Advertisement
E-Paper

দিদিমণি, তোমাকে

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্‌রঁ ব্যতিক্রম নন। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক রুশো থেকে হাল আমলে অনেকেই শিক্ষিকার শয্যাসঙ্গী। গৌতম চক্রবর্তী ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্‌রঁ ব্যতিক্রম নন। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক রুশো থেকে হাল আমলে অনেকেই শিক্ষিকার শয্যাসঙ্গী। গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৭ ০০:০০
দম্পতি: এক কালের দিদিমণি, এখন স্ত্রী। ব্রিজিত-এর সঙ্গে ইমানুয়েল মাক্রঁ

দম্পতি: এক কালের দিদিমণি, এখন স্ত্রী। ব্রিজিত-এর সঙ্গে ইমানুয়েল মাক্রঁ

মার্চ মাসের এক রবিবার জেনেভার ছেলে জঁ জ্যাকস রুশো ফ্রান্সের আনোসি গ্রামে পৌঁছল। রুশোর বয়স মাত্র ১৬, জন্মের ন’দিন পরেই মা মারা গিয়েছেন। বাবা কয়েক বছর আগে দূর সম্পর্কের পিসিকে নিয়ে অন্যত্র সংসার বেঁধেছেন। বালক রুশো তার পর থেকে মামাবাড়িতেই মানুষ।

মামা এক ঘড়ির কারিগরের কাছে শিক্ষানবিশি করতে রুশোকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রুশো এমনিতে পাটিগণিত, কারিগরি বিষয়ে ভাল। কিন্তু একটু ভুলচুক হলেই পিঠে আছড়ে পড়ত কারিগরের বেত। শিক্ষানবিশি, জন্মশহর জেনিভা সব ছেড়ে তাই রুশো পালাল। পালাতে পালাতে আল্পস পাহাড়ের নীচে আনেসি। এই গ্রামেই মাদাম ডি ওয়ারেনস থাকেন। স্যাভয় শহরে এক জনের সঙ্গে রুশোর দেখা হয়েছিল। তিনিই মাদাম ওয়ারেনস-এর সঙ্গে দেখা করার বুদ্ধিটা দিয়েছেন। ভবিষ্যতে মাদামের কাছেই রুশো ওষুধবিজ্ঞান শিখবেন, জানবেন ধর্মতত্ত্ব, পড়বেন বহু বই। মাদাম ওয়ারেনস ছাত্রকে বলতেন ‘মাই চাইল্ড’, রুশো তাঁকে ডাকতেন ‘মামন’।

মা-ছেলে বা শিক্ষিকা-ছাত্রের সম্পর্ক সেই অষ্টাদশ শতকে শুধুই প্রথাগত সীমারেখায় আটকে থাকেনি। আল্পস পাহাড়ের নীচে চেম্বুরি শহরে তাঁর এস্টেটে নিয়ে গেলেন মাদাম ওয়ারেনস, সেখানে দুজনে সারা দিন ঘুরে বেড়ান। রাতে দুজনে এক বিছানায়, রতিলিপ্সায়।

ভবিষ্যতে মাদামের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সেই রবিবারের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন ফরাসি বিপ্লবের স্রষ্টা দার্শনিক। মাদাম বাড়িতে নেই, গির্জায় গিয়েছেন। কিন্তু গির্জায় ঢোকার আগেই তাঁকে রাস্তায় পাকড়াও করে নিজের পরিচয়পত্র দিলেন রুশো। ‘তার পর থেকে কত বার ওই জায়গাটা চোখের জলে, চুমুতে ভিজিয়ে দিয়েছি। ওখানে একটা সোনার রেলিং তৈরি করে দেওয়া উচিত ছিল। প্রেমকে যারা সম্মান করে, তারা সকলে নিশ্চয় ওই রেলিং-এর সামনে নতজানু হয়ে বসত,’ আত্মজীবনী ‘কনফেশন্‌স’-এ লিখছেন রুশো।

অতএব, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্‌রঁ ও তাঁর স্ত্রী ব্রিজিত-এর সম্পর্কের মধ্যে যাঁরা অভূতপূর্ব রসালো কাহিনি খুঁজবেন, ভুল করবেন। ব্রিজিত ফ্রান্সের আমিয়েন্স অঞ্চলে একটি স্কুলে ফরাসি ও লাতিন ভাষার শিক্ষিকা ছিলেন। মাক্‌রঁ তাঁর চেয়ে ২৫ বছরের ছোট, ওই স্কুলেরই ছাত্র। ব্রিজিত স্কুল-ফাংশনের রিহার্সাল করান, ছাত্র মাক্‌রঁও সেখানে যেতেন। দিদিমণিকে তাঁর ভাল লাগার, ভালবাসার কথা বলেন।

কিন্তু এই পৃথিবীতে চাইলেই দিদিমণিকে পাওয়া যায় না। ব্রিজিত এক ব্যাঙ্কারের স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে। বহু পরে ২০০৬ সালে, ওই দাম্পত্য ভেঙে প্যারিসে এসে প্রেমমুগ্ধ ছাত্রটিকে বিয়ে করেন। তখন মাক্‌রঁ পড়াশোনা করেন, ব্রিজিত নতুন সংসার টানতে ফের শিক্ষিকার চাকরি নিয়েছেন। গত বিয়েতে জন্মানো ব্রিজিতের তিন ছেলেমেয়ের এক জন আজ আইনজীবী, এক জন ইঞ্জিনিয়ার, অন্যজন ডাক্তার। মাক্‌রঁ তাঁর সমবয়সি বা বয়সে বড় তিন জনকেই দত্তক নিয়েছেন। দত্তক পুত্রকন্যার সুবাদে নাতি-নাতনিও রয়েছে!

জঁ জ্যাকস রুশো ও মাদাম ডি ওয়ারেনস

সম্প্রতি ব্রিজিতের আইনজীবী কন্যা চমৎকার এক কথা বলেছেন। মিডিয়া যখন মাক্‌রঁ-ব্রিজিতের অসম সম্পর্ক নিয়ে ব্যস্ত, ব্রিজিত কন্যা সাফ জানিয়েছেন, ‘কে কার শিক্ষিকা ছিলেন, বউ বয়সে বরের চেয়ে কত বড়, এগুলি একেবারে সেক্সিস্ট কথা। আধুনিক দুনিয়ার মুখে মানায় না।’

আধুনিক পৃথিবীর গল্প এটাই। বিবাহ-বিচ্ছিন্ন মাদাম ওয়ারেনস ও তাঁর ছাত্র রুশোর কাহিনিতে প্রেম, প্যাশন অনেক কিছুই ছিল। ছিল না এই সাহসী বিবাহ-উপসংহার।

মাদাম ওয়ারেনস-এর বাড়িতে এক দিন সকলে খেতে বসেছেন, রুশো বললেন, ‘আরে মাদাম, আপনার খাবারে চুল।’ মাদাম মুখের খাবার প্লেটে নামিয়ে রাখলেন, রুশো সেই উচ্ছিষ্ট প্লেট থেকে উঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখে! ‘এই অনুভূতি শুধু বন্ধুত্বের ছিল না। আরও ইন্দ্রিয়ঘন, আরও কোমল,’ লিখছেন তিনি।

একটা সময় রুশো চেম্বুরি, স্যাভয় ছেড়ে চলে এলেন প্যারিসে। তার দশ বছর বাদে, ১৭৫৪ সালে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন আনেসিতে। মাদামের তখন প্রবল অর্থাভাব, রুশো বললেন, ‘চলুন, প্যারিসে আমরা তিন জন একসঙ্গে থাকব।’ মাদাম রাজি হলেন না। উলটে তাঁর আঙুলের শেষ আংটিটি পরিয়ে দিলেন রুশোর স্ত্রী টেরেসার আঙুলে। সেই বছরেই তাঁর মৃত্যু। রুশোও মারা যাবেন ১৬ বছর পরে। অসমাপ্ত স্মৃতিকথায় লিখে যাবেন, ‘সেই নারীর সঙ্গে যে পাঁচ-সাত বছর ছিলাম, তখনই পেয়েছিলাম শতবর্ষের শান্তি।’

ছাত্রকে বিয়ে করে তাই ব্রিজিত যে সাহসটা দেখিয়েছেন, সেটাই আধুনিক পৃথিবীর রূপকথা। তিনশো বছর আগেও পৃথিবী এ সব পারেনি।

প্যারিসের রূপোপজীবিনী নিনো দ্য লেনক্লস কি কখনও ছিলেন ভলতেয়ারের শিক্ষিকা? চমৎকার কবিতা লিখতেন নিনো। ভার্সেই রাজপ্রাসাদের লুই দ্য বুর্বঁ থেকে লেখক লা রোশেফুকো, মলিয়ের— অনেক আসঙ্গলিপ্সুকেই তিনি বিছানায় প্রশ্রয় দিয়েছেন, তখনকার প্যারিসে ‘লাভ মেকিং’-এর স্কুলও খুলেছিলেন। কিন্তু পুরুষটিকে পছন্দ না হলেই সটান বিদায়।

এ হেন নিনো তাঁর অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফ্রাসোয়া আরুত-এর তেরো বছর বয়সি ছেলে ফ্রাসোয়া মেরি আরুতের কবিতা শুনে মুগ্ধ হন। সেই মোহাবেশ থেকেই পরে নিজের উইলে কিশোর আরুতকে ইচ্ছেমত বই কেনার জন্য দু’হাজার ফ্রাঁ দিয়ে গেলেন। এই ফ্রাসোয়া মেরি আরুতই পরে ভলতেয়ার নামে খ্যাত।

নিনোর মৃত্যুর পরেও তাঁর রূপ আর গুণে সারা প্যারিস মোহাচ্ছন্ন। তিনি নাকি কোনও দিন বৃদ্ধা হননি, চামড়া কুঁচকায়নি, অনন্ত যৌবনা। যুক্তিবাদী ভলতেয়ার ছাড়বেন কেন? ‘বার্ধক্যের নিনোকে আমি দেখেছি। মমির মতো,’ লিখছেন ভলতেয়ার। যে বিদ্যোৎসাহী রূপোপজীবিনী প্রায় যেচে ভলতেয়ারকে বই কেনার টাকা দিলেন, তাঁকেও রেহাই দিলেন না দার্শনিক। এঁচড়ে-পাকা সমাজসচেতন কিশোর কবির সঙ্গে নিনোর সম্পর্ক এক দিনেরই ছিল কি না, এখনও লাখ টাকার প্রশ্ন।

তাই, মাক্‌রঁ শুধুই সাহসী এক প্রতীক। অঙ্কুরোদ্গমে কোন বালক না মোহাচ্ছন্ন হয়েছে বিশেষ কোনও দিদিমণির উজ্জ্বল উপস্থিতিতে, তাঁর সহৃদয় কলতানে, স্বপ্নমুখর বাচনে, ব্যবহারে? সামাজিক সংস্কার শেষ অবধি সেই মোহকে অবচেতনের বিপজ্জনক হিমশৈলে চাপা দিয়ে রেখেছে, অবশ্যই! কিন্তু হৃদয়ের সেই গোপন, নিবিড়নিভৃত অনুভূতি বয়ে নিয়েই তো বালক ক্রমে হয়েছে পুরুষ!

সব দিদিমণিই অবশ্য কৈশোরে আসেন না। কখনও কখনও নিঃসঙ্গতার জীর্ণ প্রহরে স্বেচ্ছায় তাঁর সঙ্গী হয় বিশেষ এক ছাত্র। রুশিকুমার পাণ্ডিয়া যেমন! আমেরিকার কলেজে সাহিত্য পড়ান, বাজনা শেখেন উস্তাদ আলি আকবর খাঁ-র কাছে। কোম্পানি এগজিকিউটিভদের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট পড়ানোর সুবাদেই বছরে দু’তিন মাস ভারতে এসে থাকতে হয়। এক দিন আলি আকবর বললেন, ‘যাচ্ছ তো মুম্বই? রেওয়াজ ওখানেও করতে পারো, আমার বোন থাকে ওখানে। সেতার, সুরবাহার, সরোদ সবই প্র্যাকটিস করতে পারবে।’

মুম্বইয়ের বহুতল ‘আকাশগঙ্গা’র সাত তলায় বেল টিপলেন রুশি। তাঁর সামনে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র কন্যা। আলি আকবরের বোন। সেই জীবন্ত কিংবদন্তি! অন্নপূর্ণা!

ঘটনাটা ১৯৮২ সালের। এর প্রায় চার দশক আগে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে অন্নপূর্ণার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। কমলা শাস্ত্রী থেকে সু জোন্স, অনেকেই এসেছেন রবিশঙ্করের জীবনে। কিন্তু অন্নপূর্ণা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন আলোকবৃত্ত থেকে। সেই সঙ্গহীন জীবনে এলেন রুশি।

অতঃপর ১৯৮২ সালেই ওঁদের বিয়ে। বছর চার আগে রুশি মারা গিয়েছেন, অন্নপূর্ণা আবার নিঃসঙ্গ।

যুগল: নিনো দ্য লেনক্লস ও ভলতেয়ার।

প্রেমের তাই সোজাসাপটা কোনও ফর্মুলা নেই। যদি দু’পক্ষের হৃদয়ের তন্ত্রীতে তোলপাড় ওঠে, রাজি থাকে দু’পক্ষ, বয়স বা সামাজিক প্রথাকে পাত্তা না দিয়ে তখন এগিয়ে যাওয়া যায় অনেক, অনেক দূর।

সিমোন দ্য বেভোয়া-র ঘটনাটাও মনে রাখতে হবে। জঁ পল সার্ত্র-এর সহপাঠিনী, সঙ্গিনী। বিবাহপ্রথাকে দূরে ছুড়ে আজীবন বৈদগ্ধ্যমণ্ডিত সহবাসে রত ছিলেন এই দম্পতি। তাঁরা তো সর্বদা প্রথাগত বুর্জোয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে!

ফলে, সিমোনের জীবনে ঢুকতে ক্লদ লানজামান-এর কোনও অসুবিধা হয়নি। ১৯৫২ সাল। সার্ত্রের রু বোনাপার্তের স্টাডিতে পড়াশোনা করতে জড়ো হন তরুণ ছাত্ররা। সিমোন দ্য বোভোয়া লানজামান-এর থেকে ১৭ বছরের বড়।

জুলাই মাসে এক ছাত্রীর বাড়িতে পার্টি। কয়েক দিন পরেই সার্ত্র আর সিমোন যাবেন ইতালি, লানজামান যাবেন ইজরায়েল। সে দিন তিনি অনেকটা মদ খেয়ে ফেললেন।

পর দিন সকালে সিমোনের ফোন বাজল। ও পারে লানজামান, ‘আমি কি আপনাকে আজ সিনেমায় নিয়ে যেতে পারি?’ সিমোন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ছবি?’ উত্তর এল, ‘যা আপনার ইচ্ছে।’ বিকেলে দুজনে বেরোলেন। লানজামান সে দিন প্রবল ফ্লার্টিংয়ের মেজাজে। সিমোন হেসে সতর্ক করলেন, ‘আমি ১৭ বছরের বড়, না?’ লানজামান ঠোঁট উলটোলেন, ‘দেখে তো এক বারও বুঝতে পারছি না।’ সে রাত এবং তার পরের দুটো রাতও লানজামান সিমোনের ফ্ল্যাটেই
থেকে গেলেন।

সেই শুরু। তারপর ’৫২ থেকে ’৫৯ অবধি সাত বছর লানজামান-সিমোন একত্র থেকেছেন। লানজামান তখন সার্ত্র-সিমোন প্রতিষ্ঠিত ‘লা টেম্পস মডার্নেস’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন, সুইটজারল্যান্ডে পড়ান।

তাই পাপ-পুণ্য অবান্তর। কে না জানে, শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত!

Jean-Jacques Rousseau Brigitte Macron Emmanuel Macron Marriage Teacher
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy