Advertisement
E-Paper

অঙ্কে ভুল করলেও পিঠে ধাঁইধপাধপ নয়

বরং ছাত্রের ভুলটা ডাস্টার দিয়ে মুছে ফের তাকে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলতেন মা সারদার মন্ত্রশিষ্য কেশবচন্দ্র নাগ। রাত পোহালেই মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা, বাঙালির স্মৃতিতে অঙ্কভীতি আর কে সি নাগ সমার্থক। বাঙালি অঙ্ক শুনলেই যাঁকে গড় করে, সেই কে সি নাগকে নিয়ে লিখব শুনে এক সহকর্মী বলেছিলেন, একটু জিজ্ঞেস কোরো তো ওঁর বাড়ির লোকেদের, এত কঠিন কঠিন অঙ্ক উনি কী করে বানাতেন?

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১
ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

এটা বাংলা কত সাল? ১৪২৫। আর উনি জন্মেছিলেন ১৩০০ সালে, ঠিক ১২৫ বছর আগে। ‘রাউন্ড ফিগার’ হলে কত সহজ হয়ে যায় যোগ-বিয়োগগুলো! অথচ ওঁর অঙ্কগুলো দেখো, দাঁত ফোটানো যায় না এমন সংখ্যা, বিটকেল ভগ্নাংশের হিসেবপত্তর। চৌবাচ্চায় দুটো নল, একটা দিয়ে অমুক সময়ে তমুক বেগে জল ঢুকছে, তমুক বেগে অমুক সময়ে বেরোচ্ছে। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে-নামতে বাঁদরটা কাহিল। মুদির চালে কাঁকর, গোয়ালার দুধে জল মেশানোর নিদারুণ অনুপাত। সমান্তরাল রেললাইনে কত ট্রেন আসছে-যাচ্ছে, কত স্টেশনে দেখা কতশত রেলগাড়ির। ওদের নিয়ে আঁক কষার কী আছে! ‘সরল’ যদি এতই জটিল, তা হলে তাকে আর সরল বলা কেন? প্রশ্নগুলো রামকঠিন, উত্তর অজানা।

বাঙালি অঙ্ক শুনলেই যাঁকে গড় করে, সেই কে সি নাগকে নিয়ে লিখব শুনে এক সহকর্মী বলেছিলেন, একটু জিজ্ঞেস কোরো তো ওঁর বাড়ির লোকেদের, এত কঠিন কঠিন অঙ্ক উনি কী করে বানাতেন? যাঁরা গল্প-উপন্যাস লেখেন, তাঁদের নাহয় মাথায় একটা প্লট, চরিত্র থাকে। ছবি আঁকতে গেলে তুলির আঁচড়েরও আগে কল্পনা লাগে। কিন্তু এমন কঠিন সব অঙ্ক ‘লিখতে’ পারার পিছনে কোন কল্পনা, কোন বাস্তব কাজ করেছিল কে সি নাগ, কেশবচন্দ্র নাগ নামের মানুষটির?

প্রশ্ন শুনে হাসেন ত্রিদিবেশ নাগ। এই প্রশ্ন তাঁকেও বিদ্ধ করেছে স্কুলবেলায়। ‘‘বন্ধুরা বলত, তোর দাদু এত কঠিন অঙ্ক কী করে বানালেন! অঙ্ক ক্লাসে সবার আলাদা নজর, আমি কে সি নাগের নাতি বলে কথা! তবে দাদু খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন অঙ্ক। মনে আছে, ভলিউম আর পেরিমিটারের অঙ্ক শিখিয়েছিলেন। একটা কাগজের বৃত্ত থেকে একটা স্কোয়্যার কেটে নিতে বললেন কাঁচি দিয়ে। তার পর বললেন, এ বার তুমিই ভেবে বলো, ভলিউম আর পেরিমিটার কোনটার কী হল। কোনটাই বা বাড়ল, কোনটা কমল। আজ যখন টিভি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অঙ্ক শেখার বিকল্প ও রোমাঞ্চকর পদ্ধতির টিউটোরিয়াল-অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখি, আমার তখন দাদুর কথা মনে পড়ে। সেই কবে আমাকে ‘অন্য রকম’ ভাবে অঙ্ক শিখিয়ে গেছেন!’’

দুজনে: তাজমহলে সস্ত্রীক কে সি নাগ। ছবি সৌজন্য: ত্রিদিবেশ নাগ।

হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে একটা ছবিওয়ালা জোক খুব হিট। এক বন্ধু পাঠাল এই সে দিনও। উপরে কে সি দাসের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা বানানোর জন্য বিখ্যাত। তলায় কে সি নাগের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা পাওয়ানোর জন্য বিখ্যাত! বঙ্গভূমি গণিতক্ষেত্রে বহু প্রতিভার জন্ম দিয়েছে, এই নিয্যস সত্যটাকে কী ভাবে যেন চাপা দিয়েছে বাঙালির অঙ্কভীতি, ভয়ঙ্কর হিন্দি বলা আর পেটের অসুখের পরম্পরা। শেষের দুটো নিয়ে যদি বা তাও ঘর করা যায়, অঙ্কে গোল্লার ভয় যে কত বাঙালি সন্তানকে আন-কেরিয়ারমুখো করেছে, গুনে থই পাওয়া যাবে না। আর সেই সাংঘাতিক ভয়েরই প্রতিশব্দ— কেশবচন্দ্র নাগ!

ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন, যে স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই ও পরে হেডমাস্টারও ছিলেন কে সি নাগ, সেখানকার চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক কি তার পরের দিকের ছাত্ররা কিন্তু জোর প্রতিবাদ করবেন। খোদ কে সি নাগের অঙ্ক ক্লাস করেছেন তাঁরা, জানেন, অঙ্ককে কেমন সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন মাস্টারমশাই। কেমন ছিল সে পদ্ধতি? ক্লাসে এসে গম্ভীর গলায় বলতেন ‘সিমপ্লিফাই’, আর মুখে বলতে বলতে বোর্ডে লিখে দিতেন অঙ্কটা। তার পর কোনও ছাত্রকে ডেকে বোর্ডে কষতে বলতেন। পুরোটা করতে দিতেন, ভুল করতে দিতেন। তার পর ভুল-হওয়া অংশটুকু চিহ্নিত করে, মুছে দিয়ে, ঠিক পথে নিয়ে যেতেন অঙ্কটাকে। একটা অঙ্ক ঠিক হলেই হল না। একই রকম, বা একই গোছের আরও অঙ্ক তক্ষুনি করতে দিতেন। এতে ছাত্রদের মনে অঙ্কগুলো করার তরিকা, বা এ ধরনের অঙ্কে যে যে জায়গায় ভুল হতে পারে সেগুলো গেঁথে থাকত, তারা আর ভুল করত না। বীজগণিত নয়, পাটিগণিতের পদ্ধতিতে সমাধান করতে বলতেন— তাতে যুক্তির বোধ বাড়ে। সোজা থেকে ক্রমশ কঠিন, এই ভাবে অঙ্ক করাতেন। কে সি নাগের বই থেকে অঙ্ক করা ছাত্রমাত্রেই জানে, অনুশীলনীর গোড়ার অঙ্কগুলো সোজা, পঁচিশ-তিরিশ দাগের পর থেকে জব্বর কঠিন। কিন্তু ওঁর ক্লাসে অঙ্ক শিখেছে যারা, তাদের কাছে জলভাত। অঙ্ক তো অঙ্ক নয়, ভালবাসা। দৈনিক বসুমতীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অঙ্ক কি জুজু না কি? ভালবাসলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যায়।

এত ভাল অঙ্ক কষা নিজে শিখলেন কী করে? কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম, যা শুনে স্বয়ং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে নিয়ে এলেন সে কালের কলকাতার গর্ব মিত্র ইন্সটিটিউশনে? আবারও ফিরে যাই হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া কে সি নাগ-কথায়। ছোট্ট ছেলে কেশবকে কাকা মুখে মুখে ধরছেন পৌনে তেরোর নামতা। ছেলেও বলছে ঠিক, নির্ভুল। বা, ছোটবেলার কেশব দেখছে এক ফড়ে আর আড়তদারের ইলিশের দরদস্তুর। গুঁফো আড়তদারবাবুটি ফড়েকে জিজ্ঞেস করছেন, ইলিশের মণ দেড়শো টাকা হলে একটা আড়াইসেরি ইলিশের দাম কত পড়বে? ঠোঁটের গোড়ায় নিশপিশ করতে থাকা উত্তর ফস করে দিয়ে বসছে গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা বালক কেশবচন্দ্র— ন’টাকা ছ’আনা! গোঁফবাবু ছেলের নামধামইস্কুল জেনে নিয়ে বলছেন, স্কুলের হেডস্যরকে আমার নাম বোলো, ‘আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’, পড়াশোনার খরচা মায় বইখাতাটাও ফ্রি হয়ে যাবে!

রটে যা তা সব সত্য নয়। এই সবই কে সি নাগকে ঘিরে কিংবদন্তি। আসল মানুষটা কলকাতা এসেছিলেন বড় হয়ে কলেজে ভর্তির সময়। উঠেছিলেন মির্জাপুর স্ট্রিটে বড়দা সত্যচরণ নাগের মেসে, ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন রিপন কলেজে (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। তাঁর স্কুলবেলাও গোলাপগন্ধী নয়। বর্ধমানের গুড়াপের ছেলে সিক্স অবধি পড়েছেন গ্রামেরই ইস্কুলে, পরের দু’বছর তিন মাইল দূরের ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর স্কুলে। রোজ তিন-তিন ছ’মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা। রাস্তাও বলিহারি, গ্রীষ্মে এক পা ধুলো, বর্ষায় হাঁটু-ডোবা কাদা। শীতের বেলা বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যেত সন্ধেয়। এক দিন সন্ধেয় নির্জন পথে হেঁটে ফিরছেন, হঠাৎ খটাস খটাস শব্দ। যত এগোনো, শব্দও বাড়ে। নির্ঘাত ভূত! ছেলে তো পায়ের চটিজোড়া খুলে দে দৌড়! তার পরেই বোঝা গেল শব্দরহস্য। চলতি পথে চটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল ছোট ছোট নুড়ি, পা ফেলতে তারাই এক-একটা বেরিয়ে আসছিল ছিটকে, আর শব্দ হচ্ছিল ও রকম। ইস্কুলবেলার সেই ঘটনাই নাকি পরে তাঁর বইয়ের বিখ্যাত ‘টাইম অ্যান্ড ডিসট্যান্স’-এর অঙ্কগুলোর শেকড়!

জীবন তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বিচিত্র পথে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন কিষেনগঞ্জের স্কুল থেকে। তাঁর মেজদা তখন কাজের সূত্রে সেখানে। এই মেজদা, পরে কলকাতায় থাকা বড়দা একে একে মারা গেলে কেশবচন্দ্রের উপরেই এসে পড়ে সংসারের ভার। ভবিষ্যতের প্রবাদপ্রতিম অঙ্কশিক্ষক খুব কম বয়সে স্কুলশিক্ষকতার চাকরি নেন। গোড়ায় নিজের পড়া দুই স্কুলে, পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে চাকরি পাওয়াও এক গল্প। সে আমলে বহরমপুরের বিখ্যাত স্কুলটির হর্তাকর্তা ছিলেন সাহেবরা। কেশবচন্দ্রের ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে। সাহেবরা চমৎকৃত হয়েছিলেন ছিপছিপে তরুণের আচরণের ঋজুতায়। ভাল মাটি, জল-হাওয়া পেলে প্রতিভাও বাড়ে তরতরিয়ে, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ স্কুল থেকেই নাম ছড়িয়েছিল তরুণ শিক্ষক কেশবচন্দ্রের। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ঘরের ছেলেদের টিউটর নিযুক্ত করেছিলেন তাঁকে। তাঁর জন্য খুলে দিয়েছিলেন রাজবাড়ির বিশাল লাইব্রেরি। তাতে কতশত বিজ্ঞানের বই, দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা! কেশবচন্দ্র পরে বলেছিলেন, পরে অঙ্কের বই লেখার সময় কাজে দিয়েছিল সেই বই-ভরা লাইব্রেরিতে তন্নিষ্ঠ পাঠস্মৃতি।

১৯২৪ থেকে ১৯৬০, ‘মিত্র স্কুল’ দেখেছিল এক জীবন্ত কিংবদন্তিকে। শুধু কে সি নাগ কেন, বিখ্যাত সব মাস্টারমশাইরা তখন পড়ান মিত্র ইনস্টিটিউশনে। ম্যাট্রিকে প্রথম দিকের র‌্যাঙ্কগুলো বাঁধা থাকত স্কুলের ছেলেদের, পূর্ণ সিনেমাহলের কাছে মিষ্টির দোকানের বিখ্যাত ‘মাতৃভোগ’ রেজ়াল্টের দিন নাম পাল্টে হয়ে যেত ‘মিত্রভোগ’। কোন মাস্টারমশাইদের শ্রমের ফসল ঘরে তুলত ইস্কুল? বাংলায় কবিশেখর কালিদাস রায়, সংস্কৃতে পণ্ডিত জানকীনাথ শাস্ত্রী, ভূগোলে যতীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, আর্টে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী! কবিশেখরই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন অঙ্কের বই লেখার কথা। তোমার ক্লাস ছেলেরা গোগ্রাসে গেলে, তুমি বই লিখবে না?

কেশবচন্দ্র কলকাতায় থাকতেন ভবানীপুরের ১২ নম্বর রসা রোডের মেসে, সেখানে বসেই লিখে ফেললেন পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ‘নব পাটীগণিত’। পরে পরিচয় ক্যালকাটা বুক হাউস-এর কর্ণধার পরেশচন্দ্র ভাওয়ালের সঙ্গে। এক দিন তিনি কেশবচন্দ্রের ঘরে এসে দেখেন, টেবিলের উপরে মোটা একটা খাতায় পাতার পর পাতা জুড়ে অঙ্ক। শুধু অঙ্কই নয়, কোন অঙ্ক কী ভাবে, কত রকম ভাবে করা যাবে, গুছিয়ে লেখা। পরেশবাবু চাইলেন সেই খাতা, বই আকারে ছাপবেন। কেশবচন্দ্র কিছুতেই দিতে রাজি নন, ছেলেমেয়েরা অঙ্ক শেখার আগে অঙ্কের ‘মানে বই’ হাতে পেলে বিপদ। পরেশবাবু বোঝালেন, অঙ্কের শিক্ষকদের জন্য এ খুবই দরকারি বই হবে, তাঁদের জন্য অন্তত প্রকাশ করা দরকার। রাজি হলেন কেশবচন্দ্র। ১৯৪২-এ বেরোল ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। ‘নব পাটীগণিত’-এর মতোই, মার্কেট ও মন, দুই-ই জয় করল তা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোট ৪২টা বই লিখেছেন, ‘অঙ্কের বই মানেই কে সি নাগ’ লব্‌জ হয়ে গিয়েছে তত দিনে।

এবং এখনও। ‘‘দাদুর বই বিদেশে পাঠাতে হয় আমাকে ক্যুরিয়ার করে,’’ হাসছেন ত্রিদিবেশ। তাঁর উপরেই এখন ‘নাগ বুক হাউস’ তথা কে সি নাগের যাবতীয় বই এই সময়ের উপযোগী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুভার। কাদের পাঠান বই? ‘‘ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালিরা যোগাযোগ করেন। তাঁরা নিজেরা কে সি নাগ পড়েছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে অঙ্ক শেখাতে যে এই বইয়ের বিকল্প নেই, জানেন।’’ বড় জেঠু, কেশবচন্দ্রের বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ ত্রিদিবেশকে বলেছিলেন এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা। উপযুক্ত পরিমার্জন, পরিবর্ধন, নতুন সংস্করণ, কাজ অনেক। ‘‘আমি ছোটবেলায় দাদুকে দেখেছি নিজের বইয়ের প্রুফ দেখছেন অখণ্ড মনোযোগে। বয়স নব্বই পেরিয়েছে, তখনও!’’

অঙ্কের মাস্টারমশাই মানেই রাগী, গম্ভীর, নীরস একটা অবয়ব মনে পড়ে সবার। কে সি নাগও কি তেমনই ছিলেন? বকুনি দিতেন? মারতেন? মিত্র ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তনীদের স্মৃতিচারণে তাঁদের ‘স্যর’-এর বর্ণনা আছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে, গায়ে আলোয়ান, খদ্দরের পাঞ্জাবি-ধুতিতে গটগট হাঁটতেন। ক্লাসে অঙ্ক না পারলে ‘গাধা’ সম্বোধন বিরল ছিল না, তা বলে পিঠে ধাঁইধপাধপ নয়। কারণ অঙ্ক কী কায়দায় শেখানো হচ্ছে তা তো বলাই হল! হেডমাস্টারের ঘর থেকে খেয়াল রাখতেন, পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে কোন ছেলে কত কড়া ট্যাকল করছে। পরে ডেকে পাঠিয়ে অভিনব শাস্তি: স্কুলের পিছল উঠোন পরিষ্কার, দু’দিন প্যারালাল বার প্র্যাকটিস, বা জ্যামিতির রাইডার সল্‌ভ করতে হবে! ক্লাসে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত তাঁর রসবোধের ঝলক। একটি বৃত্তের কেন্দ্র O থেকে বৃত্তের পরিধির উপরে একটি বিন্দু X পর্যন্ত রেখা টেনে জিজ্ঞেস করছেন, তা হলে এটা কী হল? ‘একটি ব্যাসার্ধ’, ‘OX ব্যাসার্ধ’, ‘কেন্দ্র O থেকে X বিন্দু পর্যন্ত OX ব্যাসার্ধ’, নানান উত্তর এল। কিছুতেই খুশি নন। বললেন, ‘‘O X যোগ করে হল অক্স, মানে ষাঁড়!’’ এক দিন ক্লাসে নিজের বইখানা ছাত্রদের দেখিয়ে বললেন, এই বইটা পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে আমার কত লাভ থাকবে, বল। ছাত্ররা সবাই বইয়ের দাম জানে, তিন টাকা। সমস্বরে উত্তর, দু’টাকা লাভ! মাস্টারমশাই বললেন, হল না। পাঁচ টাকা। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, সে কী! ‘‘আমাকে তো আর বইটা কিনতে হয়নি, তাই পাঁচ টাকাই লাভ!’’ বলেই মুচকি হাসি। এক বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন, ছেলেটির মাথায় কিছুতেই অঙ্ক ঢোকে না। পাশ দিয়ে ছাত্রের বাবা যাচ্ছিলেন, মাস্টারমশাইকে সৌজন্য-প্রশ্ন করলেন, ছাত্রের পড়াশোনা কেমন বুঝছেন? কেশবচন্দ্রের উত্তর, কালীপুজো আসছে, দেখবেন যেন এ বাইরে বেরিয়ে না যায়, মায়ের সামনে বলি দিয়ে দেবে! সহাস্য অভিভাবক মাস্টারমশাইকে ‘লাঠ্যৌষধি’র প্রয়োগ করতে বলে পা বাড়ালেন।

ঘরে ছেলে-বৌমা, নাতিনাতনিদের কাছের মানুষ। নাতনি রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের কত যে সুখস্মৃতি দাদুকে ঘিরে! আদিগঙ্গার কাছে গোবিন্দ ঘোষাল লেনের বাড়িতে তখন ডিসি কারেন্ট। লোডশেডিং হত নিয়ম করে। কারেন্ট যাওয়া মানেই দাদুর কাছটি ঘেঁষে শুয়ে পড়া, ওঁর হাতপাখার বাতাস খাওয়া যাবে! মজার মজার গল্পও বলতেন। একটা হাতি কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না, কে ঘুম পাড়াতে পারবে? একটা লোক এসে বলল, আমি পারব। ছ’টা টুল, ছ’টা লোক, ছ’টা বই চাই। গোল করে ছ’টা টুল পেতে, একটা করে লোক বসিয়ে দিল সে, তাদের হাতে ধরিয়ে দিল বই, বইয়ের পাতা বাইরের দিক করে খোলা। হাতি এল, ঘুরে ঘুরে সবার হাতে খোলা বইয়ের পাতা দেখল, তার পরেই ধপাস শুয়ে পড়ে ঘুম! খোলা বই দেখলেই সব্বার ঘুম আসে, এ তো জানা। হাতি কোন ছার!

এ এক অন্য কে সি নাগ। ইনি উত্তম-সুচিত্রার ছবির ভক্ত, নাতনিকে নিয়ে হল-এ গিয়ে ছবি দেখে আসেন। মোহনবাগান ক্লাবের কট্টর সমর্থক। ওঁর আর এক নাতি বলছিলেন, মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্যতালিকায় এক নম্বরে গোষ্ঠ পাল, আর দ্বিতীয় নামটা জানেন? কেশবচন্দ্র নাগ! মারাদোনাকে নিয়ে যে বার বিশ্বকাপে হইহই, আমার হাতে চেক লিখে দিলেন, দোকান থেকে নতুন টিভি কিনে আনার জন্য। এক পুত্রবধূ জানালেন, এমনও হয়েছে, মোহনবাগান ম্যাচ হারলে সে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন। মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন, গজা খুব প্রিয় ছিল। রথের দিন জন্মেছিলেন, প্রতি বছর রথে সন্ধেয় নাগবাড়ির ঘরোয়া স্মরণসভা শেষে আজও সবার জন্য একটা করে গজা বাঁধা। জন্মদিনে ওঁর ছাত্রেরা আসতেন বাড়িতে। অভিনেতা বিকাশ রায় আসতেন গোলাপের তোড়া নিয়ে। যত বছরের জন্মদিন, ততগুলো গোলাপ। ওঁর ছাত্রতালিকায় আছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সকলের স্মৃতিময় লেখাপত্তরে ভরে আছে মাস্টারমশাইয়ের কথা।

যশোবৃত্তের বাইরে, অন্তরঙ্গ পারিবারিকতা পেরিয়েও তো আর একটা মানুষ থাকে। ভিতরের মানুষ। সেই কে সি নাগকে জানলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। মা সারদার কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের জপ করে দেওয়া মালা, কাপড়ের উপরে আলতা বুলিয়ে নেওয়া পদচিহ্ন ছিল তাঁর সারা জীবনের সম্পদ। জপ করতেন রোজ। গুড়াপের প্রতিবেশী জিতেন্দ্রনাথ রায়— পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অষ্টম অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ— ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। তরুণ কেশবকে তিনিই দেখিয়েছিলেন কর্মযোগের দিশা। স্কুল, লাইব্রেরি, রাস্তা, সেবা সংস্থা তৈরি করে কেশবচন্দ্র পাল্টে দিয়েছেন গুড়াপকে। দুজনের মধ্যে অসংখ্য পত্রবিনিময় কেশবের অধ্যাত্মজীবনের সাক্ষী। বিবেকানন্দের আর এক গুরুভাই, স্বামী অভেদানন্দের স্নেহভাজন ছিলেন কেশবচন্দ্র। ওঁর বক্তৃতার নোট নেওয়া, বঙ্গানুবাদের কাজও করেছেন। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার ‘শিব ও বুদ্ধ’! আর ছিল নিজের এক খাতা। নাম ‘রত্নবেদী’। খুলতেই প্রথম পাতায় কয়েক লাইনের স্বরচিত কবিতা, নীচে লেখা ‘বিনা অনুমতিতে প্রাইভেট পাঠ নিষিদ্ধ’। ওঁর পরিবারের অনুমতিক্রমে হাতে নিয়ে দেখেছি সেই খাতা। পাতায় পাতায় গীতা, চণ্ডী, শিবস্তোত্র, রামনাম, খণ্ডনভববন্ধন, শ্রীমাকে নিয়ে লেখা কবিতা ‘টু মাদার্স ফিট’, ‘নৈবেদ্য ও কালীপূজার দ্রব্যাদি’, বেদান্তদর্শন। তারই পাশে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বক্তৃতা, ‘দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘ফিলসফি অব রবীন্দ্রনাথ’, বিপিনচন্দ্র পালের ‘দ্য সোল অব ইন্ডিয়া’, ‘লেকচার নোটস’। বুঝ মন যে জান সন্ধান!

আর কষ্ট, যন্ত্রণা? ত্রিদিবেশের জন্মের আগেই মারা যান তারাপ্রসাদ নাগ, কেশবচন্দ্রের ছোট ছেলে। যশস্বী মানুষটিকে ছেড়ে কথা বলেনি পুত্রশোক। তার বছরখানেকের মধ্যেই মারা যান স্ত্রী লক্ষ্মীমণি, যিনি সংসার সামলাতেন বলে স্কুল, বই লেখা আর হাজারটা কাজ করতে পেরেছেন কাজপাগল শিক্ষক। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বলেছিলেন, আই লস্ট মাই ফ্রেন্ড। ব্যক্তিগত বেদনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন বলেই এক-এক জন মানুষ বুঝি সমষ্টির হয়ে যান। কে সি নাগ যেমন হয়ে উঠেছেন গোটা বাঙালি জাতির অঙ্কের মাস্টারমশাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রদের, অন্য মানুষেরও। রসা রোডের মেসে থাকার সময় খেতেন জগদ্বন্ধু ভোজনালয়ে, তার মালিক আঁক কষায় দড় নয় বলে পাইকাররা টাকায় জল মেশাত। তাকেও হিসেব করা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর কেউ ঠকাতে পারেনি। সেই মালিকের ছেলে, হোটেলের বর্তমান মালিকও মাথায় হাত ঠেকান ‘মাস্টারবাবু’র নামে। তাঁর জীবনের অঙ্কও যে মিলিয়ে দিয়েছেন কে সি নাগ। রাত পোহালে কাল মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা, ও সব প্রশ্ন তো জলভাত!


কৃতজ্ঞতা: ত্রিদিবেশ নাগ, অসিতবরণ গিরি

KC Nag Keshab Chandra Nag Mathematician
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy