মহিলা। উনিশ শতকে কলম ধরেছিলেন মনুর বিধান, পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন সতীদাহ, বাল্যবিবাহের।

মহীয়সী: সাবিত্রীবাই ফুলের আবক্ষ মূর্তি।

মহীয়সী: সাবিত্রীবাই ফুলের আবক্ষ মূর্তি।

ত্রয়ী সিংহ

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৩৭
Share
Save

একুশ শতকে পৌঁছেও যখন দেখা যায় জাতপাত ছুঁতমার্গের তেমন সুরাহা হয়নি, তখন সহজেই অনুমান করা যায়, উনিশ শতকের এক নিম্নবর্গীয় দলিত মহিলার ইচ্ছেপূরণের লড়াই কতখানি কঠিন হয়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষ সাবিত্রীবাই ফুলের নাম সে ভাবে না শুনলেও, ইতিহাসের পাতায় তাঁর সংগ্রাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁর জন্ম ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের নাইগাঁও গ্রামে। মা লক্ষ্মীবাই ও বাবা খন্দজি পাটিল।

শুধু দলিত পরিচয়ের জন্যই নয়, সাবিত্রীবাইয়ের অপরাধ ছিল, তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতির কথা ভেবেছিলেন। তাঁদের লেখাপড়া শিখিয়ে মান এবং হুঁশ নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের ব্যাপারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথার বিরোধী ছিলেন তিনি। দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় জ্যোতিরাও ফুলের সঙ্গে। তাঁর জীবনে বাল্যবিবাহ দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠেনি। স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে জ্যোতিরাওয়ের যথেষ্ট উদ্যোগ ছিল। সাবিত্রীবাই নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া করেছিলেন এবং শিক্ষাদানকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন।

১৮৪৭ সাল নাগাদ লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষিকা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেন সাবিত্রীবাই। শুধু স্ত্রীশিক্ষা নয়, বয়স্ক নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষিত করে তুলতেও তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। সমাজে শূদ্র হিসেবে চিহ্নিত করে যে জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হত, তাঁদের শিক্ষাদানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। যে কোনও দেশের দলিত শ্রেণির অস্তিত্বরক্ষার লড়াই বরাবর অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর। সাবিত্রীবাই ছিলেন একে মহিলা, তায় দলিত। জীবনের প্রতি পদে অপমান বয়ে বেড়িয়েছেন। সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ করতে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে একত্রে বিতাড়িত হয়েছেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। সতীদাহ বা বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমাজের উচ্চবর্ণের কট্টর কুসংস্কারাচ্ছন্ন শ্রেণির কাছে অপমানিত হয়েছেন। কিন্তু কোনও কিছু তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি।

১৮৪৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভিডেওয়ারায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন সাবিত্রীবাই। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর উদ্যোগ এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৫১ সালের ৩ জুলাই, ১৭ নভেম্বর এবং ১৮৫২ সালের ১৫ মার্চ। এই কাজে তিনি বরাবর স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সময়
মাত্র আট জন ছাত্রী নিয়ে শুরু করেন আর ১৮৫১ সালের মধ্যে তিনটি বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ জন। স্কুলে তিনিই ছিলেন প্রধানশিক্ষিকা।

এক বার সাবিত্রীবাইয়েরই স্কুলের এক এগারো বছর বয়সি দলিত ছাত্রী তাঁকে চিঠি লিখে নিজের নিদারুণ মনোকষ্টের কথা ব্যক্ত করেছিল। সেই চিঠির ভাষা ছিল সাবিত্রীবাইয়েরই মনের প্রতিফলন। এর থেকে ধারণা করা যায়, আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে তিনি কতখানি সফল হয়েছিলেন। পিছিয়ে পড়া মানুষদের কষ্টকে কষ্ট বলে চিনতে শিখিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলোয় অক্লান্ত পরিশ্রমে একের পর এক বিদ্যালয় স্থাপন করে গেছেন। তবে এর জন্য তাঁর হেনস্থাও কম হয়নি। স্কুলে শিক্ষকতা করতে যাওয়ার রাস্তায় তাঁর জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করে থাকত অপমান, কুকথা, লাঞ্ছনা। ইট-পাথর, এমনকি বিষ্ঠানিক্ষেপও হত তাঁকে লক্ষ্য করে। এক জন নিম্নবর্গের মহিলার এমন কঠিন সংগ্রাম, রক্ষণশীল সমাজ একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি।

সাবিত্রীবাই তাঁর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাজের মহিলাদের বিপন্নতা আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারেন। ১৮৫২ সালে তিনি ‘মহিলা সেবা মণ্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সক্রিয় হয় সাবিত্রীবাইয়ের নেতৃত্বে। উনিশ শতকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিধবা মহিলাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারে তাদের ঠাঁই তো হতই না, উপরন্তু অপরিচিত পুরুষের কুদৃষ্টির শিকার তাঁরা হতেন আকছার। ১৮৬৩ সালে সাবিত্রীবাই বিধবা সন্তানসম্ভবা মহিলাদের জন্য একটি আশ্রম গড়ে তোলেন, যেখানে তাঁরা নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন। সাবিত্রীবাই নিজের জীবনে মাতৃত্বের আস্বাদ পান যশবন্ত নামক এক ব্রাহ্মণসন্তানকে দত্তক নিয়ে।

১৮৭৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সত্যশোধক সমাজ’। এই সমাজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সীমিত খরচে বিনা পণে পুরোহিতবর্জিত বিবাহ। এতে পুরোহিত সম্প্রদায় তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জীবনে এতে কিছুটা সুবাতাস বইতে শুরু করে। শুধুমাত্র সমাজ-সংস্কারমূলক কাজই নয়, কবিতার মাধ্যমে দরিদ্র প্রান্তিক নিরক্ষর মানুষকে লেখাপড়া শিখতেও উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। মনুর বিধানের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন তিনি। ১৮৫৪ সালে মরাঠি ভাষায় লেখা তাঁর কবিতা সঙ্কলন ‘কাব্যফুলে’ প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘স্পিচেস অব মাতশ্রী সাবিত্রীবাই’। এটি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বক্তৃতার সংকলন।

নিজের ভালমন্দ ভুলে গিয়ে মানুষের সেবার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন তিনি। উনিশ শতকের শেষে বিশ্ব জুড়ে তখন বিউবোনিক প্লেগের মড়ক। মহামারি-আক্রান্তদের সেবার জন্য পালিত পুত্র যশবন্তকে নিয়ে তিনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছিলেন। মানুষের সেবা করতে গিয়েই তাঁর মৃত্যু হয়। পাণ্ডুরঙ্গ গায়কোয়াড় নামে এক ব্যক্তির কিশোর বয়সি ছেলের শরীরে প্লেগের সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছেলেটিকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে তাকে পিঠে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিলেন তিনি। নিজের কথা ভাবার মতো অবকাশ তাঁর ছিল না। ছেলেটির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসায় অচিরেই তাঁর শরীরে রোগলক্ষণ প্রকট হয়। ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ এই রোগেই তিনি মারা যান।

তাঁরই স্মরণে ২০১৫ সালে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদল করে সাবিত্রীবাই ফুলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়। তাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মহারাষ্ট্রের দলিত মুক্তি বা নারীজাগরণের ক্ষেত্রে আলাদা করে নয়, সমাজের সার্বিক সংস্কারের ইতিহাসে সাবিত্রীবাই ফুলে এক চিরস্মরণীয় নাম।

Savitribai Phule
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy