E-Paper

মেপল সিরাপ যেন বাংলার খেজুর গুড়

কিউবেক শহরের অজস্র মেপল গাছ এই সময় ব্যস্ত হয়ে পড়ে রস উৎপাদনে। টোস্ট কিংবা কেক, মেপল সিরাপ ছাড়া জমে না এই সময়।

সুখেন্দু দাশ

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:৩৪
নিষ্কাশন: চলছে মেপল গাছ থেকে রস সংগ্রবের প্রক্রিয়া।

নিষ্কাশন: চলছে মেপল গাছ থেকে রস সংগ্রবের প্রক্রিয়া।

আমাদের দেশে যখন ঠান্ডা বেশ জমে উঠেছে, গ্রামবাংলার সারি সারি খেজুর গাছে কলসি ঝুলছে, ঠিক তখনই কানাডার কিউবেকে মেপল গাছে গুঁড়িতেও ফুটো করে বালতি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দিন ধরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে মেপল গাছের রস। আমাদের দেশে যেমন খেজুর রস জ্বাল দিয়ে হয় নলেন গুড়, তেমন ভাবেই কানাডায় তৈরি হয় সুস্বাদু মেপল সিরাপ। এটি মধুর মতো ঘন মিষ্টি একটি সিরাপ। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। কোনও প্রিজ়ারভেটিভ, কৃত্রিম রং বা বাইরে থেকে দেওয়া মিষ্টি এতে থাকে না।

কিউবেক কানাডার পূর্ব প্রান্তে, লরেন্স নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি বন্দর শহর। এক সময় কিউবেক ছিল ফরাসি উপনিবেশ। কিউবেকের ফরাসি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিল্প, প্রাচীনতা, ফরাসি ভাষার চলের জন্যই এই জায়গাটি কানাডার অন্যান‍্য প্রান্তের চেয়ে আলাদা।

সেই কিউবেকই এই মেপল সিরাপের গর্ভগৃহ। এখানেই মাইনাস ছয়-সাত ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বরফে ঢাকা মেপল গাছের বনে-বনে বসে মেপল সিরাপের ভিয়েন। শীতের শুরুতে সংগ্রহ অভিযান আরম্ভ হয়, শেষ হতে হতে মাঝবসন্ত।

মোটা মোটা মেপল গাছে ড্রিলিং মেশিন দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে দুই থেকে চার ইঞ্চি ফুটো করে সরু নল ঢুকিয়ে গাছের সঙ্গে ঝোলানো বালতিতে সংযোগ করা হয়। দিনমান ফোঁটায় ফোঁটায় রস জমা হয় বালতিতে। পরে সেই রস কখনও কাঠের জ্বালে, কখনও গ্যাসে ফুটিয়ে ঘন করা হয়। ঘন করা মধুর মতো মেপল সিরাপ তখন খাবার টেবিলে টোস্ট-স্যান্ডউইচ বা কেক-বিস্কুটের অপরিহার্য সঙ্গী, যেমন আমাদের দেশে রুটি-লুচি-পরোটা জমে ওঠে খেজুরগুড়ের সঙ্গতে। মেপল রসের ইতিহাস প্রাচীন। বহু যুগ আগে উত্তর আমেরিকার প্রাচীন ‘আদিবাসী’রা প্রথম মেপল রস আস্বাদন করেছিলেন। হরিণের মাংসে ওই রস মাখিয়ে খেয়ে বড় তৃপ্তি পেয়েছিলেন তাঁরা। তার পরই ওঁরা এর প্রচলন করেন ষোড়শ শতকে। ক্রমে তা বিস্তৃত হয় কিউবেক অঞ্চলে। কিউবেক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেপল রস উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত।

বিশ্বের নব্বই শতাংশ মেপল সিরাপ তৈরি হয় আমেরিকা ও কিউবেকে। তারও সিংহভাগের দাবিদার কিউবেকের বনাঞ্চল। রস পেতে গেলে একটি মেপল গাছকে আড়াই থেকে তিন দশক সময় দিতে হয়। এই সময় পেরোলে সেই বৃক্ষ রস দিতে সক্ষম হয়, এবং রসের জোগান দিতে পারে তার একশো বছর বয়স পর্যন্ত! ১৯৭০ সাল নাগাদ সময় থেকেই গাছের রস সংগ্রহ থেকে জ্বাল দিয়ে ঘন করার প্রণালীতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি।

মেপল কানাডার জাতীয় বৃক্ষ। সে দেশের পতাকাতেও মেপল পাতার প্রতিকৃতি। কানাডা আর আমেরিকায় রাস্তা জুড়ে শীতের শুরুতে মেপল গাছ হলুদ থেকে লাল হয়ে গিয়ে অপূর্ব সুন্দর হয়ে ওঠে, যেন আমাদের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা ছোটনাগপুর মালভূমির বসন্তের পলাশ! ভ্যানকুভার, মন্ট্রিয়ল, কিউবেক... সর্বত্র একই ছবি! পথ ঢেকে যায় লাল আর হলুদ মেপল পাতায়!

এ বার আসি পুরনো কিউবেক সিটির প্রসঙ্গে। ফরাসি উপনিবেশ ছিল বলেই বোধ হয় শিল্প-সাহিত্যের কদর এখানে খুব বেশি। সারা দিন বৃষ্টিভেজা শহরে ভিজে ভিজেই সব দেখা হল। কিউবেক সিটির গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া সেন্ট লরেন্স একটি বিশাল নদী। এতে বড় বড় জাহাজ নোঙর করে আছে দেখেছিলাম। সেন্ট লরেন্স নদীর মোহনা আটলান্টিকে মহাসাগরে। হয়তো সমাপ্তিস্থলের বিশালতার আভাস নিয়েই নদীটি সর্বত্র এমন বিশাল ও গভীর।

কিউবেকের লোকজন কানাডা থেকে আলাদা হয়ে যেতে চায়। এ কারণে তাদের অনেক লড়াই, সংগ্রাম, সংঘর্ষ। কিন্তু সবই নিষ্ফল হয়েছে। এখনও মন্ট্রিয়ল এয়ারপোর্টে নামলেই চোখে পড়বে সমস্ত ট্যাক্সির গায়ে ফরাসি শব্দে লেখা অভিবাদন, শুভেচ্ছা কিংবা সুপ্রভাত।

কিউবেক স্থাপন করেছিল ফরাসি শাসকেরা। এখানে একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক হোটেল আছে। নাম ফেয়ারমন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখানে এই হোটেলে স্যর উইনস্টন চার্চিল এবং মিত্রশক্তির মাথারা বসে একটি ঐতিহাসিক চুক্তির খসড়া করেছিলেন। অসংখ্য পর্যটক এই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন, তাই ভিড় লেগেই থাকে।

সে দিন দুপুরে লরেন্স নদীর তীরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে যখন চার্চের বেল বাজছিল, ফেয়ারমন্ট হোটেলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নদৃশ্য। যে দিকেই তাকাই, যেন জলরঙে আঁকা ক্যানভাস, ফ্রেমবন্দি হওয়ার উন্মুখ অপেক্ষায় রত।

কিউবেকের প্রাচীন মন্ট্রিয়ল-এ রয়েছে একটি অতি প্রাচীন এক চার্চ, যা আজও এই স্থানের সঙ্গে প্রাচীন ফরাসি সংস্রবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। চার্চটির নাম নোতরদাম ব্যাসিলিকা। অসাধারণ কাঠের কারুকাজ সমন্বিত এই চার্চ ফরাসিরা প্রতিষ্ঠা করেছিল ১৬৪২ সালে। প্রাচীন কিউবেকের ক্যাথলিক শিকড়ের সাক্ষীও এই চার্চ। ১৯৮২ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল এটিকে রোমের ভ্যাটিকান ব্যাসিলিকার একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

canada India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy