Advertisement
১১ মে ২০২৪

বাঙালির ছেলেবেলায় রাশিয়ার স্বাদগন্ধ

বাংলা অনুবাদে একদা বিখ্যাত হয়েছিল রাশিয়ার ধ্রুপদি ও শিশুসাহিত্যের অজস্র বই। আজ তারা আর প্রকাশিত হয় না, কিন্তু শৈশবে তাদের পাতা ওল্টানোর স্মৃতি মুছে যায়নি আজও। পৃথা কুণ্ডুঅবন ঠাকুর-লীলা মজুমদার-সুকুমার রায় গুলে-খাওয়া প্রজন্মের বড় কাছের মনে হত সোভিয়েট সাহিত্যের এই চরিত্রদের।

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

চুক আর গেক-কে মনে পড়ে? মনে আছে আলিওনুস্কার কথা? ধলা কুকুর শামলা কান, মিশকা ভালুক আর আনাড়ির মজাদার কাণ্ডকারখানা? আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও বাঙালির ছোটবেলার সঙ্গী ছিল এই বইগুলো— বাংলা অনুবাদে সোভিয়েট শিশু-কিশোর সাহিত্যের সম্ভার। এখন যারা চল্লিশ বা পঞ্চাশের কোঠায়, তাঁদের অনেকেই মনে করতে পারবেন ছোট্ট চড়ুইপাখি পুদিকসোনার গল্প, সিভকা-বুরকার জাদু ঘোড়া, নীলচে ফড়িং, বাবায়াগার অদ্ভুতুড়ে কালাজাদুর মন্তর।

একটু বড় হতে জন্মদিনে হাতে আসত ‘ভাল মানুষ হওয়া’র শুভেচ্ছা মাখা রঙিন বইগুলো— টলস্টয়, পুশকিন, গোর্কি, চেখভ, দস্তয়েভস্কি, গোগোল, তুর্গেনেভ-এর মতো লেখকদের ধ্রুপদি রচনা। ছিল মনীষীদের জীবনকথা, বিজ্ঞানের বিচিত্র খবরে বিশ্বপরিচয়ের হাতছানি। রুশ সাহিত্যের এই সব অমূল্য সম্পদ অল্প দামে বাঙালি পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত ‘প্রগতি’ বা ‘রাদুগা’র মতো প্রকাশনার হাত ধরে।

১৯৩১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় প্রকাশন সমিতি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী মতবাদের পাশাপাশি সোভিয়েট সাহিত্য অনুবাদ ও প্রচারের জন্য একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যার নাম ‘বিদেশি শ্রমজীবীদের প্রকাশন সমিতি’। ১৯৩৯ সালে সংস্থার নতুন নাম হয় ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য’ প্রকাশনালয়, পঞ্চাশের দশকে সেখানে গড়ে ওঠে স্থায়ী বাংলা বিভাগ। ১৯৬৩ থেকে ‘প্রগতি’ নামেই বাড়তে থাকে এর জনপ্রিয়তা। এর বাংলা বিভাগে সে সময় অনুবাদক হিসেবে ছিলেন ননী ভৌমিক, নীরেন্দ্রনাথ রায়, শুভময় ঘোষ, সমর সেন, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ননী ভৌমিকের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’, ‘চলো সোভিয়েত দেশ বেড়িয়ে আসি’র মতো লেখার পাশাপাশি শিশুকিশোর সাহিত্যের অনুবাদ বিখ্যাত হয়েছিল। আর বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় করতেন সামাজিক বা রাজনৈতিক মতাদর্শমূলক সাহিত্যের অনুবাদ। আলেক্সেই টলস্টয়ের ‘দ্য লেম প্রিন্স’-এর অনুবাদ ‘খোঁড়া রাজকুমার’ খুব জনপ্রিয় হয়। অনুবাদকের নাম রাধামোহন ভট্টাচার্য— ‘উদয়ের পথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এর মতো ছবির অভিনেতা।

আরও পড়ুন: মাতৃসঙ্গীত গেয়েছেন তানসেন থেকে নজরুল

সত্তরের দশকে এই বিভাগ সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেলে সোভিয়েট সাহিত্যের বাংলা অনুবাদের বাজার আরও বিস্তৃত হয়। এই পর্বে প্রগতি প্রকাশনের বাংলা বিভাগে অনুবাদকের কাজ নিয়ে যান কলকাতা থেকে অরুণ সোম, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; বাংলাদেশ থেকে হায়াত মামুদ, খালেদ চৌধুরী, দ্বিজেন শর্মা প্রমুখ। বাংলার পাঠকদের কাছে পৌঁছে যেতে থাকে সোভিয়েট ইউনিয়নের ধ্রুপদি সাহিত্য, লোকগাথা, শিশুসাহিত্য। বাঙালি পাঠকের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল কয়েকটি পত্রপত্রিকাও— ‘সোভিয়েত দেশ’, ‘সোভিয়েত নারী’, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে প্রবন্ধ, রাশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা, কারিগরি শিল্প আর হাতের কাজের বিভাগ থাকত এগুলিতে।

তবে বাঙালির কাছে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আদরের ছিল ছোটদের বই। ১৯৮২ সালে প্রগতি প্রকাশনার একটি শিশু বিভাগ গড়ে ওঠে, নাম ‘রাদুগা’। রুশ ভাষায় যার অর্থ রামধনু। ‘দাদুর দস্তানা’, ‘নাম ছিল তার ইভান’, ‘রুপোলী খুর’, ‘পীত দানবের পুরী’, ‘মোরগছানা’, ‘বাহাদুর পিঁপড়ে’, ‘আলতাজবা’— নামে আর বিষয়বস্তুতে বাঙালিয়ানা মাখা রঙিন বইগুলো ঘুরত বাচ্চাদের হাতে হাতে। অবন ঠাকুর-লীলা মজুমদার-সুকুমার রায় গুলে-খাওয়া প্রজন্মের বড় কাছের মনে হত সোভিয়েট সাহিত্যের এই চরিত্রদের। কেউ দুষ্টু, কেউ ভালমানুষ গোছের, কেউ ঝগড়ুটে, হিংসুটে, কেউ বা ভিতু। চুক আর গেকের মতো‌ রেলগাড়ি চড়ে বরফের দেশে বাবাকে খুঁজতে যাওয়া, ছোট্ট মেয়ে দারিয়াঙ্কার মতো পোষা বেড়াল লাভালাইকাকে আদর দিয়ে ‘মানুষ’ করা, গরিব চাষির ছেলের হাতে খারাপ জমিদারের শাস্তি, এই সবের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠত কৈশোরের ভালমন্দের বোধ। ‘সাগরতীরে’ বইয়ের আলসে ছেলেটা দায়িত্ব নিতে শেখায় আর এফিমকাকার বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় স্বস্তির শ্বাস ফেলত সবাই।

স্কো বা তাসখন্দে নিযুক্ত বাংলা অনুবাদকেরা নিয়মিত কাজ তো করতেনই, পাশাপাশি বাইরের অনুবাদকদের করা বেশ কিছু বই বার করত রাদুগা ও মির প্রকাশনী। পুষ্পময়ী বসুর ‘মা’ (গোর্কির ‘মাদার’ এর অনুবাদ), ইলা মিত্রের ‘চাপায়েভ’, শঙ্কর রায়ের ‘গমের শিষ’, ‘চুক আর গেক’, অনিমেষকান্তি পালের ‘কাশতানকা’র মতো বইয়ের স্মৃতি আজও অমলিন। কিন্তু সেই অনুবাদকদের কথা ক’জন মনে রেখেছি? সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সরকারি অনুদানে নির্ভরশীল প্রকাশনাগুলো এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। কাজ না থাকায় দেশে ফিরে এলেন অরুণ সোমের মতো অনুবাদকেরা। নতুন বই আর নেই, পুরনো বইগুলোও কদর হারিয়ে বিক্রি হয়ে গেল অনেকের বাড়ি থেকে, বা জায়গা পেল ধুলো-ভরা গুদামঘরে।

আরও পড়ুন: প্রোফেসর শঙ্কুরও আগে

পুরনো বইপ্রেমী দম্পতি সোমনাথ ও শুচিস্মিতা দাশগুপ্ত নিজেদের সংগ্রহে থাকা সোভিয়েট বইগুলো স্ক্যান করে ইন্টারনেটে দিচ্ছেন। সঙ্গে পেয়েছেন প্রসেনজিৎ, নির্জন, পরাগের মতো বহু বন্ধুকে। সবাই মিলে গড়ে তুলেছেন ব্লগ ‘সোভিয়েট বুকস ট্রান্সলেটেড ইন বেঙ্গলি’। তাঁরা যোগাযোগ করেেছেন অরুণ সোম, পূর্ণিমা মিত্রের মতো অনুবাদকদের সঙ্গে, পেয়েছেন তাঁদের শুভেচ্ছা। অরুণবাবু এখনও সক্রিয়, নতুন করে অনুবাদ করছেন ‘যুদ্ধ ও শান্তি’, ‘কারামাজ়ভ ভাইয়েরা’, ‘ইডিয়ট’। এক সময় প্রবাসে থেকে বাংলার শিশুদের হাতে যাঁরা তুলে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, তাঁদের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন এই কারিগরেরা। হারিয়ে যাওয়া শৈশব, ভালবাসার বইয়ের জগৎকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে অতন্দ্র তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE