সেপ্টেম্বরের শেষে দুর্গাপুজো, অগস্টের তৃতীয় দিনেই অরবিন্দ সঙ্ঘ সেরে ফেলল খুঁটিপুজো। এ বারের পুজোর থিম: বাংলার মাটি, বাংলার জল... রবীন্দ্রনাথ কি-বোর্ডে লিখবেন ‘বাংলা আমার বাংলা’। নিহিত মূল বার্তা— রাম শ্যাম বজরঙ্গ বিনায়ক দূর হটো।
ধ্রুব বলে, “এই দূর হটানোতে আছি। কিন্তু বিনায়ককে বাইরে রাখো। তিনি এই মুহূর্তে আমাদের দিয়ারায় সবচেয়ে ইন।”
কৃষি বুঝতে না পরে ভেবলে যায়। বিনায়ক মানে শুঁড়ওয়ালা গণেশ তো! আগে শুধুমাত্র পয়লা বৈশাখে তাঁকে দেখা যেত। তো তেরো-চোদ্দো বছর ধরে, কেন্দ্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিস্ময়কর উত্থান। চার বছর আগে কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ায় পথ বন্ধ করে গণপতি বাপ্পার বিশাল মূর্তি দেখে তাঁর প্রথম ট্রমাটা এই রকম হয়— সমস্ত বইপাড়া, বাঙালির শিল্প-সাহিত্যের আড্ডা, কুঁচো পত্রিকার বাটি-ঘটি প্রয়াস, সব গণপতির বাপ্পার ভুঁড়িতে ঢুকে যাবে না তো! বইপাড়া থাকবে তো!
“বিনায়ককে বাইরে কেন রে ধ্রুব?”
“কারণ গণেশ ঠাকুরের হস্তিমাথার শ্রীচরণই বাঁচাতে পারে আমাদের বিধ্বস্ত দিয়ারা।”
“হাতির পা?”
“হ্যাঁ, এটা নতুন প্রকল্প। হাতি-পায়া প্রকল্প। ভাল কাজ হচ্ছে এটায়।”
“হাতি-পা প্রকল্প! আমরা তো হাতি-পায়া লুচি জানি। ওই লুচি ভোগ দিয়েই মা গঙ্গাকে শান্তকরবি নাকি!”
“হ্যাঁ গো! ঠাট্টা নয়। বিহারে এই প্রকল্পে ভাল কাজ হয়েছে। এই প্রকল্পে তৈরি করা হয় ছ’মিটার লম্বা একটা বাঁশের খাঁচা। সেটাকে ঘেরা হয় তারের জালি দিয়ে, আর ভিতরে ভরা হয় বালির বস্তা। সব কিছু নিয়ে বিরাট, তাই নাম হাতির পা।”
সেই হাতি-পা প্রকল্প দেখতে, গঙ্গা ভাঙন কমিটির সঙ্গে, কৃষি যায় রতনপুরে।
গঙ্গা ও কোশী নদী যেখানে মিশেছে, তার ঠিক কোণ বরাবর তিনটি গ্রাম— কালুটনটোলা, কেশরপুর আর বসন্তটোলা। গ্রাম তিনটি ঘিরে যে বাঁধ ছিল, ভেঙে গিয়ে গঙ্গা কোশী ঘরের ভিটায়। এখানকার দিনু মণ্ডল, রামদেব, রাজু মাহাতো হাঁ করে দেখছে ল্যাকপ্যাকে ট্রেকারদের হ্যান্টায় বালু নিয়ে হুড়পার।
“বাঁধ মেরামতি হবে না কী বে?”
“শালা! নেকু! বালি দিয়ে বাঁধ মেরামতি হয়?”
“তা তো হয় না। গঙ্গার সামনের বাঁধটা মেরামতি না করে, বেকার বালি ফেলছে কেন?”
“বালির বাঁধ হবে। প্রায় আড়াই কিমি ধরে বাঁধ হবে বে। বন্যার জল আটকাবে।”
“আর নদীর জল? আমাদের গাঁগুলো তো নদীর পেটে চলে যেছে।”
“নদীর ধারে ঘর করেছি ক্যানে হামরা! ডুবব। মরব। মরব। মরব।”
মরা নিয়ে কোনও ভয়-হুঁশ নাই ঝকসি, বিজলা, পুতুলদের। পরিবারের পেটের আগুন নেবানোর আয়োজনে তারা উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। ধ্যারধেরে টিনের পাতের ইস্টোভটা হাতে নিয়ে সরকারকে সকাল থেকে গাল পেড়ে পেড়ে ক্লান্ত ঝকসি মাহাতো। এক দঙ্গল শহুরে মানুষ, ক্যামেরা-বাবুকে দেখে নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়ায়।
“দ্যাহেন, ইস্টোভটা দ্যাহেন। ঠনঠনা গতর। ফিতা নাই। তেল নাই। দু’কেজি চাল দেয়। ইদিকে ঘরে ছ’টা পেট।”
শহরের দাদা-দিদিরা খুবই রাগ করেন, কষ্ট পান এই সব ধারাভাষ্যে।
চার দিকে চরম বিশৃঙ্খলার মাঝে বাঁধের মাটিতে নিপুণ হাতে তৈরি তিন ঝিকের উনুন দেখে মুগ্ধ হয়ে সে দিকে এগোয় কৃষি। মাটির হাঁড়িতে শুকনো খোলায় ছোলা ভাজছে সাভা মণ্ডল। কী হবে? পিষে ছাতু হবে। বাঁধের নীচে গঙ্গায় ডুবে যাওয়া জমি থেকে পাট কেটে তুলতে ব্যস্ত মেয়ে-মরদ। বাঁধের উপর ভাত না হোক, ছাতু-চিঁড়ের আয়োজনে টিকে থাকার নানা কিসিমের আয়োজন। জীবনের নানা কূটকচালি। সুবকী মণ্ডলের শোক— “বিজয় মণ্ডল, জালিম মণ্ডলের বৌ ভাতার আশ্বাসবাণী পেল। হামি পেনু না।”
গঙ্গা আর ফুলহারের মাঝে শুকনো মরা কোশী ফুলে ফেঁপে ক্রুদ্ধ নাগিনী। ছোবল মারছে পাড়ে। তাকে বাঁধতেই হাতি-পায়া প্রকল্প। তারের জালি দিয়ে বাঁধা ৬ মিটার লম্বা বাঁশের খাঁচাটি জলের ধাক্কায় লাট খায়। পাড় ভাঙবেই।
হাতি-পায়া সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ভাঙন কমিটির খিদির তারিকুল গৌতম জিয়ো-সিন্থেটিক প্রকল্পের উল্লেখ করে বার বার। গঙ্গার চরের মাটি কেটে জিয়ো-সিন্থেটিক ব্যাগে ভরলে, ওজন হবে ৩০০ কেজি। সেই ব্যাগ, ৫০-৬০ ফিট গভীরে পৌঁছে দিতে পারলে, কাজ হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ রাজি নয়। তারা আটকে আছে সেই প্রোকোপাইন আর হাতি-পায়ায়।
গরমেন্টদের নদী বাঁধার এই সব মিটিং আর সালিশি শুনলে রাগ হয় তারা চৌধুরীর। বেকার বেকার নিত্যনতুন নামের লম্পট সব পোকল্প। সব জলে যাবে, তবু সেখানেই টাকা ঢালছে। ওই সব চাল, ত্রিপল ত্রাণ চায় না তারা। জমি চায়।
ভুতনি চরের ফসলের মতো ঝকঝকে সবুজ তারা, হাত ঘুরিয়ে মারের দাগ দেখায়। ডান্ডার বাড়িতে হাত ফুলে ঢোল। বরের মাথা ফেটেছে। সে পোতিবাদী— “সরকার বলেছে, কলুনি পাওয়া যাবে। আমাদের দিবে না ক্যানে?”
অনেকের হাহাকারের মাঝে সুরতি মণ্ডলের মুখটি নির্ভার। তার দেড় বিঘা জমি। তিন ছেলে। ওই যে দুই ছেলে জলে পাট ওঠাচ্ছে। অন্য ছেলে মতি মণ্ডল। মনসা গান গায়। ভুতনি, মানিকচক, শাদুল্লাপুর, সব জায়গার আসরে যায় তো! এক রাত সাতশো টাকা। বলতে বলতে ছেলের গরবে জ্বলজ্বল করে ওঠে তার চোখ। বলে— “শাদুল্লাপুরে আসর করতে গেলে হাতি-পায়া লুচি আনে মোতি।”
হাতি-পায়া প্রকল্প মানেই শুধু শুধু ভস্মে ঘি ঢালা। লক্ষ-কোটি টাকা জলে ছুড়ে ফেলা। শাদুল্লাপুরের শ্মশানযাত্রীরা দাহ শেষে হাতি-পায়া লুচি খায়। হাতি-পা শুনলেই শহুরে মানুষের শ্মশানের কথা মনে আসে। নামটা তাই পছন্দ হয়নি কৃষির। ধ্রুব গণপতি বাপ্পায় বিশ্বাস রেখেছিল, তারও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।
এর মাঝে গেঁয়ো মনসা গান-শিল্পী, মার জন্য হাতি-পা লুচি নিয়ে আসে, এটাই যেন একমাত্র রিলিফ। শিল্পী ছেলের গর্বে মা সুরতির মুখ আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে।
কী আশ্চর্য এই ধ্বংস আর নির্মাণের দেয়ালা! এর মাঝে দাঁড়িয়ে কৃষি দেখে আকাশ কেমন ঘন নীল। রতনপুর থেকে গোপালপুরে যাওয়ার পথে বাসের জানলা দিয়ে দেখে গাছ-ভরা শিউলি। থোপা-থোপা আতা ফল।
নিম্নবর্গের মানুষ বাবুদের দুগ্গাপুজোয় নয়, মাতে ঋতু-উৎসবে। জেগে থাকা মাটিতে, ফসলে, আকাশের নীল আর সাদা মেঘে সেই সব ইশারা। দু’হাত দূরে মৃত্যু নাচে, তবু নীল আর সবুজ নিয়ে প্রকৃতির হাতি-পায়া আয়োজনে কোনও কমতি খুঁজে পায় না কেউ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)