E-Paper

সব ভাল! সব ভাল!

বৌ খুলেছে বিউটি পার্লার। এখনও বাচ্চাকাচ্চা না হওয়ায় তত চাপ নেই। বেশ কাটে দিন তার।

শুভমানস ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৫
ছবি: পিয়ালী বালা।

ছবি: পিয়ালী বালা।

বাতের ব্যথা। লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে হাঁটেন পাড়ার শঙ্করকাকু। এক সময় পুলিশের উচ্চপদে কাজ করতেন। বিশাল চেহারা। একমুখ খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। অন্য পুলিশকর্মীদের কপালে কিছু অমৃত জুটলেও তাঁর দীর্ঘ সার্ভিস লাইফে শুধুই বিষ।

রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের কল্যাণে উপস্থিত অগাধ টাকার মালিক। দেমাকে মটমট করছেন। সকাল থেকে বসে থাকেন চায়ের দোকানে। কেউ ভাল কিছু বললে বা আশার কথা শোনালে তার মধ্যে কোথায় ভেজাল আছে ধরিয়ে দিয়ে উপসংহার টানেন, “সব বাজে! সব বাজে!”

কিন্তু তদ্গত ইয়াং ছেলে। তার প্রকৃতি উল্টো। বাড়িতেই ছোটখাটো ধূপের কারখানা করেছে। বৌ খুলেছে বিউটি পার্লার। এখনও বাচ্চাকাচ্চা না হওয়ায় তত চাপ নেই। বেশ কাটে দিন তার।

সকালে কারখানা খুলে ঘণ্টাখানেক খেটে হেল্পার আসতেই তাকে কাজ ধরিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সকাল-বিকাল খোলা হাওয়ায় একটু না-হাঁটলে মনখারাপ হয়ে যায় তার। বাইরে পড়ে পড়ে বয়ে যাচ্ছে রোদ্দুর-ঝলমলে দিন, মনোরম সন্ধ্যা, আর সে বসে আছে ঘরে! মন ছটফটিয়ে ওঠে তার।

হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় পাড়ার মামার দোকানে। মামাই দোকানটা করেছিল। সে-ই চালাত। এখন চালায় তার ছেলে। তাও লোকে বলে, ‘মামার দোকান’। কান পাতলেই শোনা যায়, সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ দেখার মতোই দুঃসাধ্য-দর্শন হল মামার ছেলের মুখে হাসি।

তদ্গত চা-প্রত্যাশীদের ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখে নেয়, ‘হেসো না’ ক্লাবের আর এক সিরিয়াস মেম্বার শঙ্করকাকু ভিতরে আছেন কি না। থাকলে সট করে মুখ লুকিয়ে ডেকে নেয় আজুকে।

আজুর বয়স মামাতো ভাইয়ের চেয়েও বেশি। কিন্তু বুদ্ধি দশ বছরেই আটকে আছে। হাউহাউ করে যা বলে, সিকি ভাগ বোঝা যায়। বাকিটা সে হেসেই ম্যানেজ করে দেয়। মজার ছেলে!

মজার ছেলেকে দিয়েই খাঁটি মোষের দুধের রেওয়াজি চা এক ভাঁড় অর্ডার করিয়ে তদ্গত নজর রাখে, শঙ্করকাকু তাকে দেখছেন কি না। দেখলেই “এই যে ইয়াং ম্যান, এদিকে এসো!” বলে ভিতরে ডেকে জোর করে বসিয়ে দেশের অবস্থা কোন তলানিতে, পরিসংখ্যান-সহ তার ব্যাখ্যান করে, “এই তো অবস্থা! যা তা! বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না!” বলে শেষ করবেন।

এক বার আধঘণ্টা তাঁর ননস্টপ লেকচার শুনে মন এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল তদ্গতর, মনে হয়েছিল, দেশের এতটা খারাপ হলে বেচারা আজুর তা হলে কী অবস্থা!

তারই প্রতিবিধান করতে সে দিন সে চায়ের দাম মিটিয়ে পকেট থেকে দশটা টাকা বার করে আজুকে ধরিয়ে দিতেই শঙ্করকাকু অ্যাক্টিভ হয়ে উঠেছিলেন। গজগজ করেছিলেন, “দু’দিনের ছোকরা! পয়সা ছড়িয়ে লোককে হাত করছে! যত্তসব!”

তার পর থেকে তদ্গতর ভয় ধরে গেছে। দোকানে এসে আগে আজুকে ডেকে ভিতরের পজ়িশন জেনে নেয়। যদি শোনে শঙ্করকাকু আছেন, দাঁড়িয়ে চা খেয়ে টাকা মিটিয়ে চুপচাপ চলে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে লোকজন দেখে, গাড়ি-সাইকেল দেখে, দোকানের ভিড় দেখে। মন ভরে ওঠে তার। কী সুন্দর করে জীবন বইছে! ফুরফুর করে কেমন হাওয়া দিচ্ছে! বেঁচে থাকার এত আনন্দ! কেন যে শঙ্করকাকু মনখারাপ করে দেন!

রোজকার মতো আজও বিকেলে চায়ের দোকানের কাছে এসেছে, তদ্গতর চোখে পড়ল, আজু দু’হাতের ফাঁকে কায়দা করে বিড়ি গুঁজে টান দিচ্ছে। সে সব জানে। ঘটনাটা তাকে নিয়েই ঘটেছিল। শিশুর মতো হেসে, “এয়েচে! এয়েচে!” বলে ভজকট উচ্চারণে যা জানাল, অন্য রকম লাগল তদ্গতর। শঙ্করকাকু আজ নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, মাথার টাক বাহারি টুপিতে ঢেকে, সোনালি ফ্রেমের নতুন চশমা পরে ফিটফাট হয়ে এসেছেন। চেনাই যাচ্ছে না তাঁকে। বিয়েবাড়ি যাবেন।

যাওয়ার আগে শঙ্করকাকু চা খেয়ে, দেশের-দশের শ্রাদ্ধ করে খিদে বাড়াচ্ছেন। সাধারণ পোশাকেই অস্থির, তায় আজ মাঞ্জা মেরে এসেছেন, চালিয়ে তো খেলবেনই। কাউকে টিকতে দেবেন না।

আজুর বিড়ি শেষ হতে তার বদান্যতায় আড়ালে আড়ালে চা খেয়ে পেমেন্ট করে তাকে পাঁচটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে হাঁটা জুড়ল তদ্গত। ভাল করে বেড়িয়ে ফিরে এল বাড়িতে।

মন ফ্রেশ হয়ে গেছে। লগনসার সিজ়ন। দূরে বিয়েবাড়ির মাইকে ভরসন্ধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, ‘এই তো ভাল লেগেছিল/ আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। দেশের এই দুর্দিনে উচিত কি না জানে না, তবু মন আরও ভাল হয়ে গেল তদ্গতর।

বাড়ির লাগোয়া বিউটি পার্লার। বৌ নির্মিতা সেজেগুজে বসে আছে কাউন্টারে। বৌকে দেখলে এমনিতেই মন খুশি হয়ে ওঠে। আজ দ্বিগুণ হল।

তার ছোঁয়াচ লেগে কি না জানে না, তাকে দেখে নির্মিতাও ডগমগ হয়ে, “অ্যাই জানো?” বলে যা বলল, তাজ্জব হয়ে গেল তদ্গত।

বিয়েবাড়ি যাবেন বলে শঙ্করকাকুর স্ত্রী এসেছিলেন। তাঁর চুল কেটে, ফেসিয়াল করে এমন ভাবে ভোল বদলে দিয়েছে, খুশি হয়ে ভদ্রমহিলা অতিরিক্ত একশো টাকা বৌয়ের হাতে গুঁজে আশীর্বাদ করেছেন, “বেঁচে থাকো মা! বেঁচে থাকো!”

একশো! আর তদ্গত আজুকে দিল মাত্র পাঁচ টাকা! আগে এক দিন দশ টাকা দিয়েছিল বলে বাঁকা মন্তব্য করেছিলেন শঙ্করকাকু। চোখ ঠিকরে গেল তার। আজকালকার মেয়ে তো নন, শঙ্করকাকুরই খোদ অর্ধাঙ্গিনী! কে বলে কাকুর সব খারাপ? মনের দু’কূল জুড়ে আনন্দ থইথই করে উঠল তদ্গতর।

তার জের চলল পরের দিন সকালেও। বেলার দিকে হাওয়া খেতে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটছিল তদ্গত, পড়বি তো পড়, শঙ্করকাকুর মুখে। শঙ্করকাকু আবার সাধারণ পোশাকে, পুরনো প্লাস্টিক চশমায় ব্যাক করেছেন। মামার চা দিয়ে জিভের আড় ভেঙে এক খেপ লেকচার সেরে এসেছেন। এ দিকটায় বড় একটা আসেন না, আজ বোধ হয় কাজ পড়েছে। শেষ করে আবার হাজির হয়ে যাবেন মামার দোকানে।

লাঠি ঠুকতে ঠুকতে আসছিলেন। সামনে আসতে মুখ তুলে তদ্গতকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, “কী হে ইয়াং ম্যান, দেখা হচ্ছে না যে বড়? কী খবর হে?”

“সব ভাল! সব ভাল কাকু!” বলে তদ্গত আজ আর পালাল না। সাহস করেই পাল্টা শুধোল, “আপনি ভাল তো? বাড়ির সবাই...?”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Short story

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy