এই এক ঝামেলা শুরু হয়েছে!
মহালয়া শুভ, না শুভ নয়? ধুত্তেরি! ভাল্লাগে না। সারা বছর একটা সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মহালয়া আমার কাছে একটা খাম, যেখানে রোদের শরীরে মেঘের হরফে প্রকৃতি বাঙালিকে লিখে পাঠায় ‘ছুটি’। কোথায় সেই গোলাপি খাম বুকে চেপে ধরব, গোপনে তার ঘ্রাণ নেব, উল্টেপাল্টে দেখব তার ভিতরের হরফগুলো, তা নয়! তার বদলে শুভ-অশুভর এই বাৎসরিক ঝগড়া আর পোষায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় মহালয়া এখন উৎসব কম, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বেশি, বছরে এক বার সবাই তুমুল হাত নেড়ে তর্ক করবে, তার পর ভুলে যাবে।
মহালয়ার সঙ্গে পিতৃপুরুষ-তর্পণের রীতি আমি অনেক পরে দেখেছি। আমাদের পূর্ববঙ্গের পরিবারগুলোয় হয়তো এটা খুব চালু রীতি ছিল না। অন্তত আমাদের বাড়িতে তা কোনও দিন কাউকে করতে দেখিনি। কিন্তু মহালয়া খুব ঘটা করেই হত। আমাদের নাটকের দল ছিল, মহালয়ার আগের সন্ধেয় ফিস্ট একেবারে বাঁধা। চলুন, বাকি বোদ্ধারা মহালয়া শুভ না অশুভ তাই নিয়ে তর্ক করুক, আমি আপনি পিছিয়ে যাই প্রায় সিকি শতক। চোখ রাখি এই সহস্রাব্দের তৃতীয় মহালয়াতে।
চিরন্তন: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এঁর কণ্ঠসম্পদ বাঙালির উত্তরাধিকার।
মহালয়া ২০০২
মাধ্যমিকের পর থেকেই বেশ একটা তালেবর ভাব হয়েছে আমার। এই সময় গড়িয়াহাটে পর পর জয়েন্টে চান্স পাওয়ার কোচিং ছিল। দাদাকে জপিয়ে ভর্তি হয়ে গেছিলাম। আর যায় কোথায়, বয়েজ় স্কুলের ছেলে গিয়ে পড়েছি কো-এড ব্যাচে। মাথা-মন-হরমোন সব গুলিয়ে গিয়ে নায়াগ্রার মতো ফুঁসছে, তাকে সামলে নিউটন বোঝার এলেম আমার ছিল না। যাকগে, থাক সে-সব দুঃখের কথা। কাল মহালয়া, আজ ফিস্ট আর আনন্দের দিন, খামোখা ক্যালকুলাস নিয়ে ভেবে মাথা গরম করে লাভ নেই। আমি, টুবাই, টুঙ্কু বেরিয়েছি কাঁচা বাজার করতে। নাটকের দলে ফিস্ট হলে কতটা মাংস, কতটা আলু, কতটা চাল— এই ফর্দ বাবা বানাতে খুব ভালবাসে। যখনই ফিস্ট হবে বাবা সবার আগে এই দায়িত্ব নিয়ে নেবে। তা বাবার ফর্দ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়েছি তিন জনে। ওদিকে শুভদেব আর পুচু গেছে বিয়ার কিনে ছাদের কোণে লুকিয়ে রাখতে। দলের বড়রা যদি টের পায় আমরা এই সব করছি, তা হলে কাল সকালে হাসপাতালে হাড়ের ডাক্তারের গলায় ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ শুনতে হবে।
টুবাই আর টুঙ্কুকে খাসির দোকানে দাঁড় করিয়ে আমি সরে এলাম এসটিডি বুথে। জানি ঘণ্টাখানেক পর নাটকের দলেই দেখা হবে, তা-ও নিভৃতে যদি এক বার গলা শুনতে পেতাম, দলের ঘরে আর আলাদা করে পাওয়া হয় কোথায়। নাঃ, তুলল না ফোন, ওর দাদার বাজখাঁই গলা শুনে তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দিলাম।
ওদিকে মুদির দোকানের সামনে পৌঁছে দেখি টুবাই আর টুঙ্কুর মধ্যে ঝামেলা লেগে গেছে। মা ওদের কোন চাল কিনতে বলেছে, তাই নিয়ে তর্ক। পাহাড়ি আতপ না বিহারি আতপ, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মুদিকাকুর মতে টুবাই-ই ঠিক। আতপ পাহাড়িই বটে, বিহারি মোটেই নয়। টুঙ্কু হেরে গিয়ে দমে গেল খানিক। আসলে টুঙ্কুর জীবনটাই কষ্টের। ওর দাদার নাম ভুটান, সেই যুক্তিতে ওঁর ডাকনাম ছিল থিম্পু। কিন্তু কলোনির মানুষের উচ্চারণের পাল্লায় পড়ে বর্তমানে টুঙ্কু রূপ ধারণ করেছে। বলা বাহুল্য, ও নিজের এই ডাকনাম বাইরের কাউকে জানাতে পছন্দ করে না, তার চেয়েও বলা বাহুল্য, ওঁর এই ডাকনাম আমরা সবাইকে (বিশেষত মেয়েদের) সুযোগ পেলেই জানিয়ে দিই।
বাড়ি ঢুকতেই মন ভাল হয়ে গেল। দীপকাকু একটা বিশাল পাওয়ারের বাল্ব ছাদে লাগিয়ে দিয়েছে। বঁটি, হামানদিস্তা, ডেকরেটরের স্টোভ, সব মিলিয়ে বাড়ি জুড়ে এক আনন্দময় ব্যস্ততা। খানিক ক্ষণ পর শুভ আর পুচু ঢুকে গেল। চোখের ইশারায় কথা হয়ে গেল— বিয়ার অকুস্থলে রাখা হয়ে গেছে। আমি বাকিদের সঙ্গে হাতে হাতে খুচরো কাজ করছি, এমন সময় সে ঢুকল।
পেস্তা রঙের সালোয়ার, হাতে কাচের চুড়ি। শরৎকাল ঠিক সেই সময় এক টুকরো হাওয়া উপহার পাঠিয়েছিল আমাদের ছাদে। আমাদের মাঝখান দিয়ে পেডেস্টাল ফ্যান নিয়ে বুবনুদা ‘কানেকশন কানেকশন’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেল। শ্রাবণী কি নাচের স্কুল থেকে আসছে? আমার বুকে হাজারটা হাতুড়ির শব্দ, মা কি আমার দিকে তাকিয়ে? আমি স্মার্ট সাজতে গিয়ে গান বাড়িয়ে দিলাম।
বাবা, মলিনকাকু, তাপসকাকু, সবাই নীচের বসার ঘরের আসরে। মাঝেমধ্যে সবাই নীচে নামছে, মিনিট পনেরো পর উপরে উঠছে যখন, সবার হাসি ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। প্রত্যেক বার। আমাদের বয়সিদের গ্রুপে শুভ আর পুচু গাঁজা-ভরা সিগারেট তো টেনেইছে, এমনকি মনকেও খাইয়েছে।
বাবাদের চোখে পড়ার আগেই মনকে আমার ঘরে চালান করা হল, কারণ সে ভুলভাল বকছে। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, আপাতত ‘লাগা চুনরি মে দাগ’ ধরেছে বাবা। চেনা রুটিন, তার মানে ছাদে আসতে আরও আধঘণ্টা। এই হিসেব করে বাকিরা বিয়ার খুলল, আমি আর শ্রাবণী ওদের পাশেই নিজেদের একটা কোণ মতো বানিয়ে নিলাম।
“তার পর, নাচের স্কুল থেকে?”
“তুই কী করে বুঝলি?”
“সন্ধেবেলা দু’বার রিং করে। পাঁচ মিনিট পর পর ফোন করেছিলাম।”
“ও আচ্ছা, তুই নিজে স্কুলে পড়িস বলে আমাকেও স্কুলে ভর্তি করবি? ওটা নাচের স্কুল নয়, আমাদের দল।”
“দেখ, আমি ফার্স্ট ইয়ারের, আর তুই থার্ড ইয়ার। বার বার শোনাস না তো!”
“শোনাব না? বাচ্চা ছেলে?”
“তুই সচিন তেন্ডুলকর আর অঞ্জলির বয়সের ফারাক জানিস?”
“তার মানে?”
“মানে এটা জরুরি নয় যে, সব ভালবাসা পরিপূর্ণতা পাবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেটা ভালবাসা নয়।”
শ্রাবণী বেদম হাসতে হাসতে বলল, “এটা ডায়রেক্ট মহব্বতেঁ থেকে ঝেড়ে দিলি, না? কী নির্লজ্জ রে তুই!”
আমার কান লাল। কোনও মানে হয়? এর আগে ওকে চিঠিতে ‘আজ হোক না রং ফ্যাকাশে, তোমার আমার আকাশে’ লিখে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রেডিট নেওয়ার আগেই ও ফোনে যখন বলল, “এ তো ‘প্রিয় বন্ধু’,” আমি আমতা আমতা করে, “হ্যাঁ তো, তাই তো বলছিলাম” বলে বেরিয়ে গেছিলাম। আজ তো ফোনের আড়াল নেই, কোথায় লুকোব ভাবছি, হঠাৎ বাবাদের দল, অবশ্যই মা আর মনীষা পিসি-সমেত উঠে হইচই জুড়ে দিল। এখন সবাই এক সঙ্গে বসবে, সবাই কিছু না কিছু করে দেখাবে।
এর কিছু ক্ষণ পর শ্রাবণী তখন মিউজ়িক চালিয়ে দারুণ নাচছে, ঝড়ের মতো ঢুকল ইন্দ্রদা। ইন্দ্রদার ছাদে ঢোকার মধ্যে একটা কিছু ছিল, শ্রাবণীর নাচ থেমে গেল। পুচু তড়িঘড়ি সিডি প্লেয়ার বন্ধ করে দিলো। বাবা ঘুরে তাকাল।
ইন্দ্রদা এক জন আশ্চর্য মানুষ। সে আমাদের নাটকের দলের বহু পুরনো সদস্য। আবার আমাদেরও বন্ধু। ইন্দ্রদার সঙ্গে বাবাও সিগারেট খায়, আবার আমিও খাই। ইন্দ্রদা অবশ্য সিগারেট খায় না বললেই চলে। দলের সদস্য হলেও বহু দিন কোনও রোলও করে না। এই দলে ও আসে ভালবেসে, আর ইন্দ্রদাকে নিয়তির মতো ডাকে পাহাড়। আজও ওর রূপকুণ্ডের স্লাইড-শো দেখানোর কথা ছিল। বাবা দু’বার খোঁজও করেছে ইন্দ্রদার। আসছে না দেখে সবাই তালেগোলে ভুলে গেছি।
ইন্দ্রদা যা বলছে, তা বেশ চাপের অবস্থা। ইন্দ্রদার বাবা-মা নেই। দাদার সংসারে থাকে, সেই সংসারেই কাজ করত ভারতীদি। ভারতীদি আমাদের নাটক দেখতে দু’-এক বার এসেছে, কিন্তু তখন আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে, ইন্দ্রদা ভারতীদিকে ভালবেসে ফেলেছে। আজ সবটা জানাজানি হওয়ায় ওদের দু’জনকেই বার করে দিয়েছে ওঁর দাদা-বৌদি। ভারতীদি এখন পাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে এক রাতের জন্য আছে। বাবা সব শুনে দুলতে দুলতে বলল, “কাল সকালে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শুনে কথা হবে। ছেলেরা কষ্ট করে হাজি-র পাঁঠা এনেছে, আগে মন দিয়ে খা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এমনিতেও ছেলেদের জন্য ঢালাও বিছানা ছিল বসার ঘরে। মেয়েরা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘরে মায়ের সঙ্গে। সবাই এক সঙ্গে ঘুমিয়ে উঠে মহালয়া শুনে পদদার দোকান থেকে ঘুগনি-পাউরুটি সেঁকা খাওয়া হবে, এটাই প্ল্যান। কিন্তু পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে গেল, যখন আমার আর দাদার ঘর থেকে মন বেরিয়ে এসে ইন্দ্রদাকে বলল, “ফুইস্কার জল আসে? চোখ ধোব, চক্ষের সুমুখে ইচা মাছ...” এই সময়গুলো আমি আমার দাদাকে আরও বেশি মিস করি, ও থাকলে মন বাইরে আসতেই পারত না। কিন্তু ছ্যামড়া অনসাইটে নাইজিরিয়ায়। যাকগে, ইন্দ্রদার পেটোর সামনে এটা কালীপটকাও নয় বলে বেঁচে গেছিলাম আমরা।
সবাই ঘুমোতে চলে গেছে, আমরা বন্ধুরা উঠে এলাম উপরে। শ্রাবণীর সামনে সিগারেট ছাড়া কিছু খাইনি, এই বার স্বাধীনতা। সবে একটা বিয়ার খুলে গাঁজা-ভরা সিগারেট ধরিয়েছি, দেবীর ছাদে পুনরাগমন। ছাদের আলসেতে ক্লিপ ফেলে গেছিল। সেটা নিতে এসেছে। আমার দুই হাতে দুই বস্তু। ওর পক্ষে সিগারেটের থেকে আমার দুষ্টু সিগারেট আলাদা করা সম্ভব হত না। কিন্তু আমরা ‘দিল চাহতা হ্যায়’ প্রজন্ম, বন্ধুর জন্য জান দিয়ে দেব।
পুচু বলে উঠল, “এ কী রে আমাদের গাঁজা জ্বালিয়ে রাখবার জন্য তুই টানছিস কেন?” শুভ হইহই করে আমার হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিল।
হতাশ হয়ে শ্রাবণী নীচে নেমে যাচ্ছিল, আমি ওর সঙ্গে নেমে এলাম। শ্রাবণী শুধু ভেজা গলায় বলেছিল, “তোকে লুকিয়ে করতে হল কেন নেশা? শাহরুখ বলেছিল না, পেয়ার দোস্তি হ্যায়?”
আমার কাছে চুমু ছাড়া আর কোনও অজুহাত ছিল না।
ওর ঠোঁটই পারে আমার বিয়ারের গন্ধ আর গাঁজার পাপ ধুয়ে দিতে।
মহালয়া এখন
দেখুন, বাসন্তীর যথেষ্ট রমরমা থাকা সত্ত্বেও শারদীয়ার এই যে বাড়বাড়ন্ত, তা শুধু ধার্মিক নয়। রান্নাপুজোর পরে আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠত। শরৎ বাংলাকে চিরকাল হাত ভরে দিয়েছে, তাই অকালবোধনের এই রমরমা। আমাদের হাতে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ভাবে এই সময় টাকা থাকত। মহালয়া মানে মহাজনী নৌকা ভিড়বে ঘাটে, সওদা হবে পমেটম, তাঁতের শাড়ি।
আজ কোথায় সে অবকাশ? মহালয়া সত্যি শুভ না অশুভ? মেয়েটাকে নতুন জামা কিনে দিতে পারব? ছেলেটাকে খাওয়াতে পারব মাটন বিরিয়ানি? অন্তত নবমীতে? না নেই, আমাদের বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাওয়া এই শহরটায় কাজ নেই, টাকা নেই, তাই শরৎ কিছু কিছু বছরে অযাচিত উপদ্রব।
সমস্যাটা যে শরতেরই, তাও জোর করে বলতে পারি না। ঢাকের আওয়াজ চায় আমরা ভাল থাকি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় কাশফুল ছুটির হাওয়ায় দোলে, আমরা মানি বা না মানি, মহালয়া আমাদের মুক্তির পাসপোর্ট নিয়ে আসত। কিন্তু এখন বাংলা মায়ের এই শতচ্ছিন্ন আঁচল ছোট হতে হতে তার সন্তানকে ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের এই রাজ্যের সবচেয়ে বড় শিল্প সম্ভবত এই দুর্গোৎসব— এটাই কি দুর্গতি বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়?
কাজেই শরৎ এখনও আসছে আগের আকাশ নিয়ে, হয়তো আমার পুকুর ঘোলাটে হয়ে গেছে, তাই তাতে আর সেই আকাশের ছায়া পড়ে না।
আমরা এখন
আগের বছরের জানুয়ারি মাস, শুটিং ছিল না। বাড়িতে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। টুবাই ফোন করল, পাগলের মতো কাঁদছে। পুচু মারা গেছে।
মারা গেছে? পুচু? মানে এই সে দিন বলল, “ফ্রি থাকলে বলিস বাবিনদা, বাড়িতে এসে আড্ডা দেব...” এই তো আমি ফ্রি পুচু! পুচু আমাদের সবার থেকে ছোট, এক সমুদ্র হৃদয়। ওর সারল্য ওকে ঠকিয়েছিল প্রচুর, তবু এক দিনের জন্যও ওর হাসিতে পলি পড়েনি। বাবা তো নেই, উঠে যন্ত্রের মতো মায়ের কাছে গেলাম।
“মা, পুচু আর নেই...” বলতে বলতেই টের পেলাম আমার হাঁটু কাঁপছে। তার পর ঘণ্টাদুয়েক সব আবছা। সন্ধের দিকে আমার ঘরে জড়ো হল মহালয়ার রাতের কুশীলবরা, শুধু পুচু নেই। আর হ্যাঁ, শ্রাবণীও নেই, ও এখন দূরদেশে থাকে।
কিছু ক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, সুতো ছিঁড়ে গেছে আমাদের। আজ হঠাৎ এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় আয়নার কাছে পুরনো চেহারা চাইলে তো আর হবে না। সময় বয়ে গেছে, আমরা যে যার কক্ষপথে ছিটকে গেছি।
মহালয়ার সকাল ২০০২
বাবা সকাল-সকাল স্নান করে রেডিয়োর সামনে বসে পড়েছে। বাবার সঙ্গে মহালয়া শোনা একটা অভিজ্ঞতা। স্তোত্রপাঠ করতে করতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলাটা যখন বুজে আসত, আমার বাবার গাল বেয়ে নেমে আসত জলের ধারা। ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শোনার পর বাবা এই অনুষ্ঠানের নানা ইতিহাস আমাদের শোনাত জলখাবার খেতে খেতে। তার ছিল অন্য আকর্ষণ। আগের বার বলেছিল ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’-এর কথা। হ্যাঁ, ১৯৭৬ সালে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ অনুষ্ঠান বদলে দিয়ে নতুন অনুষ্ঠান চালু করার কথা ভাবা হয়। সুরারোপের দায়িত্বে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভাষ্যে উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, সঙ্গে গানে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে... নক্ষত্রখচিত ব্যাপার যাকে বলে। কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ তত দিনে বাঙালির মজ্জায় ঢুকে গেছে। অনুষ্ঠান শেষের আগেই আকাশবাণী ফোন এবং কয়েক দিনের মধ্যে পত্রাঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উত্তমকুমারকে অনুষ্ঠানের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে, তিনি খুব সুন্দর বলেছিলেন, “ঠাকুরঘরকে রেনোভেট করে বসার ঘর করার চেষ্টা করলে যা হয় তা-ই হয়েছে।”
১৯৭৭-এ পুনর্মর্যাদায় ফেরত আসে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। এ-সব গল্প করার সময় বাবার চোখ চকচক করত। আবার কখনও বলত ১৯৬২ অবধি যখন সরাসরি সম্প্রচার হত, কী ভাবে নিজেকে শুদ্ধ রাখতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কেমন মাসের পর মাস পঙ্কজকুমার মল্লিক পড়ে থাকতেন শিল্পীদের পিছনে। হেমন্তকে বম্বে যেতে হয় ১৯৫০ সালে, তিনি দু’দিন রিহার্সাল করে গান গাইতে চেয়েছিলেন। বাণীকুমার বলে দিয়েছিলেন, ও ভাবে এই অনুষ্ঠান হবে না। তাঁর বদলে সুযোগ পেয়েছিলেন তরুণ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, যা তাঁর জীবনের এক বিশিষ্ট ঘটনা।
বাবা যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গল্প বলত, আমার মনে হত বাবা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে স্নান সেরে গরদের পোশাক পরে মাইকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু আজ বাবা কি গল্প বলবে? আজকের পরিবেশ যে বেজায় ঘাঁটা। ভারতীদি আজ হয়তো ট্রেন ধরে দেশের বাড়ি কাকদ্বীপ চলে যাবে। ইন্দ্রদা আমাদের সঙ্গে থাকলেও কাল রাতে ঘুমোয়নি, তা আমরা সবাই জানি। এটাও বুঝতে পারছি ইন্দ্রদার মন এখানে নেই, বাবা বলেছে বলে বাধ্য হয়ে আমাদের সঙ্গে রয়েছে। ইন্দ্রদার মুখ থমথমে, মা’র তদারকিতে সবাই চা নিয়ে বসে পড়লাম ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শুনতে। পুরোটা শুনে আমরা চুপচাপ ঘুগনি-পাউরুটি খাচ্ছি, দীপকাকু পদদার দোকান থেকে এনে দিয়েছে।
বাবা মহিষাসুরমর্দ্দিনীর গল্প বলতে শুরু করল। মহিষাসুর বধকে কেন্দ্র করে বাণীকুমারের লেখা আলেখ্যে সুর করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। তাঁর নাম ছিল শারদীয়া বন্দনা, তা প্রথম শোনানো হয়েছিল আজ থেকে ঠিক নব্বই বছর আগে ষষ্ঠীর সকালে। ঝামেলা বাধে ১৯৩৪-এ মহালয়ার সকালে এর প্রচার নিয়ে। পিতৃতর্পণ হওয়ার আগেই এক অব্রাহ্মণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠ শুনতে অনেকে নারাজ। এই বার আসরে নামলেন লেখক স্বয়ং। বাণীকুমার সটান বলে দিলেন, যদি তাঁর লেখা আলেখ্য কেউ পাঠ করে, তা হলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই করবেন। আর কেউ নন। পণ্ডিতগণ ব্যাকফুটে। কারণ বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, তাঁর লিখিত আলেখ্যটিও নিখুঁত। এই লড়াইতে তিনি পাশে পেলেন আকাশবাণীকে। ১৯৩৬-এ এর নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। ১৯৩৭ থেকে পাকাপাকি ভাবে মহালয়াতে এর সম্প্রচার শুরু হয়। একে ঘিরে গড়ে ওঠে এক অমর ত্রিবেণীসঙ্গম— “মহিষাসুরমর্দ্দিনী! রচনা ও প্রবর্তনা, বাণীকুমার; সঙ্গীত সৃজন, পঙ্কজকুমার মল্লিক; গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তোরা বুঝতে পারছিস, বাণীকুমার যদি সে দিন পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াত, আমরা আজকের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ পেতাম না। সবটাই বিশ্বাস!”
বাবা ইন্দ্রদার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কী চাস? তোর পাহাড় আছে। চাকরি-বাকরির কোনও ঠিক নেই। তুই নিতে পারবি ভারতীর দায়িত্ব?”
ইন্দ্রদা একটু থমকাল, তার পর বলল, “পারব। আমার শুধু ছ’টা মাস সময় লাগবে।”
মা বলল, “ছ’মাসে কী হবে?”
“বন্ধুর সোর্সে মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ-এর কাজে অ্যাপ্লাই করেছি, হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে থিতু হয়ে বসতে মাস ছয়েক লাগবে,” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল ইন্দ্রদা।
“বেশ, তা হলে সেই ছ’মাস ভারতী আমাদের বাড়িতে থাকবে।”
মা’র গলায় দেবীপক্ষের গন্ধ।
“ব্যস, তবে তো সমাধান হয়েই গেল। বাবিন, তোরা গিয়ে ভারতীকে নিয়ে আসবি, কেমন?”
ইন্দ্রদা হতভম্ব হয়ে গেছে। আমরা ইন্দ্রদাকে ঘিরে লাফাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে পুচু।
সে হয়েছিল বটে এক মহালয়া আমাদের।
আবার আসছে মহালয়া। আমি সত্যিই জানি না, মহালয়া আজ মিথ হয়ে যাওয়া আমাদের এক ধারণা কি না। কিন্তু এটা আমি জানি, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ আমাকে যথারীতি পাভলভের কুকুর বানিয়ে দেবে। যতই দুঃখী হোক, প্রেমিকাকে সাজাতে কার না ভাল লাগে? তাই আমার শহরও সেজে উঠবে আলোয় আলোয়। যথারীতি পায়ে ফোস্কা পড়া এক যুবতীর হাতে চটি নিয়ে রাস্তা পেরনো দেখে মনে পড়বে নিজের ফেলে আসা কোনও দৃশ্য। আমার ছেলে জাপানি কার্টুন নারুতো-র আদলে পোশাক পরবে বলেছে পুজোয়, আমি দিতে চাইনি। মা বলল, অ্যালবাম থেকে আমার ‘শক্তিমান’-এর পোশাক পরে অঞ্জলি দেওয়ার ছবি সহজকে দেখিয়ে দেবে।
কোনও মানে হয়?
আমার সব বন্ধু বিদেশে। কেউ শিকাগোয়, কেউ সান ফ্রান্সিস্কোতে। ওরা এক মাস হল সপ্তাহান্তে মণ্ডপ তৈরি করছে। মহালয়ার সকালে ওরা ওদের সময়ের ভোরে উঠে পড়ে, চালিয়ে দেয় ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। হয়তো তা আকাশবাণী নয়, অ্যালেক্সা, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে আসা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠসম্পদ আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যেতে চাই। এতে আমাদের সবার অধিকার।
পুচু আর নেই। আমরা সবাই ছিটকে গেছি। কিন্তু এটাও সত্যি, আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। এই এক সঙ্গে থাকতে পারাটাই তো উৎসব। এক সঙ্গে হতে পারাটাই মহালয়া। আমাদের যাবতীয় আনন্দ তো বন্ধুর বুকপকেটে রাখা। বন্ধুর সঙ্গে যে কোনও পুজোর উটকো স্টল থেকে এগরোল-চাউমিন খাও, কিচ্ছু হবে না।
মনে আছে, আমরা হইহই করে ভারতীদিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম ইন্দ্রদার বন্ধুর বাড়ি থেকে। ইন্দ্রদার থিতু হতে মাস ছয়েকের বেশি লেগেছিল, পরের জুনে ওদের বিয়ে হয় আমাদের বাড়িতেই। ভারতীদির পিঁড়ে বওয়া থেকে বিয়ের যাবতীয় কাজে সবার আগে ছিল পুচু। আমাদেরও উৎসাহ কম ছিল না।
আমাদের সিলেবাসে দৌড় ছিল, কিন্তু একটু স্থির হয়ে আকাশ দেখা ছিল না। এখন যেন জগৎজোড়া এক ট্রেডমিল চলছে, পা দিলেই দৌড় শুরু। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, থামার বোতাম আমার হাতে নেই। তাই হাঁপাতে হাঁপাতে জিভ বেরিয়ে গেলেও এই দৌড়কে আমি নিজেই আমার নিয়তি বানিয়ে নিয়েছি। আমার এই দৌড়ের ফাঁকে পার হয়ে যাচ্ছে চেনা পাড়া, মানুষজন, আত্মীয়, বন্ধু, মহালয়া, দোল, পয়লা বৈশাখ। আনন্দ চকচক করছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। শেষ করি তারাপদ রায়ের একটি কবিতা দিয়ে—
অনেকদিন দেখা হবে না।
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু’জনেই দু’জনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয়নি।’
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তার পর একদিন হয়ত জানা যাবে
হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)