থিয়েটার রোডের মুখে পৌঁছে আটকে গেল চঞ্চল। সিগন্যাল হলুদ। এটাকেই ভয় পায় চঞ্চল। হলুদ মানে মিছিল, নইলে অ্যাক্সিডেন্ট, অথবা তার চেয়েও খারাপ; ভিআইপি। অপেক্ষা করে করে যখন নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়, তখনই হুটারের আওয়াজ। যা ভেবেছে তা-ই, ভিআইপি। কনভয় পার হয়ে যেতে ঘড়ি দেখল চঞ্চল। পাক্কা সাত মিনিট খেয়ে নিল। এমনিতেই সামনে পুজো বলে রাস্তায় ভিড় বেশি, তার উপর এই ঝামেলা।
থিয়েটার রোড। জ্যাম-জট হয় না। মুশকিল একটাই। একশো গজ পর পর সিগন্যাল। সামনের হাচব্যাকটা তখন থেকে বজ্জাতি করছে। এমন ভাবে চালাচ্ছে, যেন রাস্তাটা ওর বাপের জমিদারি! তাও যদি হত বড় কোনও বিদেশি গাড়ি, তাও কথা ছিল। বার তিনেক হর্ন মেরেছে চঞ্চল। রাস্তা ছাড়েনি। সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হতেই রং সাইড দিয়ে ওভারটেক করে ডান দিকে ফেলে দিল হাচব্যাকটাকে। কাঁচা খিস্তি ভেসে এল হাওয়ায়। আপনমনে একচোট হেসে নিল চঞ্চল। ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ তো দেখোনি!
চৌরঙ্গী রোড। বড় ক্রসিং। তিন দিক থেকে গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বাঁ হাতের কব্জি সামান্য বাঁকিয়ে টাইম দেখল চঞ্চল। হাতে আর এগারো মিনিট। একটা মেসেজ এসেছিল বেরনোর সময়। তাতে লোকেশন আর ডিরেকশন। পরে আরও দুটো মেসেজ এসেছিল, ‘কোথায়?’ ‘কত দূর?’
চঞ্চল জবাব দেয়নি।
এত ক্ষণ স্টার্ট বন্ধ করেনি চঞ্চল। সিগন্যাল সবুজ হতে না হতেই তিরবেগে বেরোল। ভিক্টোরিয়া। ঘাড় কাত করে ভিক্টোরিয়ার মাথার দিকে তাকায় চঞ্চল। খোঁজে মাথার পরি। পরি নাকি আবার নাচতে শুরু করেছে। পরির নাচ কখনও দেখেনি চঞ্চল। পরি কি রাত্তির হলেও নাচে? নাকি শুধুই দিনের বেলা নাচে? এক দিন বাইক থামিয়ে পরির নাচ দেখবে, মনে মনে ঠিক করে সে।
সামনে পুলিশ! কী ব্যাপার? নাকা চেকিং। পুজো এলে নাকা বাড়ে। চঞ্চলরা অবশ্য দুধভাত। ওদের নাকায় ধরা বারণ। কিন্তু সামনে নাকা থাকলে কি আর পিছনের গাড়ি ওভারটেক করতে পারে? ওভারটেক করলে কেস খেয়ে যাবে।
পাঁচ-পাঁচটা মিনিট খেয়ে নিল নাকা। বাইক ছুটছে হু-হু করে। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল হু-হু করে। চোখ বন্ধ করল চঞ্চল।
রেসকোর্স ক্রসিং। হাতে আর পাঁচ মিনিট। ক্রসিং পেরোলে একশো গজ এগিয়ে ডান দিকে উঁচু বাড়ি। সামনে সিকিয়োরিটি। তাকে দিয়ে এলেই হবে।
বেরনোর সময় মা বলে দিয়েছিল হজমের একটা ওষুধ আনতে। মায়ের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। প্রায়ই হাঁপ ধরে, কষ্ট পায়। ডাক্তার দেখানো দরকার। এত রাতে ওষুধের দোকান কি খোলা থাকবে! পুজোর সময় কাজ বাড়ে চঞ্চলের। প্রায় সারা রাতই চলে ছোটাছুটি। সকালগুলো একটু ছাড় পায়, কিন্তু পুজোর সময় আবার ডাক্তারবাবুদের পাওয়া মুশকিল। আর কাজের চাপ কখনই বা কম! এই করে করে মাকে ডাক্তার দেখানোটা ক্রমশ পিছিয়েই চলেছে। মাথায় বড় চাপ লাগে চঞ্চলের।
এক সঙ্গে অনেকগুলো গাড়ির হর্নের আওয়াজ। একটু কি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল চঞ্চল? সিগন্যাল সবুজ, ডান পাশের এসইউভিটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে যেতে গেল। খেয়াল করেনি, রবীন্দ্রসদনের দিক থেকে আসা বারো চাকার লরিটা কখন তার নাকখানা বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রেক কষল চঞ্চল। তত ক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।
বনেটে ধাক্কা খেয়ে তুবড়ে গেল বাইকটা। ছিটকে উপরে উঠে গেল চঞ্চল। হাত দশেক দূরে আছড়ে পড়ল।
“গেল! গেল!” আওয়াজ। ছুটে এল লোকজন। পুলিশ সার্জেন্ট ওয়াকিটকি হাতে বলতে বলতে এলেন, “এই হয়েছে ডেলিভারি বয়গুলোর কাণ্ড। এক মিনিট দেরি হলে যেন পৃথিবীটা উল্টে যাবে!”
মাথায় কপালে রক্ত লেগে আছে। ঠোঁট নড়ছিল চঞ্চলের। এক জন মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলেন।
সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলছে? নাম? কোথায় থাকে?”
ভদ্রলোক বললেন, “না... বলছে আর তিন মিনিট... ওটুকু পেলেই ও পৌঁছে যেতে পারত।”
একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালেন সার্জেন্ট। চঞ্চলকে তোলা হল। দু’জন উঠলেন চঞ্চলের সঙ্গে। এক জন চঞ্চলের মাথাটা কোলে নিয়ে বসলেন।
ভিড়, জ্যাম পেরিয়ে অনেক কষ্টে সার্জেন্ট ট্যাক্সিটাকে গাইড করে হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দিলেন।
ট্রলিতে শোয়ানো হল চঞ্চলকে। ট্রলি ভিতরে ঢুকল। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন। বুকে যন্ত্র বসালেন, চোখে আলো ফেললেন। তার পর হাঁটা দিলেন। যেখান থেকে এসেছিলেন সেই দিকে।
চঞ্চলের সঙ্গে আসা এক জন পথ আটকালেন।
“কী দেখলেন, ডাক্তারবাবু?”
“দেখাদেখির আর কী আছে!” নিরুত্তাপ গলা ডাক্তারবাবুর।
“কেন?” জানতে চান লোকটি।
“আর একটু আগে আনতে পারলেন না?”
“কত ক্ষণ আগে?”
“এই ধরুন... মিনিট তিনেক।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)