E-Paper

স্লাইডের ছবি তুলতে দিয়েই শিকার হলেন চরম প্রতারণার

এই হতভাগ্য চিকিৎসক মার্তে গুচিয়ে। গত শতকে ‘ডাউন সিনড্রোম’ নামে এক বিশেষ ব্যাধির কারণ আবিষ্কার করেও তিনি পাননি প্রার্থিত সম্মান। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ।

কৃষ্ণা রায়

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৫ ০৮:০৯
ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

জানুয়ারি, ২০১৪। গ্যারন নদীর ধারে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রধান বন্দর-শহর বর্দোর উপকণ্ঠে সাদামাটা একটি হোটেলে অষ্টাশি বছর বয়সি এক ফরাসি চিকিৎসক মন দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছিলেন। পরনে ছিমছাম স্কার্ট আর টপ। দিনটি তাঁর কাছে খুব অন্য রকম। ‘ফ্রেঞ্চ ফেডারেশন অব হিউম্যান জেনেটিক্স’ (এফএফজিএইচ) আয়োজিত এক ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞান সমাবেশে তিনি আমন্ত্রিত। একটি বিশেষ বিষয়ে বলবেন তিনি, আর সভা শেষে বিশ শতকের বিজ্ঞান-গবেষণায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দেওয়া হবে একটি মেডেল। কিন্তু সে দিন এক বিশেষ আইনি জটিলতার কারণে তিনি না পারলেন ভাষণ দিতে, না পেলেন সেই মেডেল। হতাশ চিকিৎসক তখন দুঃখ করে বলেছিলেন, “আয়্যাম হার্ট অ্যান্ড সাসপেক্ট ম্যানিপুলেশন, আই হ্যাভ দ্য ফিলিং অব বিয়িং দ্য ফরগটন ডিসকভারার।”

এই হতভাগ্য চিকিৎসক মার্তে গুচিয়ে। গত শতকে ‘ডাউন সিনড্রোম’ নামে এক বিশেষ ব্যাধির কারণ আবিষ্কার করেও তিনি পাননি প্রার্থিত সম্মান। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ।

ডাউন সিনড্রোমের কথা অবশ্য জানা ছিল ১৮৬৬ সাল থেকে। জন লংডন ডাউন নামে এক ব্রিটিশ চিকিৎসকের সূত্রে। আমাদের চার পাশে মাঝে মাঝে এমন কিছু মানুষ দেখতে পাওয়া যায়, যাঁদের মুখের গড়ন কিছুটা চ্যাপ্টা, ছোট্ট ঘাড়, ছোট ছোট হাত পা আর কিছুটা তেরছা চোখ, বুদ্ধিতে কিছুটা খাটো, দেহ-মনের বাড়-বৃদ্ধির অনেক মাইলস্টোন বেশ দেরিতে আসে— যেমন, বসা, হামাগুড়ি দেওয়া, হাঁটা, কথা বলা ইত্যাদি। এঁরাই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষ। এই রোগের আসল কারণ যে দেহকোষের ক্রোমোজ়োম সংখ্যার পার্থক্য, সে কথা তরুণী বয়সে প্রথম আবিষ্কার করেন মার্তে। ক্রোমোজ়োম-ঘটিত ব্যাধির প্রথম প্রমাণ তিনি দিলেও আবিষ্কারের কৃতিত্ব পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি পাননি, সেটি পেয়েছেন তাঁরই সহকর্মী এক পুরুষ-গবেষক, জেরোম লেজিউঁ।

কৃষক-পরিবারের মেয়ে মার্তে পেশায় ছিলেন এক জন শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ। ১৯২৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। প্যারিসের কাছে একটি খামারবাড়িতে, আরও ছ’টি ভাই-বোনের সঙ্গে কাটে প্রথম জীবন। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের নিয়ে মার্তের বেশ আগ্রহ ছিল। সতেরো বছর বয়সে ক্যাথলিক মেয়েদের জন্য একটি বোর্ডিং স্কুল থেকে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্যারিসে ডাক্তারি পড়তে যান। ফ্রান্সে তখন মেয়েরা সচরাচর ডাক্তারি শাস্ত্রের পাঠ নিতেন না। কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর বেশ কয়েক বছর ধরে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হত।

সময়টাও ছিল প্রবল অস্থিরতার। হিটলারের নাৎসি-বাহিনী সমস্ত ইহুদি অধ্যাপক এবং কমিউনিস্টদের দেশ থেকে তাড়াতে শুরু করেছে। ১৯৪৪ সালে নাৎসিরা প্যারিস আক্রমণ করলে শহরের পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল। জার্মান আর ফরাসি সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধে, ছুটে আসা বুলেটের আঘাতে মারা যান মার্তের ডাক্তারি পড়ুয়া দিদি পলেট। গভীর আঘাত লাগল মার্তের মনে। কানে অহরহ বাজতে লাগল দিদির বলে যাওয়া কথা, “ভুলে যেয়ো না আমরা সামান্য নারীমাত্র। আমাদের উন্নতি করতে গেলে একটি পুরুষের থেকে দ্বিগুণ শ্রম করতে হবে। এ ছাড়াও, আমরা সাধারণ কৃষক পিতা-মাতার সন্তান, সমাজের উপরতলার কারও মেয়ে নই।”

মন শক্ত করে ডাক্তারির সব পরীক্ষায় সফল হলেন মার্তে। স্থানীয় হাসপাতালে অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে লাগলেন। ডাক্তারি পড়ার শেষ বছরে মার্তের থিসিসের অভিনবত্ব লক্ষ করে তাঁর শিক্ষক, উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁকে আমেরিকার বস্টনে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে পাঠালেন। এক বছরের স্কলারশিপ। দিন-রাত পরিশ্রম করে শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে লাগলেন। সপ্তাহের শেষে অথবা ছুটির দিনে বাসে চড়ে ছ’টি ভিন্ন শহরে গিয়ে শিশুদের রিউম্যাটিক ফিভার-এর চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন টেকনিক শিখলেন। আরও একটি পার্ট-টাইম কাজ নিলেন, যাতে ল্যাবরেটরিতে সেল-কালচার করার জন্য এক জন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের মতোই কাজ করতে পারেন। মাইক্রোস্কোপের নীচে শরীরের কোষগুলির কালচার পরীক্ষা করে, প্রয়োজনে তাদের ফোটো নিতে হয়, ফোটোকে ডেভলপ করতে হয়। তখনও পর্যন্ত স্থির ছিল প্যারিসে ফিরে গিয়ে তিনি একটা স্থায়ী চাকরি পাবেন, জন্মসূত্রে পাওয়া শিশুদের কিছু হার্টের অসুখ নির্ণয় এবং প্রয়োজনীয় সার্জারি করা যেতে পারে যেখানে।

১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে ফিরে মার্তে অবাক, কিছুটা হতাশও। অন্য এক জন সেই চাকরি পেয়ে গেছেন। প্যারিসের আরম্যান্ড ট্রোসিউ হাসপাতালে প্রফেসর রেমন্ড তারপ্যাঁ তখন শিশুদের অসম্পূর্ণ দেহ গঠনের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, যার মধ্যে প্রধান ছিল ডাউন সিনড্রোম, সে কালের ভাষায় ‘মঙ্গোলিজ়ম’। তারপ্যাঁ বিশ্বাস করতেন, ক্রোমোজ়োমের ত্রুটিই এই রোগের আসল কারণ। মার্তের তখন প্রয়োজন শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি চাকরি। আমেরিকার খোলামেলা ল্যাবরেটরি থেকে প্যারিসে তারপ্যাঁ-র রক্ষণশীল ল্যাবরেটরিতে এসে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও তিনি কাজটি নিলেন। স্বল্পভাষী, অ-মিশুক তারপ্যাঁ নিজে তাঁকে গবেষণায় তেমন পরামর্শ দিতেন না। ইতিমধ্যে তারপ্যাঁ জেনেছেন, সুইডেনের বিজ্ঞানীরা মানুষের দেহকোষ থেকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজ়োম ভাল করে দেখতে পেয়েছেন। সুইডেনের বিজ্ঞানীদের ক্রোমোজ়োম তত্ত্বে উৎসাহিত তারপ্যাঁ চাইলেন, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের ক্রোমোজ়োম-সংখ্যা পরীক্ষা করে দেখা হোক। তখন গোটা ফ্রান্সে এই বিষয়ে গবেষণা করার মতো মার্তে ছাড়া দক্ষ আর এক জনও ছিলেন না। সানন্দে সে দায়িত্ব মাথায় তুলে নিলেন মার্তে।

তখন ফ্রান্সে গবেষণার কাজ বেশ দুঃসাধ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্বল দেশে অর্থাভাব প্রবল। ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের শুধু পড়ানো, কারণ গবেষণা প্রকল্পের অর্থ অমিল। জেদি মার্তে পিছু হটতে রাজি নন। হাসপাতালের এক পরিত্যক্ত ল্যাবরেটরিতে শুধু জল, গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা দেখে কাজ শুরু করলেন। সম্বল ছিল পুরনো এক রেফ্রিজারেটর, একটি সেন্ট্রিফিউজ় মেশিন, একটি ফাঁকা আলমারি আর কিছু ধুলোয় ঢাকা বহু পুরনো মাইক্রোস্কোপ।

প্রয়োজনীয় গবেষণা-অর্থের অভাবে নিজেই টাকা ধার করে কাচের যন্ত্রপাতি, স্লাইড ও অন্যান্য পরীক্ষার জিনিসপত্র কিনে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের দেহকোষ আর সাধারণ শিশুদের দেহকোষের তুলনামূলক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন, সাধারণ শিশুদের দেহকোষে ৪৬টি ক্রোমোজ়োম থাকলেও, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের ক্রোমোজ়োম ৪৭টি। সেই প্রথম ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গে ক্রোমোজ়োমের অস্বাভাবিক সংখ্যারসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হল।

মার্তে নিজ উদ্যোগে প্যারিসে ঘুরে ঘুরে দেহকোষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। সেল-কালচারের জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রূণ-দশার বাছুরের রক্ত সংগ্রহের অসুবিধা লক্ষ করে নার্সদের আবাসস্থলের কাছে মোরগ পুষেছিলেন, যাতে কালচারের কাজে তাদের শরীর থেকে স্বল্প ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ রক্তরস সংগ্রহ করা যায়। সময়ে সময়ে নিজের শরীরের রক্তও ব্যবহার করতেন।

কিছু দিন পরেই তারপ্যাঁ-র এক সহায়ক গবেষক, জেরোমে লেজিউঁ নিয়মিত মার্তের ল্যাবরেটরিতে যাতায়াত শুরু করলেন। ১৯৫২ থেকে তারপ্যাঁ-র অধীনে তিনি ডাউন সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা করছেন, মার্তের কাজে তাঁর আগ্রহ জাগাটাই স্বাভাবিক। এক সময় মার্তে দেখলেন ২১ নম্বর ক্রোমোজ়োম-জোড়ে রয়েছে দু’টির পরিবর্তে তিনটি ক্রোমোজ়োম। ক্রোমোজ়োমগুলিকে স্পষ্ট ভাবে দেখার জন্য ডিএনএ-কে গাঢ় নীল রঙের জিমসা স্টেন ব্যবহারে রঙিন করলেন। হাসপাতালে তখন ভাল ছবি তুলতে পারে এমন মাইক্রোস্কোপ ছিল না বলে মার্তে ছবি তুলতে পারেননি। তাঁর চেনা ল্যাবরেটরিতে উন্নত মানের ফোটো-মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে মার্তের আবিষ্কারের ছবি তুলে দেবেন, এই অঙ্গীকারে সুযোগসন্ধানী লেজিউঁ স্লাইডগুলি চাইলেন। সরল বিশ্বাসে তেত্রিশ বছরের মার্তে ১৯৫৮ সালের মে মাসে তাঁর সংগ্রহে থাকা ক্রোমোজ়োম-সংক্রান্ত সমস্ত স্লাইড লেজিউঁর হাতে তুলে দিয়ে সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মাত্র তিন মাস পরে লেজিউঁ কানাডার মন্ট্রিয়লে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব হিউম্যান জেনেটিক্স-এর সম্মেলনে গিয়ে মার্তের কাজটি তাঁর নিজের করা বলে জনসমক্ষে প্রচার করলেন।

ও দিকে ফ্রান্সে বসে মার্তে অপেক্ষা করছেন, কবে তারপ্যাঁ-র সহায়তায় আবিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবে। তখন ইন্টারকম, ই-মেলের বালাই ছিল না। আর অ-মিশুকে, কিছুটা নারী-বিদ্বেষী তারপ্যাঁও মার্তের কাছে অধরা। ফ্রান্সে ফিরে লেজিউঁ কিন্তু স্লাইডের ছবি মার্তেকে দিলেন না। তত দিনে তাঁর কানে এসেছে, দুই স্কটিশ গবেষক আর একটি ক্রোমোজ়োম-জোড়ের (এক্স-ক্রোমোজ়োম) মধ্যে অতিরিক্ত একটি ক্রোমোজ়োম পেয়েছেন, যার দরুন পুরুষদের মধ্যে দেখা গিয়েছে ক্লাইনফেল্টার সিনড্রোম। ১৯৫৯-র জানুয়ারি মাসে লেজিউঁ যথেষ্ট ছলচাতুরি করে মার্তের কাজের উপর গবেষণাপত্র জমা দিলেন, আর গবেষণাপত্রে লেখক হিসেবে পর পর নাম রাখলেন জেরোম লেজিউঁ, মেরি গুচিয়ে আর শেষে রেমন্ড তারপ্যাঁ। স্পষ্ট প্রতারণার নজির। প্রথম নাম থাকে তাঁর, যিনি মূল কাজটি করেন, আর শেষ নাম, যিনি এই ধারণার প্রবক্তা এবং ল্যাবরেটরির প্রধান। কিন্তু মার্তের নাম কোথায়? মার্তে গুচিয়ে-এর পরিবর্তে মেরি গুচিয়ে? একেবারেই ভুল নাম। প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশের দু’মাস পর আরও দু’টি, পরে ক্রোমোজ়োমের ছবি-সহ চতুর্থ গবেষণাপত্র প্রকাশ পেল, সব ক্ষেত্রেই লেজিউঁের নাম প্রথমে। মার্তে তাঁর স্লাইডগুলো আর ফেরত পাননি, ক্রমে মার্তে ও তারপ্যাঁ-র নামও অদৃশ্য হল। লেজিউঁ একক ভাবে অজস্র গৌরবময় পুরস্কারের অধিকারী হলেন। মার্তে নিশ্চুপ থাকলেও তারপ্যাঁের তরফে অবশ্য মামলা হয়। পুরো ঘটনাটিতে হতাশ হয়ে মার্তে বুঝলেন, এই পুরুষপ্রধান দুর্নীতির আবর্তে তিনি পেরে উঠবেন না, তাঁর কোনও ‘গডফাদার’ নেই।

এ কাজে সমস্ত উৎসাহ-আগ্রহ ভুলে আশ্রয় খুঁজলেন শিশুদের হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, তার চিকিৎসা, গবেষণার কাজে। তখন বেশির ভাগ মেয়েই ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞান-গবেষণায় টেকনিক্যাল কাজ করতেন। গবেষণা-অর্থ থেকে বঞ্চিত এবং পুরুষশাসিত বিজ্ঞান-গবেষণা দুনিয়ায় টিকে থাকতে নিজেকে বোঝালেন, তিনি তো কোনও পুরস্কারের আশায়, বা জনসমক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার দায়ে এই গবেষণা করেননি। পরে মার্তে এক পরিচিত বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি ভাল করেই জানতাম আমার পিছনে কী ধরনের কাণ্ড চলেছে, কিন্তু মেডিসিনের জগতে আমার তখন যথেষ্ট অভিজ্ঞতা বা কর্তৃত্ব করার মতো অবস্থা ছিল না। এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা কী করে করতে হয়, তাও বুঝতাম না। আমি তখন নেহাতই কমবয়সি একটি মেয়ে, যে এই সব খেলার নিয়ম কিছুই জানত না। তাই হাতের নাগালে থেকেও জানতাম না কেন তাঁরা সরাসরি গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেননি।”

মার্তের সমস্ত নোট, পরবর্তী পেপার, সব কিছুতেই এই ব্যাপারটিতে তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতার পরিচয় মেলে। আর লেজিউঁ কেন, তখন সারা ফ্রান্সে কেউ জানতেন না জীবদেহের সেল-কালচারের কাজ। মার্তে খুব সন্তর্পণে ভঙ্গুর ক্রোমোজ়োম নিয়ে কাজ করার কৌশল শিখেছিলেন, স্লাইডের উপর প্রতিটি কোষকে সযত্নে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখতেন, না হলে তাদের চেহারা হয়ে যেত ছড়ানো দেশলাইকাঠির মতো। ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু করলেন শিশুদের লিভার-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা ও গবেষণার কাজ। অবসর-সময়ে কাগজে, পোর্সেলিনে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতেন। কিন্তু সেই শিল্পী-মন জীবনের উপান্তে এসেও অতীতের অসম্মান, বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির কথা ভোলেনি। ২০০৯ সালে এক বন্ধুর তাড়নায় পঞ্চাশ বছর নীরব থাকার পর জনসমক্ষে এনেছিলেন তাঁর প্রতি প্রতারণার কাহিনি, ফ্রান্সের এক বিখ্যাত সায়েন্স ম্যাগাজ়িন ‘লা রেসার্শে’-তে সেটি প্রকাশ পায়। জানা গেল এই কাজে রয়ে গেছেন এক নারী বিজ্ঞানী, যাঁর কৃতিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। লেজিউঁ তখন প্রয়াত। ২০১৪-র সেপ্টেম্বর মাসে এথিক্স-কমিটি সব তথ্য-নথি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এল, এই কাজে মার্তে গুচিয়ে-এর ভূমিকাই ছিল প্রধান। সেই বছর জানুয়ারিতে লেজিউঁ ফাউন্ডেশন মার্তের বক্তব্যের জন্য আইনি পদক্ষেপ নিলেও সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হল। অতীতে বহু বার এই পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেষ পর্যন্ত লেজিউঁ ফাউন্ডেশনের নির্লজ্জতার প্রতি ধিক্কার জানিয়ে পুরস্কারটি নিলেন।

জীবনের শেষ ক’টি বছর মার্তে গুচিয়ে পুরুষশাসিত বিজ্ঞান-গবেষণার জগতে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মুখর হয়েছেন; বিজ্ঞানের ইতিহাসে নিজের অবদান, তথ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে সজাগ প্রহরা রেখেছেন। বহু বছরের অনাদৃত জীবন কাটিয়ে ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল, ছিয়ানব্বই বছর বয়সে প্যারিসে তাঁর জীবনাবসান হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Down Syndrome Scientist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy