Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩

সাম্বার

পিনাকী ভট্টাচার্য

এক ছিল ওস্তাদ রাঁধুনি, নাম ছিল আমা। তার বউয়ের নাম ছিল থাইর সাদাম। তাদের ছিল দুই ছেলে: সাম্বার আর রসম। আমা ছিল খুবই ব্যস্ত রাঁধুনি, সারা তামিলনাড়ুতে বড়লোকের বাড়ি বিয়ের অনুষ্ঠান হলেই আমা’র ডাক পড়ত। অনুষ্ঠান বাড়িতে শেষ পাতে আমা’র কর্মচারীরা কার্ড-রাইস পরিবেশন করতো, যা কিনা থাইর সাদাম-এর আবিষ্কার।

সাম্বার-এর বয়স যখন আঠেরো, সে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে একটা পদ রান্না করে। সেই অনুষ্ঠানে আবার মুখ্য অতিথি ছিলেন রাজকুমার ত্রয়োদশ চোল। সেই পদ পেল্লায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল, সেটা ভাত, ইডলি, দোসা, এমনকী কার্ড-রাইসের সঙ্গেও খাওয়া যায়। স্বয়ং ত্রয়োদশ চোল ইন্দোনেশিয়ায় সাম্বারের নতুন পদের প্রচার করলেন, আর ওদের ব্যবসা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে সুদূর মিশর আর রোমেও ছড়িয়ে গেল।

এই সময় দূর দেশ থেকে এক জ্যোতিষী উপস্থিত হলেন তামিলনাড়ুতে। তিনি সাম্বারের পদের নাম দিলেন, তারই নামে— ‘সাম্বার’, আর ঘোষণা করলেন এক দিন আসবে যখন এই পদের প্রতিপত্তি কমে যাবে, আর জনপ্রিয়তায় একে ছাড়িয়ে যাবে এক নতুন পদ।

এই সময় সাম্বারের ভাই রসম দূর গুজরাতে সেখানকার নানা রান্নার কলাকৌশল শিখতে ব্যস্ত ছিল। সেখানে তামিলনাড়ু থেকে বহু দিন আগে আসা পরিবারের মেয়ে মোর কুঝাম্বুর-কে বিয়ে করে দুজনে মিলে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। এসে দেখল, রাজার আদেশে সমস্ত রাজ্যবাসী সাম্বার দিয়ে খাওয়া শুরু করে, আর কার্ড রাইস দিয়ে খাওয়া শেষ করে। দেখল অর্থ, ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি তার দাদাকে অনেক বদলে দিয়েছে। মনের দুঃখে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে রসম নিজের একটা ছোট্ট ব্যবসা গড়ে তুলল। রেগে গিয়ে আমা রসমের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল।

মায়ের মন ছোট ছেলের জন্য মাঝেমাঝেই কাঁদে। কয়েক বছর বাদে এক দিন থাইর সাদাম আর থাকতে পারল না— চুপিচুপি হাজির হল ছোট ছেলের বাড়ি। রসম খুশিতে ফেটে পড়ল মা-কে দেখে, জোর করে মা-কে খেতে বসিয়ে দিল। অনেক ক্ষণ ধরে নতুন পদের রসাস্বাদন করল থাইর সাদাম। জানতে পারল এই পদের নাম ছোট ছেলের নামে— রসম। রসমকে জিজ্ঞেস করে জানল, এই খাবারের রন্ধনপ্রণালী ১৩ বছর ধরে মন্দিরে থাইর সাদামের কার্ড-রাইসের রন্ধনপ্রণালীর তলাতেই লেখা আছে— কারও চোখে পড়েনি (সেই জমানায় নতুন পদের রন্ধনপ্রণালী মন্দিরে লেখা থাকত, সবার সুবিধার জন্য)। থাইর বাড়ি ফিরে এই পদ রেঁধে আমা-কে খাওয়াতে আমা-র চোখ দিয়ে জলের ধারা নামল, স্বাদের আনন্দে। আর সে দিন এক লুকনো কথা সে থাইর সাদামের কাছে স্বীকার করল— সাম্বারের কৃতিত্বও আসলে রসমের— কিন্তু সে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল সাম্বারকে এগিয়ে দিয়ে।

এটা একটা লোককথা। ‘আমার গপ্প ফুরল নটে গাছটা মুড়োল’ বলার আগে একটা কথা জানান দেওয়া ভাল, সাম্বারের মালিকানার গপ্প শুধু লোককথায় না, ইতিহাসেও আছে। আজ থেকে ২০০ বছরেরও আগে তাঞ্জাভুর-এর মরাঠা শাসক শাহুজি ছিলেন খুব ভোজনরসিক, রান্না নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ছিল তাঁর নেশা। তিনি এক বার মরাঠিদের জনপ্রিয় পদ আমতি-র ওপর পরীক্ষা করেন, কোকাম-এর বদলে তেঁতুল আর মুগ ডালের বদলে অড়হর ডাল ব্যবহার করে। তিনি নতুন পদের নাম দেন সাম্বার— সেই দিনের বিশেষ অতিথি মরাঠি শাসক সাম্বাজি’র নামে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আর জায়গা নাই, এহানে মরতে আইছ!

১৯৬৫। সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি। চাকরি চাই। সিভিল এভিয়েশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলে ‘এয়ারোড্রোম অপারেটর গ্রেড ওয়ান’ পদে দরখাস্ত করলাম। চিঠি এল। চাকরি পেতে গেলে লিখিত, মৌখিক ও ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। দেেশ ছোটবড় গাদা এয়ারপোর্ট-এয়ারোড্রোম। যেখানে পাঠাবে, যেতে হবে।

লিখিত পরীক্ষার পর এয়ারপোর্ট দেখতে এলাম। পুরনো দিনের টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে আসার পথে ছিল সুন্দর করে বসানো গাছের সারি। বাঁ দিকে বাসস্ট্যান্ড, এয়ারপোর্ট ক্যান্টিন। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের চারপাশ তারকাঁটা-ঘেরা। এর আগে এয়ারপোর্ট দেখিনি, অবাক হয়ে প্লেনের নামাওঠা দেখার পর, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ দেখতে গেলাম। নানান এয়ারলাইন্সের কাউন্টার, সুন্দর দেখতে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত চলাফেরা। শাড়ি আর হাই-হিল পরা ক’জন মেয়ে হাতে বটুয়ার মতো বাক্স নিয়ে লাউঞ্জে ঢুকল। সহ-পরীক্ষার্থী এক জন আমাকে টোকা মেরে বলল, এরা এয়ারহোস্টেস! আর ওই যে সাদা জামাপ্যান্ট, কাঁধে দুই ফিতা, আর তিন ফিতা, বুকে ব্যাজ, ওরা পাইলট আর কো-পাইলট। আমি মনে মনে বললাম, ভগবান, এই চাকরিটা যেন পাই।

ইন্টারভিউয়ের চিঠি এল। এলাম এয়ারপোর্টের রিজিওনাল কন্ট্রোলারের অফিসে। ‘এজ?’ আমি অতি সাধারণ বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলে, ভয়ে ভয়ে বললাম। ‘নেম?’ বললাম। এক জন বিদ্রুপ ভরে বললেন, ‘আর ইউ অ্যান অ্যাক্টর?’

শেক‌্সপিয়রের লাইনগুলো মনে ছিল, বলে দিলাম: অল দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ আ স্টেজ, অ্যান্ড অল দ্য মেন অ্যান্ড উইমেন মিয়ারলি প্লেয়ার্স, সে অর্থে আমিও অভিনেতা। মনে হল, ইমপ্রেস্ড। কলেজে ইন্ডিয়ান নেভির এনসিসি ক্যা়ডেট ছিলাম, নেভাল অফিসাররা কী ভাবে স্যালুট করেন, প্রশ্ন করা হল। আমি অ্যাটেনশন পজিশনে নেভাল স্যালুট করলাম, সবাই উঠে দাঁড়ালেন। পরের প্রশ্ন, নেভাল স্যালুটে হাতের পিছনের দিক কেন দেখানো হয়? আমি বললাম, হাতে হাজা হয় বলে। ওঁরা তো অবাক, ‘হাজা’ কী? খুব লজ্জা পেয়ে বললাম, সমুদ্রের জলে লবণ থাকে, তাই হাতের চেটোয় এক ধরনের রোগ হয়, ওটাই...

ডাক্তারি পরীক্ষার কিছু দিন পর ট্রেনিংয়ে যোগ দেওয়ার চিঠি এল। মানে, চাকরি পেয়েছি! সেই রিজিওনাল কন্ট্রোলার অফিস। আর এক জনও এসেছে জয়েন করতে। ‘সেটকো’র সঙ্গে দেখা করো। ‘সেটকো কী?’ ‘সিনিয়র এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার।’ পৌঁছলাম সেখানে। তখন এয়ারপোর্টের আধুনিকীকরণ হয়নি। চারদিক দেখছি। চেয়ারটেবিলের দৈন্যদশা, দেওয়ালে চুনকাম নেই। ক্যান্টিেন কাঠের আস্তরণে শ্যাওলা, বাসি ডালের দাগ। মনখারাপ হয়ে গেল।

সেটকোর অফিস ফাঁকা। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। কেউ ধরার নেই। ‘হ্যালো’ বলতে ও-পাশ থেকে কে বলে উঠল, ‘পুট মি টু সেটকো।’ আমি কিছু না বলে রিসিভার টেবিলে নামিয়ে রাখলাম। অফিসের বাইরে এসে দেখি এক প্রৌঢ়। ধুতি, চাঁদির চশমা, টায়ারের চপ্পল। একটা বিড়ি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এয়ারোড্রোম অপারেটর ট্রেনি? ‘হ্যাঁ’ বলে তাঁকে ফোনের কথা বললাম। তিনিও টেলিফোন কানে দিয়ে নামিয়ে রাখলেন, তার পর দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলেন। লম্বাচওড়়া, সুদর্শন আর এক জন হেঁটে আসছেন। মাথায় অশোকস্তম্ভের টুপি, বুকে একই রকম ব্যাজ, জামার কাঁধে চার ফিতা। প্রৌঢ় তাঁকে বললেন, স্যর, আপনার ফোন। উত্তর এল, এমারজেন্সি ল্যান্ডিং হচ্ছে, আমি রানওয়ে ইন্সপেকশনে যাচ্ছি। প্রৌঢ় মানুষটি ফোনে সেটা বলে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, বিড়িটা কই? আমরা তো অবাক! দরজার ফাঁকে আধপোড়া বিড়িটা পড়ে ছিল, দেখিয়ে দিতে সেটা তুলে ফের ধরালেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কী কাজ করেন? তিনি জবাব দিলেন, এয়ারোড্রোম অপারেটর। ইনি!! আমার সাধের চাকরির বেলুনে যেন কেউ পিন ফুটিয়ে দিল!

এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল আর এক জগৎ। কিছু লোক কানে হেডফোন লাগিয়ে দুর্বোধ্য ইংরিজিতে কী সব বলে চলেছে। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে: ‘রজার, রজার’, ‘ওভার, ওভার!’ বড় একটা যন্ত্রের সামনে ডান্ডাওয়ালা মাইক নিয়ে এক জন নাগাড়ে বলছে: ‘কুম্ভিগ্রাম, কুম্ভিগ্রাম! লীলাবাড়ি, লীলাবাড়ি! পাশিঘাট, পাশিঘাট! রিকোয়েস্ট ইয়োর ওয়েদার!’ আমাদের দেখেই হঠাৎ এক জন বাঙাল ভাষায় তেড়ে বলতে লাগলেন: ‘তোমাদের কি আর যাওনের জায়গা নাই, এহানে মরতে আইছ! আশি টাকা স্টাইফেন, নয় মাস ট্রেনিং, তায় এলাহাবাদ যাইতে হইব। কয়েকটা সাবজেক্ট জানো: এটিসি থিয়োরি আর প্র্যাকটিকাল, নেভিগেশন, এয়ার লেজিসলেশন, মেট্রোলজি, ফায়ার, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, মোরস্। মোরস্ বুঝো? মানে টরেটক্কা। পাশ মার্ক একশোয় সত্তর, আর এটিসি প্র্যাকটিকালে একশোতে একশো, নো মিসটেক! এক বারে কেওই পাশ করতে পারে না, কারও কারও পাঁচ বৎসরও এক্সটেন্ড হইয়া যায়। কত জন যে ভাইগ্যা গেসে ঠিক নাই। যদিবা পাশ কইরা যাও, রাত জাইগ্যা ডিউটি করতে হইব। পোস্টিং কারে কয় জানো, এমন সব অ্যারোড্রোম আছে যেখানে খুইদা জল খাইতে হয়। খুইদা মানে বুঝো? মানে হইল বালির মধ্যে গর্ত কইরা জল তুলতে হয়। কিছু অ্যারোড্রোম আছে, যাওনের সুবিধা নাই। প্রথমে প্লেনে, নাইম্যা বাসে, নৌকায় নদী পার হইয়া হাতির পিঠে। আজ রওনা হইলে কবে পৌঁছাইবা তার কুনো ঠিক নাই।’

আমি তো পালাতে পারলে বাঁচি। তখন আর এক জন আগের জনকে বললেন,‘আপনার লজ্জা করে না? কোথায় এদের উৎসাহ দেবেন, তা না করে নিরাশ করছেন! এই চাকরি যথেষ্ট ভাল। এরাই ভবিষ্যতে এক দিন এয়ারোড্রোম ইন-চার্জ হবে।’ আমাদের সমস্ত ইউনিট ঘুরিয়ে দেখালেন।

শুরুটা এ ভাবেই। কয়েক বছরের মধ্যে ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়ে গে়জেটেড অফিসার হই। অনেক বড় পদে কাজ করেছি। সে দিন যিনি আমাদের হতাশ করেছিলেন, তাঁর কাছেই পরে অনেক ভালবাসা পেয়েছি, অনেক কিছু শিখেছি। এখন নতুন টার্মিনাল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। পুরনো সেই দিন, সেই মানুষগুলো আর নেই। আমার সেই অফিসে অর্থের প্রাচুর্য ছিল না, অকৃত্রিম হৃদয় ছিল। মিস করি।

পাহাড়ী সান্যাল, সন্তোষপুর

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

Robibasoriyo magazine pushku officefice khana tallasi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy