Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৬

মায়া প্রপঞ্চময়

রেঞ্জারবাবুর কাছ থেকে বেন্দা জানতে পারে, কালীপুর চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর তাকে খুঁজছে। কোনও এক অদৃশ্য কারণে বেন্দা মুখোমুখি হতে চায় না তার। 

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৯ ০১:২৮
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: স্বপনবাবু মারা গিয়েছে, জানতে পারে বেন্দা। মনে পড়ে স্বপনবাবুর সঙ্গে তার কাজের স্মৃতি, এক বার এক সঙ্গে এক খেপা হাতির খোঁজে যাওয়া। যে এক বৃদ্ধাকে মেরেছিল। বেন্দার মনে হয়েছিল, স্বপনবাবু এক অসহায় সরকারি কর্মচারী। যে এক জন বৃদ্ধার অপঘাত মৃত্যুতে ব্যথায় কাতর, আবার তার হত্যাকারী সেই হাতির বীভৎস ক্ষতের যন্ত্রণাতেও সমান ব্যথিত, যে ক্ষত দিয়েছে কোনও না কোনও মানুষই। রেঞ্জারবাবুর কাছ থেকে বেন্দা জানতে পারে, কালীপুর চিড়িয়াখানার ডিরেক্টর তাকে খুঁজছে। কোনও এক অদৃশ্য কারণে বেন্দা মুখোমুখি হতে চায় না তার।

সব চুক্যেবুক্যে গেলে খপর দিবেন - তক্ষন ফিরব, আঁজ্ঞা।’’ এত দুঃখের মধ্যেও রেঞ্জারবাবু হোহো করে হেসে ওঠেন, ‘‘দূর বোকা, এত ঘাবড়ে যাস কেন সব কিছুতেই? সাহেবের কথা থেকে তো মনে হল ভাল ভেবেই তোর খোঁজ করেছেন। কী যেন নাম শুনলাম... দাঁড়া, হ্যাঁ মনে পড়েছে... অনিকেত বোস। চিনিস না কি এই নামের কাউকে?’’

বৃন্দাবনের শরীরে যেন একটা ঝটকা লাগে, একটু আগেই তো স্বপনবাবুর কথা ভাবতে গিয়ে বোসস্যরের কথা ভাবতে শুরু করেছিল ও। নিজের নামের ব্যাখ্যাও ওর কাছে করেছিলেন এক দিন। ‘‘অনিকেত মানে হল যার কোনও স্থায়ী ঠিকানা নেই। চালচুলোহীন, বাউন্ডুলে বলতে পারো। আবার অন্য অর্থে মহাদেব বা ভোলানাথকেও বোঝায়। আমি অবশ্য প্রথম দলে পড়ি,’’ মজা করে বলেছিলেন উনি।

রেঞ্জারবাবুকে ও ‘‘হঁ আঁজ্ঞা’’ বলে চুপ করে যায় বটে, কিন্তু ওর মনের মধ্যে পুরনো স্মৃতি তোলপাড় করে। বোসস্যর বান্দোয়ানে আসছেন এত দিন বাদে। তাও আবার ওর খোঁজ নিয়েছেন আলাদা করে। তার মানে ওঁরও মনে আছে পুরনো দিনগুলোর কথা। ভাবতেই ওর ভাল লাগছে, ভয়টয় সব যেন উবে যায় মন থেকে। স্মৃতির পাখায় ভর করে ওর মন উড়ে যায় ছাবিবশ-সাতাশ বছর পিছনে। যে দিন বোসস্যর জোসেফ ড্রাইভারের ঝরঝরে জিপটা থেকে নেমে লম্বা পা ফেলে ওর সামনেই এসে দাঁড়ালেন। ও তখন বাইকটার স্পার্ক প্লাগ খুলে একটা কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করছিল। স্টার্টিং প্রবলেম হচ্ছিল গাড়িটায় থেকে থেকে।

ছিপছিপে চেহারার লম্বা মানুষটা সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর কেমন যেন মনে হয়েছিল যে এ লোকটা এখানকার আর পাঁচ জনের মতো নয়। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘রেঞ্জ অফিসার কোথায় বসেন?’’ থতমত হয়ে ও ঠকাস করে একটা স্যালুট ঠুকে বসেছিল। হাত বাড়িয়ে বড়বাবুর ঘরটা দেখিয়ে কান খাড়া রেখেছিল কী কথা হয় তা শোনার জন্য।
কানে এসেছিল আগন্তুকের রেঞ্জারবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলো, ‘‘আসতে পারি ভিতরে? আমি অনিকেত বোস, বান্দোয়ানে রেঞ্জ ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়েছে আমাকে। আপনি তো রেঞ্জ অফিসার এখানকার?’’ চেয়ার টেনে সরানোর আওয়াজও পায়, সঙ্গে রেঞ্জারবাবুর গলা, ‘‘আসুন, আসুন স্যর, বসুন। আপনার কথা শুনেছি, অফিস অর্ডারও পেয়েছি। অ্যাকাউন্ট, অন্যান্য কাগজপত্র রেডি করছি চার্জ হ্যান্ড-ওভার করার জন্য। অনেক বেলা হল আসতে, দুপুরের খাওয়াও বোধহয় হয়নি। রেস্টশেড ছোট একটা আছে এখানে, রান্না করতে বলে দিই ?’’

একটু চুপ করে থেকে নতুন মানুষটা জবাব দেয়, ‘‘নাহ, আসার পথে বলরামপুরে আমি আর ড্রাইভার মাছ-ভাত খেয়েছি। আপনি বরং আজ রাত থেকে রান্নার জন্য এক জনকে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। পেমেন্ট আমি করব। অবশ্যই রিজনেবল রেটে। আর থাকার ব্যবস্থাটাও করতে হবে সেই সঙ্গে।’’ বড়বাবু বলেন, ‘‘কয়েক দিন লাগবে আমার পরিবার আর আসবাবপত্র শিফট করতে, বোঝেনই তো স্যর, সংসারী মানুষ। সে ক’টা দিন কষ্ট করে রেস্টশেডে যদি থাকেন। আপনি তো একলা মানুষ! আর রান্নার জন্য কাউকে দেখতে হবে না। অর্ডালি মধুময় আছে আপনার দেখভাল করার জন্য, আমার ফ্যামিলিকেও তো ও সাহায্য করে সময়ে-অসময়ে। ও-ই আপনার সব কিছু দেখাশোনা করবে এখন থেকে।’’

জবাব আসে, ‘‘প্রথমটা ঠিক আছে, আমি একা মানুষই বটে। এসেছিও একটা মাত্র সুটকেস নিয়ে। যাওয়ার দিনেও ওই ভাবেই চলে যাব। আপনি সময় নিয়ে আপনার কোয়ার্টার খালি করুন। সমস্যাটা পরের অংশটা নিয়ে। দেখুন, এখানে থাকতে হবে প্রায় এক বছর। অতটা সময় ব্যক্তিগত কাজকর্মে এ ভাবে কারও কাছে অবলাইজ হয়ে থাকা, বিশেষ করে সেও যখন এক জন সরকারি কর্মচারী! ওকে কাজের জন্য আলাদা রেমুনারেশন দিলেও কাজটা বিবেকের অনুমোদন পাচ্ছে না। এক-আধ দিন হলে নাহয় বিপদে-আপদে মানুষ পরস্পরকে সাহায্য করছে বলে মেনে নিতাম। আপনি বরং লোক খোঁজার কাজে আমাকে একটু সাহায্য করুন।’’

বেন্দা জানত না, আগেই খবর থাকায় বড়বাবু মধুদাকে দিয়ে রেস্টশেড সাফা করিয়ে বিছানা-মশারি-জলের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করিয়ে রেখেছেন। বাইরে এসে ওকেই সামনে পেয়ে বড়বাবু বলে ওঠেন, ‘‘অ্যাই বেন্দা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়! এই সাহেব এর পর তোদের রেঞ্জের দায়িত্ব নেবেন। স্যালুট কর হতভাগা, উনিই এ বার থেকে তোদের কর্তা! যা, ওকে নিয়ে ঘর দেখিয়ে দে, উনি রেস্ট নেবেন। আর হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি ফিরবি, কাজ আছে।’’

উনি হেসে বলেন, ‘‘তোমার নাম কি বৃন্দাবন? বেশ, তবে স্যালুট আপনার বেন্দা আগেই সেরে রেখেছে। আর সাহেব বলে ডাকা আমার মতো শ্যামবর্ণ মানুষের সহ্য হবে না, আমাকে বোসস্যর বলে সম্বোধন করলেই যথেষ্ট হবে। কী বলো, বৃন্দাবন? ধন্যবাদ রেঞ্জারবাবু, সন্ধের সময় দেখা হবে। আপনি কাজকর্ম করুন বরং, আপনাকে তো অফিস আর বাড়ি দুটোই সামলাতে হবে।’’

বৃন্দাবন রেঞ্জ চৌহদ্দির শেষ প্রান্তে বোসস্যরকে নিয়ে ছোট ঘরটা দেখিয়ে দেয় আর জানায় যে ও সদ্য ট্রেনিং শেষ করে ফরেস্ট গার্ডের কাজে যোগ দিয়েছে। কাজে ভুল হলে সাহেব থুড়ি স্যর যেন মাফ করে দেন। স্যর হেসে বলেন, ‘‘ভালই হল, তুমিও ট্রেনিং করে এসেছ আর আমিও দু’বছরের ফিল্ড ট্রেনিং করে আর এক বছরের রেঞ্জ ট্রেনিং করতে এলাম। আমাদের জমবে ভাল, তুমি তো এনফিল্ডটা মোছামুছি করছিলে। বাইক ঠিকমতো চালাতে পারো তো? তা হলে তুমিই হবে আমার সারথি।’’

টুকটাক কিছু কথা হল। বান্দোয়ানে বিদ্যুতের লাইন আসতে কত দিন লাগবে, এখানে সপ্তাহে ক’দিন হাট বসে, সিনেমা হল আছে কি না, টাটকা খবরের কাগজ পাওয়া যায় কি না ইত্যাদি ওর কাছ থেকে জানতে চা। ও জানায় যে বুধোবার আর শুক্কোরবার হল এখানের হাটোবার। বাকি সবই না-বাচক শুনে উনি বেশ হতাশ হন। ওকে সন্ধের আগে ডেকে দিতে বলে উনি ঘরে ঢুকে যান। অফিসে ফিরে ও দেখে, বেশ জমাটি মিটিং বসেছে।

আগেই বোধহয় রেঞ্জারবাবু ওয়ারলেস আরটি-তে খবর দিয়েছিলেন, তাই সব বিট থেকেই বিট অফিসাররা রেঞ্জ অফিসে হাজির হয়েছে। আটটা বিট বান্দোয়ান রেঞ্জে, অ্যাটাচড অফিসারকে নিয়ে নয় জন বিটবাবু আর রেঞ্জারবাবু তুমুল আলোচনা করছেন। এক কোণে মধুময় মাহাতো আর জনাচারেক গ্রুপ ডি কর্মচারী দাঁড়িয়ে, মধুদা ওকে ঠোঁটে আঙল দিয়ে ইশারা করে চুপ করে থাকতে। একটা চাপা উত্তেজনার পরিবেশ ঘরে, অফিসের মাথা বদল হলে এমনটা হয়। নতুন চাকরি হলেও বেন্দা বোঝে।

বড়বাবু প্রথমে মুখ খোলেন, ‘‘দেখো সবাই, গত আড়াই বছর তো তোমাদের নিয়ে আমি চালালাম। ছোটখাটো গন্ডগোল কোথায় না হয়। একটা সংসারেও কি হয় না? এ বার নতুন অফিসার এখানে কাজও শিখবেন, অফিসও চালাবেন। ছেলেটাকে প্রথমেই দেখে যা মনে হল তা যদি ঠিক হয় তবে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোঁব না, কাশী যাব... গোছের আর কী! আমার সব হিসাব-কিতাব তোমরা আজ ভাল ভাবে মিলিয়ে নাও। তার পর তোমরা নতুন লোকের সঙ্গে কী ভাবে চালাবে সেটা ঠিক করো।’’

ধাদিকার বিটবাবু গোপাল মাহাতো এমনিতেই রগচটা টাইপের, কথায় কথায় হাত চালানোর রোগ আছে বলে বিপদেও পড়ে। সে হুঁকে উঠল, ‘‘আরে ওই তো সে দিনের বাচ্ছা, পড়াশোনা করতেই দিন কাবার করেছে। আমরা এতগুলো এত দিনের পোড় খাওয়া ফরেস্টার এক জন লোককে সামলাতে পারব না? বেশি বাড়াবাড়ি করলে।’’ ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়ে কুচিয়া বিটের ঠান্ডা মাথার লালমোহন মাহাতো বলে, ‘‘এটা গা-জোয়ারির সময় নয়, এর পরেও অনেক দিন আমাদের একই দফতরে চাকরি করে খেতে হবে। আগে দেখি না নতুন সাহেব কী বলেন বা করেন!’’

বুদ্ধিতে ওস্তাদ বান্দোয়ান বিটের শিবরাম দুয়ারি সব চেয়ে সিনিয়র, তাই সবাই ওর পরামর্শ চায়। দুয়ারি ভারিক্কি চালে জানায়, ‘‘দেখো, আমরা সব মিলিয়ে এই রেঞ্জে বিরানব্বই জন স্টাফ। এক জন নতুন লোক, যার কিনা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এবিসিডি জানা নেই, তার জন্য এত ভাবনাচিন্তা করার দরকার নেই। অবস্থা বুঝে আমরা ব্যবস্থা করব। যদি আমাদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে চলে তো কোই বাত নেহি, না হলে আঙুল বাঁকা করলে টেরা লোকও চাপের মুখে বাপ-বাপ বলে সোজা হয়ে যাবে। বেশি ফেস তো আমিই করব ওকে, আমার উপর সব ভার ছেড়ে দাও দেখি।’’

মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবুরা সব সভাভঙ্গ করে। রেঞ্জারবাবু তাঁর বকেয়া হিসাবপত্র নিয়ে বসেন, বেন্দা এই অল্প দিনেই দেখেছে লেনদেনের বিষয়ে বাঁটোয়ারা নিয়ে বাবুদের মধ্যে তুলকালাম ঝগড়া বেধে যায়। বাইরে থেকে মধুদা চাপা গলায় নারদ-নারদ করতে থাকে, বোঝাই যায় যে বেশ মজা পাচ্ছে। ওকে মাঝেমধ্যে বলে, ‘‘এই তো সবে চাকরিতে ঢুকলি, এখানে আমাদের মতো লোকেদের লাভ-লোকসান বেশি নেই, তবে দুনো মজা আছে, বুঝলি! আর যদি এর কথা ওকে লাগান-ভাঙান করতে পারিস তবে কিছু নগদ-নারায়ণও জুটে যাবে।’’

এই লাইনে বেন্দা সত্যিই নতুন, মধুদার শিক্ষা সত্ত্বেও ওর মনের ভিতরটা কেমন যেন করতে থাকে। নতুন অফিসারকে ওর বেশ ভাল লেগে গিয়েছে, বয়সও ওর কাছাকাছি বলে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া মানুষটার মধ্যে কোনও অহঙ্কার নেই, ওর মতো এক জন ছোটো কর্মচারীর সঙ্গেও কেমন হেসে কথা বলছিল। এখানে এতগুলো পোড় খাওয়া অফিসারের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একলা মানুষটা কি এঁটে উঠতে পারবে? ওর ছোটবেলায় পাড়াতে কম্পিটিশনের যাত্রাপালায় অভিমন্যুবধ দেখে দু’দিন কেঁদেছিল। যখন সপ্তরথীতে মিলে অন্যায়ভাবে অভিমন্যুকে মেরেছিল, ওর মন সেটা মেনে নিতে পারেনি। আজ হঠাৎ যেন বোসস্যরকে অভিমন্যুর মতো মনে হয় ওর, বিশ্রাম নিতে থাকা লোকটা জানতেও পারল না এখানে ওর ক্ষতি করার প্ল্যান তৈরি হয়ে গেল।

এক বার মনে হল, যা শুনেছে রেস্টশেডে গিয়ে সব কথা স্যরকে বলে দেয়। দু’পা এগিয়েই মধুদার উপদেশ মনে পড়ে গেল, ‘‘দ্যাখ বেন্দা, আদার বেপারিদের কখনও জাহাজের ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক্যে নয়, বিপদে পইড়তে হয়।’’

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

bengali literature Maya Kanailal Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy