যুদ্ধপ্রস্তুতির মতো মহাশ্বেতা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজলেন। যুদ্ধই বটে। পুজোর আর কয়েকটা দিন বাকি।কেনাকাটা শুরুই করতে পারেননি। মাথা গুঁজে স্কুলের খাতা দেখতে হয়েছে শনি-রবি পর্যন্ত। আজ ঠিক করেছেন, পুরো পুজোর বাজার শেষ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন।
টিচার্স রুমে শুনেছেন হেমলতা শাড়িকুঞ্জ-র কথা। অনেকেই গিয়েছে। কালেকশনও ভাল, দামও যথাযথ। তখন থেকেই মাথায় ছিল, এ বার পুজোর শাড়িগুলো হেমলতা থেকেই কিনবেন।
আজ রবিবার। মেয়ে রাকাকে কোনও ক্রমে রাজি করিয়েছেন সঙ্গে যেতে। রাকার শাড়ি নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অসহ্য লাগে ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে বাজার করতে। বরং অনলাইন ভাল।
মহাশ্বেতার আবার অসহ্য লাগে রাকার অনলাইনে পোশাক কেনাকাটা দেখে। ছেঁড়া-ফাটা জিন্স, রংচটা টপ। বলতে গেলেই অশান্তি। সেই রাকাকেই আজ অনেক তোয়াজ করে রাজি করাতে পেরেছেন। আজ রবিবার। ড্রাইভার স্বপনের ছুটি। কেনাকাটার পর অত প্যাকেট একা সামলে অ্যাপ-ক্যাবে আসা ঝঞ্ঝাটের।
হেমলতা শাড়িকুঞ্জে ঢুকে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গেলেন মহাশ্বেতা। একটা বড় হলঘরের মতো জায়গা। চার দিকে কাউন্টার। সেখানে উপচে পড়ছে শাড়ির স্তূপ। বিক্রি করার জন্য অসংখ্য সেলসগার্ল। তাদেরই এক জন, মধুরিমা, ওঁদের ডেকে নিল, “আসুন ম্যাডাম।”
ভিড়ের ফাঁক গলে মহাশ্বেতা এগোতে এগোতে রাকাকে বললেন, “আয়।”
বিরক্ত গলায় রাকা বলল, “ডিসগাস্টিং!”
কাউন্টারের সামনে পৌঁছতে মধুরিমা বলল, “বলুন ম্যাডাম, কী দেখাব? তাঁত, সিল্ক...”
মহাশ্বেতার লম্বা লিস্ট। কাকে কী ধরনের শাড়ি দেবেন, তার কী রঙ পছন্দ, বাজেট ইত্যাদি ধরে ধরে মোবাইলের নোটপ্যাডে লিস্ট তৈরি করে এনেছেন। লিস্ট দেখে দেখে মহাশ্বেতা বলতে শুরু করলেন। মধুরিমা হাসিমুখে শাড়ি দেখাতে থাকল। মাঝে-মাঝে মহাশ্বেতার পছন্দের বাইরেও নানা রকম শাড়ি। অন্য রকম সেই শাড়িগুলোও নিজের জন্য বেছে রাখলেন। মধুরিমা মহাশ্বেতার পছন্দ করা শাড়ির স্তূপ আলাদা করছে, এমন সময় একটা গলা পেলেন, “আরে, মহাশ্বেতা না?”
ভিড়ের মধ্যে মহাশ্বেতা খুঁজে পেলেন হৈমিকে। কত বছর পর দেখা! বছর কুড়ি তো হবেই। তখন ওঁরা দু’জনেই স্বামীদের চাকরিসূত্রে থাকতেন দুর্গাপুরে। কাছাকাছি কোয়ার্টার্স। বেশ বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছিল। শ্যামল কলকাতায় বদলি হয়ে চলে আসার পর যোগাযোগটা কেটে গিয়েছিল।
ভিড় ঠেলে হৈমি এগিয়ে আসার পর মহাশ্বেতা বললেন, “কেমন আছিস? দেখ কী আশ্চর্য, এখানে দেখা হয়ে গেল!”
“অনিমেষ রিটায়ার করার পর আমরা নিউ টাউনে ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছি। তোরা?”
“ওই মতিঝিলে। দাঁড়া তোকে রাকাকে দেখাই। এই রাকা...”
রাকা ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের ডাকে একটু এগিয়ে এল।
“চিনতে পারছিস? হৈমি কাকিমা। দুর্গাপুরের।”
রাকা চিনতে পারল না। দুর্গাপুর থেকে যখন এসেছিল তখন বোধহয় বছর চারেক বয়স ছিল। হৈমির দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসল।
“ও মা! কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে তুই!” রাকার চিবুকটা ধরে অল্প নাড়িয়ে আলতো চুমু খেয়ে হৈমি বললেন, “তা, তুই কী শাড়ি কিনলি?”
মহাশ্বেতা মুখ ভার করে বললেন, “ও পরবে শাড়ি? তা হলেই হয়েছে।”
“সে কী কথা! বাঙালি মেয়ে পুজোয় শাড়ি পরবে না? এখন কত রকম শাড়ি বেরিয়েছে।”
মধুরিমা সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করল, “দিদি, দেখাই তোমাকে? খুব ভাল মাশরুম শাড়ি আছে। লেহেরিয়া শাড়িও দেখতে পারো।”
“মা, আমার একটা ফোন আছে...” বলে রাকা আবার ভিড় কাটিয়ে ফাঁকায় বেরিয়ে এল।
“হ্যাঁ রে মহাশ্বেতা, মেয়ের বিয়ে দিবি না?”
“তা হলেই হয়েছে। বলেই দিয়েছে বিয়ে করবে না। আজকালকার মেয়েদের যে কী হয়েছে! প্রায় সবাইকেই দেখি, বিয়ে করতে চাইছে না।”
“দোষটা আমাদেরই। বড্ড বেশি স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি। কেন শুনবে না আমাদের কথা? আমি তো ছেলেকে ধুতি-পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি। বলেছি, অষ্টমীর অঞ্জলির সময় পরতেই হবে।”
দুই বন্ধুতে শাড়ি দেখা, গল্পগুজব চলতে লাগল। একটা সময় হৈমি বিলিং কাউন্টারে চলে গেলেন।
মহাশ্বেতারও কেনাকাটা হয়ে গিয়েছিল। তবে মনটা খচখচ করছিল। কেন রাকা ওর কথা শুনে পুজোর দিন একটাও শাড়ি পরবে না? আবার রাকাকে ডাকলেন।
এগিয়ে এসে বিরক্ত গলায় রাকা বলল, “হয়েছে তোমার, মা?”
গলাটা কঠিন করে মহাশ্বেতা বললেন, “তোমাকে একটা পুজোর শাড়ি নিতে হবে।”
“হোয়াই আর ইউ ওয়েস্টিং ইয়োর মানি?”
“চুপ করো! আমি বলছি, তুমি শাড়ি নেবে। আর ওটা পুজোতেও এক দিন পরবে।”
রাকা মায়ের এই ‘তুমি’ করে বলা গলাটা চেনে। স্কুলের দিদিমণির গলা। ঝামেলা না বাড়িয়ে রাকা মধুরিমাকে জিজ্ঞেস করল, “একদম প্লেন কালো শিফন হবে?”
মহাশ্বেতা চোখ কুঁচকোলেন। পুজোয় প্লেন কালো শাড়ি!
“নিশ্চয়ই। শিফন আছে, জর্জেট আছে...” বলতে বলতে মধুরিমা বার করে আনল খানকয়েক কালো শাড়ি। রাকা তার থেকে একটা দ্রুত বেছে নিয়ে বলল, “চলো এ বার ক্যাশ কাউন্টারে।”
বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে খাটের উপর শাড়ির প্যাকেটগুলো ছড়িয়ে বসলেন মহাশ্বেতা। এ বার গুছিয়ে আয়েশ করে দেখবেন যা কেনাকাটা হল। কিন্তু সেটা দেখতে গিয়েই বিপত্তি। মোট সতেরোটা শাড়ি কিনেছেন। বিলেও তাই আছে। কিন্তু কোথায় রাকার কালো শাড়িটা? তার বদলে আছে একটা ঘিয়ে রঙের মটকা!
“রাকা... রাকা...”
আবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাকা এসে বলল, “কী হল আবার? দোকান খুলে বসেছ তো দেখছি!”
“তোর শাড়িটা নেই তো!” মহাশ্বেতা ফ্যালফেলে চোখে বললেন, “তার বদলে এই দেখ, ঘিয়ে রঙের একটা মটকা!”
“ওটা তুমি পরে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যেয়ো। উফ, একটা যদিও বা পছন্দ হয়েছিল... মিটেছে তো ভিড়ে গুঁতোগুতি করে শাড়ি কেনার শখ? এই জন্য বলি অনলাইনে কেনো।”
খুব উদ্বিগ্ন হয়ে মহাশ্বেতা হেমলতা শাড়িকুঞ্জে ফোন করলেন। ওরা বিনীত ভাবে জানিয়ে দিল, কাউন্টার ছাড়ার আগে শাড়ি মিলিয়ে নিয়ে দেখার দায়িত্ব ক্রেতার। অন্য কেউ শাড়ি বদলে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে যোগাযোগ করেননি। যদি কেউ করেন, পরের দিন সকাল এগারোটার সময় তাকে দোকানে আসতে বলবেন।
রাকাকে ব্যাপারটা জানাতে যথারীতি ও বলল, “বলেছিলাম ডোন্ট ওয়েস্ট ইয়োর মানি। সেটাই হল। কাল তা হলে স্কুল ছুটি নিয়ে যাও।”
“কাল কী করে হবে? স্কুলে পরীক্ষা আছে। তুই এক বার...” অনুনয়-বিনয়-অভিমান করে মহাশ্বেতা শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পারলেন রাকাকে পরের দিন এগারোটায় হেমলতা শাড়িকুঞ্জে যেতে।
নিমরাজি হয়ে গজগজ করতে করতে রাকা চলে যাওয়ার পর মহাশ্বেতা চার দিকে তাকিয়ে ফোন করলেন হৈমিকে, নিচু গলায় বললেন, “শোন। কাল সকাল এগারোটা। বাপাই কালো শিফনটা নিয়ে পৌঁছে যায় যেন...”
শাড়ি কেনার গল্পগুজবের ফাঁকে হৈমি বলেছিলেন, “তোরটা তো বিয়ে করবে না বলছে, আর আমার ছেলেটা? ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি করে টাকা জমাচ্ছে। তার পর নাকি এমবিএ করবে। তার আগে বিয়ের নাম উচ্চারণ করতে বারণ করেছে। অথচ ছোটবেলায় দুটো দুটোকে কত পছন্দ করত। বলত, বিয়ে করবে!”
“একটা বুদ্ধি আছে, বুঝেছিস! দেখি চেষ্টা করে। বিলিং-এর সময় আমার সামনে দাঁড়াস।”
দুই বন্ধুর এই অভিসন্ধিটা শেষ পর্যন্ত সফল হল কি না, জানা যাবে পুজোয় যদি কালো শিফন পরা রাকাকে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাপাইয়ের সঙ্গে দেখা যায় অষ্টমীর দিন, কোনও পুজো প্যান্ডেলে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)