Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ৩

মায়া প্রপঞ্চময়

জোরালো সার্চলাইটের আলো মুখে এসে পড়তে তিরিশ বছর আগের অতীতচারিতা থেকে বর্তমানের বাস্তবে ফিরে আসে অনিকেত।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: কালীপুর চিড়িয়াখানার ভিতর অন্ধকারে ছাতিমতলায় বসে থালার মতো চাঁদটাকে দেখছিল অনিকেত। তখন রামাশ্রয় এসে জানায়, শঙ্কর, মানে এই চিড়িয়াখানার প্রবীণ সিংহটির মৃত্যু আসন্ন। দীর্ঘ দিন ধরে সে অসুস্থ। রামাশ্রয়ের অনুরোধে শঙ্করকে দেখতে যায় অনিকেত। সে পৌঁছনোর অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যায় সিংহটি। কান্নায় ভেঙে পড়ে রামাশ্রয়। শঙ্কর ছিল তার সন্তানের মতো। এ দিকে শঙ্করের মরণ-যন্ত্রণা অনিকেতকে নাড়িয়ে দেয়। সঙ্গিনী উমা মারা যাওয়ার পর থেকে একা হয়ে যাওয়া শঙ্করকে দেখে অনিকেতের নিজের কথা মনে হত। এক দিন ও এ ভাবে মারা যাবে।

অবাক হয়ে অনিকেত ভাবে, ‘‘কত দিন পরে যেন আবার মনের দুঃখ আর যন্ত্রণা কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে। শেষ কবে যেন এমন ভাবে নিঃসাড়ে কাঁদতে পেরেছিল... সেও তো অনেক কাল হয়ে গেল। মা মারা যাওয়ার দিনে বুক খালি হয়ে যাওয়া এক অনুভূতিতে। তার আগে বাবা যে দিন চলে গেলেন। তারও আগে কবে যেন? তিরিশ বছর হতে চলল বোধহয়! সর্বস্বান্ত, নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার মর্মবেদনা নিয়ে জংশন থেকে হাওড়াগামী ট্রেনে চেপে বসেছিল সে দিন। বার বারই মনে হচ্ছিল, বেশি দূর তো যেতে হবে না। উল্টো দিকের লাইনে এই রকম একটা ট্রেন আসছে দেখলেই চোখ বুজে কেবল লাফিয়ে পড়া। তার পর তো আর কোনও কষ্টই থাকবে না! বসেছেও তো ঠিক দরজার পাশে। বুকের ভিতরে যে কষ্ট, ট্রেনে শরীরটা ছিন্নভিন্ন হওয়ার সময় তার চেয়ে বেশি কষ্ট তো আর হবে না! খালি বাবা-মায়ের মুখদুটো কেন যে বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেটাই মাথায় আসছে না। হঠাৎ চিন্তার জাল ছিঁড়ে গিয়েছিল পাশ থেকে এক মহিলাকণ্ঠে, ‘‘ও বাছা, এত কান্না কীসের? আপনার জন কেউ মারা গেচে বুঝি সদ্য সদ্য? পেরায় এক ঘণ্টা ধরে লক্ষ করছি, সমানে দু’চোখ দে’ জল পড়চে আর কেমন ভাবে যেন লাইনের দিকে চেয়ে রয়েচ। বলি, বাপ-মা নিচ্চয় মারা যায়নি?’’ অনিকেত তাকিয়ে দেখে, বাউল আর বাউলানি। গেরুয়া আলখাল্লা, চুড়ো করে বাঁধা চুল, কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। কথা না বলে দু’দিকে ঘাড় নাড়ে ও। এ বার পুরুষটি দোহার দেয়, ‘‘তব্বে আর কী, মহাগুরু দুজনা যখন সঙ্গে আচেন তাঁরাই সামালি নিবে’খন। মন নিচ্চে, বড্ড দাগাই খাইচ তুমি বাপ, তবে মনে রাখো সব কষ্টেরই পিতিকার তোমার ওই দুজনা আর তাঁদেরও উপরে যিনি আচেন, সেই পরমগুরুর পায়ের তলায়। তোমায় একটা গান শোনাই, মনের বেথা কিচু কমবে।’’

পিড়িং পিড়িং করে দোতারা বাজিয়ে পুরুষটি প্রথমে গান ধরে, সঙ্গিনীটি তাতে সঙ্গত করে, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না / তার সঙ্গে নাই লেনা দেনা/ খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা/ সে জন সোনা চেনে না।’ অনিকেত অবাক হয়, এরা কি ওর মন পড়তে পারছে, না কি আন্দাজে বলছে? যেমনটা নিত্যদিন অন্যান্য সব যাত্রীদের সঙ্গেও করে থাকে! গান চলতে থাকে, মনটা অন্য দিকে বিক্ষিপ্ত হওয়ায় ওর শূন্যতার বোধ কিছুটা কমে আসে। বাউলরা গাইতে থাকে ‘ওই পিঁপড়া চেনে চিনির-ও-ও দাম/ ও বানিয়া চেনে সোনা।/ মাটির প্রেমের মূল্য কে জানে?/ ...ধরায় আছে কয়জনা/ যে জন মানিক চেনে না/ যে জন... চেনে না!’

অনিকেতের চোখ দিয়ে অবিরাম ধারাপাত ওর কষ্টকে কিছুটা কমিয়ে এনেছিল। গান শেষে পুরুষটি ওর কাঁধে হাত রাখে, ‘‘ভাবচ বুঝি পেটের দায়ে আমরা ট্রেনে গান গেয়ে বেড়াই? তা নয় গো, তা নয়। তোমার মতো একটা ছেলে আমাদেরও ছিল। কে জানে কার টান তার কাছে আমাদের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াল! যে দিন সকাল থেকে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে টানা চোখের জল ফেলল, সে সময়েও ভেবেছিলাম সময় সব ঠিক করে দেবে। মাঝরাতে কখন যে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো আমাদের মায়া তুচ্ছ করে রেললাইনে শুয়ে শান্তি পেল...’’

তার সঙ্গিনীর দু’চোখে কোল-ছাপানো জলের ধারা, ‘‘তার পর থেকেই ফাঁক পেলেই বুড়ো-বুড়ি দোতারা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দু’জনের চার চোখ তোমার মতো ছেলেমানুষদের খুঁজে বেড়ায়, কোনও মরীচিকার পিছনে ছুটে যারা জীবনের মানে হারিয়ে ফেলেছে। বাপ-মায়ের ছেলে, তাদের কাছেই ফিরে যাও। ঠিক মনের শান্তি ফিরে আসবে, দেখে নিও।’’ সম্পূর্ণ অচেনা দু’জন মানুষ ওকে জীবন-মৃত্যুর দোলাচল থেকে জীবনের কিনারায় এনে পরের স্টেশনে নেমে যায়। শেষ বার জানালার কাছে এসে বলে যায় চোখে-মুখে জল দিতে, তাতে চোখ দিয়ে জল পড়া কমবে।

বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বোঝাতে অনেকটা সময় লাগে। কেন ও গবেষণা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে এল। মিথ্যা বলার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই নেই অনিকেতের। এ দিকে বাবা-মা দু’জনকেই এতটাই ভক্তি-শ্রদ্ধা করে যে নিজের মুখে নিজের পতন ও মূর্ছার ইতিবৃত্ত বলতে কোথায় যেন বাধে। তাই বাস্তবতার সাহায্যই নেয়, ‘‘বলতে পারো, বেশি ডিগ্রি নিয়ে কী হবে? রেজ়াল্ট তো কোনও দিনই খারাপ করিনি, তবু তার কোনও প্র্যাকটিক্যাল সুুবিধা কি কখনও পেয়েছি? এক মাত্র ফ্রি-স্টুডেন্টশিপ আর সামান্য স্কলারশিপ ছাড়া? নেট পরীক্ষা কোয়ালিফাই করেই বা কী হল? চাকরির গ্যারান্টি পেলাম না তো! তাই ঠিক করেছি, এ বার স্কুলগুলোতে ইন্টারভিউ দেব। শিক্ষকের একটা চাকরি হবে না? ভগবান তো মুখ তুলে চাইছেন না! বড় হতাশ লাগে মা।’’

মা বলেছিলেন, ‘‘ছিঃ বাবা! অমন বলতে নেই। তিনি না থাকলে কে তোকে এত দিন সাহায্য করেছে বল দেখি? তোর বাবার শরীর ভাল নয়, আর্থিক অবস্থা এমন যে ছোটবেলা থেকে তোকে একটা প্রাইভেট টিচার দিতে পারিনি। তা হলেও তুই পড়াশোনাটা করলি কিসের জোরে? প্রতি বার পরীক্ষার আগে হয় অসুুখে পড়েছিস না হলে আত্মীয়-পড়শিদের সঙ্গে কিছু না কিছু একটা নিয়ে লেগেছে। বলতে গেলে পায়ে পা বাধিয়েই গন্ডগোল করেছে ওরা, যাতে তুই ভাল রেজ়াল্ট করতে না পারিস। কিন্তু সে বাধা পেরিয়ে তো তুই ভাল ভাবেই পাশ করেছিস। এ সব ভগবানের আশীর্বাদ না থাকলে হয়? তবে এখন আর তোকে বাধা দেব না। গবেষণা যখন করতে চাইছিস না, থাক। চাকরির চেষ্টাই দেখ। তোর বাবার শরীরের তো এই অবস্থা, মানুষটা যদি দেখে যেতে পারে যে তুই বাঁধাধরা কিছু একটা করছিস...’’ বাকি কথা অনুক্তই রেখে দিলেন মা।

মা ভগবানে বিশ্বাস রাখতে বললেও, ঈশ্বরের উপর থেকে অনিকেতের বিশ্বাস ক্রমশ হারিয়ে যায়। চার্বাক-দর্শন ছিল ওর পছন্দের। ‘যাবজ্জীবেৎ সুুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ এই জাতীয় কথাবার্তা ওর মুখে সব সময় লেগে থাকত। কিন্তু জীবনে অনামিকা আসার পরে বদলে গেল অনিকেত। সেই বদলটা সে নিজেও টের পেয়েছিল। তাই রাখঢাক না করে এক দিন সে অনামিকাকে বলেই ফেলে, ‘‘জানো তো, তোমার পাল্লায় পড়ে আমি পুরোপুরি বদলেই গেলাম।’’

অনামিকা কৌতূহলী চোখে তাকাতে ও বলেছিল, ‘‘চান্স পেলে পড়ে নিও, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘চার্বাক ও মঞ্জুভাষা’। তোমার পড়তে অসুুবিধে হবে না। ভালই তো বাংলা বলতে আর পড়তে পারো।’’

******

জোরালো সার্চলাইটের আলো মুখে এসে পড়তে তিরিশ বছর আগের অতীতচারিতা থেকে বর্তমানের বাস্তবে ফিরে আসে অনিকেত। বিরক্তিতে চোখ কোঁচকায়। বুঝতে পারে এ চাঁদুর কাজ। সে ছাড়া ওর মুখে আলো ফেলার সাহস এখানে আর কারও হবে না।

চাঁদুর বচনামৃত কানে আসে, ‘‘ঠিক জানি আপনাকে এখানেই পাওয়া যাবে! এ বার হিম পড়তে শুরু করেছে, বুকে ঠান্ডা লাগলে আবার যখন কাশি হবে, রক্ত পড়বে, তখন কে দেখবে শুনি? তখন তো এই চাঁদু ছাড়া গতি নেই। আবার দেখলাম ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে, আপনার না বারণ আছে ও সব? চোখদুটোও তো ছলছল করছে, জ্বর এল নাকি অনিয়ম করার জন্য? আমি আর আপনার দেখভাল করব না। জেনেশুনে যে লোক মরতে চায়, তাকে আমি তো ছার, ভগবানও বাঁচাতে পারবে না।’’ একটানা বকবকানির সঙ্গে সঙ্গে হাতের ভাঁজ করা শালটা ও অনিকেতের গায়ে যত্ন করে জড়িয়ে দেয়।

চাঁদু ওরফে চন্দ্রবর্ধন দলাই চিড়িয়াখানার গ্রুপ ডি কর্মচারী। কানে বেশ খাটো। কিন্তু লিপ রিড করে বুঝে নেয় অন্যের কথা। বড়বাবু ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় সেই রকমই বলেছিলেন। ‘‘তা হলে কাজ হবে কী করে?’’ উত্তরে বড়বাবু ছাড়াও ওখানে হাজির তিন-চার জন স্টাফ এক সঙ্গে হেসে উঠেছিল। মুরুব্বির মতো মাথা নেড়ে বড়বাবু বলেছিলেন, ‘‘স্যর, ওর মতো লোকের কথা ভেবেই তো মোবাইলের সৃষ্টি হয়েছে! সাইড পকেটে সর্বদা ডিরাইভেশন মুডে মোবাইল অন রাখে চাঁদুবাবু।’’

অনিকেত বুঝে নেয়, বড়বাবু ভাইব্রেশন মোডের কথা বলছেন। ও বলে, ‘‘তা নাহয় হল, কিন্তু মোবাইলে কথা শোনে কী করে?’’ পাশ থেকে ক্যাশিয়ারবাবু বলেন, ‘‘অফিসের সকলের নাম ছাড়াও সব চেনা লোকের নাম মোবাইলে আছে। কে ডাকছে দেখে নিয়ে পাঁচ মিনিটে ও সেখানে হাজির হয়ে যায়। দূরের কেউ ফোন করলে কাছাকাছি কারও হাতে ফোনটা দিয়ে কথা বলিয়ে নেয়।’’

তার পর থেকে জিনিয়াস চাঁদু অনিকেতের খাওয়া-দাওয়া, রোগ-শোক, সব ভাল-মন্দের ঠিকাদার। ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ি রকমের গার্জেনগিরিও করে থাকে। তখন সে ভুলে যায় অনিকেতের অফিশিয়াল পোজ়িশন। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হলেও অনিকেত আজ পর্যন্ত চাঁদুকে স্বাধীনতা দিয়ে এসেছে এই ভেবে যে, ‘‘যাক, তবু তো এক জন অন্তত ওর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। সে জানে চাঁদু তার জন্য যা করেছে, নিজের লোকেরা কাছে থাকলে অনিকেত তা পাওয়ার আশা করতে পারত না! তাই তো যার এক হাঁকে এত বড় চিড়িয়াখানার দুশো লোক তটস্থ হয়ে ওঠে, সেই দাপুটে এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর সুুবোধ বালকের মতো গুটিগুটি পায়ে বাংলোর দিকে রওনা দেয় চন্দ্রবর্ধনের পিছনে পিছনে!

মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে পুরনো রেডিয়োটা খুলে ভিতরের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করছিল বেন্দা। পুরো নাম বৃন্দাবন কুম্ভকার, গত মাসেই বান্দোয়ান রেঞ্জের ফরেস্ট গার্ডের চাকরি থেকে অবসর পেয়েছে। শেষ দিকে এসে শরীর-মন কোনওটাই আর কাজকর্মে সায় দিচ্ছিল না। অবসর নিয়ে এক দিক থেকে বেঁচেছে। তবে এর মধ্যেই টের পাচ্ছে, পেনশনের টাকায় সংসার চালাতে গেলে বুঝেশুনে চলতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Kanai Lal Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE