Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩

পিনাকী ভট্টাচার্য

ষোড়শ শতাব্দীর কোনও এক সময় এক ওলন্দাজ জাহাজ ফ্রান্সের বন্দরে নোঙর করেছিল, নিজের দেশে নুন, কাঠ আর ওয়াইন নিয়ে যাবে বলে। তখন ওয়াইনের পরিমাণের ওপর কর বসত— বেশি ওয়াইন নিয়ে গেলে বেশি মাশুল গুনতে হবে। এ দিকে ওয়াইনে জল থাকে অনেকটা। বুদ্ধি খাটিয়ে ওলন্দাজরা ঠিক করল, ওয়াইন ফুটিয়ে জলটা বার করে দিয়ে শুধু অ্যালকোহলটা নিয়ে যাবে কাঠের পিপেতে করে। দু-দিক দিয়েই লাভ— শুল্কও কম গুনতে হবে, আর দেশে গিয়ে এই পরিশুদ্ধ অ্যালকোহলে জল মিশিয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ওয়াইন বিক্রি করা যাবে। দেশে ফিরে দেখে, আজব কাণ্ড— কাঠের পিপেতে থেকে এই অ্যালকোহল ওয়াইনে একটা অন্য স্বাদ যোগ করেছে। ওলন্দাজদের ভাষায় ‘ব্র্যান্দেওয়াইজ্‌ন’ বা ‘পোড়া ওয়াইন’ হচ্ছে এখনকার ব্র্যান্ডি। এই ব্র্যান্ডি তাদের হাত ধরে বিশ্বের বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে পড়ল, বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো ব্র্যান্ডি তৈরি শুরু করল।

এই ওয়াইনটা এসেছিল আদতে ফ্রান্সের কনিয়্যাক ‌অঞ্চল থেকে। সেখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শারান্ত্ নদী আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়ে, তাই এই অঞ্চলের লোক বাণিজ্যের ব্যাপারে চিরকালই বেশ দ়ড়। পান-ভোজনের স্বর্গ ফ্রান্স— ওদের দেশ থেকে অন্য দেশ মদ নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে নতুন ওয়াইন আবিষ্কার করে বাহবা পাবে, ফরাসিদের পক্ষে সেটা হজম করা খুবই কষ্টের। প্রতিবাদ করলে আবার ব্যবসায় ভাটা পড়বে— তাদের হল সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা। বিমর্ষ ফরাসিরা অগত্যা এই কনিয়্যাক ‌অঞ্চলের আঙুর নিয়ে মদ বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু রাখল হৃত গৌরব ফেরত পাওয়ার আশায়। মদ বানানোর প্রণালীতে আনল অপরসায়নের কারিকুরি— পরিশোধনের জন্য তামার এক বিশেষ পাত্রের ব্যবহার শুরু করল, আর এক বার পরিশোধন করে না থেমে গিয়ে আরও এক বার পরিশোধনের পদ্ধতি চালু করল, যাতে বিশুদ্ধতর অ্যালকোহল পাওয়া যায়। সেই অ্যালকোহল জমা করা হত ওক কাঠের পিপেতে। সেই পিপে সময়ের সঙ্গে জমা অ্যালকোহলকে দিল সোনালি রং আর স্বাদের বৈচিত্র। সব মিলিয়ে কনিয়্যাক ‌অঞ্চলে তৈরি ব্র্যান্ডি হয়ে উঠল স্বাদে বর্ণে এক্কেবারে স্বতন্ত্র।

দ্বাদশ শতাব্দীতে মুর’দের সময় ফ্রান্সের আরমানিয়্যাক অঞ্চলের আঙুর দিয়ে এক ওয়াইন তৈরি হত, তাতে আগুনের ভূমিকা ছিল, যেমন আছে ব্র্যান্ডিতে, কিন্তু সেটা খুব প্রচারিত ছিল না— সেখানকার মানুষজনের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল সেটা। ফরাসিরা আরমানিয়্যাক নিয়েও পরীক্ষা শুরু করে দিল, আর সেটা বানাতে শুরু করল এক বার পরিশোধন করেই। এ বার কনিয়্যাক আর আরমানিয়্যাক অঞ্চলের ব্র্যান্ডির নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে, সবাই মেতে উঠল এই ব্র্যান্ডি তৈরি করতে।

এই বার ফরাসিরা বেঁকে বসল। ব্র্যান্ডি হাত ফসকে গিয়েছে যাক, এই নতুন তৈরি ওয়াইনগুলোর অধিকার কিছুতেই ছাড়া হবে না। এ দিকে এদের চাহিদা আকাশ ছুঁই-ছুঁই। পাণ্ডবদের মধ্যে থেকে অর্জুন আর ভীমকে বাদ দিলে যেমন হয়, ব্র্যান্ডি থেকে এদের বাদ দিলে বিশ্বের সুরা-ব্যবসায়ীদের অবস্থা তেমনই। শেষে ফরাসিদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল সারা বিশ্ব। কনিয়্যাক আর আরমানিয়্যাক অঞ্চলের আঙুর দিয়ে তৈরি ব্র্যান্ডি কনিয়্যাক আর আরমানিয়্যাক হিসেবে পরিবেশিত হবে, আর ব্র্যান্ডি নামটা রইল বিশ্বের বাকি প্রস্তুতকারকদের জন্য।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আজিদুর ডাক্তারের হালখাতা

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে অনেক আমগাছের তলায় রামবাবুদের চায়ের দোকানে ডাক্তারি পড়ার ফর্ম পাওয়া যেত। নিমতা অঞ্চলে একটা চায়ের দোকানের গায়ে বোর্ড দেখেছিলাম ‘কম খরচে পাশ-করা ডাক্তার করা হয়।’ প্রসপেক্টাস বলতে একটা হ্যান্ডবিল। দেখেছিলাম এম.বি.বি.এস পড়ার যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ। দু’বছরের এম.বি.বি.এস কোর্স সমাপন করে এক বছরের এম.ডি-ও পাশ করা যায়। কোনও প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় কিংবা হরিসভার চাতালে ডাক্তারি বিদ্যার পঠন-পাঠন হত। সারা পশ্চিমবাংলায় এক ডজনেরও বেশি এ রকম মেডিকাল কলেজ গড়ে উঠেছিল। ছ-সাত বছর ধরে এই সব মেডিকাল কলেজ বহু এম.বি.বি.এস, এম.ডি ডাক্তার বানিয়েছিল। মেডিকাল কাউন্সিলগুলোর চাপে এ সব বন্ধ হয়ে যায়।

ওই সময়ে আমরা বিরাটিতে থাকতাম। আমাদের বাড়িতে দুটো খেজুর গাছ ছিল। আমজাদ নামে এক জন আমাদের খেজুর গাছ কেটে হাঁড়ি ঝোলাত শীতকালে, ভোরবেলায় হাঁড়ি পেড়ে নিয়ে আমাদের কিছুটা রস দিত, কিছু কাল সেই রস খেয়েছি, রসে সুগন্ধি চাল ফুটিয়ে এক অপূর্ব ‘ভাতরসি’ও তৈরি হত বাড়িতে। আমজাদ ‘অ’-কে প্রায়শই ‘র’ উচ্চারণ করত। নিজেকে বলত রামজাদ। এখন শুনলে প্রবীণ তোগাড়িয়া’রা খুশি হতেন। আমজাদের সঙ্গে কিছু দিন তার কিশোর ছেলেটি আসত, সাহায্য করত। আমজাদ এক দিন আমার বাবাকে বলল— বাবু, আমার ছাওয়ালটাকে ডাক্তারি পড়াব, পঞ্জিকা দেখে একটা ভাল দিন দেখে দেন।

বাবা বলেছিলেন, হিন্দুদের পঞ্জিকার শুভদিনে তোমাদের চলবে? ও বলেছিল, আমাদের পঞ্জিকা আছে কি না জানি না, তবে আল্লার সব দিনই ভাল দিন, তবুও আপনি একটা দিন দেখে দেন, সে দিনই টাকাটা দেব।

বাবা দিন দেখে দিয়েছিলেন কি না মনে নেই, তবে ছেলেটা ডাক্তারি পড়েছিল। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় অনেক দিন পর। শান্তিনিকেতন থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে লাভপুরের পথে একটা গ্রাম্য চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, উলটো দিকে একটা বোর্ড, একটা রেড ক্রস-এর পাশে লেখা ‘ইলাজ সেন্টার’, ডাঃ আজিদুর রহমন, এম.বি.বি.এস, এম.ডি., এ.এম। এখানে সব রকম রোগব্যাধির চিকিৎসা সহ শরিয়তি ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে ছোন্নত করা হয়। এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। থুতনিতে দাড়ি, প্যান্টের উপর শার্ট ঝুলছে, গলায় স্টেথো, বললেন— চিনতে পারছেন? আমি কিছু ক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে, উনি বলেন— আমার বাবা আমজাদ শিউলি, খেজুর গাছ, বাবার সঙ্গে যেতাম...

মনে পড়ল। ও বলল, দেখছিলাম চেম্বার থেকে। ভাল আছেন?

চেম্বারে নিয়ে গেল। সেখানে কংকালের ছবি ঝুলছে, কাবা শরিফের ছবিও। চেম্বারে দু’তিন জনকে অল্প কথায় বিদায় করল। এক জনকে বলল, লিখেছিলাম লিঙ্গাকেনি মলম, কিনে রেখো। আমি পরে বলি— এ রকম নামের মলম হয় না কি? ও বলল, আসলে লিগ্‌নোকেন। ওটাই লিখেছি, কিন্তু বলি এটা, লিঙ্গের অগ্রভাগ কাটতে হয় কিনা... জিজ্ঞাসা করি ডিগ্রির মধ্যে ‘এ.এম.’-ও লেখা আছে দেখি, এর মানে কী? ও বলল, অল্টারনেটিভ মেডিসিন। কিছু ক্ষণ গল্প হল। জানলাম কাঁথা স্টিচ শাড়ি এ সব অঞ্চলেই হয়। মুসলমান মেয়েদের হাতের ছুঁচ-সুতোয় ফুল-পাখি-মাছ-হাতি তৈরি হয়। এরা মজুরি হিসেবে খুব বেশি রোজগার করে না। ও বলল, ওর শ্বশুরবাড়ি এ তল্লাটেই। বিরাটির কাছে ফতুল্লাপুরে ওরা থাকত, বিরাটি জায়গাটার রমরমা হতেই ফতুল্লাপুরেও জমির দাম হুহু করে বেড়ে গেল। অনেকেই জমি বেচে অন্যত্র চলে গেল। ওখানে বহু ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে গেছে। কোয়াক ডাক্তারি ওখানে ভাল চলত না। বাবার ইন্তেকালের পর এ দিকে চলে এসে প্র্যাকটিস করছে।

এ বারের শেষ বসন্তে দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম। আজিদুরের সঙ্গে দেখা। আজিদুর বলল— প্রান্তিকের কাছেই নতুন বাড়ি বানিয়েছি। বলি, কেন? বললে, গামছারও সাধ হয় ধোপাবাড়ি যেতে। ছোট ছেলেটাকে ভর্তি করালাম পাঠভবনে। আসুন না, কাছেই বাড়ি।

ওর টেবিলের উপর দেখি অনেক কার্ড। কার্ডের এক ধারে চাঁদ-তারার ছবি, অন্য ধারে খাড়া হয়ে ওঠা মসজিদের মিনার। ফুল-পাতার নকশার তলায় লেখা— ‘এলাহি ভরসা। সবিনয় নিবেদন। ১৪২২ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ মদীয় চেম্বারে আগমন করিয়া নতুন খাতা মহরত করিবার জন্য...।’ বলি, ডাক্তারের চেম্বারে হালখাতা‌? আজিদুর বলে— ধার-বাকির ডাক্তারি, কিছুটা উশুল হয়... একটা চিঠি দেখায় আজিদুর। চিঠির কোনায় বাকির পরিমাণটা লেখা ছিল।

একটি ফুটফুটে বালক এল সাইকেলে। সাইকেলের সামনে একটা চরকি ঘুরছিল। চরকিটা থামলে দেখলাম, দুটো হালখাতার কার্ড গেঁথে চরকিটা বানানো হয়েছিল।

শ্রীশ্রী গণেশায় নমঃ আর এলাহি ভরসা।

সে দিনের কাগজেই ঢাকার ওয়াশিকুর রহমানের আর কেনিয়ার দে়ড়শো ছাত্রর রক্ত লেগেছিল।

swapnoc@rediffmail.com

robibasoriyo magazine la jobab chalti ka nam gari punch line khana tallasi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy